#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৪
রুমিদের টিচার্স রুমটা টপ ফ্লোরে। পুরোটা ফ্লোরে বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের জন্য ছোটো ছোটো কাঁচ ঘেরা রুম করে দেওয়া। আলাদা রুমগুলোর আবার দুই ভাগ, মাঝে কাঁচের পার্টিশন দিয়ে একপাশে হেড অব দ্য ডিপার্টমেন্টের বসার ব্যবস্থা, অন্য পাশে কমন চেয়ার টেবিল দেওয়া সেই বিভাগের অন্য শিক্ষকদের জন্য। সবগুলো রুমের মাঝ বরাবর হল রুমের মতো খোলা জায়গায় বিশাল বড়ো টেবিল দেওয়া, যাতে একসাথে বিশ-পঁচিশ জন বসতে পারেন। এই জায়গাটায় সাধারণত অন্য সময় লেকচারাররা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করেন, এমনিতে মাসে একদিন সব শিক্ষকদের নিয়ে এখানেই মিটিং হয়।
লিফটের পাঁচে নামলে শুরুতেই কাঁচঘেরা বড়ো রুম দুটো প্রিন্সিপাল ম্যামের এবং ডিরেক্টর স্যারের, লিফটের পাশেই সিঁড়ি। রুমির মনে হয় এটা কলেজ কতৃপক্ষের ইচ্ছে করে করা, কেননা কেউ দেরি করে আসলে চোখ এড়ানোর উপায় নেই। লিফট বা সিঁড়ি যাই ব্যবহার করুক স্যার, ম্যামের চোখ এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সময়ের ব্যাপারে সবাই তাই সতর্ক। এরপরও রুমির মাঝেমধ্যেই পাঁচ দশ মিনিট লেট হয়ে যায়। রুমি রোজ ভয়ে থাকে কোনদিন তাকে এরজন্য প্রিন্সিপাল ম্যাম ডেকে পাঠান। আজ তো পুরো পনেরো মিনিট লেট!
সকালে ছয়টার এলার্ম দিলেও সারাদিনের ক্লান্তিতে ছয়টায় ওঠা হয় না রুমির, রোজ সাড়ে ছয়টা বেজে যায় । আজ তো ফজরের নামাজ পড়ে একটু শুলে এমন চোখ লেগে আসে যে উঠতে উঠতে সাতটা বেজে গিয়েছে । এরপর দৌঁড়ে নিজের নাস্তা সারে, হালকা কিছু বক্সে ঢুকিয়ে নেয়, তিতলির নাস্তা রেডি করে বের হতে হতে সাতটা চল্লিশ। সাড়ে সাতটার পরই রাস্তায় জ্যাম, এইটুকু পথ আসতে আটটা পনেরো বেজে গেল।
“রুমি, তোমার শরীর খারাপ নাকি? কেমন ফ্যাকাসে লাগছে।”
“নাহ্ স্যার। আজ দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াহুড়োয় বের হয়েছি। তাই হয়তো এমন লাগছে।”
“আচ্ছা, শুনো প্রিন্সিপাল ম্যাম তোমার খোঁজ করেছিলেন, ক্লাসে যাওয়ার আগে দেখা করে যেও।”
মনে মনে ইন্না-লিল্লাহ পড়ে রুমি। নির্ঘাত দেরি হওয়ার জন্য বকাবকি করবেন। কী বলা যায় ভাবতে ভাবতে লেডিস ওয়াশরুমের দিকে আগায় রুমি, একটু নিজেকে গুছিয়ে ম্যামের রুমে যাওয়া উচিত। চুলে চিরুনি বুলিয়ে, মুখে হালকা ময়েসচারাইজার লাগায়, আর চোখে কাজল। ছিমছাম থাকতেই ভালো লাগে রুমির। আগে সাজের ভীষণ সখ ছিল, সময়ের সাথে সাজের আগ্রহটা মরে গেলেও একটু টিপটপ থাকা এখনো পছন্দ। চিলড্রেন ডিপার্টমেন্টের রৌশন, আর মিতুও আছে ওয়াশরুমে।
-“কী আপু খুব সাজগোজ হচ্ছে?”
-“না মিতু, সাজ কোথায়, আজ বাসা থেকে বের হতে দেরি হয়ে গেল, চুল আঁচড়ানোর সময়ও পাইনি। এখন তাই ক্লাসে যাওয়ার আগে একটু চুল ঠিক করলাম।”
-“কী বলেন আপু, আপনি থাকেন মায়ের বাসায়, সংসারের চাপ নেই, বাচ্চা দেখে মা বোন। তারপরও সময় পান না!”
-“মিতু, তোমার বেবি হোক, তখন দেখবা সময় কই যায়।”
-“আপু মনে হয় আমার বিয়ে নিয়ে খোঁচা দিলেন। বিয়েই হয়নি বাচ্চা কোথা থেকে আসবে। আর আপনার বিয়ে হলে কী হয়েছে আপু, আমার মতো আপনিও বাবার বাড়িতেই থাকেন।”
এতক্ষণ চুপ করে থাকলেও এবার রৌশন আপা সক্রিয় হোন, “আরে মিতু, কী বলো? রুমি তোমার বিয়ে নিয়ে খোঁচা দিল কই? ও বললো ভবিষ্যতে তোমার ছোটো বাচ্চা থাকলে বুঝবে যে সময় বাচ্চার পেছনে চলে যায়। এখন আর অযথা কথা না বাড়িয়ে চলো সবাই, ক্লাসের সময় হয়ে গেল আমাদের।”
রুমি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে যায়, হঠাৎ মনে পড়ে মোবাইলটা সাবানের স্ট্যান্ডের উপর রেখে এসেছে, মোবাইলটা নিতে ফিরে এসে শুনে রৌশন আপা মিতুকে আস্তে আস্তে বলছেন, “বাদ দেও ওর কথা। ওমন বিয়ে করা আবার ছাড়া ওর মতো মেয়ের জন্য কিছু না। স্বামী নাই, সংসার নাই কার জন্য এত সাজে আমরা বুঝি না? কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টের হাসান জামিল এখনো অবিবাহিত জানো তো। কয়েকদিন দেখেছি আড়ালে কথা বলতে। ঐ দিকেই টোপ ফালানোর চেষ্টায় আছে। অবশ্য বিবাহিত অবিবাহিত কিছু যায় আসে না, দুই নাম্বার বিয়ে যাকে পাবে করবে। আমি তো তাই হায়দারকে চোখে চোখে রাখি। ওর আশেপাশেও ঘুরঘুর করে।”
ঘৃণায় রুমির দুই চোখে জল নেমে আসে। রৌশন আপার মতো সিনিয়র মানুষ এত নোংরা ভাষায় কথা বলতে পারেন! ওনার হ্যাসবেন্ড হায়দার স্যার ওরাল এনাটমির এসোসিয়েট প্রফেসর, রুমির প্রায় বিশ বছরের বড়ো, রুমি এসব কথা চিন্তাও করতে পারে না। অথচ আপা কী অবলীলায় বলে দিলেন। রুমি একপাশে সরে ওনাদের বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করে, নিজেদের কথায় মগ্ন রৌশন আপা আর মিতু রুমিকে খেয়াল করে না। ওয়াশরুমে ঢুকে চোখটা টিস্যু চেপে মুছে নেয় রুমি, কাজল ঠিক করে। এসব কথার আঘাতে নিজেকে আরও শক্ত করে প্রতিবার। এরা সবাই খুব ভালো করেই জানে রুমি কেন মায়ের বাসায়। সামনাসামনি ভীষণ সহমর্মিতা দেখায়, অথচ পেছনে কী কুৎসিত কথা বলে ওকে নিয়ে। এই হীনম্মন্যতা মেয়েদের মাঝেই বেশি দেখেছে রুমি, পুরুষেরা খারাপ ইশারা করে, আর মেয়েরা করে খারাপ আলোচনা। হিমেলকে ছেড়ে আসার এগারো মাসে পরিচিত মন্ডলের এই নতুন রূপ রুমি এতবার দেখেছে যে এখন আর আগের মতো কষ্ট পায় না।
-“আসসালামু আলাইকুম ম্যাম? আসতে পারি?”
-” আসো রুমি। কেমন আছ?”
-“জ্বি ভালো ম্যাম। স্যরি ম্যাম, আজ পনেরো মিনিট লেট হয়ে গেল। নেক্সট টাইম এমন হবে না।”
-“হ্যাঁ চেষ্টা করবে যেন না হয়। তোমার ক্লাস কখন আজ?”
-“এই তো পাঁচ মিনিট পর।”
-“ঠিক আছে বেশি সময় নেব না তাহলে। যে কারণে ডাকলাম। তুমি তো ‘কনজার্ভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি এন্ড এন্ডোডনটিকস’ এ এফসিপিএস পার্ট টু করছো তাই না?”
-“জ্বি ম্যাম, শেষের দিকে। যদি পাশ করি আরকি।”
-“কলেজের ডিউটির সাথে ট্রেইনিং এ ঝামেলা হয় না?”
-“আমি ম্যাম সময় এডজাস্ট করে নিয়েছি। একটু কষ্ট হয়, শারীরিক ভাবে চাপ যায়। কিন্তু ম্যাম চাকরি আমি ছাড়তে চাই না। আমি যখন চান্স পাই তখন তো এফসিপিএস অনারারি ছিল। এখন যারা চান্স পায় তাদের বিশ হাজার দেয়। আমি কলেজে কিন্তু পূর্ণ মনোযোগ দেই ম্যাম। হয়তো মাঝেমাঝে একটু লেট হয়, এছাড়া কোন অবহেলা করি না।”
-“না,অবহেলা কেন করবে? এটা তো তোমার পেশা, তোমার দায়িত্ব। আমি যে জন্য ডাকলাম তা শোনো। আমাদের কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টে একজন মেডিকেল অফিসার কাম লেকচারার প্রয়োজন। তুমি কী এসডিএম থেকে কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টে যেতে চাও? যেহেতু তুমি এই বিষয়েই পোস্ট গ্রাজুয়েশন করছে, ভবিষ্যতে প্রমোশন পেতে তোমার সুবিধা হবে। আর এখন ডাবল দায়িত্ব বলে স্যালারিও একটু বেশি পাবে। তবে হ্যাঁ তোমার পরিশ্রম হবে। সরাসরি রোগী দেখতে হবে, স্টুডেন্টদের হাতে কলমে শেখাতে হবে।”
-“অনেক অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। আমি আপনাকে একটু ভেবে জানাচ্ছি। এখন ক্লাসে যাই ম্যাম?”
-“হ্যাঁ যাও। দ্রুত জানিও।”
রুমির খুশিই হওয়া,উচিত, কেননা একে তো নিজের পছন্দের বিষয়ে ঢোকার সুযোগ, আবার স্যালারিও বেশি। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের কথাগুলো মনে পড়ে, কনজার্ভেটিভ ডিপার্টমেন্টেই আছেন হাসান জামিল, সবাই শুনলে আবার কী কথা বলে কে জানে!
(চলবে)