যে শহরে এখনো ফুল ফোটে পর্ব-৫ ৬

0
898

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৫ও৬

“তাহলে তুমি সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না তাই তো?”

“জ্বি আপা, কিন্তু আমার বাড়তি বেতন দরকার, তাছাড়া কনজার্ভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি আমার নিজের পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর সাবজেক্ট। এসডিএম পড়ানোর চেয়ে এই বিষয়ে পড়াতে আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবো।”

“তাহলে সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত তুমিই বলো?”

“সুইচ করা উচিত।”

“অবশ্যই সুইচ করা উচিত। এফসিপিএস পার্ট টু কবে পাশ করবে তার কোন ঠিক নেই। নিজে চেম্বার করতে পারছ না। সামনে মেয়েকে স্কুলে দিলে বাড়তি বেতন অবশ্যই লাগবে। তাহলে তুমি কী শুধু কয়েকজন মানুষের গসিপের ভয়ে পিছিয়ে যাবে রুমি? এত দুর্বল তো তুমি না।”

সিদ্ধান্ত কী নেওয়া উচিত তা রুমিও জানে, তারপরও আপার সাথে ছাদের এককোণে একান্তে কথা বলতে এসেছে, কেননা ওর একটা মানসিক শক্তি দরকার ছিল, একটু মোটিভেশান দরকার ছিল যা মরিয়ম আপা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না এই মুহূর্তে। নিজের দুই ছোটো ভাইবোন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত, আম্মা আব্বা কথা শোনার আগেই হইচই শুরু করেন, আর অফিসের কাউকে জড়িয়ে কোন কলিগ নোংরা কথা বলেছে শুনলে রুমির আব্বা রেগে দেখা যাবে অফিসেই অভিযোগ করতে চলে আসবেন, শেষে অনেক বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। কোন বান্ধবীকে বলেও শান্তি নেই, বন্ধু মহলে গসিপ শুরু হবে। এমনিতেই ডিভোর্সের পর অনেক ক্লোজ ফ্রেন্ড ওকে এড়িয়ে চলে, এদের মনে হয় স্বামীহীনা রুমি ওদের স্বামীকে না চুরি করে নেয়! হাসি পায় রুমির, যে চুরি হওয়ার সে সিন্ধুকের ভেতর থেকেও চুরি হবে, যে হওয়ার না, তাকে ছেড়ে দিলেও নিজেরই থাকবে।

“আপা কী করা দরকার জানি। শুধু করার শক্তিটা পাচ্ছিলাম না। আপনার সাথে কথা বলে সেই শক্তিটা নিলাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপা।”

“যাও বোকা মেয়ে। এই সামান্য জিনিসের জন্য ধন্যবাদ লাগবে না। রুমি, হিমেল কী তিতলির ভরণপোষণের টাকা দেয় না?”

“দেয় আপু। আদালত থেকে ঠিক করে দিয়েছিল, মাসে পাঁচ হাজার করে দেওয়ার কথা, তাই দেয়। আমার নিতে ইচ্ছে করে না সামান্য দুইপয়সা, ঘিন্না লাগে। কিন্তু সবাই বলে তিতলির অধিকার, তাই ওর নামে পাঁচ হাজার ডিপিএস করে রেখেছি। মাসে মাসে সেই একাউন্টে জমা হয়। হয়তো কখনো কাজে আসবে। আমার নিজের জন্য এক টাকাও আমি নেই না। কাবিন ছিল আট লাখের, তার অর্ধেক উসুল ধরেছিল। বাকি চার লাখ ডিভোর্সের সময় দিয়ে দিয়েছে। উকিল চেয়েছিল, পুরো আট লাখ আদায় করে দিতে, কিন্তু আমি আর আইনি ঝামেলায় যেতে চাইনি। যত দ্রুত সম্ভব সরে যেতে চেয়েছিলাম।”

“তুমি ঐ টাকাটা দিয়ে তো চেম্বার দিতে পার রুমি।”

“টাকাটা পুরো নেই আপু, চাকরি পেলাম সবে সাত মাস। এর আগের চার মাসের নানা খরচ ওখান থেকে করলাম, একটা কোর্সে বেশকিছু টাকা গেল। বাকি টাকাটা ব্যাংকে রেখেছি, বিপদ আপদে কাজে আসবে। আব্বা অবসরে গিয়েছেন, বোনটার বিয়ে বাকি। টাকা হাতে রাখা দরকার। আমার আর তিতলির খরচের চাপ আম্মা আব্বার উপর দিতে চাই না।”

“মাশাল্লাহ রুমি, তুমি অনেক ম্যাচুয়র একটা মেয়ে।।কারও কোন কথায় মন খারাপ করো না। তুমি জানো তুমি কী, আর এটাই যথেষ্ট।”

মরিয়ম আপার সাথে কথা বলা শেষে প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে যায় রুমি। নিজের সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেয়। কে কী বললো, তা ভেবে নিজের ক্ষতি করা যাবে না। আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী লাগে রুমির।হিমেলের ধারণা ছিল রুমি মেয়ে নিয়ে একা অসহায় হয়ে যাবে, সব ভুলে আবার তার কাছেই ফিরে আসতে হবে। মেয়েকে নিয়ে যখন বেরিয়ে আসে রুমি, পাশে কাউকে পায়নি, এমনকি নিজের পরিবারকেও না। হিমেলের প্রতারণা মাফ করে আবার নতুন শুরু করাই সবার পরামর্শ ছিল। কিন্তু যেখানে বিশ্বাস শেষ হয়ে যায়, সেখানে নতুন শুরু কী করা যায়! এই সহজ সত্যটাই কেউ বুঝতে রাজি ছিল না।

#যে_শহরে_এখনো_ফুল_ফোটে
#পর্ব৬

যাদের এখন ক্লাস নেই তারা সবাই বড়ো হলরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। রুমি আজ ইচ্ছে করে বাইরে বসেনি, রুমির ভেতর বসে আছে। ডিপার্টমেন্টের হেড আনিস সাবেত স্যারকেও জানিয়ে দিয়েছে ডিপার্টমেন্ট পরিবর্তনের কথা। স্যার রুমির মতো দায়িত্বশীল একজন সহকর্মী হারিয়ে একটু মন খারাপ করেছেন ঠিক, তবে রুমির ভালো ভবিষ্যতের জন্য অনেক অনেক শুভকামনাও জানিয়েছেন।

সায়েন্স অব ডেন্টাল ম্যাটিরিয়াল সাবজেক্টে আসলেই রুমি আগাতে পারতো না, কেননা এবিষয়ে ওর উচ্চতর ডিগ্রি নেই। সেসময় চাকরিটা খুব প্রয়োজন ছিল বিধায় এই বিষয়েই লেকচারার হিসেবে জয়েন করে। এখন যেহেতু সুযোগ এসেছে, নিজের বিষয়ে যাওয়ার, তখন ওকে আটকানোর কোন মানে হয় না।

“স্যার, নতুন যে আসবে, আমি তাকে সব বুঝিয়ে দেব। কোন কোন চ্যাপ্টার পড়ালাম, কী আমার বাকি ছিল সিলেবাসের সব বুঝিয়ে দিয়ে যাব। আপনাকে কোন সমস্যায় পড়তে হবে না।”

“এটা ভালো হয় রুমি। হঠাৎ নতুন একজন বছরের মাঝামাঝি আসলে সিলেবাস নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যেতে পারে। তুমি একটু পাশে থেকে দেখিয়ে দিও। অবশ্য যে আসবে সে অনেক সিনিয়র। তারপরও ভালো স্টুডেন্ট মানেই কিন্তু ভালো শিক্ষক নয়। ও ছাত্র খুব ভালো, শিক্ষক কেমন হবে এখনো জানি না। সেক্ষেত্রে তুমি তার সিনিয়র, যেহেতু তুমি আগে পড়ানো শুরু করেছ। তুমি অবশ্যই সাহায্য করবে।”

“কে আসবেন স্যার? আপনি চেনেন মনে হচ্ছে।”

“আরে আমি নাম রেকমেন্ড করেছি, আমি তো চিনবই। বছরের মাঝামাঝি সার্কুলার দিয়ে, পরীক্ষা নিয়ে একজন নিয়োগ দেওয়া সময়সাপেক্ষ। আমার ডিপার্টমেন্টের ক্ষতি হবে, ক্লাস শিডিউল নিয়ে সমস্যা হবে। তাই আমার ছাত্রের নাম সাজেস্ট করলাম। ও University of HongKong থেকে Msc করেছে ডেন্টাল ম্যাটিয়ালে। যদিও লেকচারার পোস্টটা ওর জন্য ঠিক না, তারপরও করতে রাজি হয়েছে আমার কথায়। আশা করি শীঘ্রই প্রমোশন পাবে।”

“ওয়াও স্যার। তাহলে তো একদম যথাযথ লোকই আসছেন। বিষয়ভিত্তিক উচ্চতর পড়াশোনা করা টিচার পেলে স্টুডেন্টদের জন্যই ভালো।”

“হ্যাঁ, তবে ভালো স্যালারি আর সুযোগসুবিধা না দিলে দক্ষ মানুষ ধরে রাখা যাবে না। প্রাইভেট মেডিকেলগুলোর এই একটা দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যোগ্য ক্যান্ডিডেটকে বাড়তি স্যালারি দিয়ে হলেও নিয়োগ দিতে হবে, না হয়ে কোয়ালিটি ফুল সার্ভিস দেওয়া সম্ভব না। সেক্ষেত্রে আমাদের কলেজ বেশ ভালো, একটা হ্যান্ডসাম স্যালারি দেয়। অনেক প্রাইভেটে নামমাত্র বেতন দেয়, যার জন্য ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা চাকরি করতে উৎসাহী হয় না।”

আনিস সাবেত স্যারের সাথে আলোচনা করতে খুব ভালো লাগে রুমির। ব্যক্তিত্বের অধিকারী, ভদ্র এই মানুষটাকে ফাদার ফিগার মনে হয় এই কলেজে। স্যার একসময় সরকারি ডেন্টালের অধ্যাপক ছিলেন, অবসর গ্রহণের পর এই মেডিকেলের এসডিএম (সায়েন্স অব ডেন্টাল ম্যাটিরিয়াল) এর ডিপার্টমেন্ট হেড হিসেবে দায়িত্ব নেন। বাইরে বসে গসিপ করার চেয়ে স্যারের সাথে আলোচনা করতে বেশি ভালো লাগে। অবশ্য এটা নিয়েও হাসাহাসি হয়, রুমি নাকি তেল মারতে এমন করে, ডিপার্টমেন্টের হেডকে তেল দেওয়ার জন্য অবসরেও বসে বসে কথা শোনে!

মোটামুটি কলিগদের সবাই জেনে গিয়েছে যে রুমি ডিপার্টমেন্ট সুইচ করছে। অধিকাংশই সামনাসামনি শুভকামনা জানিয়েছে, পেছনে কী বলে তাতে রুমির কিছু আসে যায় না। আজ বাসায় যাওয়ার সময় কাচ্চিবিরিয়ানি নিয়ে যাবে রুমি, ওর বেশ পছন্দ।
যদিও এখন টাকা নষ্ট করা ঠিক না, সামনের শুক্রবার রশ্মিকে দেখতে ছেলে পক্ষ আসবে, আম্মার হাতে কিছু টাকা দেওয়া দরকার, যেন বাজার করতে সুবিধা হয়।

রুমির আব্বা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন, অবসরে গিয়ে এককালীন একটা এমাউন্ট পেয়েছেন, তবে পেনশন নেই। এমাউন্টার অধিকাংশ ওদের ফ্ল্যাট নিতে চলে গিয়েছে, সামান্য কিছু রেখেছেন ছোটো মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য। রুমির ভাই আদিল এখনো জবে ঢুকেনি, একের পর এক সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছে, কয়েকটায় রিটেনে সুযোগ পেয়েছে, কিন্তু ভাইবা পর্যন্ত যাওয়া হয়নি। বয়সও শেষ হয়ে আসছে, রুমির মতে এখন ভালো একটা জব পেলে ঢুকে যাওয়া উচিত। সরকারি চাকরি করতে করতে বয়স শেষ হয়ে গেলে ভালো প্রাইভেট জবও হবে না।

কিন্তু আদিল ওর কথা গায়ে মাখায় না। একমাত্র ছেলেকে অন্ধ ভাবে রুমির আম্মাও সমর্থন করেন। এই বাসায় এখন সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে রুমি। তার সবকিছুতেই যেন সবাই বিরক্ত হয়, পরামর্শ দিলেও বিরক্ত, মতামত দিলে বিরক্ত, কিছু বললে বলে ‘তুই বেশি বুঝিস বলে আজ তোর এই অবস্থা ‘! কী অবস্থা বলে, সেটা রুমি বোঝে। প্রচন্ড কষ্ট লাগলেও, আপন মানুষের কথা গায়ে মাখতে নেই ভেবে এভয়ড করে যায়। শুধু একাকী নির্ঘুম রাতগুলোয় বালিশ ভিজে ওঠে।

নেবে কী নেবে না, ভাবতে ভাবতে দুই প্যাকেট কাচ্চিবিরিয়ানি কিনে নেয় রুমি। একদিন না হয় একটু বাড়তি খরচই হলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here