রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ। [১৯]

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[১৯]

আজ আর ফ্ল্যাটে যাওয়া হলোনা আরাভের। ক্লান্ত শরীরে নিজ বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। অনিমা বেগম ড্রাইনিং পরিষ্কার করছিলেন এমন সময় কলিংবেলের শব্দ মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে তার। ছেলের আগমনে উৎফুল্ল মন নিয়ে দরজা খুলে দেন তিনি। দরজার ওপাশে আরাভ দাঁড়িয়ে ছিলো। একহাত পকেটে অপর হাত দিয়ে কাধের উপর নিজের ব্লেজার ঝুলিয়ে রেখেছে। অনিমা বেগমকে দেখে আরাভ একগাল হেসে একহাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ভিতরে নিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমে এসে অনিমা বেগমকে সুফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। অক্ষিদ্বয় বন্ধকরে বলে,
” মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দাওনা মা, বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

অনিমা বেগম হাসলেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন পরম যত্নে। মনে পরে সেই পুরনো দিনের কথা। আরাভ হুট করে মায়ের কোলে মাথা রেখে বলল, ” আমি আজ তোমার সাথে ঘুমাবো। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গান শুনাবে।” অনিমা বেগম রাতভর ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে গান গেয়ে ঘুম পারাতো। আরাভের বাবা ছিলেন একজন নেভী অফিসার।কর্মসূত্রে তাকে দেশের নানা জায়গায় যেতে হতো। এমনকি দিনের পর দিন তিনি সাবমেরিনেও কাটিয়েছেন। তাই ছোটবেলা থেকে বাবার খুব একটা সঙ্গ পায়নি সে। ছোট্ট্ বেলা থেকা তারা মা-ই সুখ দুঃখের সাথী। অনিমা বেগম হাসলেন। তার ছেলেটা আজও বড় হলো না। এখনো ক্লান্তি অনুভব করলে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে তাকে শুতেই বলে। অনিমা বেগম খেয়াল করলেন আরাভ এখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শরীর অধিক ক্লান্ত থাকায় শোয়ার সাথে সাথে রাজ্যের ঘুম এসে ভর করেছে আরাভের দুচোখে।

পরেরদিন আরাভ কলেজে গেলেও ভূমির দেখা পেলো না। ভূমির নাম্বারে কল দিতেই তন্মর রিসিভ করে বলল,
” আপু আজ কলেজে যাবে না বলছে। আপুর নাকি মাথা ব্যাথা।”

” ঠিক আছে।” বলে কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি যে আজ কেন কলেজে আসেনি সেটা তার অজানা নয়। আসলে কালকের ব্যাপারটা নিয়ে সহজ হতে পারেনি। আরাভ পরপর নিজের ক্লাসগুলো করে বেড়িয়ে যাচ্ছিল, মনিরুল স্যারের কেবিনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দাঁড়ালো সে। ঘাড় ঘুড়িয়ে ভিতরে দেখলো স্যার মনোযোগ দিয়ে লেপটপে কিছু একটা করছে। আজকাল মনিরুল স্যারের উপর তার বেশ সন্দেহ হয়।মনে মনে ভাবে, স্যার নিজেকে যতটা সহজ দেখায় আধোও কি সে ততটা সহজ সরল।” দাঁড়ায় না আরাভ। বাহিরের দিকে চলে যায়। মাঠ পেড়িয়ে যাওয়ার সময় দিগন্তকে দেখলো একটা ছেলের সাথে কথা বলছে। আরাভ ভ্রু কুঁচকে সে দিকে তাকালো। দিগন্ত দীর্ঘসময় ধরে ছেলেটার সাথে কথা বলে কলেজের ভিতরে চলে গেলো। আরাভ সবটা লক্ষ করলো কিন্তু কিছু বলল না। ততক্ষণ তুহিন তাকে একটা মেসেজ দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে ফ্ল্যাটে যেতে হবে। জরুলি তলপ না হলে তুহিন তাহমিদ সোহান তাকে ডাকে না তাই সে কোন দিক না ভেবে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা দেয়।

প্রায় পনেরো মিনিট পর ফ্ল্যাটে এসে পৌঁছায় সে। তাদের স্পেশাল রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই দেখে তাহমিদ পিসির সামনে বসে আছে আর বাকি দুজন দুপাশ থেকে। তিনজনে মিলে কিছু দেখছে পিসি তে। আরাভ সেখানে গিয়ে দাঁড়াতে তাহমিদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
” এটা দেখ।”
আরাভ বসে পরলো তাহমিদের জাগায়। পিসিতে স্পষ্ট দৃশ্যমান প্রায় দশ মিনিট আগে ডেথ আর কিং এর কথোপকথন। সেখানে কিং লেখেছে,
” এই অফিসারটা বেশ ঝামেলা করছে। একে শেষ করতে হবে।” নিচে লেখা, KING.

ডেথ এর ওপাশ থেকে রিপ্লাই এলো,
” ডিটেকটিভ বয়ের থেকেও আরাভ বেশী ভয়ংকর, ওকে ফলো করো।” নিচে লেখা, DEATH.

“সরি মিস্টার ডেথ, আজ এই অফিসারের শেষ দিন হবে। আপনার কথা মানতে পারলাম না। আমি আজ একে প্রানে মেরে দিবো।” নিচে লেখা, KING.

আরাভ উঠে দাঁড়ালো। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ডিটেকটিভ বয় নামটা। এই নামটা সে কোথাও শুনেছে। কিন্তু কোথায় মনে পরছে না। অনেক্ষন ভেবেও যখন মনে করতে পারলো না। তখন আবার বসে পরলো। তাহমিদ বলল,
” এখন উপায় কি? ডিটেকটিভের প্রাণ সংশয়।”

ডেথ এর ভাবনায় দিগন্তের কথা ভুলেই গিয়েছিলো আরাভ। এই অভি যে আজ দিগন্তের সাথে ঝামেলা করবে এটা নিশ্চিত। মানুষের প্রান নেওয়াটা এদের কাছে খেলা বৈ কিছুই নয়। দিগন্তকে কল করে সাবধান করতে হবে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিগন্তের নাম্বারে কল করলো কয়েকবার। কিন্তু দিগন্ত রিসিভ করলো না। তাই বাধ্যহয়ে আরাভ বেড়িয়ে পরে কলেজের উদ্দেশ্যে। যে করেই হোক দিগন্তের প্রান বাঁচাতেই হবে।

__________________________
এদিকে মনিরুল ইসলাম কাজ শেষ করে হাত ভাজ করে তার উপর চিবুক ঠেকিয়ে লেপটপের সামনে বসে আছে। অভিকে নিষেদ করার পরেও সে কোন কথা শুনলো না। অভি যে দিগন্তকে এ্যটাক করবে এটা নিশ্চিত সে। তবে যেই হোক দিগন্ত মরবে না হয় অভি। যার প্রাণ যাক তাতে তার কিছু যায় আসেনা। এমনিতেই কদিন পর তার কাজ শেষ হলে অভিকে ছুড়ে ফেলে দিত মনিরুল। আরাভ হয়তো তার সমন্ধে জেনেগেছে এতক্ষণ। এবার তার কাজ শেষ করতে হবে। তারপর সবাইকে নিজের গোলাম বানাবে। এই দেশের সরকার যাবে তার হাতের মুঠোয়। সে যা চাইবে তাই হবে। সকলকে দিয়ে তার গোলামি করাবে। নিজের উদ্দেশ্য সফলের কথা ভেসে শয়তানি হাসি হাসে মনিরুল ইসলাম।

দিগন্ত গাড়ি নিয়ে কলেজ থেকে কিছুদূর আসতেই অভি তার বাইক নিয়ে দিগন্তের গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। দিগন্ত কিছু বুঝে উঠার আগেই অভি বাইক থেকে নেমে দিগন্তের দিকে রিভালবার তাক করে। ভ্রুকে কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বিরক্ত সহকারে গাড়ি থেকে নামে দিগন্ত। নিজের রিভালবার অভির দিকে তাক করে বলে,
” সমস্যা কি তোমার? পথ আটকে দাঁড়িয়েছ কেন?”

” তোর প্রাণ নিবো তাই।”

” মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিসের পাগলামি করছো?”

” কোন পাগলামি না অফিসার। সেদিন তুই আমার ভাইয়ের পায়ে গুলি করেছিস। আজ আবার তার পিছু নিয়েছিস। তোর জন্যে কোন কাজ করতে পারছিন।”

” ওও আচ্ছা, তাহলে তুইও ডেথ এর গোলাম। নে শ্যুট কর। দেখি তোর কত দম।”

দিগন্ত অভির পা বরাবর শ্যুট করে। অভি শ্যুট করবে এমন সময় পিছন থেকে আরাভ এসে অভির গলা চেপে ধরে যার ফলে অভি লক্ষভ্রুষ্ট হয়। আর গুলি লাগে গাড়িতে। আরাভ অভির নাক মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুসি দিতেই দিগন্ত এসে অভিকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,

” আরাভ কন্ট্রোল। এদের শাস্তি আইন দিবে।”

আরাভ বলে,
” ঠিক বলেছেন ডিটেকটিভ, এই নরকের কিটের উপর হাত দিয়ে নিজের হাত নোংরা করাটা একদম বোকামি।”

দিগন্ত পুলিশকে কল করে। কিছুক্ষণ পর পুলিশ ভ্যান এসে অভিকে নিয়ে যায়। আর আরাভ দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
” বের হতে লেট করলেন যে?”

” মনিরুল ইসলাম স্যারের সাথে কথা বলছিলাম।”

মনিরুল ইসলাম নামটা শুনতেই আরাভের মনে পরলো উনার ডাক, ডিটেকটিভ বয়। আরাভের ভ্রু কুঁচকে এলো। তার সন্দেহ সোজা মনিরুল ইসলামের দিকে। আচ্ছা আরাভ নিজে ভুল নয়তো। এভাবে কোন প্রমান ছাড়া মনিরুল ইসলামকে সন্দেহ করাটা কি ঠিক হচ্ছে। দিগন্তের কথায় ঘোর কাটলো আরাভের।
” আপনি কি সবটা জানতেন?”

আরাভ প্রসন্ন হাসলো। তারপর বলল,
” ভুলে যাচ্ছেন ডিটেকটিভ, আমি হ্যাকিং গ্রুপ লিড করি।”

” ধন্যবাদ, আমার প্রান বাচানোর জন্যে।”

আরাভ হাসলো কোন জবাব দিলোনা। তারপর দুজন দুজনকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো।

_______________________
ঘড়ির কাটা বারোটা ছুঁইছুঁই। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেটের ধোয়া উড়াচ্ছে আরাভ। দু আঙ্গুলের ফাকে সিগারেট রেখে সেটা মাঝে মাঝে নিজের অধোরে ছুয়াচ্ছে আর ভূমির কথা ভেবে চলেছে। আজ সারাদিনে একবারও ভূমির সাথে দেখা কিংবা কথা হয়নি তার। অথচ এমন ফিল হচ্ছে যেন কত জনম ধরে তাদের দেখা হয় না।বুকের বা পাশটা চাপা ব্যাথায় আর্তনাদ করছে। চিনচিন ব্যাথা করছে বেশ অনেক্ষন ধরে। দূর আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো আরাভ। তারপর বলল,

” আজ আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলো আমি তোমার কাছে দিলাম আমার নিলাদ্রিতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। আমরা তো একই আকাশের নিচে আছি তাহলে সে নিশ্চয় বুঝবে এই নিগাঢ় কালো অন্ধকারের কাছে নিরবে বলা আমার অনুভূতি গুলো।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরাভ। মনটা বড্ড ছটফট করছে। একবার, শুধু একবার যদি তার নীলাদ্রিতার কন্ঠশ্বর শুনতে পেতো তাহলে হয়তো একটু শান্তি পেতো। কিন্তু এত রাতে তাকে কল করে কথা বলাটাও সম্ভব না। তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটবে। বেলকনি ছেড়ে রুমে আসলো আরাভ। বিছানা হাতরে মোবাইলটা হাতে নিলো। এখন ভূমিকে কল করে বলতে ইচ্ছে করছে,
” আচ্ছা নীলাদ্রিতা, তুমি কি আকাশে আমার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও? শুনতে কি পাও আকাশের কাছে বলা আমার অব্যক্ত কথাগুলো। অনুভব করতে পারো আমার হৃদয়ের আর্তনাদ।”

ভূমির নাম্বারে ডায়াল করেও কেটে দিলো। মোবাইলটা বিছানায় রেখে মাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে অমনি সোহানের হাক পরলো। আকস্মিক এমন ডাকে চমকে উঠে আরাভ। দ্রু বিছানা ছেড়ে চলে আসে তাদের তৈরী করা স্পেশাল রুমে। সামনে পিসির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, পিসিতে জ্বলজ্বল করছে, ডেথ কলিং।
আরাভ হেডফোন কানে নিয়ে পিসির সামনে বসে পরলো। কল রিসিভ করে হ্যালো ডেথ বলতেই ওপাশ থেকে ডেথ বলল,
” কেমন সারপ্রাইজ দিলাম জুহায়িন আহমেদ আরাভ।”

আরাভের মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। সে জনতো ডেথ তার পরিচয় জানে। আরাভ বলল,
” কেন এমন মৃত্যর খেলা খেলছো ডেথ?”
” ডেথ এর কাজই হলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলা।”
” কি চাই তোমার? কেন নষ্ট করছো তরুন সমাজ। কি ক্ষতি করেছে তোমায় এই মানুষগুলো। তুমি অনেক ট্যালেন্ট ডেথ। তোমার এই প্রতিভা তুমি ভালো কাজে ব্যবহার করো দেখবে সবাই তোমায় মাথায় করে রাখবে। ছেরে দাও এই মৃত্যু খেলা।”
ডেথ হাসলো।শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল,
“আমার যেটা চাই সেটা তো আমি নিবোই আরাভ। আর মাত্র দুটো দিন।”
” কি করবে তুমি? আতঙ্কিত কন্ঠে বলল আরাভ।
” গোলাম বানাবো। এই দেশের সবাইকে আমার গোলাম বানাবো। তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না আরাভ।”
” এত রাগ তোমার এই দেশের প্রতি। যে দেশ তোমায় আলো দিয়ে ছায়া দিয়ে বড় করেছে সেই দেশকে তোমার গোলাম বানাবে। এতটা অকৃতজ্ঞ তুমি ডেথ।”
ডেথ হাসলো ব্যাঙ্গাত্বক হাসি তার।চোখমুখ শক্তকরে বলল,
” কৃতজ্ঞতা! কোন দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা বলছো তুমি আরাভ। যে দেশে সত্যি বলার জন্যে জিবন দিতে হয়। ক্ষুদার তাড়নায় দুটো বাচ্চাকে চুরি করতে হয়। এই দেশের মানুষ বাড়ির কুকুরকে ভালোভালো খাবার দেয় অথচ একটা ক্ষুধার্ত বাচ্চার দিকে তারা ফিরেও তাকায় না। এই দেশের প্রতি তুমি কৃতজ্ঞতা থাকার কথা বলছো।”

আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। ডেথ যে তার ব্যাক্তিগত ক্ষোপ থেকে এমন ভুল করছে সেটা বুঝতে বাকি রইলো না তার। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তোমার ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারনে এতগুলো মানুষের প্রান নিয়ে খেলবে তুমি। এই মানুষগুলো তোমার কি ক্ষতি করেছে?”
” দেশের মানুষ! যতদিন না দেশের মানুষের উন্নতির হচ্ছে ততদিনে দেশের উন্নত সম্ভব নয়। একটা দেশ তখনি উন্নতির শিখরে পৌঁছাবে যখন দেশের মানুষের মনের উন্নতি হবে।”
আরাভ ভেবে পায়না এমন সুশিক্ষিত মানুষ কি করে এমন জঘন্য কাজ করতে পারে। আরাভের ভাবনার মাঝে ডেথ বলল,
” একটা গল্প শুনবে আরাভ। গ্রামের এক স্কুল শিক্ষক ও তার ছেলের গল্প। শুনবে?”

চলবে,,,,,,,,,

#Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here