রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ। [২০]

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[২০]

প্রাইমারি স্কুলের অংকের শিক্ষক ছিলো এক বাবা। মা ছিলো গৃহিণী। বাবা যেমন সৎ ন্যায়পরায়ণ ছিলো তেমন ছিলো স্পষ্টভাষি। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলতে দু’বার ভাবতো না সে। সব সময় সত্যের পথে চলেছে অন্যায়ের কাছে কখনো মাথা নত করতো না সেই বাবা। বাবার আদর্শ মেনে বড় হতে লাগলো তার দুই সন্তান। ছেলে যে বছর ক্লাস ফাইভে আর মেয়ে থ্রিতে সে বছর গ্রামের কলেরা রোগ আসে। গ্রামের প্রায় অর্ধেক মানুষ কলেরায় মারা যায় সেই সাথে মারা যায় সেই আদর্শবান বাবা মা’। রেখে যায় তাদের দুই সন্তান। চাচা চাচি সন্তান দুটোর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সাথে নিলো গ্রামবাসী। একবেলা খাবারের জন্যে গ্রামের সকলের ধারে ধারে ঘুরলো ছেলেটা। ছেলেটা না হয় বড়, বোন। বোনটা তো ছোট ছিলো। পেটের জ্বালায় মেয়েটা কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে যেত। দু’দিন পর চাচা চাচি ক্ষুদার্থ দুই বাচ্চাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কারন, ছেলেটা তার চাচির হাড়ি থেকে ভাত চুরি করে বোনকে খাইয়েছিলো। সেদিন সন্তানদুটো বাবা মায়ের কবরের পাশে বসে কান্না করলো। গ্রামের একজন মানুষও তাদের দিকে ফিরে তাকায়নি। অন্নতুলে দেয়নি। ক্ষুধার গ্রামের এক বাড়িতে রাখলের কাজ করলো ছেলেটা। রাতের বেলা দুই ভাইবোনকে এক প্লেট ভাত দিলো। দু’জনেই সেই ভাত খেয়ে রাতে মাটিতে ঘুমিয়ে যায়। তিনদিন সেই বাড়িতে রাখালের কাজ করার পর তারাও কাজ থেকে তাড়িয়ে। অসহায় হয়ে পরে ছেলেটা। ছোট্র বোনটাকে নিয়ে কোথায় কার কাছে দাঁড়াবে সে। গ্রাম ছেড়ে চলে আসে তারা। তারপর তারা দু’জনেই অনাথ আশ্রমে আশ্রয় পেলো। ছয়মাস পর শহরের এক ধনী ব্যবসায়ী আসে অনাথ আশ্রমে। যার কোন সন্তান ছিলোনা। একটা বচ্চার জন্যে তিনি অনাথ আশ্রমে আসেন আর সেখানে ব্যবসায়ী লোকটার বউ মেয়েটাকে পছন্দ করে। মেয়েটাকে তারা নিয়ে যেতে চাইলে মেয়েটা যেতে চায়না। তারা মেয়েটাকে ভালো খাবার ভালো পোষাক আর ভালো স্কুলের লোভ দেখায় তাতেও রাজি করাতে পারেনা। মেয়েটার এক কথা সে তার ভাইকে ছাড়া যাবে না। কিন্তু ওই লোকগুলো তো একটা বাচ্চা নিতে এসেছিল সেখানে দুজন তারা নিবে না। মেয়েটাকে একা নিবে। মেয়েটা একা যাবে না। অবশেষে মেয়েটার জেদের কাছে হার মেনে তারা ছেলেটাকেও সাথে নেয়। তারপরের সময়গুলো ভালোই কাটছিলো। একবছর, একবছর পর থেকে তাদের পালিত বাবা বদলে যেতে লাগে। দু ভাইবোনকে অপমান করতো। এটা নিয়ে তাদের পালিত মায়ের সাথে খুব ঝগড়া হলো। তারা মাঝে মাঝেই ঝগড়া করতো। ওরা দু ভাইবোন দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনতো আর ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকতো। তাদের পালিত বাবা আর তাদের মানতে চাইতো না।তাদের আশ্রমে ফিরিতে দিতে চাইতো। তাখন তাদের পালিত মা আর তার মধ্যে খুব ঝগড়া হয়। এতটাই ঝগড়া হয় যে তাদের পালিত বাবা তার উপর হাত তুলে। এভাবেই চলে ছয় সাত মাস। তারপর একদিন রাতে ঘুম থেকে উঠে ছেলেটা দেখে বাড়ি ভর্তি মানুষ। বাড়িতে এত মানুষের কারন বুঝতে পারলো না। তাই সামনে এগিয়ে যায় সে। বসার ঘরে আসতেই দেখে তাদের পালিত মা মেঝেতে পরে আছে। হ্যাঁ রাতেই স্ট্রোক করে সে মারা গিয়েছিলো। সেদিন খুব রেগে গিয়েছিল তাদের পালিত বাবা আর দুভাইবোনকে পরে খুব মেরেছিলো।”

নরম আবেগ জড়ানো কন্ঠে কথাগুলো বলল ডেথ। ডেথ এর চোখ জ্বলজ্বল করছে।গলায় কথাগুলো আটকে গেছে।আর কোন কথা সে বলতে পারছে না। আরাভ বলল,
” গ্রামের লোকগুলো তোমার সাথে যা করেছে সেটা অন্যায়। তাই বলে তুমি নিরিহ মানুষের সাথে যা করছো সেটা কি ঠিক। কেন এতগুলো মানুষের প্রান নিলে তুমি। কি দোষ করেছিল ইশান মিমি দিয়া ইমাদ। গ্রামের ওই মানুষগুলোর সাথে তোমার পার্থক্য রইলো কই? আর ভূমি? তার অপরাধ কি ছিলো। কেন সকলের সামনে ওর সম্মান নষ্ট করলে। তুমি যানো এটা রিতিমতো সে*ক্সওয়াল হ্যারেজমেন্ট।”

আরাভের কথাশুনে শব্দকরে হাসলো ডেথ। ফোনের অপর পাশ থেকে সেই হাসি বিদঘুটে শুনালো। ডেথ তার গলার স্বর করো কঠিন করে বলল,
” যে ছেলেটা মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে তার পালিত বাবার যৌ*ন চাহিদার শিকার হয়েছে তাকে তুমি সে*ওয়াল হ্যারেজমেন্ট শেখাচ্ছো। ।”

” মানে? কি বলতে চাইছো তুমি?”

” আগে পুরো গল্পটা তো শুনো। মাঝখানে এত প্রশ্ন করলে হয় নাকি। ছেলেটার পালিত মায়ের মৃত্যর পর ওই নরপিশাচটা ছেলেটাকে দিয়ে তার শারীরিক চাহিদা মিটিয়েছে। যন্ত্রনায় ছটফট করেছে ছেলেটা। কত চিৎকার করেছে তার চিৎকার শুনার মতো কেউ ছিলো। তখন শুধু চিৎকার করে ছেলেটা তার মৃত্যু চাইতো। মেয়েটার কথা মনে হতেই পারেনি সে নিজের জিবন শেষ করতে। ছেলেটা না থাকলে যে মেয়েটাও এই নরপিশাচের শিকার হবে। শেষ রক্ষা আর হলো না। একদিন বাজারে গিয়েছিলো ছেলেটা , বাড়ি ফিরে দেখে তার বোনের রক্তাক্ত দেহ। ওই নরপিশাচ মেয়েটাকেও ছাড়েনি। মদ খেয়ে বারো বছরের একটা মেয়েকে রে*ব করে। বোনের রক্তাক্ত দেহ দেখার পর ছেলেটা ঠিক ঠিক করলো ওই নরপিশাচকে নিজ হাতে খুন করবে। করলও সেটাই। সেদিন, সেই মুহূর্তে ছেলেটার হাতে খুন হলো তার পালিত বাবা । আর বোনকে নরেন কাকার সাহায্যে হাসপাতালে নেয় । বাড়িতে সবাই যখন ছেলেটার পালিত বাবার মৃত্যর কারন জানতে চাইলো তখন ছেলেটা অনায়াসে মিথ্যে বলে দিলো, বাড়িতে ডাকাত এসেছিল, ডাকাতের দল তার পালিত বাবাকে খুন কর সব নিয়ে পালিয়েছে।” বিশ্বাস করো আরাভ, সেদিন সেই মিথ্যে শুনে সবাই ছেলেটার প্রতি সহানুভূতি দেখালো কতজন ছেলেটাী মাথায় হাত রেখে তাদের জন্যে আল্লাহর কাছে দোয়া করলো। ছেলেটা সেদিন-ই বুঝেছিল, এই পৃথীবিতে বাচতে হলে, ভালো নয় খারাপ কাজ করে মিথ্যারে আশ্রয়ে বাচতে হবে।” একটা মিথ্যে ছেলেটাকে সবার সামনে ভালোমানুষ বানিয়ে দিলো। আর ছেলেটার ভিতরের থাকা খুনি মানুষটাকে কেউ জানতেই চাইলোনা। তারপর থেকেই ছেলেটা প্রতিজ্ঞা করলো, বাচতে হলে খারাপ মানুষ হয়ে বাচবে আর সবাইকে তার হাতের মুঠোয় নিয়ে নাচাবে।

” তোমার বোন এখন কোথায়?”

” সেই ঘটনার চারদিন পর বোন হসপিটালেই মারা যায়।”

আরাভের এখন কি বলা উচিৎ বুঝতে পারলো না। তাই কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো সে। ডেথ এর সাথে যেটা ঘটেছে সত্যিই খুব খারাপ হয়েছে। এটা ওর প্রাপ্য ছিলো না। ডেথ ও বাকি সবার মতো পরিবার নিয়ে ভালো থাকতে পারতো। আরাভ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
” তোমার সাথে যেটা হয়েছে সেটা সত্যিই অন্যায়। তাই বলে তুমিও কি তোমার গ্রামের ওই পঙ্চাতের লোকেদের মতো করবে। এতগুলো মানুষের প্রান নিয়েও কি তোমার এই প্রতিশোধ পূর্ণ হলো না। আর ভূমির সাথে যেটা করেছো তাতে তো তোমার আর তোমার পালিত বাবার মাঝে কোন পার্থক্য দেখছি না আমি। ডেথ একখনো সময় আছে আইনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করো, তহলে হয়তো তোমার শাস্তি কিছু কম হবে। না হলে মৃত্যু যেদিন তোমায় দু হাতে ডাকবে সেদিন কোন নিস্তার নেই।আর সেই দিনটা খুব তাড়াতাড়ি আসবে।”

” ওসব নীতিকথা আমাকে শুনিয়ে লাভ নেই আরাভ। আমি অকারনে কারো প্রান নেইনি। একটু ভালো কিছুর জন্যে তো জিবন দিতেই হবে। স্বপ্ন দেখার বয়সে স্বপ্নকেই হাড়িয়েছি আমি। তাহলে অন্যকে স্বপ্ন দেখতে দিবো কেন? তোমাকে চব্বিশঘন্টা সময় দিলাম। পারলে নিজের দেশকে বাঁচিয়ে নাও।”

কথাগুলো বলেই কল ডিসকানেক্ট করে দিলো ডেথ। আরাভ হেডফোন খুলে বাকি সবার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর সবাইকে ডেথ এর কথাগুলো বলল। সব শুনে তাহমিদ বলল,
” তাহলে মিমির মৃত্যুটা,,,,
” এক্সপেরিমেন্ট। আসলে একটা মানুষকে কি পরিমাণ দ্যা ফরবিডেন ড্রা*গ দেওয়া যাবে তার এক্সপেরিমেন্ট করেছিলো ডেথ। তাই এ ডেথ এটাকে ভালো কাজ বলেছিলো।”

তুহিন বলল,
” দ্যা ফরবিডেনের পরিমাপ তাইতো।”

” হ্যাঁ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে “দ্যা ফরবিডেন” ড্রা*গ এর প্রচলন ছিলো। তারা এই ড্রা*গ ব্যাবহার করে শত্রু নিধন করতো। সামাজিক ধন্ধ এক দেশের সাথে আরেক দেশের ধন্ধ, এসব কারনে তারা এই ড্রা*গ ব্যাবহার করতো। তখন প্রায় দু লক্ষ মানুষের প্রাণহানি হয় এই ড্রা*গের কারনে। আসলে তারা জানতো না এই ড্রা*গ কি পরিমান ব্যাবহার করা যেতে পারে। তাই এত মানুষের মৃত্যু। পরে যখন এই ড্রা*গ নিয়ে গবেষনা করা হলো তখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই ড্রা*গ ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হলো। এবং এই তথ্য গোপন করা হলো। কারন এই ড্রা*গ সামান্য পরিমান ব্যবহারের ফলেই মানুষ তার ভারসাম্য হাড়িয়ে ফেলে। সে আর নিজের মধ্যে থাকে না। যন্ত্রে চালিত মানব হয়ে যায়। তাকে দিয়ে যে কোন কাজ করানো সম্ভব নয়। মানে রোবটের মতো আর কি। আর পরিমানের বেশী ব্যবহারের ফল ততক্ষণিৎ মৃত্যু। তখনকার সময় মানুষ নিজের কাজ হাসিল করার জন্যে এই ড্রা*গ অন্যের উপর প্রয়োগ করতো। যার ফলে মারামারি কাটাকাটি গেলেই থাকতো। তাই মাত্র দু মাসের মধ্যে এই ড্রা*গ কে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। ইশান মিমি আর কুড়িজন ছেলের মেয়ের মাধ্যমে ডেথ এই ড্রা*গের এক্সপেরিমেন্ট করেছে।”

একদমে কথাগুলো বলে থামলো আরাভ। মাথার চুলগুলো উপরের দিকে ঠেলে লম্বা শ্বাস নিলো। সোহান বলল,
” ডেথ তো চব্বিশঘন্টা সময় দিলো। আচ্ছা এই ডেথ করতে চাইছে কি?”

তাহমিদ বলল,
” ইচ্ছে করছে একে এখুনি গলা টিপে হত্যা করি।

তুহিন আরাভের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
” কি ভাবছিস? এখনো পযন্ত এই ডেথকে শনাক্ত করতে পারলাম না। ওর মাথায় কি চলছে সেটা জানবো তো দূর।”

আরাভ উঠে দাঁড়াল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
” কাল সকালের মধ্যে হয়তো ডেথ এর পরিচয় পাবো। এবার তোরা যায় ঘুমিয়ে পর। এত টেনশন করিস না। কাল অনেক কাজ করতে হবে।”

আরাভ টেবিল থেকে চাবি নিয়ে বলল,
” আমার বের হচ্ছি। আজ আর ফিরবো না।”

আরাভ বেড়িয়ে যায়। বাকি সবাই ওর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুমাতে যায়।

_________________________
ঘড়ির কাটা রাতের দুটো বাজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আরাভের বাইক এসে থামলো ভূমির বাড়ির সামনে। ভূমির বেলকনি বরাবর দাঁড়িয়ে কল করলো ভূমির নাম্বারে। ভূমি তখন গভীর ঘুমে নিমগ্ন। বিছানায় কম্পনের ফলে ঘুম ভাঙে তার। ঘুম ঘুম মোবাইল হাতরে কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শুনতে পেল,
” আমি ক্লান্ত, বড্ড তৃষ্ণার্থ। একটু তোমার সঙ্গ চাই। নীলাদ্রিতা, তোমার প্রেমের পরশে আমার ক্লান্ত মনটাকে একটু শান্ত করে দিবে। আমি অপেক্ষা করছি। প্লিজ নিচে এসো।”

কল কেটে দেয় আরাভ। ভূমি মোবাইল হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আসলে ঘুমের ঘোরে আরাভের কথাগুলো বুঝতে পারেনি। আর যখন বুঝতে পারলো তখন উঠে তাড়াতাড়ি বেলকনিতে চলে যায়। রাস্তার পাশে বাইকের উপর বসা যুবকটাকে তার চিনতে অসুবিধা হলো না। রুমে এসে একটা উড়না গলায় জড়িয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

ভূমি আরাভের কাছে এসে দাঁড়াতেই আরাভ বাইক থেকে নেমে ভূমির কোমড় জড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নেয়। ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বলে,
” অনেক কেঁদেছো?

ভূমি কথা বলল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আরাভ ভূমির চিবুক ধরে মুখটা উচু করে বলল,
” মাথা নিচু করে উঁচু করে দাঁড়াও। তুমি কোন ভুল করোনি নিলাদ্রিতা। আর আমার সামনে কখনো মাথা নিচু করে দাঁড়াবে না। তোমার সামনে মাথা নত করবো আমি। এবার উঠতো। বাইকে বস।”

আরাভ ভূমিকে ছেড়ে বাইকে গিয়ে বসলো। ভূমি বলল,
” কোথায় যাবো?”
” জানিনা। দু’চোখ যেদিকে যা চলে যাবো। আমি আমরা মুক্ত পাখি ন্যায় ডানা জাপ্টাবো। চলে যাব দূর থেকে বহু দূরে।”

চলবে,,,,,,,,,,,
#Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here