রহিবে মনের গহীনে পর্ব-২৩

0
1880

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_২৩
#Nishi_khatun

অরিন আগ্রহ নিয়ে বলল,”অবশ্যই বলেন!
আমি জানতে চাই,কি এমন কষ্ট এই মানুষটার!”

ইহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো,” ইফান কলেজে ভর্তি হতেই তার ক্লাসমেইট রোহিনির প্রেমে পরেছিল। যাকে বলে বয়ঃসন্ধির আবেগে ভরা ভয়ংকর প্রেম!”

ইফান যেমন শান্ত, চুপচাপ ছিল।
ঠিক তার বিপরীত স্বভাবের ছিল রোহিনি।
চঞ্চলা হরিণের মতো ছিল তার চলাফেরা।
আর ইফানের দিকে এত গভীর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিল যে, ইফান অন্ধের মতো বিশ্বাস করতো তাকে।আর ভালোবাসতো পাগলের মতো।
রোহিনি যা বলতো,তাই ই শুনতো ইফান।

রোহিনির অনেক বন্ধু-বান্ধব ছিল।
কিন্তু ইফানের এক মাত্র বন্ধু ছিল সে।
রোহিনি কোথায় থাকে, তার পরিবারে কে কে আছে এই সম্পর্কে কখনোই ইফানকে জানাতো না।
ইফান জানতে চাইলে এড়িয়ে যেতো।

যাই হোক, এভাবেই তাদের সম্পর্ক দুষ্টু-মিষ্টি খুনসুটিতে এগিয়ে যাচ্ছিল।

তারা দুজনে একসাথে নানারকম মজার কান্ড করত। কখনো লুকিয়ে সারারাত জেগে ফোনে প্রেমানুভুতি আদানপ্রদান। তো কখনো রাত জেগে লং ড্রাইভে যাওয়া। রোহিনির যতো আবদার ছিলো সব কিছু পূরণের দাঁয়িত্ব ইফানেে ছিলো। রোহিনির যখন টাকার দরকার হতো তখন ইফান বিনাবাক্যে তাকে টাকা দিত। কোনদিন সে রোহিনির কাছ থেকে টাকার হিসাব নেই নি। কারণ ঐ যে বড্ড বেশি অন্ধবিশ্বাস।

ইফানের স্বপ্ন ছিল দেশের বাহিরে যেয়ে পড়াশোনা করবে। রোহিনিকেও সে সঙ্গে নিয়ে যাবে।
কিন্তু একদিন রোহিনি ইফানকে শর্ত দিল,
আগে তাকে পাঠাবে, তারপর ইফান যাবে।
ইফান বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়েছিল সেদিন।

দেখতে দেখতে তাদের কলেজ জীবনের সমাপ্তি ঘটে। কলেজ শেষে ভালো ফলাফল করেছিল ইফান।
তখন আবার শুরু হয় ইফানের নতুন চিন্তা।
যে ভাবে হোক রোহিনির বিদেশে যাবার ব্যবস্থা করে দিতে হবে তাকে।
এইজন্য ইফানের অনেক টাকার দরকার ছিল।
তাই হুট করে বাবার অফিসে কাজ করা শুরু করেছিল। বাবা-মা অবাক হয়েছিল।
কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করে নাই।

এদিকে ইফান রোহিনি কে বিদেশে পাঠানোর জন্য পরিক্ষার পরে ঢাকাতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। বিদেশে যাবার পিপারেশন নিতে ব্যস্ত ছিল রোহিনি।

হঠাৎ করে ইফান ঢাকাতে ভর্তি পরিক্ষা দেয়।
আল্লাহ রহমতে সে ভাল নাম্বারের সাথে সেখানে চান্স পায়। পরিবারের সবাই তখন ইফান কে নানারকম প্রশ্ন করে। কেন সে বিদেশে যাওয়ার জন্য এপ্লিকেশন জমা না দিয়ে দেশের ভার্সিটিতে ভর্তি হচ্ছে।
তাদের ছেলের ছোট থেকে স্বপ্ন ছিল বিদেশে যেয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার। তাহলে আজ কেন সে ছেলে নিজের স্বপ্ন গলা টিপে হত্যা করছে?

তবে পরিবারের কেউ তো জানতো না তাদের অতি আদরের ছেলেটা যে তার প্রেয়সী কে দেওয়া ওয়াদা পূরণের জন্য আপাতত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হচ্ছে। এদিকে ইফান লেখাপড়ার পাশাপাশি বাবার অফিসের দাঁয়িত্ব পালন করতে থাকে। ছেলে যদি বাবার অফিসের দেখাশোনা করে তাহলে তো কেউ কোন সন্দেহ করার সুযোগ পাই না। সবাই ভাবছিল ইফানের স্বপ্ন হয়তো দেশে থেকে ভাল কিছু করার। আর তার পাশাপাশি বাবার অফিসের কাজে সহায়তা করা।

এরমাঝে একদিন রোহিনি ইফানের কাছে ফোন দিয়ে বলে,
” জান তুমি কোথায়? ”

ইফান তখন অফিসের কাজে সিলেট গিয়েছিল।
তা-ই সে রোহিনির প্রশ্নের জবাবে বলে,
“আমি বাবার অফিসের কাজে একটু সিলেট এসেছি। তোমার কোন কিছুর দরকার? ”

প্রতিউত্তরে রোহিনি বলে,”জান আমার কোন কিছুর দরকার নেই।আমার শুধু তোমাকে দরকার।
জান তুমি দেশে আসবা কবে সে কথা আগে বলো?”

সেদিন ইফান ভ্রূ কুঁচকে বলে,”আমি কি বিদেশে আছি? সিলেট কি বাংলাদেশের বাহিরে?”

সেদিন ইফান কে তেল দিতে রোহিনি বলে,

“আমার থেকে তোমার দূরত্ব মানে তুমি বিদেশে।
জান তুমি আমার থেকে এইটুকু দূরত্বে আছো তাতেই আমি বিরহবেদনা সহ্য করতে পারি না। বিদেশে যেয়ে তোমাকে ছাড়া থাকবো কি করে?”

ইফান প্রশান্তির নিশ্বাস নিয়ে বলে,” সমস্যা নেই।
তুমি আগে চলে যাও। তারপর দেখে আমিও তোমার পিছনে চলে যাব। ”

এর কিছুদিন পর ইফান রোহিনি কে বিদেশে পাঠানোর সব ব্যবস্থা কমপ্লিট করে। সেখানে যেন রোহিনির কোন রকমের আর্থিক সমস্যা না হয় সে ব্যবস্থা করে রাখে।

এরপর নিজে দায়িত্ব নিয়ে রোহিনিকে বিদেশে পাঠাতে এয়ারপোর্টে প্রেয়সী কে বিদায় জানাতে ইফান আসে।

বিদায়ের আগমুহূর্তে ইফান রোহিনিকে আলিঙ্গন করে চোখেরজল আড়াল করতে পারে নাই। তবে সেদিন রোহিণীর চোখে কোন অশ্রু ছিল না।
তার চেহারাতে ছিল বিশ্বজয়ের হাসি।
ইফান তো জানতো না এই হাসির পিছনের উদ্দেশ্য।
কী ছিলো এই কাল-নাগিনীর হৃদয়ে?

আলিঙ্গনরত অবস্থায় ইফানের কানের কাছে মুখ নিয়ে রোহিনি বলে,”জান তুমি বড্ড বেশি বোকা। কি ভাবে কেউ বয়ঃসন্ধিকালের আবেগের মায়াতে জড়িয়ে নিজের স্বপ্ন পায়ের তলায় মাড়িয়ে অন্যের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করে?
তুমি আমার প্রতি থাকা আবেগের জন্য নিজের স্বপ্ন ভেঙ্গেছ। কিন্তু আজ আমি তোমার সেই বয়ঃসন্ধিকালের আবেগ কে বাস্তবতার আয়না দেখিয়ে দিয়ে যাব।”

তখন ইফান দ্রুত রোহিনি কে ছেড়ে দিয়ে বলে,”প্রেয়সী এসব কি উল্টাপাল্টা কথা বলছো তুমি?”

সেদিন রোহিনি অট্টহাসি দিয়ে বলে,

–“আমি কোনদিন তোমাকে ভালোবাসি নাই।
আরে আমি নিজেকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসতে জানি না। আর তুমি যেটাকে ভালোবাসা বলো ঐটা কখনোই ভালোবাসার অনুভূতি ছিল না।বয়ঃসন্ধিকালে দুটি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি থাকা টান আবেগ আর মায়া ছিল। তুমি কোনদিন ও আমার ফ্যামিলি সম্পর্ক জানতে পারো নাই। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমি কখনো বলি নাই। তাহলে আজ শোন আমি বলছি আমি এতিম। এতিমখানা থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়েছি। তারপর কলেজে একজন বড়লোকের দয়াতে লেখাপড়া করেছি। যেদিন প্রথম কলেজে প্রবেশ করি সেদিন তোমার সম্পর্কে জানতে পারি বড়লোক বাবার ছেলে তুমি। তোমাকে যদি ভালোমতো পাটিয়ে রাখতে পারি তাহলে কলেজের দিনগুলো ভালোই যাবে। তা-ই তো তোমার সাথে গভীর বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছিলাম। আর তুমিও বোকার মত আমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কে জড়িয়ে যাও। তারপর বুঝতে পারি তুমি আমার প্রতি দুর্বল।তোমার দুর্বলতাকে আমি আমার উদ্দেশ্য পূরণের কাজে ব্যবহার করি। তোমার যাতায়াতের জন্য নিজস্ব গাড়ি আছে টাকার কমতি নেই। গাড়ি পারোসোনাল থাকাতে ভালোই হয়েছিল। তোমার সাথে ঘুরাঘুরি করলেও কেউ জানতে পারতো না। তোমাকে পটিয়ে আমি নিজের জীবন সিকিউরড করতে চেয়েছিলা। দেখো আজ তা-ই করেছি,আমি সফল। তুমি বলদের মতো বিদেশে আমার আরাম আয়েশে থাকার সব ব্যবস্থা করেছো। তা-ই ভাবলাম যাবার আগে অন্ততপক্ষে তোমার ভুল মানুষের প্রতি থাকা আবেগটা মিটিয়ে দিয়ে যায়। বিদেশে গিয়ে তোমার সাথে কোন রকমের সম্পর্ক রাখতে চাইনা। তার কোন দরকার পড়বে না বুঝলে ইফান। ”

সেদিন এয়ারপোর্টের ভেতরে ইফান রোহিনির হাত ছেড়ে পা জড়িয়ে ধরে বলে,”প্লিজ তুমি আমার ভালোবাসা কে এভাবে অপমান করিও না।
সত্যি আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। কখনো তোমার কোন কাজে বাধা দিব না।
প্লিজ তুমি শুধু একটিবার বলো এসব কিছু মিথ্যা। তুমি কোন নাটক করছো আমার সাথে।
তুমি আমাকে ভালোবাস।”

পাবলিক প্লেসে রোহিনি নিজের পা ঝামটা দিয়ে ইফান কে দূরে সরিয়ে দিয়ে বলে,” ষোড়শীর প্রেমে কখনো পড়িও না। ষোড়শী তো বয়ঃসন্ধি কালের একটা মায়া। যখন ম্যাচুরিটি আসবে, তখন তাদের মোহ কেটে যাবে তারা বাস্তবতা বুঝবে। আর তাদের পায়ের কাছে এভাবে ভালোবাসা তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের সাথে গড়াগড়ি খাবে।”

এরপর রোহিনি নিজের যাত্রা পথের দিকে রওনা দেয়।সে পিছনে ফিরে একটিবার দেখেনি ইফান সেখানে বেঁচে আছে না কি মরে গেছে।

ইফান সেদিন ওখানে চিৎকার করে বলে,
“আমি ঘৃণা করি ষোড়শী কে। যার জীবনে ম্যাচুরিটি আসলে ভালবাসাকে ভুলে বাস্তবতাকে ভালোবাসে। ঘৃণা করি ঐ সকল কিশোরীর মন যারা বয়ঃসন্ধিকালের নামে অন্যের অনুভূতিকে পদদলিত করতে পিছপা হয় না। ঘৃণা করি ঐ সকল মেয়েদের যারা এতিম। যাদের সঠিকপথের সন্ধান দেওয়ার কেউ নেই। কোনদিন ও কোন ষোড়শী কে আমার জীবনের ছায়াও মাড়াতে দিব না।”

…..ইহান সব কিছু বলে থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

অরিন বলে,
“এই মানুষটার সাথে ঐ মেয়েটা এমন কাজ কি ভাবে করতে পারলো? আরে যে তোর সুখের জন্য নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছে। তার থেকে বেশি ভালোবাসার মানুষ কোথাও খুঁজে পাবে না। যে কারো মন ভাঙ্গে সে কোনদিন ও সুখি হতে পারে না।”

ইহান অশ্রুসিক্ত নয়নেও ঠোঁটের কোণায় হাসির রেখা ফুঁটিয়ে বলে,
“জানি না কারো মন ভেঙ্গে সুখি হওয়া যায় কি না।”

-আচ্ছা রোহিনি কথা আপনারা জানতে পারলেন কি করে? ইফান আপনাদের কাছে সবটা বলেছিল?

ইহান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“নাহ! সে আমাদের কোনকিছু বলে নাই।”

(এই পর্বটা পোষ্ট করার আগমুহূর্তে ডিলেট হয়ে গেছিল দ্বিতীয় বার লিখেছি জানি না কেমন হয়ছে। কালকে আমি ব্যস্ত থাকবো তা-ই কেউ গল্পের আশায় থাকবেন না। আশা করি এই পর্ব সম্পর্কে গঠনমূলক মন্তব্য করবেন সবাই।)



চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here