রহিবে মনের গহীনে পর্ব-২৪

0
1847

#রহিবে_মনের_গহীনে
#পর্ব_২৪
#Nishi_khatun

ইফান মলিন কন্ঠে আবারো বলতে শুরু করলো,
“আমার ভাইয়ের মনে যে এতো চাপাকষ্ট লুকিয়ে ছিল
তা সম্পর্কে আমরা কেউ অবগত ছিলাম না।”

রোহিনি চলে যাবার পর থেকে ইফান ডিপ্রেশনে চলে যায়। তবে তখন তো আমাদের বাড়িটা এতো চুপচাপ ছিলো না আত্মীয়স্বজনে ভরা থাকতো।
এতো মানুষের মাঝে আমরা কেউ ইফানের নিকষকালো চেহারাতে দৃষ্টিপাত করতে পারি নাই। সময় কোথায়? চুপচাপ থাকা ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখার?

এভাবে কিছুদিন যাবার পর একদিন রাতে খাবার খাওয়ার জন্য জরিনা ভাইকে ডাকতে যায়।
অনেক সময় ধরে তাকে ডাকাডাকি করার পরেও তার কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।

জরিনা নিজে এসে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“বাবাই দরজাকবাট বন্ধ করে রেখেছে।
তাকে অনেক সময় ধরে ডাকছি সে কোন সারা দিচ্ছে না।”

জরিনার মুখে এমন কথা শুনে আম্মুর হাত থেকে ডালের বাসন পড়ে যায়। তার মনের মধ্যে হুট করে অনাকাঙ্ক্ষিত ভয় কাজ করতে শুরু করে দেয়।
কারণ তার বড় ছেলে কোনদিন ও এমন কাজ করে না। সে তো সব সময় ডাকাডাকি করার আগেই এসে উপস্থিত হয়।

বাড়ির সবাই দ্রুত ইফানের দরজার সামনে এসে কড়া নাড়তে থাকে। এতো মানুষের আওয়াজেও সে যখন সারা দিচ্ছিল না তখন বাড়ির সবাই মিলে দরজা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেই। তবে সে কাজ করতে হয় না। বাড়িতে সকল রুমের এক্ট্রা চাবি ছিল। আব্বু দ্রুত রুমের এক্ট্রা চাবি এনে দরজার লক খুলে।

দরজা খোলার পর সবাই যা দেখলো তার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। সে মেঝেতে পড়ে আছে।
সবাই দ্রুত তাকে সোজাভাবে শোয়াতেই আঁৎকে ওঠে।আমার ভাই সুইসাইড করছে সে বিষপান করেছে।
তার মুখ থেকে বিষের বিষাক্ত গন্ধ বাহির হচ্ছিল।
কেউ কোন কারণ বুঝে উঠতে পারছিল না।
তবুও সবাই করাণ খোঁজা বাদ দিয়ে ছেলেকে নিয়ে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
বাড়িটা পুরো ফাঁকা পড়েছিল।

সবাই হসপিটালে চলে গেছিলো কিন্তু আমি যাই-নি! কীভাবে যাব? আমার এতো শান্ত ভদ্র প্রাণোচ্ছল ভাই হঠাৎ কেনো সুইসাইড করবে?
তার কারণ জানতে সেদিন ভাইয়ার পুরো রুমটা আমি এলোমেলো করেছিলা।
তবে কোথাও তেমন কোন কিছু পাইনি যা থেকে তার সুইসাইড করার রহস্য জানতে পারবো।
হঠাৎ মনে পড়ে আমাদের লেখাপড়া করার রুম তো আলাদা। লাইব্রেরী রুমে হয়তো কিছু পেতে পারি। লাইব্রেরী রুমে এসে অনেক খোঁজাখুঁজি করার পর বুকশেলফ এর এক কোণায় একটা হালকা কালোরঙ এর ডায়েরি পাই। আর সে ডায়েরি থেকে জানতে পারি আমার ভাইয়ের আত্মহত্যা করতে চাওয়ার কারণ।

ডায়রি পড়ে খুব রাগ হচ্ছিল। তখন যদি ঐ রোহিনি কে হাতের কাছে পেতাম তাহলে হয়তো গলাটিপে মেরে দিতাম। তবে আফসোস সে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে ছিল।

এরপর সে ডায়রি হাতে করে হসপিটালে চলে যায়। হসপিটালে এসে তো মাথায় হাত।
ডাক্তারা অনেক চেষ্টার পর তার দেহ থেকে বিষ বাহির করতে সক্ষম হয়। তবে ভাইয়ার অবস্থা তখনো খুব খারাপ ছিলো। ডাক্তারা তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করছিল। তবে তার বাঁচা মরা সবটা আল্লাহর ইচ্ছা।
সেদিন সারারাত আমরা সবাই হসপিটালের করিডোরে বসে আল্লাহর কে ডেকে পাড় করেছিলাম।
বাবা-মা তো স্তব্ধ হয়ে সারারাত বসে ছিল।
যখন তাদের সবাইকে আমি ভাইয়ার ডায়েরীর ঘটনা খুলে বলি।

এরপর ভোরের নতুন সূর্যের আলোর মতো আমার ভাইয়ের জীবনের নতুন সূচনা হয়। ইফানের জ্ঞান ফেরার পর বাবা- মা কে এমন অসহায় অবস্থায় দেখে সে হাউমাউ করে কান্না করে দেয়। তারপর নিজেই নিজের কান ধরে তাদের উদ্দেশ্যে দুঃখীত বলে।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি কোনদিন ও তোমাদের কষ্ট দেওয়ার কথা চিন্তা করবো না। আমি কিভাবে এতোটা স্বার্থপর হতে পারি? তোমাদের কথা চিন্তা না করে আমি স্বার্থপরের মতো লুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চাইছিলাম?”

সেদিন জিনিয়া আর ইজাজ ইফান কে জড়িয়ে ধরে বলে,”আমরা কেমন বাবা- মা নিজের সন্তানের মনের ভেতরে চলা এই ঝড়ের কোন আভাষ বুঝতে পারি নাই?”

এর কিছুদিন পর ভাইয়াকে বাড়িতে আনা হয়।
এই ঘটনার পর থেকে আমাদের বাড়িতে আত্মীয়দের আসা কমে যায়। আমি জানি এরপর থেকে ভাইয়া নিজের জন্য না শুধুমাত্র বাবা- মা কে সুখি রাখার জন্য হাসে। নিজের গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ভার্সিটিতে লেকচারার হিসাবে জয়েন করে।
সে যতোই ঠাট্টাতামাসা করুণ, গম্ভীর হয়ে থাকুক জানিত তার মনের সেই ঘাঁ এখনো কাঁচা আছে।
সে যে জ্যান্ত লাশ।

আসলে জানো কি? একটা মেয়ে পারে কারো জীবন সুন্দর করে সাজাতে। আবার সে মেয়েটা যদি সর্বনাশী রুপ ধারণ করে তো হাজারো মানুষের জীবন সে একাই বিষাক্ত করতে পারে।

অরিন এতো কিছু শোনবার পর মেঝেতে বসে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। সে ইফান কে না বুঝে কতো ভুল ভেবেছিল। আর সে তো সব সময় অরিনের খেয়াল রেখেছে। অরিনের প্রতি একজন আদর্শ স্বামী হবার সকল দাঁয়িত্ব পালন করেছে।
শুধু মাত্র ভালোবাসি এ কথাটা প্রকাশ করে নাই আর তাকে এখনো স্ত্রী অধিকার দেয় নি। তার জন্য কি সে খারাপ হয়ে গেল? হ্যা সত্যি তো অরিন নিজেও এখনো বয়ঃসন্ধিকাল পাড় করছে। এরপর সে যদি বদলে যায় বাস্তবতা দেখে? ইফান একবার ভেঙ্গে টুকরোটুকরো হয়েছে হয়তো অরিনকে নিজের জীবনে গ্রহণ করে দ্বিতীয় বার ভাঙ্গতে চাইছে না।

ইফান কোন কারণে যেনো ছাঁদের উপর উঠে আসে। ছাঁদে এসে অরিন কে মেঝেতে বসে কান্নারত দেখে দ্রুত অরিনের কাছে যেয়ে বসে বলে,” তুমি কান্না করছো কেন? কেউ তোমাকে কিছু বলেছে? মেহেদি খারাপ ব্যবহার করেছে না কি তোমার সাথে? এই তুমি আমার কথা উত্তর দিচ্ছ না কেন?”

ইফান কে আসত দেখে ইহান আড়ালে চলে যায় তা-ই ইফান জানে না এখানে তৃতীয় কেউ উপস্থিত আছে।

অরিন নিজের বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে বলে,”আমার এখানে খুব কষ্ট হচ্ছে লেকচারার সাহেব। আমার আপনজন দের জন্য খুব খারাপ লাগছে।”

অরিনকে দ্রুত নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখে। অরিন ইফান কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে। ইফান অরিনকে শান্তনা দেয় না তার মাথায় হাত বু্লিয়ে দিতে থাকে। একটা সময়পর অরিন নিজেই শান্ত হয়ে যায়।

ইফান অরিনকে উদ্দেশ করে বলে,”যাও অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো।”

অরিন চুপচাপ ছাঁদ থেকে প্রস্থান করে। অরিনের চলে যাবার পর ইফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজেও প্রস্থান করে।

দুজনে চলে যাবার পর ইহান আড়ালে থেকে বেড়িয়ে এসে বলে,”এদের দুজনের মধ্যে কোন খিঁচুরি আছে। নয়তো যে অরিন আমাকে তার হাত স্পর্শ করতে দেয় না দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলে। সে কি ভাবে কোন অধিকার বোধ থেকে ইফানের বুকে মাথা গুঁজে কান্না করতে পারে? কোথায় যে কোন ডাল রান্না হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না ধেত।”

এভাবে দু দিন পার হয়ে যায় দেখতে দেখতে।
ঈদের দিন সকালে বাড়ির ছেলেরা গোছল করে নতুন পাঞ্জাবি পড়ে মিষ্টিমুখ করে নামাজ পড়তে বেড়িয়ে যায়। একমাস সিয়াম পালনের পর ঈদের মজাই আলাদা।
ঈদের পরেরদিন সকালে সবাই নিজেদের গন্তব্যে ফিরে আসে। কারণ ইহান আর ইফান সম্পর্ক তার মা অবগত। কিন্তু মেহেদির দৃষ্টিভঙ্গি অরিনে প্রতি ভাল না। তাছাড়া জিনিয়া চাইছে না উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষার আগে তার মনে কোন কিছুর দাগ আঁচড় কাটুক। সে ছেলে সন্তানের মা তার মানে এই নয় যে সে একটা মেয়ের অস্বস্তির কারণ বুঝতে পারবেনা। একদিকে মেহেদির খারাপ দৃষ্টি ত অন্যদিকে তার মায়ের অরিনের প্রতি কঠোরতা। মেয়েটাকে মনের শান্তি দিতে না পারলেও অশান্তি দিতে চাই না জিনিয়া।

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আর গঠনমূলক মন্তব্য আশা করবে! আচ্ছা ওদের কাহিনী এমন ভাবে হুট করে একদিন শেষ হয়ে যাবে?)



চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here