রিস্টার্ট পার্ট-১

0
8812

রাত তিনটা। কাল সকালে নাদিয়ার স্কুলের ক্লাস ও আছে। কিন্তু ও এখনো জেগে আছে, বিছানার এক পাশে মুখ করে , আর ওর চোখের জলে বালিশ ভিজছে। ওর জীবনটা এমন কেন হলো? ওর স্বামী কেন ওর দিকে তাকিয়ে ও দেখে না?

ওদের বিয়ের এখন সাত মাস চলছে। কিন্তু এই সাত মাসে জাহিদ ওর সাথে ঠিক করে একটু কথাও বলেনি। জাহিদ কখনো ওর হাতটাও ধরে নি। এই তো এখন শুয়ে আছে, কিন্তু বিছানার অন্য পাশে। নাদিয়া কাঁদছে, জাহিদ ঘুমাচ্ছে। কাল আবার সকাল হবে। আবার ওদের দেখা হবে। একই ছাঁদের নীচে দুই আগন্তুক। একটা বাস স্টেশনেও যদি দুই অচেনা মানুষের দেখা হতে থাকে, ওরা কোনো না কোনো ভাবে পরিচিত হয়ে যায়। কিন্তু এই দুজন স্বামী স্ত্রী নামধারী প্রাণীর ক্ষেত্রে তা নয়।

প্রতিদিন সকালে উঠে নাদিয়া নাস্তা বানায়। ওরা নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ে। নাদিয়া রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক। ও এখানে কিছুদিনের জন্যই আছে। ওর ইচ্ছা অন্য একটি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতা করার, তার জন্য ওর এইখানে অভিজ্ঞতা অর্জন। ও চাইলেই নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাপ্লাই করতে পারত তবে ওর স্কুলেই শিক্ষকতা করার ইচ্ছা ছিল। আর এদিকে জাহিদ, নাদিয়া শুধু এটুকুই জানে ওর ব্যাপারে যে ও খুব মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিল। ওর মা বাবা এখন আর কেউই বেঁচে নেই। ওর বড় দুই ভাই স্ত্রী নিয়ে আলাদা থাকে। জাহিদ একজন আইবিএ গ্র্যাজুয়েট, আর বিদেশ থেকে এমবিএ। এখন দেশে একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির বড় পদে আছে। এটুকু বোধহয় ওকে অল্প চেনা বাহিরের লোকেরাও জানে।

নাদিয়া খুব মনোযোগ দিয়ে ওর স্বামী কে দেখছে আর চায়ে চুমুক দিচ্ছে। মানুষটা ও একই কাজ করছে। তবে সে পত্রিকা দেখছে। জাহিদের গালের দাঁড়ি গুলো এত ছোট না, আবার এত বড়ও না। প্রতিদিন ট্রিম করে। ওর চুল গুলোও একই। অত্যন্ত সুশীল ওর চেহারা। তবে এই চেহারায় কিছু একটার যেন অভাব। হাসি। কিন্তু জাহিদের চোখগুলো খুব সুন্দর। চশমা ভেদ করে যতদূর দেখা যায় আরকি। তবে এই সুন্দর চোখ জোড়া ওর চোখে চোখ কখনো মেলায়নি। আর তাই ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য নাদিয়া এখন পর্যন্ত অনেক কিছুই করেছে। যেমন এই নাস্তা। ও একবার এই নাস্তা বানানো ও বন্ধ করে দিয়েছিল। নাস্তা না বানিয়ে কাজে চলে যেত। কিন্তু তা নিয়ে লোকটা ওকে কিছুই বলেনি। আরেকবার নাস্তা না বানিয়ে বসে ছিল। জাহিদ নিজে ওকে নাস্তা বানিয়ে খাইয়েছে। কিন্তু কিছুই বলেনি। ওর উচিত ছিল ওকে জিজ্ঞেস করা, আপনি কী রাগ করেছেন? কিন্তু ওর কিছুই যায় আসে না। এই তো, নাদিয়া যে ওর দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে ওর তো উচিত ওকে কিছু জিজ্ঞেস করা। অন্তত পক্ষে ওর দিকে একবার তাকানো। নাদিয়া রাগ করে চায়ের কাপ টা জোরে রেখেই বেরিয়ে গেল। জাহিদ হালকা চোখ ফিরিয়ে তাকালো। নাদিয়া দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল। জাহিদ বুঝতে পারল কিছু একটা হয়েছে। এরপর ওর চা শেষ করে চায়ের কাপ আর বাকি বাসন গুলো ধুয়ে বেরিয়ে পড়ল।

স্কুলের লাঞ্চ টাইমে নাদিয়া বসে আছে। স্কুল থেকে খাবার দেওয়া হলেও সব টিচাররা বাসা থেকে কিছু না কিছু আনেন। কারো স্ত্রী বানিয়ে দেন, কারো স্বামী কিছু উপহার দেন। তবে শুধু নাদিয়া ই খালি হাতে থাকে। ওর সকালে উঠে তৈরী হওয়ার পর এতো এনার্জি থাকে না কিছু এক্সট্রা আনার। ও শুধুই ওর সিনিয়রদের দেখছে। কেউ এনেছে কাঠবাদাম, কেউ এনেছে চকলেট, খাবারের পর ডেজার্টের জন্য। পাশে ওর বন্ধু আফরা। সে এনেছে আম।

– এই, নে না।
– কী?
– আম। সাব্বির এনেছে। আমার স্পেশালি এই আম ই পছন্দ তো, তাই।
– কিন্তু একটু আগেই তো লাঞ্চ করলাম।
– তো কি হয়েছে?
– খাবার খাওয়ার পরপর ই ফল খাওয়া উচিত না। হজমে সমস্যা হয়। আরেকটু পর খা।

আফরা মুখ বাঁকা করে বাটি টা বন্ধ করে দিল। পাশ থেকে সুলোচনা ম্যাডাম বললেন, “ও না খেলে আমরা খাচ্ছি। ওর চেহারা দেখেই মনে হচ্ছে কাল রাতে ঘুম হয় নি। কী? ইজেন্ট ইট? বিয়ের পর এমন হয়। কিন্তু তোমার বিয়ের সাত মাস ডার্লিং! একটু তো পুরনো হয়েই গেছে। ” কথাটি শুনে নাদিয়া হালকা করে হাসল। তবে হাসিটা ওর কপালের উপর পাচ্ছে। বাবার কথামতো অ্যারেঞ্জ মারেজ টা না করলেই পারতো। এত তাড়া কোথায় ছিল? আরেকটু সময় নিয়ে বুঝে শুনে কাউকে করতো। কী দরকার ছিল বিয়ের? ওর চেহারা দেখে ফাহিমা ম্যাডাম বলল,

– মনে হচ্ছে কাল অন্য কারণে জেগেছিলে।
– জ্বী!
– রেগেছিলে? ঝামেলা হয়েছিল! তাই তো ঘুমাও নি। আর কান্না ও করেছ বোধহয়। আইস আর সোলেন!
– না কান্না করিনি। এমনি রাগ করেছিলাম।

নাদিয়া নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকি সবাই ফাহিমা ম্যাডাম কে বকছে। তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আফরা দেখছে, সত্যি তো চোখগুলো ফোলা !

– সে রাগ ও ভাঙায়নি। এখন পর্যন্ত কল ও করেনি। অ্যাম আই রাইট?

আফরা তাড়াতাড়ি করে নাদিয়ার পিঠে হাত বুলোতে লাগল। আফরা ভয়ে আছে, নাদিয়া যদি ওনাকে কিছু শুনিয়ে দেয়। নাদিয়া কিছুই বলছে না। সে তো বুঝবেই না ও যে রাগ করেছে। আর নাদিয়ার নাম্বারটা ও বোধহয় নেই ওর কাছে। ডিলিট ই করে দিয়েছে হয়তো।

– জানো, আমার উনিও এমন করেছিলেন বিয়ের পর। রাগ ও ভাঙায়নি আর খোঁজ ও নেয়নি। এমন শিক্ষা দিয়েছি না।
– কী করেছিলেন?

নাদিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল। সবাই খানিকটা অবাক। কারণ নাদিয়া এখানে চাকরি করছে ঠিকই, কিন্তু কখনো এ ধরণের আলোচনায় আগ্রহ নেয়নি।

– খাবার দেইনি।
– মানে?
– পুরুষ মানুষের মনের রাস্তা যায় তাদের পেট দিয়ে। আর রাতের বেলা তারা না খেয়ে থাকতেই পারে না। তাই রাতের বেলা ও আসার আগেই খেয়ে শুয়ে পড়তাম, আর কিছুই রাখতাম না ওর জন্য। সকাল বেলা বা দিনের বেলা যেকোনো জায়গায় যেতে পারবে, কিন্তু রাতের বেলা একটু আনএভেইলেবল। এক রাত উপোস করেই স্যরি বলেছে।
– কেন?
– ছেলেরা ক্ষুধা সহ্য করতে পারে না। আসলে ছেলেরা কিছুই সহ্য করতে পারে না। আবার অনেক কিছুই পারে। যা তারা বাইরে পারে, তা তো অবশ্যই বাড়িতে এসে পারে না। ঢং আরকি!
– এমনটা করা কী উচিত?

সুলোচনা ম্যাডাম বললেন,
– অফকোর্স! আমার হাবিকে করতে হয়নি যদিও, ওয়ার্নিং ইস এনাফ।

সাথে সাথেই বেল বাঁজতে শুরু করল। সবাই এখন ক্লাসে যাবে। নাদিয়া আর আফরার ক্লাস নেই। আফরা নাদিয়াকে জিজ্ঞেস করল,

– কী হয়েছে রে? কেন রাগারাগি করলি? তুই না বললি সে খুব শান্ত লোক।
– সে তো শান্ত ই।
– দেখ, এসব করিস না। ওনাদের কথা মতো এসব করে পরে আরো বারোটা বাজাবি। আর রাগারাগি করতে হলে আমার কাছে আসিস। আমি শুনব , তবুও ওনার সাথে করিস না। আমরা তোর রাগটা নিতে জানি। সে তো জানে না।

নাদিয়া আফরার দিকে তাকায়। আফরা ওর দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে যায়। বারবার ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। নাদিয়া যে খুব রাগী সে ব্যাপারে সবাই জ্ঞাত। ও আবার শুধু একটা ক্ষান্ত দৃষ্টি দিয়ে রাগ দেখানো লোক নয়। ওর রাগ চিৎকার করা থেকে ভাঙচুর পর্যন্ত যায়। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে আর দুই ভাইয়ের একমাত্র বোন। সবার চোখের মণি যখন কোনো একজনের চোখেই পড়ে না তখন তো আর মাথা ঠিক থাকার নয়। তাই আজ তাড়াতাড়ি খাবার খেয়েই শুয়ে পড়ল সে। শোয়ার আগে বেঁচে যাওয়া খাবার গুলো দাড়োয়ানকে দিয়ে দিল।

রাত সাড়ে নয়টায় বাড়ি ফিরে খাওয়ার জন্য জাহিদ কিছুই পায়নি। কিচেন কেবিনেটে যে সবসময় ম্যাগি থাকে তা নাদিয়ার খেয়াল ছিল না। রান্না ঘরে কিছু একটা শব্দ পেয়ে গিয়ে দেখল জাহিদ ম্যাগি বানাচ্ছে। রাগে নাদিয়ার খুন করতে ইচ্ছে হলো জাহিদকে। জাহিদ ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে জিজ্ঞেস করল,

– আপনি খেয়েছেন?
– হ্যাঁ। খেয়েছি। পেট ভরে খেয়েছি। ভাত, মাছ, ডাল আর আলু ভাজা।
– ওও।
– রাহেলা খালার হাতের রান্না আসলেই মজা।

জাহিদ সিংকে সব বাসন দেখল। ও জানে, রাহেলা খালা এত কম রান্না করেনি যে নাদিয়া সব ফেলল। আর নাদিয়া ও এত খাদক না। অন্য কিছু হয়েছে। ততক্ষণে নাদিয়া রেগে ঘরে চলে আসল। পরদিন সে ঘর থেকে সব বিস্কিট ম্যাগি খুঁজে দাড়োয়ানকে দিয়ে দিল। আজ ও এক কাহিনি। তবে জাহিদ কিছু না পেয়ে আজ পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সারা রাত ওর পেটের ইদুরগুলো খাবার না পেয়ে খুব দৌড়াদৌড়ি করল। বেচারা! তারপর ও একটা সাড়াশব্দ করেনি। সকালে নাদিয়া নাস্তা না বানিয়ে স্কুলে চলে আসলো। কী জানি, এক পৈশাচিক আনন্দ বোধ করছে সে। আজ ও শুধু নিজের ওজনে খাবার অর্ডার করে খেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। রাহেলা খালাকে ফোন দিয়ে রাঁধতে বারণ করে দিয়েছে। জাহিদ বুঝতে পেরেছে ব্যাপার টা। তাই এখন আগেই খাবার টা অর্ডার করে রাখে। যখনই আসে রিসিভ করে খেয়ে সে ও ঘুম। দুদিন পর ব্যাপার টা টের পেল নাদিয়া। তাই আবার আগের রুটিনেই ফেরত গেছে তারা। এই বিয়ে টা এখন ওর অসহ্য লাগছে। ওর ইচ্ছে করছে খুন করে ফেলতে এই জাহিদ নামের রোবটটা কে। ও কথা বলে না কেন? ও কেন শুধু সব কথার হ্যাঁ বা নাতে জবাব দেয়? রাগ হয়ে নাদিয়া বসে আছে খাটের উপর। পাশে রেডিও চলছে।

” আজ দিনটা খুবই সুন্দর। এক বিষণ্ণ সুন্দর। মেঘাচ্ছন্ন, বিষণ্ণ, তবুও সুন্দর। বিষণ্ণতাতেও সৌন্দর্য আছে। একটি রিসার্চে পাওয়া গেছে আমাদের পছন্দের গান গুলো বেশির ভাগ বিষণ্ণ ই হয়ে থাকে। কারণ আমরা রিলেট করতে পারি। আজকে আমরা শুনছি সব বিষণ্ণ গান। পরের গানটি আমার খুবই প্রিয়। অনেক বিষণ্ণ, বিষণ্ণ সুন্দর। গানটি শুনতে থাকুন, গান শেষেই আমি আরজে ঐশী ফিরে আসছি বিষণ্ণ কবিতা নিয়ে। সঙ্গেই থাকুন।”

গানটি শুরু হলো এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। বিষণ্ণ চোখে নাদিয়া জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।
“I steal a few breaths
From the world for a minute
And then I’ll be nothing forever
And all of my memories
And all of the things I have seen
Will be gone
With my eyes with my body with me

But me and my husband
We’re doing better
It’s always been just him and me
Together.”

গানটি শুনতে শুনতে নাদিয়া ওদের ঘরের দেয়ালে ওদের বিয়ের ছবিটার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ সেটা দেখল, “me and my husband, we are doing better. It’s always been just him and me together…” দেখার পর ওর আরো রাগ হলো। ক্ষিপ্ত হয়ে নাদিয়া সেই ছবিটা নিয়ে এক আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলল। জিনিসটা ভাঙার পর ওর ভেতরের রাগ একটু একটু কমতে থাকে। এরপর ওর মনে হলো, এমন একটা সম্পর্কে থাকার চেয়ে সম্পর্ক টা ভেঙে দেওয়াই উচিত। আজ হোক, কাল হোক এটা ভাঙবেই। এই সম্পর্কে থাকলে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া ও স্ট্রং আর ইন্ডিপেন্ডেন্ট। ও নিজেকে সাপোর্ট করতে পারবে। এখানে থেকে এই মানসিক চাপ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। পেছনে সেই গানটা বাঁজছে।

কিছুক্ষণ পর রেডিও টা বন্ধ করে দিয়ে নাদিয়া ওর লাগেজ গুছিয়ে সাথে সাথে ওর বাবার বাসায় চলে আসে। সেখানে এসে ও স্বাভাবিকভাবে হাসিমুখে ওদের সাথে থাকতে শুরু করে। কেউ কিছু সন্দেহ করেনি, ওর ভাবি ছাড়া। বাড়ি ফিরে ছবির ফ্রেম টি ভাঙা দেখে জাহিদ তা পরিষ্কার করল। এরপর সোফায় বসল। তারপর মুখে হাত দিয়ে চিন্তা করতে লাগল, নাদিয়া সত্যিই চলে গেছে। ওর আলমারিটাও পুরো খালি। ওর লাগেজ টাও নেই। ওর কী নাদিয়াকে কল করা উচিত? কিন্তু ওর নাম্বার টা কোথায়?

(চলবে)

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here