রিস্টার্ট পার্ট-৪৪

0
2363

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৪৪

নাদিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসছে না অনেকক্ষণ হয়েছে। মিষ্টি ওর ঘরে গিয়ে দেখে এসেছে ও ঘরে নেই, ওয়াশরুমে আছে। এরপর গুটি পায়ে মিষ্টি ওর শাশুড়ির ঘরে এসে বলল,

– মা, অরনী না ওর ঘরে নেই।
– কোথায় যাবে? বাইরে কখন গেল? একা যেতে দিলে কেন?
– আমি দেইনি তো। ও বাসায় ই আছে কিন্তু ঘরে নেই।
– ছাঁদে গেল নাকি? আবার ওখানে উল্টা পাল্টা কিছু করলে,
– মা, ও ওয়াশরুমে। অনেকক্ষণ দরজা খুলছে না।
– কতক্ষণ?
– এক দেড় ঘন্টা হবে।
– কেন? কী করল আবার?
– ও একটা প্রেগনেন্সি কিট কিনেছে। ওটাই দেখতে গিয়েছে হয়তো।
– তুমি কী করে জানো?
– মা, এই যে অর্ডারের বিল টা ভুলবশত রেখে গেছে। এখন তো মনমরা থাকে তাই মনে নেই।
– কী বলছ মিষ্টি! ও কী?
– কংগ্রাচুলেশন !!! মা আপনি হয়তো নানি হবেন। তাই অনেক দেরি হচ্ছে বের হতে।
– তোমার মাথা ঠিক আছে মিষ্টি!

নাদিয়ার মা দৌঁড়ে ওর ঘরে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে লাগলেন, “অরনী মামনি, বেরিয়ে এসো। দেখো মায়ের চিন্তা হচ্ছে!” নাদিয়া ওর চোখ মুছে দরজা খুলে বের হলো হাতে এখনো কিট টা আছে। মিষ্টি গিয়ে কিট টা ধরে খুশি হয়ে বলল, ” মা, পজিটিভ!” নাদিয়ার মা ভূত দেখার মতো নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। নাদিয়া চোখের নীচের কালি আর অনুভূতি শূন্য চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে ও একটুও খুশি নয়। মিষ্টি তাই মুখটাকে না চাইতেও গোমড়া করে ফেলল। নাদিয়ার মা নাদিয়া কে বুকে টেনে নিতেই ওর বুক ফেঁটে কান্না আসতে থাকে। একটা সময় নাদিয়া আর্তনাদ করতে থাকে। মিষ্টি নাদিয়াকে ওর খাটে শুইয়ে দিতেই ঘরে ওর বাবা আসলো। নাদিয়ার মায়ের অশ্রু সিক্ত চোখ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন না। মিষ্টি আস্তে করে বলল নাদিয়া গর্ভবতী। নাদিয়ার বাবা খুবই নিরপেক্ষ মানুষ। এই মুহুর্তে তিনি কারো উপর রাগ করতে চান না। জাহিদ কে তিনি খুবই স্নেহ করেন। কিন্তু তার মেয়ের পক্ষেও সংসার করাটা সম্ভব না তিনি জানেন। তিনি নাদিয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলেন, “আই ডোন্ট থিংক তোমার কান্না করা উচিত। বাচ্চা আল্লাহর রহমত। নাদিয়া, তুমি ওর মা। এটাই ওর বড় পরিচয়। তুমি যা নিয়ে কান্না করছো আমার মনে হয় তোমার মাথায় সে চিন্তা আসা ও উচিত না। পুরো চয়েস টা তোমার। আমরা কেউ চাপ প্রয়োগ করবো না।” বাবার এই কথা শুনে নাদিয়া কান্না একটু থামায়। এরপর ওর মা বলে, “উঠ অরনী, একটা স্ট্রিপ এ ভরসা না করে ফুল টেস্ট করিয়ে আসি। নিশ্চিন্তে থাকবো।” নাদিয়া মিষ্টি সহ রাহুর হাসপাতালে যায়। রাহু প্রথমে রেগুলার চেক আপ ভাবলেও পরে বুঝতে পারে এটা প্রেগনেন্সির টেস্ট। “কী বলতে চাস? তুই প্রেগনেন্ট!” নাদিয়া চুপ করে থাকে। মিষ্টি বলে, “কিটে পজিটিভ।” রাহু কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে।

সপ্তর্ষি এখানে কাজ করছে তা রাহুর পরিবার জানে না। তবে লবিতে সবাইকে এভাবে দেখে সপ্তর্ষি এগিয়ে যায়। সবাইকে আস্তে আস্তে সালাম দেওয়ার পর ও রাহু ওর দিকে তাকায় না। সপ্তর্ষি বুঝতে পারে কিছু সিরিয়াস হয়েছে। তারপর ও আস্তে আস্তে নাদিয়াকে জিজ্ঞেস করে , “অরনীপু, আপনি ঠিক আছেন?” বলতেই রাহু চিৎকার করে ওঠে,”না নেই! তোমার কারণে ওর জীবন টা ধ্বংস হয়ে গেছে! এখনো শান্তি হয়নি? দাঁড়িয়ে আরো তামাশা দেখা বাকি আছে!” কথাটা শোনার পর সপ্তর্ষি আর সেখানে দাঁড়ায় না। কাঁদতে কাঁদতে চলে আসে। মিষ্টিও ওর পেছনে যেতে পারে না। রাহু এখন আগুন হয়ে আছে। অতঃপর সবাই মিলে বাসায় চলে আসে। বাসায় আসার পর নাদিয়ার ঘরে মিষ্টি আর রাহু বসে আছে। রাহু আস্তে আস্তে বলে,
– তো তুই এই বাচ্চা রাখবি?
– কী করব? ওর কী দোষ?
– ওর দোষ ওর বাবা! এই লোকের বাচ্চা নিয়ে সারাজীবন তুই থাকতে পারবি না। সারাটা জীবন এই বাচ্চা তোর সামনে ঘুরঘুর করবে আর তোকে মনে করাবে কে ওর বাবা। পারবি থাকতে?
– তো কী করবো?
– আমার মনে হয় এখনো বেশি দেরি হয়নি। কাল অ্যাবর্শন করিয়ে নিবি।

মিষ্টি চিৎকার করে উঠে, “রাহু!!! ” মিষ্টি চোখ গরম করে রাহুর দিকে তাকায়।

– আমি তোমাকে খুব ভালো ভাবতাম। তুমি একজন ডাক্তার হয়ে মানুষ মারতে চাইছো!
– হ্যাঁ চাইছি। খু*নির বাচ্চা রাখার কী দরকার? ও প্রিয়মের খুনি।
– ও খু*নি না। ও নিজেও ভিকটিম।
– ও দেখেছে প্রিয়মের সাথে অত্যাচার। তারপর ও বলেনি। এত বছর চুপ ছিল। এটা ভাবতেই আমার রাগ হয়। ওকে খু*ন করতে ইচ্ছে হয়। এই বাচ্চা আমার সামনে থাকলে প্রতিদিন আমাকে স্মরণ করাবে আমার প্রিয়ম কত কষ্ট পেয়েছিল!
– আর তাই তুমি ও খু*ন করবে? তুমি ওর মামা!

রাহু চুপ হয়ে গেল। মিষ্টির খুব কষ্ট হচ্ছে কারণ রাহুকে ও সত্যিই খুব সম্মান করতো। ক্ষোভ থাকতেই পারে কিন্তু নির্দোষের উপর? ” শুনে রাখো রাহু, আমি বেঁচে থাকতে এই বাচ্চা আমি মারতে দেব না। এটা আমার ওয়াদা নিজের কাছে। আমি একজন মা।” কথাটা শেষ করার আগেই নাদিয়া বলল, “প্লিজ তোমরা বের হয়ে যাও আমার ঘর থেকে। বাচ্চা টা আমি ধারণ করছি তো আমার ইচ্ছা হলে থাকবে না হলে থাকবে না। তোমাদের কারো চয়েস ডাজেন্ট ম্যাটার। কে মামা কে মা আই ডোন্ট কেয়ার!”

মিষ্টি সারারাত ঘুমাতে পারলো না। এই কথা ও যদি জাহিদকে বলে তো ও এখনই এখানে চলে আসবে আর সব ফাঁস হয়ে যাবে যে মিষ্টি এ বাড়ির সব কথা ওকে জানায়। কিন্তু অংশুও মানা করে দিয়েছে। ওর বোনের সিদ্ধান্ত ওর বোন নেবে। কিন্তু বাচ্চার বাবার ও জানার অধিকার আছে। পরদিন সকালে মিষ্টি দেখলো নাদিয়া রাহুর সাথে বাইরে গেছে। ওর শ্বশুর শাশুড়ি কেউ কিছু বলছে না। ওরা হয়তো সত্যি সত্যিই মেরে ফেলবে এই শিশু কে। মিষ্টির নিজেকে অপরাধী মনে হলো। ও সাথে সাথে ওয়াজিরের সাথে যোগাযোগ করলো।
জাহিদ তখন ওয়াজির আর গুরুত্বপূর্ণ লোকেদের সাথে বসে কেস নিয়ে ডিসকাস করছিল। মিষ্টির মেসেজ টা এমন ছিল যে নাদিয়ার কিছু হয়েছে। জাহিদ সাথে সাথেই মিষ্টি কে ফোন দিতেই,

– হ্যালো জাহিদ ভাই, আপনি কোথায়?
– আছি এক জায়গায়। কী দরকার?
– রাহুর হাসপাতালে যেতে পারবেন?
– কেন? নাদিয়ার কী হয়েছে? ও ঠিক আছে।
– ঠিক আছে কিন্তু কতক্ষণ জানি না। সুখবর আছে।
– কী সুখবর?
– আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।
– কী?
– হ্যাঁ হ্যাঁ সত্যি। তবে কতক্ষণ থাকবেন তা আমি জানি না।
– মানে?
– মানে রাহু বলেছে অরনীকে যে এই বাচ্চা না রাখতে। অ্যাবর্শন করতে। আপনার সাথে যখন সম্পর্কই থাকবে না তখন,
– এ হতে পারে না! অরনী এমন না! বাচ্চা কেন মারবে?
– কিন্তু এখন তো ও আপনার উপর রেগে আছে।
– আমার রাগ বাচ্চার উপর কেন?
– তাই বলছি কী ওখানে গিয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচান।
– হ্যাঁ। আমি যাচ্ছি।

জাহিদ কিছু না বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। ওয়াজির ও ওর পেছনে এলো।
– কী হয়েছে শুদ্ধ?
– নাদিয়া নাকি প্রেগনেন্ট।
– কংগ্রাচুলেশন!
– ও নাকি রাখবে না বাচ্চা।
– আমি বিশ্বাস করি না। যাই হোক, নাদিয়া এমন না। ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কোনো।
– ও হাসপাতালে গেছে। ওর ভাই আছে। আমার বাচ্চা কী বাঁচবে?
– অবশ্যই। তুমি চিন্তা করো না। আমার বাইকে এসো।

ওয়াজির আর জাহিদ বাইকে করে শর্টকাট রাস্তায় হাসপাতালে যাচ্ছে। আর নাদিয়া হাসপাতালের লবিতে অপেক্ষা করছে। রাহু এসে ওকে বলল ,

– ভেতরে যা। তোর রিপোর্ট ম্যাডাম দেখছেন।
– রাহু!
– কী?
– আমি এই বাচ্চা অ্যাবর্ট করবো না।

রাহু চুপ করে শুনছে। ও কিছু বলছে না। আবেগে কাল এই কথা গুলো বলে শুধু শুধু নিজের বোনকে কষ্ট দিয়েছে।

– ওর বাবা যেই হোক, আমি তাকে যতই ঘৃণা করি না কেন আমি ওর মা। আমি ওকে মেরে আরো বড় অপরাধী হতে পারব না।
– তোর যা ইচ্ছা। আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি ইমোশনাল হয়ে বলেছিলাম। আর আমি ঠিক করেছি তোর পাশে থাকবো।
– এত তাড়াতাড়ি?
– হ্যাঁ। সারারাত ভেবেছি, খুব অন্যায় করতে যাচ্ছিলাম।
– তারপর?
– আমি ওকে মামাই ডাকবো। আর সবচেয়ে ভালো মামা হবো।

রাহুকে এভাবে দেখে নাদিয়ার চোখে জল এসে গেল। এরপর ও রাহুর হাত ধরে ভেতরে গেল। রাহু ওকে ভেতরে রেখে বাইরে আসলো। ভেতরে ডাক্তার রিপোর্ট দেখছেন,

– আপনাকে কে বলেছে আপনি প্রেগনেন্ট?
– কিটে দেখেছি। পজিটিভ ছিল।
– কয়টা পজিটিভ ছিল আর কয়টা নেগেটিভ?
– একটাই করেছি।
– ফলস্ পজিটিভ।
– মানে?
– মানে এই কিটে শত ভাগ সঠিক হয় না। এক পার্সেন্ট ভুল আসে। আপনার পক্ষে সেটা। আসলে খুব স্ট্রেসে আছেন মনে হয়। সে কারণেই পিরিয়ড লেট। আপনার স্বামী কোথায়?
– উনি, জানিনা।
– ওহ! আপনি প্রেগনেন্ট না। খাওয়া দাওয়া ভালো করে করেন না বোধহয়। বাসায় গিয়ে ভালো করে খাবেন, বিশ্রাম নেবেন। এই ঔষধ গুলো খাবেন।

নাদিয়া রিপোর্ট সহ বের হলো। রাহু দাঁড়িয়ে আছে। ওর মন খারাপ দেখে এগিয়ে গিয়ে বলল,
– কী হয়েছে? মামাই ঠিক আছে?
– আমি প্রেগনেন্ট না।

রাহুর হাসি গায়েব হয়ে গেল। এদিকে জাহিদ দৌঁড়ে দৌঁড়ে আসছে। আশেপাশে নাদিয়াকে খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে ও দেখলো নাদিয়া রাহুর সাথে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিয়া কে দেখতে পেয়েই জাহিদ ওর সামনে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে নাদিয়ার চেহারা স্পর্শ করে বলল, “অরনী তুমি ঠিক আছো?” নাদিয়া সাথে সাথে জাহিদের হাত সরিয়ে দিল।

– কী সমস্যা তোমার? এখানে কী করছ?
– তুমি কী করছ? কী করতে যাচ্ছ?
– তোমাকে কে বলেছে আমি এখানে?
– যেই বলুক। তুমি প্লিজ এটা করো না। আমার উপর রাগ করে আমার বাচ্চা কে,
– তোমার বাচ্চা জাহিদ? তোমার বাচ্চা কী করে বলো? কোথায় ছিলে এতদিন? আমাকে রেখে কোথায় আত্মগোপনে ছিলে? আর বলা নেই কওয়া নেই কার কাছ থেকে শুনলে তোমার বাচ্চা তাই চলে আসলে। স্বার্থপর নির্লজ্জ কাপুরুষ!

আশেপাশের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাহু নাদিয়াকে শান্ত করতে বলল, “এখানে না, ওদিকে যা।” নাদিয়া রেগে চলে যাচ্ছে। জাহিদ ও দৌঁড়ে দৌঁড়ে নাদিয়ার পেছনে যাচ্ছে। এভাবে দুজনেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল,

– অরনী শোনো। দেখো আমি তোমার লাইফে আর আসব না। প্লিজ তুমি এই কাজটা করো না।
– আমাকে অরনী ডাকবে না! তোমার এই অধিকার নেই!
– আচ্ছা নাদিয়া, নাদিয়া প্লিজ! তুমি শান্ত হও। ও তোমার ও তো বেবি।
– হ্যাঁ! ও শুধু আমার বেবি হতো। কিন্তু আমি প্রেগনেন্ট না।

জাহিদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তো মিষ্টি ভাবি যে বলল।

– আর হ্যাঁ, আমি ভেবেছিলাম আমি প্রেগনেন্ট। আর আমি অ্যাবর্শন করতাম না। তোমার মতো মানুষ আমার বাচ্চার বাবা হলে প্রিয়মের মতো সেই বাচ্চা সহ সুই*সাইড করতাম!
– অরনী!!!
– তুমি আমাকে অরনী ডাকবে না!

“তোমার মতো মানুষ আমার বাচ্চার বাবা হলে প্রিয়মের মতো সেই বাচ্চা সহ সুই*সাইড করতাম!”
এই কথাটা নাদিয়া ওকে বলতে পারলো? জাহিদের চোখ দিয়ে আপনাআপনি অশ্রু ঝড়ছে। ওয়াজির দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। নাদিয়া যে এই ভাবে কথা গুলো বলবে ও স্বপ্নেও ভাবেনি। রাহু আর সপ্তর্ষি ও শুনেছে। ওয়াজির কে সেখানে দেখে নাদিয়া ও অবাক হয়। ওর খোঁজ নেই, ও এখানে কী করছে? ওয়াজির এসে জাহিদ কে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে। পরক্ষণেই ওয়াজিরের খুব খারাপ লাগলো। ও ফিরে এসে নাদিয়ার সামনে বলল, “তোমার প্রিয়ম সুই*সাইড করেনি। ও এতটাও কাপুরুষ ছিল না। ওর মিসক্যারেজ হয়েছিল আর ওর পরিবারের সম্মানের জন্য ওর মা বাবা আর ভাই এটাকে আত্ম*হ*ত্যা সাজিয়েছিল। আর একটা বার তোমার কষ্ট হলো না জাহিদ কে এই কথা গুলো বলতে? কী নির্দয় তুমি! আমার মনে হয় নির্বোধের সাথে তর্ক করা সময় নষ্ট। ”

ওয়াজির আর জাহিদ চলে গেল। নাদিয়া বুঝতে পারল না ওরা কী বলে গেল। রাহুর মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো আর কী কী জানা বাকি আছে। নাদিয়া সেখানে দাঁড়িয়েই প্রিয়মের মা থেকে নিশ্চিত হলো ব্যাপারটা। রাগে ঘৃণায় নাদিয়া ফোন কেটে দিল। একদিক থেকে ওর পরিবার ও ওর খু*নী। সময়মতো চিকিৎসা টা ওর দরকার ছিল। চিকিৎসার চেয়ে ওনাদের সম্মান বেশি। সারাজীবন ওর আত্ম*হ*ত্যার প্ররোচনার মিথ্যে বদনাম নিয়ে বেঁচেছিল। আর আজ যখন জানলো ওর কোনো হাত ছিল না তখন আরো খারাপ লাগছে। সেই কল গুলোর একটা ও যদি তুলতো তবে কী ওকে বাঁচাতে পারতো?

“একটা অথর্ব লোক আমি। ভালো হয়েছে নাদিয়া প্রেগনেন্ট না।” জাহিদের মুখে এই কথা শুনে ওয়াজিরের খারাপ লাগলো। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া ওর কিছুই করার নেই।
বাসায় আসতে একটু দেরি হয়েছে নাদিয়াদের। নাদিয়ার ফোনে হঠাৎ একটি বিদেশি নাম্বার দেখে অবাক হলো। ফোনটা তুলতেই সেই বিরক্তিকর আওয়াজ। মিশান ভাইয়া নাদিয়ার খোঁজ নিচ্ছে।
– তুমি নাকি অসুস্থ?
– জ্বী।
– হাসপাতালে গিয়েছিলে?
– জ্বী।
– এখন কেমন আছ?
– ভালো।
– তোমার স্বামী কোথায়?
– আছে।
– ডিভোর্স দিচ্ছ?
– আপনি কেন ফোন করেছেন সোজা কথা বলুন।
– সোজা বললে তুমি ফোনটা রেখে দিবে। তাও বলছি, তোমার বাচ্চার স্বীকৃতি আমি দেব। ওকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। ওসব নিয়ম মানার দরকার নেই। ঐ যে প্রেগনেন্ট অবস্থায় ডিভোর্স হয় না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর মতো বাজে লোককে জীবন থেকে সরাও। তোমার বেবি আমার বেবি হবে। আমরা জার্মানে সেটেল হবো। আমাদের,

নাদিয়া মিশানকে কথা শেষ না করতে দিয়েই ফোনটা কেটে দিল। এরপর বাইরে এসে মিষ্টিকে জিজ্ঞেস করলো,

– কী দরকার ছিল ভাবি?
– কী?
– ওকে বলেছ কেন? একটা দিন কী স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারো না?
– ও বাবা। ওর অধিকার আছে তাই ভেবে বলেছি।
– কে বাবা? মিশান ভাইয়া কেন বাবা হবে?
– মিশানকে কেন বলব? আমি তো জাহিদ ভাইকে বলেছি।

সবাই এবার মিষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। অংশু মিষ্টিকে ধমক দিতেই যাবে তখন নাদিয়া হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দিল।

– ওর সাথে তোমার যোগাযোগ আছে? হ্যাঁ বা না তে জবাব দাও।
– হ্যাঁ।

সবাই অবাক হয়ে গেল। মিষ্টি জাহিদের সাথে যোগাযোগ রেখেছে!

– কতদিন?
– এই পুরোটা সময়। ও তোমার খোঁজ নিচ্ছিল।
– ও কোথায় ছিল? নিজে খোঁজ নেয়নি কেন? (রেগে)
– ওর নিরাপত্তায় জটিলতা ছিল। তাই ও এক জায়গায় লুকিয়ে আছে। ও ভালো মানুষ।

সবাই চুপ হয়ে গেল। কিন্তু নাদিয়া যে কারণে এসেছে তা ছিল মিশান। ও কী করে জানলো? নাদিয়ার চাচা বলেছে ওর ফুফুকে আর সেখান থেকে। নাদিয়া আর এই বাসায় থাকতে চায় না। সত্যিই ওর খুব বিরক্ত লাগছে। জাহিদের সাথে বাজে ব্যবহার করার জন্য খারাপও লাগছে। আজকে বেনজিরের কাছে গিয়েছে তাই। বেনজির জানে কী কী হয়েছে ওদের সাথে। তবুও নাদিয়া থেকে সব শুনলো।

– ম্যাডাম আপনি জানতেন। ও আপনাকে বলেছিল।
– সব জানতাম।
– আমাকে বলেননি কেন?
– কারণ ও আমার পেশেন্ট। ওর কথা আমি বলতে পারব না।
– ওকে সত্যি টা বলে দিতে বলতেন।
– তুমি চিন্তা করো তুমি কী করেছিলে? ওর সামনে আয়না ভেঙে আত্ম*হ*ত্যা করতে গিয়েছিলে। সেই দৃশ্য দেখার পর ওর কী সাহস হবে তোমাকে সেসব বলার?
– সবাই ওর পক্ষ নিচ্ছেন। সবাই!
– কারণ ও ভিকটিম। আমি জানি তোমার ওকে দোষারোপ করাটার কারণ। অনেকদিন ধরে কোনো কিছুর কারণ খুঁজছিলে। অবশেষে পেলে। আমাদের সমাজে আমরা দোষারোপ করে অনেক শান্তি পাই। সবাই মিলে দোষারোপ করতে ভালোবাসি। কিন্তু যাকে দোষারোপ করা হয় তার কথা ভাবি না।
– তো আপনি ওর মিথ্যা বলা সাপোর্ট করেন?
– মোরালি না। কিন্তু আমিই বলেছিলাম তোমাকে সময় দিতে।

নাদিয়া মন খারাপ করে আছে। বেনজির ওর হাত ধরে বলল,
– যা হয়েছে তা আর বদলানো যাবে না। জাহিদ কে দোষ দিলে বা ওর উপর রাগ করে থাকলে প্রিয়ম ফিরে আসবে না।
– তো আমি ওর কাছে ফেরত যাব?
– কেউ তোমাকে যেতে বলছে না। তুমি তোমার মতো থাকো, শুধু ওকে দোষারোপ করে অপরাধ বোধ করাবে না। আচ্ছা, তোমাকে একজনের গল্প বলি। ছেলেটা আমার সহপাঠী ছিল। অনেক মেধাবী মনোবিজ্ঞানের ছাত্র। ওর একটা ছোট বোন ছিল, পারমিতা। খুব আদর করতো তাকে। ওর ছোটবেলার এক বন্ধু কায়সার, খুব ভালো চাকরি করতো। এই জাহিদের মতো। অনেকটা জাহিদের মতোই চাপা স্বভাবের ছিল। তবে পারমিতা ছিল সব কিছুতেই পারদর্শী। আর প্রচন্ড সুন্দরী ও। এমন কিছু ছিল না যে ও পারতো না। ওর জন্য ছেলের অভাব ছিল না তবে পারমিতার বাবার কায়সারকেই পছন্দ করতো। এরপর একদিন পারিবারিক ভাবে ওদের বিয়ে দিয়ে হলো। দুজনকে একসাথে দেখতে অনেক সুন্দর লাগতো। একদম পারফেক্ট! তবে ওদের মধ্যে না সেই যোগাযোগ টা ছিল না। কাছাকাছি থাকলেও মন থেকে অনেক দূরত্ব ছিল। কায়সারের কোনো প্রেমিকা ছিল না যে তাই ও মিতাকে ইগনোর করতো। তবে ও খুব ব্যস্ত থাকতো। এভাবে তিন বছর ওদের সংসার চলল। মিতা এডজাস্ট করছিল। সবই পারতো, আর এটাও পারবে ভেবেছিল। যেই ওকে দেখতো বুঝতো ও খুশি নেই। আর তাই ওকে এডজাস্ট করার উপদেশ দিয়ে যেত। একদিন মিতা ওদের বিবাহ বার্ষিকীর আয়োজন করেছিল। আর কায়সার সেদিন ও আসেনি। উল্টো অফিসের ঝামেলা নিয়ে ওকে বকেছিল। সেদিন মিতা ভেঙে পড়েছিল। ওদের ঢাকা শহরের বাসাতে নতুন সরকারি গ্যাস লাইন ছিল। চুলা ছেড়ে আগুন লাগিয়ে দিল মিতা।
– কী! আত্ম*হ*ত্যা?
– তৎক্ষণাৎ ও মারা যায় নি। কায়সার ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার সহপাঠী তখন লন্ডনে ছিল। বোনকে শেষ বার দেখতে আসার আগেই মিতা ইন্তেকাল করে।

বেনজিরের চোখ ভিজে আসছিল। সে পাশের টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে। নাদিয়া জিজ্ঞেস করে,

– কায়সারের কী হয়েছিল? সে কী কষ্ট পেয়েছিল?
– অবশ্যই পেয়েছিল। কিন্তু কায়সার ওর কষ্ট দেখাতে পারতো না। তখন থেকে শুরু হলো সেই অমানবিক দোষারোপ খেলা। আমার সহপাঠী সবার সামনে ওকে খু*নি বলে দিল। কারণ মিতার ডায়েরিতে ও সব লিখেছিল। প্রতিটা মুহূর্ত ও কায়সারের ভালোবাসার জন্য কী করে কষ্ট পেয়েছিল। ভাই হিসেবে এই আবেগটা ওর মতো বিজ্ঞ লোক দেখিয়ে দিল। সেই ডায়েরিগুলো পাওয়ার পর সবাই মিলে ওকে এত দোষারোপ করেছিল যে ও নিঃশ্বাস নিতে পারছিল না। একদিন সকালে মিতাদের বাড়ির পাশের নদীতে কায়সারের লাশ ভেসে উঠে। ওর পকেটে একটা ভেজা চিরকুট ছিল। তাতে আবছা করে লেখা ছিল, “আমিও পারমিতার কাছে চলে যাচ্ছি। হয়তো সেখানে ওকে অনেক ভালোবাসবো।”
– কায়সার ও আত্ম*হ*ত্যা করলো!
– হ্যাঁ। এরপর শুরু হলো আমার সেই সহপাঠী কে দোষারোপ। কায়সারের মৃ*ত্যুর জন্য ও দায়ী। ও দোষারোপ করতো তাই কায়সার নিজেকে শেষ করে দিয়েছে।
– তারপর আপনার সহপাঠী কী করল?
– ও আত্ম*হ*ত্যা করেনি। তবে কায়সারের মৃ*ত্যুর পর ওর টনক নড়লো। ও বসে বসে এই মৃত্যুর কারণ বের করতে চাইলো। কায়সারের না, মিতার ও। কারণ বলতে গেলে যা ছিল তা হলো ওদের বিয়ে। ওদের বিয়ে তে অনেক সমস্যা ছিল। ভালোবাসার অভাব না ঠিক প্রকাশ ছিল না। কায়সার যে মিতাকে পছন্দ করতো তা ও জানতো। কিন্তু সেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হয়নি। কোনো ম্যারেজ কাউন্সিলর বা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি যদি ওদের সম্পর্কে একটা সেতুর মতো কাজ করে সেই যোগাযোগ টা করে দিত তবে ওদের এই পরিণতি হতো না। এরপর আমার সেই সহপাঠী তার ক্রিমিনাল সাইকোলজিতে সুন্দর ভবিষ্যতকে ছেড়ে বিবাহিতদের সাইকোলজিতে মনোনিবেশ করে। আর এভাবে ও অনেক বিবাহিতদের বাঁচিয়ে দেয়। ও শিক্ষা নিয়েছে।
– সেই সহপাঠী আর কেউ না, পিপি স্যার?
– সেই ছেলেটা পারিজাত। পরবর্তীতে ও পিপি হয়েছে। তখন পারিজাত ছিল। আর পারিজাত তোমাদের মধ্যে পারমিতা আর কায়সারকে দেখতে পায়। তাই তোমাদের নিয়ে ও একটু পার্সোনাল হয়ে যায়।
– আর সেই পারিজাত আপনার স্বামী?
– হ্যাঁ।
– আমার মনে হচ্ছিল। বলেও ছিলাম জাহিদ কে।
– ব্যাপারটা জাহিদ জানে। ও খুব অবাক হয়েছিল।
– ওনার নাম পারিজাত। তো পিপি কেন রেখেছে?
– শর্ট ফর্ম। আমিও পিপি ডাকি। তবে ব্যাপারটা সেটা না। ব্যাপারটা হলো ব্লেইম করা। তুমি নিজে জানো, কী পরিমাণ আঙুল তুলেছিল সবাই তোমার উপর। তুমি আত্ম*হ*ত্যা করতে চেয়েছিলে। আর তুমিই কিনা জাহিদ কে দোষারোপ করছ।
– আমি ওর সাথে সত্য লুকানোর জন্য রেগে আছি। এভাবে আমাকে রেখে গায়েব হয়ে যাওয়ার জন্য রেগে আছি। আমাকে প্রতিবার মিথ্যা বলা আর ধোঁকা দেওয়ার জন্য রেগে আছি। আর ও এসেছিল, বাচ্চার কথা শুনে। প্রচন্ড স্বার্থপর লোক। আমি যখন ম্যাগনেফিসেন্টে ছিলাম তখন ও কিছুই বলেনি। ভেতরে আমি যদি ধরা পড়ে যেতাম?

নাদিয়ার কান্না দেখে বেনজির ওকে সান্ত্বনা দেয়। নাদিয়া চোখ মুছতে মুছতে বলল, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে এটা ভেবে যে আমরা ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কারণ আমি যা জানতাম তা কখনোই সত্যি ছিল না। পুরো দুনিয়াটাই মিথ্যা। মাঝে মাঝে মনে হয় প্রিয়ম কী দোষ করেছিল? ওর পরিবার ওর সাথে এমন করল! জন্মদাতা মা বাবা এমন করতে পারলে জাহিদ কী! আমরা দুজনেই ভালোবেসে ভুল করেছি। আমার মনে হয় সেদিন অ্যাক্সিডেন্টে ম*রে গেলেই ভালো হতো। এত জঘন্য সত্যি গুলো জানতে হতো না। জাহিদের সাথে দেখা হতো না।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here