রিস্টার্ট পার্ট-৪

0
5505

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৪

জাহিদ তখন স্ট্যান্ডার্ড সেভেনে পড়ত যখন ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে ‘ও’ লেভেলে ওঠার আগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। ওর সব ভাইদের মধ্যে শুধু জাহিদ ই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েছে। সে খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। তাই জাহিদের বাবা চাইত ও ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুক। তাহলে পরে বিদেশ যেতে পারবে। খুব কষ্ট করে ওর খরচ জোগাতেন। ওনার অবর্তমানে জাহিদের বড় ভাই পরিবারের হাল ধরেন। তিনি অনেক কষ্ট করে বিসিএস পাস করে সরকারি চাকরি করেন। এভাবেই ছোট দুই ভাইয়ের দায়িত্ব নেন। জাহিদের সাথে ওর বড় ভাইয়ের বয়সের পার্থক্য প্রায় চৌদ্দ বছর। পিতৃসম ভাইকে জাহিদ খুবই সম্মান করে। ওর বড় ভাই সবসময় ওকে সন্তানের চোখে দেখেছেন। ও জীবনে সফল হোক তাই তিনি চান। কিন্তু বিগত কয়েক বছর জাহিদ আর তাকে খুব একটা বিরক্ত করেনি। তিনি চিন্তা মুক্তই ছিলেন। আজ ওর ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে, সেই চিন্তা ওনাকে সারা রাত জাগিয়ে রাখে।

জাহিদের শারীরিক জটিলতার জন্য ওর বউয়ের সাথে সম্পর্ক ভালো না তাই ভেবে অফিসে তার দিন যায়। তিনি পত্রিকায় নানা বিজ্ঞাপন দেখেন, দেয়ালে দেয়ালে নানা পোস্টার দেখেন। অবশেষে কলিকাতা হার্বালে ফোন দিয়ে পুরুষের শক্তি বর্ধক এক ঔষধ অর্ডার করলেন। এই ঔষধ তাকে কীভাবে দেবে তা ভেবেই তার অস্বস্তি হচ্ছে। সত্যি বলতে সবসময় তো ওকে ছেলেই ভেবেছে, সেরকম ভাইয়ের মতো সম্পর্ক নেই। তিনি তাই তার মেজ ভাই সাহিদ কে কল করে এনে সব বললেন। বড়ই লজ্জার বিষয়। সালাম ভাইয়ার দুটো মেয়ে, সাহিদের তিনটে ছেলেমেয়ে আর তাদেরই ছোট ভাইয়ের বিয়ে কিনা এই তুচ্ছ কারণে ভাঙছে। তাই দুই ভাই মিলে জাহিদের বাসায় গেল। প্রথমে জাহিদ ছিল না। পরে ওকে ফোন করে আনল।

– আপনারা?
– তোর বাসায় আসতে আমাদের দাওয়াত লাগবে?
– না।

ওনারা ঢোকার পর জাহিদ দরজা বন্ধ করে দিল। সালাম ভাই আর সাহিদ ভাই নিজেদের মধ্যে টেপাটেপি করছে কীভাবে তুলবে বিষয় টা।

– কিছু বলবেন?
– না তো। মানে হ্যাঁ। তুই আমাদের আপন ছোট ভাই। তুই আমাদের আপনি করে কেন বলিস? (সালাম ভাই )
– সম্মান করে।

সাহিদ ভাই এবার বললেন,
– সবসময় এত মেপে মেপে বলিস কেন? তোর কথা বলতে কী টাকা কাটে?
– না।
– আরে!!! এই কারণেই তোর বউ যাবে। যতটা বিয়ে করবি ততটা বউ যাবে।

জাহিদ কিছু বলে না। সাহিদ এবার অতিষ্ঠ হয়ে বলে,

– আমার তো বিশ্বাস ই হয় না তোর বিয়ে হয়েছে! মানে মেয়েটা তোকে অ্যাপ্রোভ কী করে করল? তুই নাদিয়াকে কী বলেছিলি?
– কিছুই না।
– ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চা! তোকে কী বলছি? একটু কথা বল। শুধু কথার উত্তর দিস না! আর দিলে কয়েক শব্দে বল। বাড়িয়ে বল। উপমা, তুলনা, উদাহরণ ব্যবহার করবি।

জাহিদ কোনো পাল্টা উত্তর করল না। সালাম ভাই বলল,

– কথা ঠিক। জাহিদ তো তিন নাম্বার বাচ্চা। তারমানে তুই মা বাবা কে ছাগল বললি? অইইই!!!
– আমি কখন বললাম। আমি তো উদাহরণ দিলাম।

দুই ভাই হালকা বিবাদে জড়িয়ে গেল। জাহিদ ওনাদের থামানোর চেষ্টা করছে।
“এই জন্যই আমি যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু বলি। আপনি যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা টা না বলতেন, এই ভুল বোঝাবুঝি হতো না।”

ওর দুই ভাই বিবাদ ছেড়ে আসল কাজে লাগলেন। সাহিদ ফ্রিজ থেকে পানি নিয়ে বললেন,
– নাদিয়া সত্যি অসাধারণ। ও তোর সাথে আটমাস ছিল।
– সাতমাস।
– তোদের বিয়ের আটমাস না?
– প্রায়। তবে উনি দুই সপ্তাহ হলো এখানে থাকেননা।
– আর আসবে ও না।
– জানি।
– আসবে না তাই আনবি না?
– উনি এখানে ভালো থাকবেন না। ওনার যেখানে ভালো লাগে উনি সেখানে থাকুক।

সালাম এবার মন খারাপ করে বললেন,

– মেয়েটা আসতে চায়।
– না।
– চায়।
– উনি না বলেছেন।
– মেয়েরা যা বলে তার উল্টো হয়।
– ওনার কথার একটাই মানে।
– তুই কী ওকে ভালো রাখতে চাস না? ওকে নিয়ে আয়।

জাহিদ কফি বানাতে থাকে। সাহিদ এবার ঐ ঔষধের প্যাকেট নিয়ে জাহিদের কাছে যায়।

– এই যে দেখ।
– কী?
– ভালো রাখার জিনিস।

জাহিদ প্যাকেট টা দেখে। “কলিকাতা হারবাল। পুরুষের শক্তি বর্ধক। এক ফাইলই যথেষ্ট। ” এরপর ও জিনিসটা ট্র্যাশ ক্যানে ফেলে দিল। সাহিদ সেটা আবার তুলে পরিষ্কার করে আনল।

– একটা বার ট্রাই করে দেখ। দেখবি, এবার খুশি ও হবে আর বাচ্চা ও হবে।
– দরকার নেই।
– কী দরকার নেই! খুশি না বাচ্চা? খুশি থাকার পাশাপাশি বাচ্চা ও দরকার। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার তিনটা দেখ কী সুন্দর বাড়ি আলো করে রাখে।
– আপনারা আসল ব্যাপারটা জানেন না। তাই এ ধরণের উল্টো পাল্টা ধারণা না করাই ভালো।
– তো তোর জটিলতা নেই? আমরা তো জানতাম তোর শারীরিক জটিলতা।
– কে বলেছে?

জাহিদ খুবই বিরক্তির সুরে বলল। ওর চেহারা দেখে সালাম বলল,
– ও যে বলল, দূরত্ব। বিছানার দুই ধারে দুজন।
– সেটা অন্য দূরত্ব। এসব কোনো ব্যাপার আসছেই না। আপনারা প্লিজ,

সাহিদ এবার জাহিদের সামনে এসে বলল,

– তুই ভার্জিন?
– কী!!!
– তুই কী ভার্জিন? তুই এখনো কিছুই করিস নি!
– আপনারা কোনো প্রয়োজনীয় কথা না বললে আসতে পারেন। আমি এ ধরণের কথা পছন্দ করি না।
– আমার সন্দেহ হয় তুই কী আমাদেরই ভাই কিনা! ভার্জিন জাহিদ!
– আপনি একটু কম কথা বললে ভালো হয়।

রাতের বেলা মিষ্টি ওর মেয়ে অর্ষা কে ঘুম পাড়াচ্ছে। অংশু আসার পর মিষ্টি বলল,
– তোমার কী সত্যিই মনে হয় জাহিদ অরনী কে পছন্দ করে না।
– আমি জানি না।
– দেখ অরনী কিন্তু এতটা ও সুন্দর না। মানে ফেস কাটিং ভালো, চুলের গোছা, হাইট মোটামুটি। কিন্তু ওর গায়ের রং একটু ময়লা। জাহিদ ভাই কী এজন্য?
– কার গায়ের রং ময়লা? অরনীর?
– না তো কী? ওর গায়ের রং ময়লা তাই আমার মেয়ে টা ওর পিপিমণির গায়ের রং পেয়ে বসে আছে। নইলে আমি তুমি অনেক সাদা।
– দেখো, আমার সামনে বলেছ তাও চলছে, যদি এটা অরনীর সামনে বলো তো ও তোমার নামে বর্ণবাদের কেস করে দেবে। অর্ষার হাতে লিখে দেবে আমার মা বর্ণবাদী।
– যাহ!
– অরনীর রাগ দেখার দুর্ভাগ্য তোমার হয়নি। সাপের লেজে পা দিও না।

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বলল,
– এখন বুঝলাম।
– কী বুঝলে ?
– ব্যাপারটা অন্য। তোমার বোন ভাব বাড়াতে বোধহয় জাহিদ ভাইয়ের সামনে রাগ দেখিয়ে বসেছেন। আর তাই সেও কম না। লৌহমানব! অরনী পাথরে গড়া হলেও জাহিদ ভাই লৌহমানব। রাগ দেখাচ্ছেন। খাপে খাপ। মূলত এই কারণে জাহিদ ভাই ও কথা বলছে না তোমার বোনের সাথে।
– তুমি এসব গবেষণা বাদ দাও। অরনীকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। ওকে আমরা বোঝাব। আমরা দেখব ব্যাপার টা।

পরদিন অর্ষা কে স্কুলে দিয়ে আসার সময় মিষ্টি একটা খেলনার দোকানে ঢুকে। সেখান থেকে কী হাবিজাবির কিনে বাড়ি ফিরল। নাদিয়া বাসায় ফিরতেই ওর এক্সট্রা খাতির যত্ন করতে লাগল। ব্যাপারটা অনেক অদ্ভুত। মিষ্টির এমন রং নাদিয়া আগেও দেখেছে। মিষ্টির বিয়ের পর মিষ্টির নিজের ঘর থেকে নাদিয়ার ঘর পছন্দ হয়েছিল। তাই ও তখন বলেছিল নাদিয়ার ঘর টা ওর চাই। বড় ঘর, বড় বারান্দা, আলো বাতাসপূর্ণ। সামনে একটা গাছ ও আছে। পিওর অক্সিজেন। তারপর বাথরুম টা তো সেই। বাথটাব, শাওয়ার চেম্বার। মিষ্টি এসব শুধু টিভি সিরিয়ালেই দেখেছিল। তাই বলে ওর টা একদম যে বাজে ছিল তা নয়। ওর ও একই সুবিধা, তবে পেছনের দিকে। শুধু তাই নয়, নাদিয়ার ড্রেসিংরুম ওর ড্রেসিংরুম থেকে পুরো বিশ সেন্টিমিটার বড়। আর ওর বাথরুমে তখন বাথটাব ও ছিল না। যদিও সেটা পরে হয়েছে। তাই তখন নাদিয়ার খুব খাতির যত্ন করছিল, ও যদি এই দিকটা ওকে ছেড়ে দেয়। তখনও নাদিয়া দেয়নি। বিদেশে যাওয়ার সময় ও এমন করেছিল। নাদিয়া চরম হুমকি দিয়ে গিয়েছিল, তাই ওর ঘরটা সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু ওর বিয়ের পর সেটা রাহুকে দিয়ে দেয়। তবে মিষ্টি এখন এমন কেন করছে? ঘরটা তো রাহুর। খুব সম্ভবত ওর বাজে ব্যবহার করার কথা। কারণ বাজে ব্যবহার করলেই নাদিয়া রেগে যাবে, আর এরপর বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।

মিষ্টি কিছুক্ষণ পর ওর কাছে সেই জিনিসগুলো আনলো। একে একে সব বের করছে। নাদিয়া সব কিছু দেখছে। নাদিয়ার মা ও এলো।

” শোনো অরনী, এগুলো হচ্ছে স্ট্রেস বল। এগুলো চাপলে স্ট্রেস কমে। যখনই তোমার রাগ উঠে কিছু না কিছু ভাঙতে ইচ্ছে করে, ঠিক? তাই তুমি রাগ উঠলে এগুলোর উপর ঝাড়বে। এই দেখ।”
মিষ্টি বল গুলো চাপতে শুরু করল। নাদিয়ার খুব হাসি পাচ্ছে। মিষ্টি এমন কেন করছে? নাদিয়ার মা মাথায় হাত দিয়ে সেখান থেকে চলে যাচ্ছেন। কারণ একটু পর এখানে কিছু হলে তিনি দায়ী নন।

– কিন্তু এগুলো কেন ভাবি?
– রাগ কমানোর জন্য।
– আসল কারণ টা জানতে চাই।
– আসল কারণ টা রাগ।
– আরেকটা কারণ।
– বলব? রাগবে না তো?
– আগে শুনি?
– আমার কেন যেন মনে হয় জাহিদ তোমার সাথে তোমার রাগের জন্য কথা বলে না। তুমি যে বদমেজাজি।

নাদিয়ার চেহারা পাল্টে গেল। এরপর ও একটু স্বাভাবিক হয়ে বলল,

– আমি, ওর সাথে, কখনো রাগারাগি করিনি।
– তো ও তোমার সাথে কথা বলে না কেন? আমার তো মনে হয় ও তোমাকে ভয় পায়।
– তুমিও তো আমাকে ভয় পাও। কখনো কী কথা বলা ছেড়ে দিয়েছ? ওর সাথে রাগ করা, শোনো, কেউ একটা কথা বলবে তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষ রাগ দেখাবে। এই যে তুমি, এত বিরক্তিকর ফালতু কাজ করো সারাদিন। এগুলো আমার ভালো লাগে না। তাই আমি রাগ করি। কিন্তু তবুও তুমি চুপ করো না।
– তুমি আমাকে এই কথা গুলো বলতে পারলে?
– পারলাম। কারণ তোমরা আমার অবস্থান জান না। আর না জেনেই এই সব উদ্ভট জিনিস দিচ্ছ।

নাদিয়া এরপর সেখান থেকে উঠে চলে আসল। কিছু দূর আসার পর আবার গেল। গিয়ে একটা স্ট্রেস বল নিল।
” ধন্যবাদ। বল গুলো সত্যি মজার। আর মনে কষ্ট নিয়ে থাকলে স্যরি। পরের বার থেকে শুধু আমাকেই না, না জেনে কাউকে এ ধরণের জিনিস দেবে না। দিলেও নিজের ধারণা অনুযায়ী কথা বলবে না। কারণ তুমি তার জায়গায় নেই।”

এখন তো মিষ্টির ই রাগ হচ্ছে। তাই ও নিজেও একটা স্ট্রেস বল নিল। আর আজ সন্ধ্যায় ছাঁদে বাবা মা আর ছেলেরা নাদিয়ার ব্যাপারে কথা বলছে। ওনাদের যা মনে হলো নাদিয়া আর জাহিদের মধ্যে কমিউনিকেশন গ্যাপ। দুজনের মধ্যে কেউই খারাপ না। একটু কথা বলে নিলে নিজেরাই সামলে নিবে। ওদের বিয়ে এভাবে ভেঙে গেলে পরিবারের বদনাম হবে। তাই তারা সবাই একটা সিদ্ধান্ত নিল। কাল সকালে,

” তুমি আজ এই মুহূর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।”

বাবার মুখে এমন কথা শুনে নাদিয়া আশ্চর্য হয়নি। তাই ও বলল, ” চিন্তা করবেন না, কিছুদিন সময় দিলেই চলে যাব।”

সবার মুখে আশার হাসি ফুটল। ও তবে বাড়ি ফিরে যাবে। নিজের সংসারে। মাথা তবে ঠান্ডা হয়েই গেছে।

” নিজের বাসায়, জাহিদের বাসা না। আমি চাকরি করি। আমি একটা বাসা নিয়ে চলে যাব।”

রাহু আর অংশু তাকিয়ে আছে। এটা তো আউট অফ সিলেবাস। মানে ও সত্যি সত্যি এখন এমনই করবে। একবার যদি এমনটা হয় তবে ডিভোর্স টা আটকানো যাবেই না। নাদিয়া নাস্তার টেবিল থেকে চলে গেল। অংশু টেবিলে ঘুষি মেরে বলল,

” বাবা, ওকে সময় দেওয়া যাবে না।”

ওদের বাবাও এবার ভাবছে। বিকেলে নাদিয়া বাড়ি ফেরার পর অংশু ওর লাগেজ গুলো ফেলে দিল।

– গেট আউট!
– এটা আমার ও বাসা!!!
– চিৎকার করবি না! আওয়াজ নিচে! এটা আমাদের প্রাইভেট প্রপার্টি।
– তোমার যতটুকু, আমার ও ততটুকু! আর আমরা কেউই এখনো মালিক না। সো সরে যাও!
– ওকে। তাহলে মালিক থেকে শোন।

নাদিয়ার বাবা এসে বলল,
– আমার বাড়ি, আমি ডিসাইড করব কে থাকবে।
– বাড়িটা মায়ের নামেও। মা, তুমি বলো।

নাদিয়ার মা বলল,

– বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি মেয়েদের আসল বাড়ি। বাবার বাড়িতে তারা গেস্ট।
– দেন গেস্ট।
– যথেষ্ট থেকেছ।
– কে বলল? মা, আমার বিয়ের আটমাস। মানে নরমাল বিয়ে হলে আমি এতদিনে প্রেগনেন্ট থাকতাম। তখন তো এমনিতেও থাকতে হতো। সেই হিসেবে আমার কোটা এখনো বাকি।

নাদিয়া একপেশে একটা হাসি দিল। যুক্তিতর্কে ওর সাথে পারা কঠিন। তবুও মা তো মা।

– দেন প্রেগনেন্ট হয়ে এসো, এরপর যত ইচ্ছে তত থেকো।
– মা!!!

সত্যি ওর এখন পুরো বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। শেষ পর্যন্ত মা ও। কেউ সাপোর্ট করবে না। রাহু? রাহুও হাসপাতালে। থাকলেও ঐ পক্ষে থাকতো। এত ডেসপারেট হওয়ার কী আছে? ঘরের চেয়ে পর ভালো। ওর কী অভাব আছে নাকি। ও লাগেজ উঠিয়ে চলে গেল। ওর মা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি এসে ধরল ওনাকে। অনেক সাহস লাগে এমন একটা কাজ করতে। উনি মিষ্টির হাত ধরে ভেতরে গিয়ে বসলেন। রাহুর কাছে ও খবর চলে গেছে এতক্ষণে। ও ভাবছে, এটা কী সত্যি অন্যায় হলো না? কিন্তু সপ্তর্ষি সেদিন দেখা করে বলেছে ওর বাবা বিয়েটা ভেঙে দিতে চায়। উনি কার কাছে যেন শুনেছেন রাহিয়ানের বোনের ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। ডিভোর্সি ননদ থাকলে তিনি তার মেয়ে কে দেবেন না। এখন ও তো এসব মিথ্যে বলে সামলে নিয়েছে। সত্যি যদি জানে তবে বিয়ে টা আর হচ্ছে না।

নাদিয়া দাঁড়িয়ে ফোনটা হাতে নিল। এরপর আফরা কে একটা কল করল।

– কী ব্যাপার? মাত্রই তো গেলি বাসায়।
– হুম। বের করে দিয়েছে।
– কী!
– হ্যাঁ।
– এখন কোথায়?
– রাস্তায়।
– কী করবি?
– তোর বাসায় আসব। কিছুদিন থাকতে দে। সাব্বির ভাইয়া কে বল ওনার আপত্তি আছে কিনা। কয়েকটা দিন, এরপর আমি নিজেই বাসা নিব।
– কিন্তু,
– কিন্তু কী?
– আমার শাশুড়ি আসবে রে।
– কবে? সে আসার আগেই আমি চলে যাব।
– এখনই আছে।
– আজকে বলিস নি তো?
– একটু আগেই আসলো।
– বাহ! সম্পর্ক ভালো হয়ে গেছে তবে।
– হ্যাঁ। ঐ নানি শাশুড়ি মারা গেলেন না, এরপরই নরম হয়ে গেছে।
– মা বলে কথা।
– হ্যাঁ। মেয়ের মন।
– ওকে। ওকে।
– তুই রাগ করিস না। অন্য কোথাও যা।
– ঠিক আছে।
– কোথায় যাবি?
– তোর শ্বশুর বাড়ি। তোর শাশুড়ি তো তোর বাসায়। ওটা তো খালি থাকবে।
– যা বলিস না। হাহাহা!!!

নাদিয়া আর ওর বোকার মতো হাসি শোনার অপেক্ষা করল না। ফোনটা কেটে দিল। এই আফরা ভার্সিটি লাস্ট ইয়ারে পালিয়েছিল। ওর শ্বশুর শাশুড়ি মা বাবা কেউ মানেনি। থাকার জায়গাও ছিল না। রাতারাতি কোনো নব বিবাহিত যুগল কে কেউ ভাড়া দেয় না। তখন নাদিয়া ওর বড় খালা কে বলে তাদের একটা বাড়ির চিলেকোঠা ভাড়া করে দিয়েছিল। আজ সেই আফরা ওর খালার আরেক আলিশান ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। আর ও এখন আফরার সাহস দেখে অবাক হয়। মিথ্যা কথা বলার সময় গলাও কাঁপে না। ওর নানি শাশুড়ি যে মরেছিল সে ওর শাশুড়ির খালা ছিল। মা না। আফরা নিজেই বলেছিল। আর সেইখানে আফরা আর সাব্বির গিয়েছিল আর বাজে ভাবে অপমানিত হয়েও এসেছে। সেই অপমানে নাদিয়ার কাঁধেই জল ফেলেছে। ঐ কাহিনীর পর ওর শাশুড়ি তো অবশ্যই ওর সামনে বসে নেই। আফরার সামনে বসে চা খাচ্ছে নাদিয়ার বড় খালা। চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ পিরিচে রাখতেই তিনি বললেন,

– আমি ঠিক ছিলাম, ও তোমার কাছেই আসবে।
– আর তো কেউ নেই ওর ভরসা করার মতো।
– এই মেয়ে আমি গেলে ওকে একটা কল ও করবে না। যদি ওর ভালো চাও স্বার্থপরের মতো আচরণ করো।
– জ্বী খালামণি। ওর জন্য আজ আমি আর সাব্বির সংসার করতে পারছি। ওর সংসার আমি ভাঙতে দেব না।
– আর শোনো, ওর আর জাহিদের মধ্যকার সমস্যা গুলো ওর কাছ থেকে জেনে আমাকে বলবে, বাড়ি ভাড়া দুই হাজার কম রাখব।
– ছিছি খালামণি! আমি এরকম না। আমার বান্ধবীর সংসার আমিও ভালো রাখতে চাই।
– মন খারাপ করেছ?
– না খালামণি। আপনারা তো আপন লোক।
– এখন বলো আর কার কার কাছে যেতে পারে ও।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে নাদিয়ার রাস্তায় বসে। হোটেল গুলো ওর ভালো লাগছে না। মানুষ গুলো ও কেমন। বাড়ির দিকে ও আর যাবে না। মিনা, সূচি ওরা কেউ ফোন ধরছে না। এরমধ্যে হুট করে বৃষ্টি ও শুরু হলো। এখন কে ওকে সাহায্য করবে? আচ্ছা,

– হ্যালো জাহিদ।
– জ্বী।
– আমি কী আজ রাত আপনার বাসায় থাকতে পারি?

জাহিদ সিট থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
– জিজ্ঞেস করার কী আছে? পারেন।
– ধন্যবাদ। আপনি কী আসতে পারবেন?
– কেন?
– বাড়িটা খুলে দিতে?
– আপনার কাছে তো চাবি ছিল।
– চাবি টা ফেলে দিয়েছি। ভেবেছিলাম তো আর আসব না।
– এখনই আসছি।
– একটু জলদি আসুন না। বৃষ্টি হচ্ছে। আমি রাস্তায়।
– আপনি রাস্তায় কেন? আপনি বললে আমিই আপনার বাসায় আসতাম।
– আমি বের হয়ে গেছি বাসা থেকে। যত তাড়াতাড়ি আসা যায় আর কি।
– জ্বী। আপনি বাসার কাছে আসুন। আমি বাসায় ই আসছি।

জাহিদ চাবি নিয়ে জলদি জলদি বের হলো। বাসার কাছে এসে নাদিয়া কে একটা কল করল। ও পাশের একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে। একদম ভিজে গেছে। জাহিদ গাড়ি থেকে একটা ছাতা নিয়ে নাদিয়ার কাছে যাচ্ছে।পাশে চায়ের দোকান। বৃষ্টি পড়ছে। কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। ভিজে ভিজে চা খাওয়াতে হয়তো অনেক রোমাঞ্চ আছে। পাশে রেডিও চলছে।

” আজ ঢাকা শহরটা ভিজে গেছে। অনেক অপেক্ষার ছিল এই বৃষ্টি। এই বৃষ্টি হয়তো কোথাও কোনো প্রেমিকাকে কাঁদাবে। অনেকদিন পর হয়তো তারও আজ বাইরে বেরোনোর কথা। বৃষ্টি আসায় তা ভেস্তে গেল। আবার কোনো স্বামী হয়তো স্ত্রীর কাছে আবদার করছে গরম চা আর পাকোড়ার। কিন্তু স্ত্রী তো ক্লান্ত, মানা করবে কীভাবে জানেনা, যদি তিনি রাগ করেন? তবে কোথাও কোনো সাহসী প্রেমিক যুগল আজ ভিজতেই বের হয়েছে। আর কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে মানা না করে একসাথেই হয়তো পাকোড়া বানাচ্ছে। আর সেই ধারায় তারা আরো কাছাকাছি চলে আসছে। বৃষ্টি কখনো কোনো আপনজনকে দূরে সরায় না। বৃষ্টি সবসময় সবাইকে কাছে নিয়ে আসে। যদি কেও আজ অভিমান করে প্রিয় মানুষটা থেকে দূরে থাকছেন, কাছে চলে আসুন। হয়তো ঢাকার রাস্তার জমা বৃষ্টির পানির মতো রাগ জমে আছে, কিন্তু সেই পানিও বৃষ্টি থামলেই নেমে যাবে। আপনার রাগটাও নেমে যাবে। আচ্ছা, তাকে ছেড়ে কোথায় যাবেন? সেই তো আসল মানুষ। এখন একটা সুন্দর গান শুনিয়ে আমি আরজে ঐশী বিদায় নিচ্ছি। আমাকে ছেড়ে যাবেন না। কাল আবার আসব , ইনশাআল্লাহ। ততক্ষণ পর্যন্ত থাকুন প্রিয় মানুষটার সাথে। ”

জাহিদ গিয়ে নাদিয়াকে ছাতা ধরল।

“যাবি কোথায় ছেড়ে বল
চারিদিকে তোর অথৈ জল
ভয় হয়, ও.. ভয় হয়।

ভেসে থাকা যাদের নয়
তাদের ডুবেই যেতে হয়
ভয় হয়, ও.. ভয় হয়।

যাবি যদি যাস রে তুই
আর কটা দিন পর
প্রেম বাদে তো এই পৃথিবীর
সবই নশ্বর..”

– আপনি ভেতরে গিয়ে বসতে পারতেন।
– কী বলতাম , ওরা যখন জিজ্ঞেস করত উপরে যান। তারপর কী দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম?
– তাই করতেন, অন্তত ভিজতেন না।

ওরা দুজনেই একসাথে বাড়ি ফিরল। অনেকদিন পর নাদিয়া জাহিদের বাসায়। জাহিদ ওর জন্য তোয়ালের ব্যবস্থা করল।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here