রিস্টার্ট পার্ট_৩৮

0
2438

#রিস্টার্ট
#পিকলি_পিকু
#পার্ট_৩৮

নাদিয়ার যে জন্মদিন এটা জাহিদের খুব ভালো করে মনে আছে। তাই খুব স্পেশাল কিছু করার ইচ্ছা আছে। তবে যাই করুক ওর পছন্দ অনুযায়ী করবে। রাহুকে ফোন করে একটু আলোচনা করা যায়। রাহুর তো সব শুনে এক প্রকার খুশি আর হিংসে দুটোই হচ্ছে। কিন্তু আদর্শ ভাইয়ের মতো নিজের দুলাভাই কে সব পরামর্শ ঠিকই দিয়েছে। বিকেল বেলা জাহিদের সাথে বের হয়ে নাদিয়ার জন্য শাড়ি, কেক আর আনুষঙ্গিক জিনিস কিনেছে। প্ল্যান অনুযায়ী কাল যেহেতু শুক্রবার, তাই ওকে নিয়ে জাহিদ সারাদিন ঘুরে বেড়াবে। আর সন্ধ্যার সময় ওকে বাবার বাড়িতে আনা হবে। তখন ওর জন্য সেখানে মা আর মিষ্টি ভাবি একটা ছোট পার্টি দেবে। বাইরের কেউ না, নিজেরা নিজেরা। বাবা একটা কবিতা লিখেছিল নাদিয়ার জন্য যখন ও রাগ করেছিল। কিন্তু শোনাতে পারেনি। তাদের ছোট পরী টার জন্মদিন গত বছর ও করা হয়নি। অনেকগুলো ঝড় গিয়েছে তার উপর এই বছরটা। সামনের দিন গুলো যাতে তার খুব ভালো যায় তারা সেই দোয়াই করেন।

বাসায় ফিরে জাহিদ যখন এইসব কিছু দেখল ও বুঝতে পারল না হয়েছে টা কী। বিরামহীন ক্রন্দনরত দাড়োয়ান যা বললেন তাতে বুঝতে পারল নাদিয়া কে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কোন থানা এসব না জেনেই জাহিদ বেরিয়ে যায় গেলো নাদিয়াকে খুঁজতে। চুরির দায়টা ঠিক ওর মাথায় ঢুকলো না। বিল্ডিংয়ের সবাই ও বলছে নাদিয়া মেয়েটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের। ওদেরকে আগেও টার্গেট করেছিল কারা যেন। এটা শুধুই হয়রানি করার জন্য।

পুলিশ স্টেশনে এসেও নাদিয়া বলছে ওর কথা শুনতে। ওর আকুতি মিনতি যেন ওনারা কানেই নিচ্ছেন না। “আমার ফোন থেকে একটা মেসেজ দেখলেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যাচ্ছে।” কেউ শুনলো না ওর কথা। খুবই খারাপ ব্যবহার করছে ওর সাথে। থানার সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

বাহিরে ঠান্ডা ও অনেক। পুলিশেরা ওকে একটা ওড়না পরার ও সময় দেয়নি। নাদিয়ার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। কেন যেন ওর মনে হচ্ছে এসব ই উদ্দেশ্য প্রণোদিত। তখনই একটি গম্ভীর কণ্ঠ নাদিয়ার কানে প্রবেশ করলো, “আমি কী জানতে পারি ওনাকে কেন এখানে আনা হয়েছে?”

নাদিয়া মুখ ফিরিয়ে দেখল এ এক সুদর্শন যুবক। এনাকে কোথায় যেন দেখেছে। পুলিশ তাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

– আরে নাফিস সাহেব! আপনি এখানে?
– অন্য একটা কেসের জন্য এলাম। ওনাকে কী কারণে?
– চুরির কেস। অনেক দামি একটা ঘড়ি চুরি করেছে।

নাদিয়া রেগে গিয়ে বলল,
– মিথ্যে কথা। আমি এটা আজ কিনেছি, আমার স্বামীর জন্য। বিল টা কোথায় গেছে জানি না। তবে ফোনে মেসেজে প্রমাণ আছে। আমি অ্যাপের মাধ্যমে পে করেছি।
– দেখি ওনার ফোন?

পুলিশ ফোন দিতে অস্বীকৃতি জানালো। এসব দেখে নাফিস বলল, ” আমি ওনার উকিল।” নাদিয়া অবাক হয়ে তাকালো। কখন হলো ? কিন্তু পুলিশ বলল,
– মেসেজ ভুয়া ও হতে পারে।
– আচ্ছা তো কী হলে বুঝবেন?
– বিলের প্রমাণ। নগদ প্রমাণ।
– উনি তো অ্যাপে করেছেন।
– তো সেটার হার্ডকপি।

নাফিস নাদিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার ব্যাংকের নাম আর অ্যাকাউন্ট ডিটেইলস টা দিন।
– ডাচ বাংলা ব্যাংক। আর ফোনে আছে ডিটেইলস।

নাফিস পুলিশের দিকে তাকালো। এবার তাদের ফোন দিতেই হলো। এইসব ডিটেইলস নিয়ে নাফিস এক জায়গায় ফোন করতে গেল। কিন্তু মহিলা পুলিশ গুলো নাদিয়াকে লক আপে নিয়ে যাওয়ার জন্য টানা হেঁচড়া করেই যাচ্ছে। ফোনটা রেখেই নাফিস এসে বলল,

– থামুন! কোথায় নিচ্ছেন?
– লক আপে।
– এখনো প্রমাণ হয়েছে?
– এই যে জব্দ হওয়া ঘড়ি।
– কমপ্লেইনে কাগজ দেখি তো। ইক্জেক্টলি কী হারানোর কমপ্লেইন করা হয়েছে? কী দেখে আপনারা ওনাকে অ্যারেস্ট করেছেন?
– সিসিটিভি ফুটেজ।
– ঠিকানা কী করে জানলেন?

এবার পুলিশ যেন ধরা পড়ে গেল। তার উপর অভিযোগ পত্রে বলা নেই আসলে কী হারিয়েছে।
– এত বড় দোকানে মাত্র একটা ঘড়ি হারিয়েছে! আর সেই ঘড়িটির কথাও উল্লেখ নেই। ওনাকে কোন অভিযোগে গ্রেফতার করেছেন তার ব্যাখ্যা দিন।
– দেখুন, অপরাধীর বাসায় মালামাল পাওয়া গেছে।
– সে যে চুরি করেছে তার ফুটেজ টা দেখান।
– আপনাকে কেন দেখাব?
– কারণ আমি ওনার উকিল! ওনার হাত খুলুন!!!
বাধ্য হয়েই পুলিশ নাদিয়ার হাত খুলে দিল। এরপর নাফিসের আরেকটা কল আসলো। এরপর সে বলল,
– আপনাদের ফ্যাক্স মেশিন চেক করুন। ব্যাংক থেকে ওনার পেমেন্ট ডিটেইলস চলে এসেছে।
– ব্যাংক কী খোলা নাকি এখন?
– স্যার, অনলাইন ব্যাংক বলেও একটা কথা আছে। ওনারটা সেটার আওয়তায়।

আর কোনো উপায় না পেয়ে এখন নাদিয়া কে ছাড়তেই হলো। ছাড়া পাওয়ার পর নাদিয়া নাফিস কে ধন্যবাদ দিয়ে বলল,
– আপনাকে কোথায় যেন দেখেছি?
– আমি নাফিস রেজা। খুব সম্ভবত সোস্যাল মিডিয়া তে।
– আপনি সেই বিখ্যাত উকিল! আপনাকে এতদিন অসহায় দের পাশে দাঁড়াতে দেখতাম।
– আজ সার্ভিস পেলেন।
– আপনার ফি?
– অপমান করছেন আমাকে।
– না না। একদমই না।
– আমি কোর্টে কোনো কেস লড়িনি তাই ফি ও নেব না। বাই দ্য ওয়ে, আপনাদের কী কোনো শত্রু আছে?
– কেন?
– এটা আপনাকে হয়রানি করার জন্য ছিল। আজকে বৃহস্পতি বার। কাল শুক্রবার আর পরশু শনি। দুইদিন কোর্ট বন্ধ। জামিন ও হতো না। একবার কেস হয়ে গেলে আপনি আর বের হতে পারতেন না। যেই প্ল্যান করুক, তাগড়া করেছে। শুধু ইক্জেক্টলি কোন জুয়েলারি তার উল্লেখ নেই। আপনি কী রিসেন্টলি কোনো জুয়েলারি কিনেছেন?

নাদিয়া ওর গলায় হাত দিয়ে দেখলো। পেন্ডেন্ট টা ওর কুর্তির নীচে।

– হ্যাঁ। পেন্ডেন্ট। তবে সেটা আমি এখন পড়ে আছি।
– আর ঘড়িটা আজ কিনলেন। এটা হয়তো ওরা জানতো না। জানলে দুটো জিনিসের উল্লেখ থাকতো। আচ্ছা যাই হোক, আপনার বাসা কোথায়? পৌঁছে দিয়ে আসবো?
– না। আমার স্বামী কে ফোন করা প্রয়োজন।
– আচ্ছা, আপনি কী কেস করতে চান? এই যে আপনাকে হয়রানি করলো।
– না। আমি আর ঝামেলা চাই না।

নাদিয়া জাহিদকে ফোন করতেই জাহিদ ফোন তুলল। ও ভালো আছে শুনেই সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া জানালো। জাহিদ অন্য একটা পুলিশ স্টেশনে গিয়েছিল। সেখান থেকে নাদিয়া কে নিতে আসলো। এরপর নাফিসের সাথে কথা বলে ওকে বিদায় জানিয়ে বাসায় আসলো। সোসাইটির সকলে নানা প্রশ্ন করছে ওদের। নাদিয়া অপমানে কোনো কথাই বলছে না। ওর পক্ষ থেকে জাহিদ ই জানালো এটা নিতান্তই হয়রানি করার জন্য ছিল। অনেকে বিশ্বাস করলো, অনেকে বিশ্বাস করেও ওদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানালো। এভাবে সোসাইটির মান সম্মান নষ্ট হচ্ছে।

এদিকে বাসায় এসে নাদিয়া চুপচাপ ওর ঘরে শুয়ে আছে। কেন করলো এমন? কারাই বা করলো? এখন ও সবাইকে মুখ দেখাবে কী করে? ধর্নাঢ্য পরিবারের একমাত্র মেয়েকে কিনা চুরির অপবাদে জেলে যেতে হলো! এসব ভেবেই নাদিয়া কাঁদতে থাকে। আজকে যে ওর জন্মদিন তা ওর মনে নেই। বাসার অবস্থা এমনিতেই বেহাল। জাহিদ একটা জিনিস ঠিক করছে, আর একটু পরপর নাদিয়া কে দেখে যাচ্ছে। ও আবার আগের মতো আয়না ভেঙে তুলকালাম না করে বসে। কিন্তু এখন যখন ওকে কাঁদতে দেখলো দৌঁড়ে এসে ওর সামনে নীচে বসে পড়লো,

– কী হয়েছে?
– আমাকে কেন নিয়ে গেল? সবাই আমাকে এখন কী ভাববে? (কাঁদতে কাঁদতে)
– কিছু না। সবাই জানে তুমি কেমন মানুষ।
– আমি কিছুই করিনি। আমি তোমার জন্য একটা ঘড়ি কিনেছিলাম।
– কী দরকার ছিল? আমার জন্য কী দরকার!
– এসব নাকি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। কে করবে এসব?

জাহিদ চুপ হয়ে গেল। কে হয়রানি করবে ওদের? সানি? আজফার ? না, সারা!!! এই শপে যে ওরা গিয়েছিল এটা শুধু সারাই জানে। আর সারাই পারে এ ধরণের জঘন্য কাজ করতে। প্রিয়মের সাথে যা করেছে তার পর বাকি সবই ওর কাছে পানির মতো। নাদিয়া এবার উঠে বসলো।

– কী হলো? তুমি কী কিছু জানো?
– আ’ম স্যরি।
– তুমি স্যরি কেন? আমি নিজেই তোমার জন্য ঘড়ি কিনেছি, এতে তোমার কী দোষ?
– আ’ম রিয়েলি স্যরি। সারা না, স্যরি! স্যরি!

জাহিদ নাদিয়ার কোমড় কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ও কান্না করছে বুঝতে পারছে। ও নাদিয়া কে ছাড়তেই চাইছে না। বার বার শুধু ক্ষমাই চাইছে। নাদিয়ার আর বুঝতে বাকি রইলো না এর পেছনে কে দায়ী। সেদিন ওদের মধ্যে কোনো খারাপ কিছুই হয়নি, তবুও সে কেন এমন নীচ কাজ করলো? কী এমন ঘটনা ঘটেছিল জাহিদ আর সারা মধ্যে যে আজ এত বছর পর দেখা করে একদম তার স্ত্রী কে তিনদিনের জন্য জেলে পাঠিয়ে দিতে হবে? ওদের দুজনের মধ্যে কিছু তো ছিল।

– শুদ্ধ, কী হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?
– কারা?
– তুমি আর সারা।
– কিছু না।
– সে কী সত্যি তোমার প্রাক্তন প্রেমিকা নয়?
– না। আমার সত্যি কোনো প্রেমিকা ছিল না।
– সারা কী তোমায় পছন্দ করতো?

জাহিদ নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাদিয়া জাহিদকে ছাড়িয়ে দেয়। জাহিদ চেষ্টা করে ওকে ধরে রাখার, তবু নাদিয়া নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়।

– আমাকে দূরে সরাচ্ছ কেন?
– আমি একটু একা থাকতে চাই।
– আমি কোনো মিথ্যা কথা বলিনি তো। আমার কোনো দোষ নেই।
– আমি জানি।
– আমাকে দূরে ঠেলে দিও না। আর আজকে তো তোমার জন্মদিন ও।
– তাই আমাকে একটু একা থাকার উপহার দাও।

এ বলে নাদিয়া অন্য পাশে ফিরে শুয়ে পড়লো। এখানে আরো অনেক কিছু আছে। ও কেন সব খুলে বলে না?

“সারা আমার স্কুলে ছিল। অনেক সুন্দরী আর উদার মনের অধিকারী ছিল। সবাই ওকে পছন্দ করতো। একই সাথে সবাই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। আমি ওদের লেভেলের যে ছিলাম না। হ্যাঁ, সারাকে আমি পছন্দ করতাম। ওর দয়ালু স্বভাবের জন্য। আমি আর ও একসাথে হোমওয়ার্ক করতাম, পড়তাম। আমাদের বন্ধুত্বের কথা সানি সারার বাবা কে বললে ওর বাবা আমাকে সাসপেন্ড করে দিতে চায়। সেদিন আমাকে প্রিন্সিপালের অফিসে ডেকেছিল।”

কথা গুলো বলার সময় জাহিদ খেয়াল করলো নাদিয়া ঘুমিয়ে গেছে। নাদিয়া কে ঘুমাতে দেখে জাহিদ হতাশ হয়ে পড়লো। এরপর সে নিজেও মাটিতে শুয়ে পড়লো।

” আজকে আমি বলতে চাইছিলাম কিছু কথা। সেসব তোমার অনেক আগেই জানার কথা ছিলো। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে অরনী। তুমি কেন শুনছ না? পুরোটা হয়তো কখনোই বলতে পারব না, আর চাই ও না। তবুও খানিকটা তো শুনতে পারো। পুরোটা শুনলে তো সেই আমাকেই দোষারোপ করবে। আমি কোথায় যাব অরনী?”

নাদিয়া ওর চোখ টা খুলে ফেলল। সে এখনো ঘুমায়নি। শুধু চোখটা বন্ধ করে ছিল। কারণ তার মনে হচ্ছিল খুব খারাপ কিছু বলবে জাহিদ। সেই খারাপ কথাটা নাদিয়া এখন শুনতে পারবে না। খুব ভয় হচ্ছে। হয়তো তেমন কিছুই না, তবুও ভয় হচ্ছে। আচ্ছা, শুধুমাত্র আজকের রাতটা শুনবে না। এতটা ভয়ংকর জন্মদিন ও চায় না।

সারারাত ওর ঘুম না হলেও ও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। ভোরে জাহিদ ফজরের নামাজ পড়তে উঠেও দেখলো নাদিয়া শুয়ে আছে। অনেক বেলা পর্যন্ত ও শুয়েই ছিল। ঘুম থেকে উঠেও কোনো কথা বলে নি। ওর কথা বলতেই ভয় করছে। ও শুনতে চায় না সেসব। সকাল থেকেই জাহিদ ওর জন্য রান্না করে টেবিল সাজিয়েছে। রাহেলা খালা ও এসেছেন। ওর অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা জাহিদকে ভাবিয়ে তোলে।

– মামা, আমার মনে হয় পুলিশে কিছু কইসে। ডরাইসে হের লাইগা।
– না খালা।
– পুলিশ কেডা পাঠাইসে? খালার মতো মানুষের কেডা এত ক্ষতি করতে চাইবো?
– জানি না।

রাহেলা খালার সাথেও নাদিয়া কোনো কথা বলেনি। বিকেল বেলা রাহুর ফোন আসে। ওদের সে বাড়িতে যাওয়ার জন্য। তবে নাদিয়ার যে অবস্থা তাতে ওর যাওয়া সম্ভব না। তাই জাহিদ মানা করে দিল। খবরটা শুনে ওর বাড়ির লোক আশাহত হলো। বসার ঘরটা মিষ্টি আর অংশু সাজিয়ে ফেলেছে। এখন এত সব সাজের কী হবে? ছোট্ট অর্ষা অনেক আনন্দ করছিল ওর পিপিমণির জন্মদিন তাই। নাদিয়ার মা তাই খাবার বাক্স ভরে রাহুকে দিয়ে পাঠালেন। রাহু খাবার নিয়ে গিয়ে বোনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে আসলো। ওর কাছে কিছু ঠিক লাগলো না। আবার ঝগড়া লাগলো নাকি ওদের? শাড়ি পছন্দ হয়নি? নাকি ওর গাঁধা স্বামী কিছু গন্ডগোল করে বসে আছে। নীচে নামার সময় লিফ্টে দুজন বাসিন্দার আলোচনা ওর কানে আসলো। নববিবাহিত দম্পতির কী যেন বলছিল। চুরির দায়ে গ্রেফতার এমন। ঠিকমতো শুনতে পায়নি রাহু। দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই সে সব খুলে বলল। কাল তবে এত কিছু হয়ে গেল আর ওরা কিছুই বলেনি! তবে দাড়োয়ানের অনুরোধেই রাহু আর উপরে উঠে কিছু বলল না। ওর বোনটা বিয়ে করার পর এক দন্ড শান্তি পেল না। এই সাদাসিধে মানুষটার এত শত্রু কেন থাকবে? ব্যাপারটা উল্টো হওয়ার কথা।

রাহু যাওয়ার পর জাহিদ আবার নাদিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে,

– শুভ জন্মদিন। তুমি কী আজ সত্যিই কোনো কথা বলবে না বলে ঠিক করেছ?
– কী কথা বলব?
– ওরা কী তোমাকে সত্যিই কিছু বলেছে?
– না।
– তবে একদম কিছু বলছ না যে? তোমার আজ জন্মদিন। আজ আমাদের একসাথে অনেক আমোদ করার কথা। আমি তোমার জন্য অনেক উপহার কিনেছি। আজকে ঘুরতে যাওয়ার কথা। আমি তোমাকে খুশি দেখতে চাই।
– আমি কী করবো?
– তোমার সব কষ্ট আমাকে দিয়ে দাও।

নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। জাহিদ নাদিয়ার দুটো হাত ধরে ফেলে। নাদিয়া এবার জাহিদের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে,
– কী করে কষ্ট গুলো ফেরত দেব? আমার তো মনে হচ্ছে, তোমার কষ্ট গুলোই আমি নিয়ে নিয়েছি।
– তাহলে আবার দিয়ে দাও।
– এভাবে কতবার পাসিং দ্য পার্সেল খেলবো?
– যখনই কষ্ট হবে। আমি তোমাকে এতটা কষ্টে দেখতে চাই না। আর সেজন্যই আমি,

নাদিয়া বুঝতে পারলো জাহিদ হয়তো আবার আগের কথা গুলো বলবে। ওর সেই অজানা ভয় ওকে জাহিদ কে থামাতে বাধ্য করলো,

– তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো?
– জানিনা। পরিমাপ করা যাবে না।

নাদিয়া জাহিদের দিকে তাকালো। আগে যখন ও কিছু বলতে চাইতো না ও শুনতে চাইতো। আজ বলতে চাইছে তো শুনছে না কেন? নিজেকে আবার অপরাধী লাগছে
– তুমি কাল রাতের কথাটা শেষ করো।
– কোন কথা?
– সারা।
– না থাক।
– বলো। সারা অনেক ভালো ছিল। তুমিও তাকে পছন্দ করতে, এরপর। সে কী করেছিল এমন যার জন্য তুমি তাকে ঘৃণা করো আর সে তোমাকে আজ ও ভালোবাসে?
– সে আমাকে ভালোবাসে না। সে অনেক জেদী আর অহংকারী একটা মেয়ে। সারা মানুষকে তার প্রয়োজনে বস্তুর মতো ব্যবহার করে, আবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।
– তোমাকে?
– পড়ালেখার কাজে ব্যবহার করতো। কিন্তু আমি জানার পর ওকে ইগনোর করি। ও তা ভালোভাবে নেয়নি। সেই রাগ এখনো আছে। সবাই ওর দিওয়ানা, আমি বাদে। সেই ঝালটা তুলল আরকি।
– আমি কেন?
– জানি না। হয়তো তোমাকে বিয়ে করেছি তাই।

জাহিদ এই কথা গুলো বলার সময় চোখ মেলাচ্ছিল না। কিন্তু নাদিয়া ওর থেকে চোখ সরাচ্ছিল না। এত সাধারণ ব্যাপার! এত সাধারণ ব্যাপার তো না। এই সামান্য ব্যাপারে জাহিদ কাউকে এই পরিমাণ ঘৃণা করবে না যেটা ও সেদিন বলেছিল। হয়তো ওর ঘৃণার পরিমাণ মিথ্যা, হয়তো সারার কাহিনী টা অর্ধেক সত্যি।

– তুমি কী সত্যি সত্যি সব বলছ?
– হ্যাঁ।

আবার মিথ্যা বলছে। পুরো সত্যি টা ও কখনো বলবে না। তবুও কেন এই মিথ্যেবাদী কে ও ভালোবাসে? ওর সাথে কেন থাকতে চায়? নাদিয়া জাহিদের হাত ধরে বলে,

– আজকে তো আমার জন্মদিন।
– হুম।
– আমাকে একটা উপহার দেবে?
– কী? যা চাইবে তাই দেব।
– আমার সাথে ডান্স করবে?

জাহিদ অবাক হলো! এ কেমন ইচ্ছা! ডান্স করা! এরকম সিরিয়াস মুহূর্তে ওর ডান্স করতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন? তবুও জাহিদ হ্যাঁ বলে দিলো। নাদিয়া ওর খুব পছন্দের একটি মিউজিক বাঁজালো। এটা শুধুই সুর। জাহিদ জিজ্ঞেস করলো,
– এটা কী মিউজিক?
– এর নাম রিফ্লেকশন, প্রতিচ্ছবি। এর সুরকার তোশিফুমি হিনাতা।
– এটা কী খুব পুরনো?
– ১৯৮৬ সালের। কেন জানি এই সুরটা আমার কানে আসলে আমার পুরো জীবনের প্রতিচ্ছবি আমার চোখের সামনে ফুঁটে উঠে। আমার সুখ, আমার দুঃখ সব।

জাহিদ চুপ হয়ে গেল। নাদিয়া জাহিদের হাত ধরে দুলতে লাগলো। জাহিদ বুঝতে পারছে না এখন কী করা উচিত। তবে সে নিজেও নাদিয়ার তালে তালে চলছে। আস্তে আস্তে সুর আগাচ্ছে, আর জাহিদ ও নিজেকে দুলিয়ে যাচ্ছে। সে নাদিয়ার সাথে স্লো ডান্স করছে। ধীরে ধীরে ওর জড়তা কেটে যাচ্ছে। নাদিয়া পুরোটা সময় তার স্বামীকেই দেখেছে। এই মানুষটাকে সে স্বামী বলে চিনেছিল। তার মধ্যে সে দেখতে পেত দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মানুষটিকে। সে দুর্বল ছিল, অসহায় ছিল। সে কোনো কথা বলতো না। তার মধ্যে সে রহস্য দেখতে পেত। কিন্তু আজ সে তার কিছুই দেখতে পারছে না। অন্য কাউকে দেখতে পারছে সে। এই সেই আগের জাহিদ না। এটা অন্য কারো প্রতিচ্ছবি। কোনো মিথ্যেবাদী।

“এ আঁখি যত কথা বলে
সবই কেন মিছে লাগে?
যদি বলো ভালোবাসি
কেন তা তেঁতো লাগে?
তুমি প্রিয় আমার
এমনই তো ছিলে আগে।
তবু কেন একই কথা
একই সুর মিছে লাগে?

ছোট ছোট মিছে তুমি
বলেছিলে এ আমারে,
কেন সব মিঠে কথা
এ মন বুঝিল না রে?
তাই আজ যাই বলো
সবই যেন মিছে লাগে।

এ আঁখির ভাষা আমি
আজও বুঝি না রে
তুমি মোরে প্রিয়
কেন মিছে বলেছিলে?
তাই আমি প্রাণ খুলে
ভালোবাসতে না পারি রে।”

আস্তে আস্তে নাদিয়া জাহিদ কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। জাহিদ ও থেমে যায়। নাদিয়া সত্যিই অনেক আঘাত পেয়েছে। সত্যিই ওর সারাকে বলা উচিৎ হয়নি অরনীর কথা। আফসোস হচ্ছে জাহিদের। নাদিয়ার ও আফসোস হচ্ছে। কেন সে এই সম্পর্ক রিস্টার্ট করলো? পিপির কথা মতো হার্ডডিস্ক এখন ক্র্যাশ করার পথে। নাদিয়ার সবকিছু খুবই অনিশ্চিত লাগছে। সারাজীবন কী এভাবে থাকতে পারবে?

পুলিশ থেকে খবর টা অর্ঘ্যদীপ আগেই পেয়েছে। তবে সে ব্যাপারটা সারা কে জানাতে পারবে না। তাহলে ওর আর মান সম্মান থাকবে না। পুলিশকে স্পেসিফিক পেন্ডেন্টই বলা উচিত ছিল। গাঁধার গাঁধা পুলিশ ঘড়ির জন্য ধরে পুরো প্ল্যানটাই মাটি করলো। আর এদিকে নাফিস রেজা কোত্থেকে আসলো! সব মিলিয়ে এসব কিছুই সারাকে বলা যাবে না। এখন ও ভালোয় ভালোয় লন্ডনে ফিরে গেলেই হলো। কিন্তু সারা রবিবার দিন জাহিদকে ফোন করলো। অপরিচিত নাম্বার জাহিদ রিসিভ করে না। কিন্তু ওর সন্দেহ হচ্ছিল,
– জ্বী?
– সারা। চিনতে পেরেছ?
– কেন না?
– ফ্রি আছ?
– তোমার কী দরকার?
– ঠিক করে তো সেদিন কথাই বলতে পারিনি।

জাহিদ খুবই বিরক্ত হচ্ছিল। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

– কোথায় দেখা করবে?
– তোমার যেখানে সুবিধা।

জাহিদের অফিসের কাছে একটি ক্যাফেতে সারা আসলো। জাহিদ আসতেই সারা পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে বসে বলল

– ব্যস্ত?
– না। কেন?

সারা অবাক হলো। ওর স্ত্রী তো জেলে থাকার কথা। তারপরও ও এত চিন্তাহীন!

– হওয়ার কথা?
– না। আসলে দুদিন সরকারি ছুটির পর কাজের চাপ।
– আর আজকে জামিন পেতে কষ্ট হতে পারে।

জাহিদ মুচকি হাসলো। সারা অনুভূতি শূন্য। জাহিদ কী হাসছে?

– তুমি নিজেকে কী মনে করো সারা? শুধু কী তুমিই বুদ্ধিমান?
– তেমন কিছু না। তোমার অফিসের কথা বলছিলাম। আমি অরনীর কথা বলছিলাম না।
– অরনীর কথা তো আমিও বলিনি। ও তো জেলে নেই। এত কাঁচা খেল কেন? কাপুরুষ! তোমাকে দেখলে না ঘৃণা ও হয়না। ঘৃণা তোমার জন্য অনেক ছোট একটা শব্দ।
– শুদ্ধ!
– চিৎকার করো না। তোমার মতো নীচ মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তুমি আজ সহী সালামতে আছো শুধুমাত্র তোমার জেন্ডারের জন্য। একজন নারী বলে সেই কার্ড দেখিয়ে বারবার বেঁচে যাও। আগে হলে বলতাম তুমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের ক্ষতি কী করে করতে পারো! প্রিয়মের সাথে তুমি যা করেছিলে এরপর তোমাকে আর মেয়ে বলা যায় না। এখন তুমি অরনীর দিকে কেন হাত বাড়িয়েছ?
– কী আছে ওর মধ্যে? কেন এমন করো?
– তোমার সাথে আমি আর কোনো কথা বলতে চাইনা। তবে জেনে রেখো, তখন আমি দুর্বল ছিলাম। এখন আর নই। অরনীর সাথে যদি আরেকটা কিছু করো তো আমি ভুলে যাব তোমার জেন্ডার।
– কী করবে?
– ডেমো দেখতে চেও না। আর হ্যাঁ, বারবার ওর মধ্যে কী আছে বলো তাই না? আয়নায় নিজের কুৎসিত প্রতিচ্ছবির সাথে ভেতরের নোংরা সত্তাটাকেও দেখে নিও। এতেও তোমার কিছু হবে না। তোমরা প্রিয়মের সাথে যা করেছিলে এরপর তো তোমাদের সবার ড্রেনে ডুবে মরা উচিত ছিল। কিন্তু নির্লজ্জ বিবেকহীন হলে যা হয় আর কি।

সারা ক্ষোভে সেখান থেকে উঠে চলে আসছিল। কিন্তু রাগে অপমানে ও পা পিছলে সেখানে পড়ে গেল। ক্যাফের সবাই ওর দিকে তাকালো। কেউ ওকে তুলতে এগিয়ে আসলো না। ও খেয়াল করলো শুদ্ধ আসছে। কিন্তু শুদ্ধ ওর পাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল। এরপর সারা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ালো। এ যেন আগের সব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। আবার কোনো এক মহাপ্রলয়ঙ্কারী আসতে চলেছে।

গাড়ির ভেতরই সারা অর্ঘ্যদীপ কে ফোন করে বলতে লাগলো, ” ইউ ফা*কিং বাস্টার্ড!!! হোয়াই ইউ ডিডেন্ট টেল মি শি ইজ আউট!!! দ্যাট বি*চ ইজেন্ট ইন জেইল! ইউ মোর*ন মাদা*ফাকা!! কল ফাইয়াজ এ এস এ পি। আমি জানি না ও যা ইচ্ছা করুক! আই ওয়ান্ট দোজ টু অন মাই ফিট!” অর্ঘ্যদীপ বুঝতে পেরেছে খুব বড় কিছু হয়েছে ,
– কাম ডাউন সারা। রিল্যাক্স!
– আই ওন্ট রিল্যাক্স। শুদ্ধের সাহস কী করে হয় এসব বলার! আমি ওদের ছাড়ব না।
– আচ্ছা বাসায় আয়।
– আগে ফাইয়াজ কে ডাক। প্রিয়মের কী হাল হয়েছিল, ওর থেকে মিলিয়ন টাইম খারাপ অবস্থা হবে ওদের।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here