রৌদ্রমাখা বর্ষা পর্ব-১

0
1430

#রৌদ্রমাখা বর্ষা
আলহীনা ইনাম [ছদ্মনাম]

০১,,

ভোর পৌনে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠেছে আফাফ। গতকাল রাতেই শ্বাশুড়ি তাকে আজকের সারাদিনের কাজের তালিকা ধরিয়ে দিয়েছে হাতে। আজকে নিদ্র ইউএস থেকে ফিরবে ব্যবসায়িক কাজকর্ম সেরে। যতোটা ভালো লাগার কথা এতে, ততোটা লাগছে না আফাফের। নিদ্রের মেয়ে বন্ধু, ইউএস টপ মডেল, আনাবিয়া আয়রা এবার নিদ্রের সাথেই ফিরবে। বাড়িতে অনেক আত্মীয় স্বজনরা এসেছে, তাই আফাফের কাজের চাপও বেশি। গতকালই জানতে পেরেছে, ও অন্তঃসত্ত্বা। কাউকে বলেনি। বলবেই বা কোন মুখে? ওকে কেউ বিশ্বাসই করবে না। এমনকি নিদ্রও না। নিদ্র তো সজ্ঞানে কোনোদিনও আফাফের দিকে ভালো করে তাকায়নি পর্যন্ত। নিদ্রের ইউএস যাওয়ার দেড় মাস আগের কথা আফাফ এখনো মনে পড়লে খানিকটা শিউরে ওঠে। সেটা নিদ্র এবং অবশ্যই ওর জন্যও একটা দূর্ঘটনা ছিলো মাত্র!!

দুই বছর আগে আফাফ এবং নিদ্রের বিয়ে হয়েছে। নিদ্র বাসর রাতেই নিজের রুম ছেড়েছে, আর খুব প্রয়োজন না হলে এরুমে আসে না। কথা বলা তো দূরের কথা, মুখ দেখতে না পারলে দেখে না। তবে স্বামীর দ্বায়িত্ব হিসাবে ওর কোনো প্রকার কমতি রাখেনি চাহিদা পূরণের দিক থেকে কেবল স্বামীর অধিকার ছাড়া। আফাফ ইতিমধ্যে কয়েক কোটি টাকা নিয়েছে নিদ্রের কাছে থেকে আর নিদ্র বিনা কৈফিয়তে দিয়ে গিয়েছে। আফাফ তার এক টাকাও নিজের পিছনে খরচ করেনি। আসলে ও নিজের জন্য নিদ্রের টাকা খরচ করে না। সব টাকাই নিজের দুই নেশাখোর জুয়ারি ভাইদের দেওয়া লেগেছে। আফাফ চায়না দিতে। কিন্তু ওর মা বিভিন্নভাবে ওর মন গলিয়ে দুই ছেলের জন্য আদায় করে নেন। এমন না যে, এই দিয়ে ওরা ভালো কিছু করে স্বাবলম্বী হোক। তারা তো শুধু ফুর্তি করতে ওড়ায় টাকা। বোনকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের ভাগ্য খুলে নিয়েছে।

আফাফের পরিচয়!! কোনোদিনও শিকদার বাড়ির বউ হয়ে ওঠা হয়নি। ও কেবল এবং কেবল এ বাড়ির পুরনো ড্রাইভারের মেয়ে। নিদ্রের দাদু নিয়াজ শিকদারের বিশ্বস্ত ড্রাইভার, বরকত উল্লাহর, যে কিনা নিয়াজ শিকদারকে টার্গেট করে ছোঁড়া গুলি নিজের বুক পেতে গ্রহণ করেন। যেদিন তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তখন আফাফ কেবল একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ওর বড় ভাই, আফতাব, এইচএসসির পর পড়াশোনা ছেড়ে টুকটাক কাজ করতো। আর ওর ছোট ভাই, আলী, কেবল দশম শ্রেণিতে ছিলো। নিয়াজ শিকদার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ ওদের পুরো পরিবারের দ্বায়িত্ব নেন। তবে এতে ওনার শুধু কৃতজ্ঞতা না বরং বরকত উল্লাহের প্রতি ওনার স্নেহও পরিলক্ষিত হয়।
নবযৌবনা আফাফের নম্র আচরণ তাঁকে মুগ্ধ করে। তিনি নিজের বড় নাতি নিদ্রের সাথে ওর বিয়ের প্রস্তাব রাখেন, যখন নিদ্র কেবল দাদুর পরের চেয়ারে বসেছে কোম্পানিতে (তার বাবা এবং চাচাকে টপকে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং বিজনেস নিয়ে অধিক জ্ঞান অর্জনের খাতিরে) আর আফাফ ইউনিভার্সিটিতে উঠেছে।

নিয়াজ শিকদার রাতের খাবার গ্রহণের পর পারিবারিক মিটিং ডাকেন। লিভিং এ সবাই জড়ো হতেই তিনি নিদ্রের বিয়ের কথা বলেন। নিয়াজ শিকদারের, শিকদার গ্রুপ, (ওদের পারিবারিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান) উপর কেউ কোনো কথা বলার সাহস রাখে না। এরপরও নিদ্র এবং তার মা, নিলা শিকদার, তেতে ওঠেন পাত্রীর পরিচয় পাওয়ামাত্র। নিদ্রের মতো একটা ছেলের বউ হবে কিনা ড্রাইভারের মেয়ে!! মানতে পারছিলেন না কোনোমতে। নিয়াজ শিকদারের বোধগম্য হয়, নিদ্রকে কোম্পানির দ্বায়িত্ব দেওয়ায় তার অহংকার বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি সে দাম্ভিক এবং অনেক বেশি ক্ষমতাবান মনে করছে নিজেকে। নিয়াজ শিকদার তৎক্ষনাৎ মা-ছেলেকে প্রস্তাব দেন, বিয়ে না করলে তিনি নিদ্রকে দ্বায়িত্ব থেকে বহিষ্কার করবেন। এটা প্রস্তাব ছিলো না বরং হুমকি ছিলো। আর ওনি যে এটা করার ক্ষমতা রাখেন সেটা প্রত্যেকেরই জানা ছিলো। নিদ্র এরপরও মানতে চায়নি। তাকে নিলা শিকদার বোঝালেন। ছেলের মাধ্যমে পাওয়া ক্ষমতা এবং নিজের ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত তিনি নষ্ট হয়ে যেতে দিতে পারেননা।
নিয়াজ শিকদার ইতিমধ্যে নিদ্রের মেয়েদের সাথে অবাধ মেলামেশা সম্পর্কে জানতেন। ভয় ছিলো, এবাড়ির বউ কেমন হবে সেটা নিয়ে। আফাফ অত্যন্ত শালীন একটা মেয়ে। ওনার কাছে এবাড়ির উপযুক্ত মনে হয়েছিলো, যে কিনা সংসারটাকে ওনার অবর্তমানেও স্থিতিশীল রাখতে পারবে। ভেবেছিলেন একবার বিয়ে হয়ে গেলে নিদ্র ওর আচরণে মুগ্ধ হতে বাধ্য হবে। মায়ায় পরে যাবে ওর। কিন্তু ওনার সমস্ত আশায় পানি ঢেলে নিদ্র আফাফের সংস্পর্শেই আসেনি সজ্ঞানে কখনো।

আফাফও প্রথমে রাজি হয়নি বিয়েটা করতে। এটা জড়তার জন্য ছিলো। এছাড়া তো আফাফ প্রকৃতপক্ষে নিদ্রকে পছন্দ করতো। কিন্তু বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেওয়ার সাহস ওর হয়নি। ছোটবেলায় প্রায়ই এবাড়িতে আসতো আফাফ। নিদ্র বরাবরই লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত একজন ছিলো। আফাফ তো শুধু তাকে দেখতেই বায়না ধরতো আসতে যখন সে একটা সৌন্দর্যমন্ডিত কিশোরীতে পরিনত হয়। তবে তার দেখা খুব কম পেতো আফাফ, বেশি ওকে কাজে সাহায্য করতে ডাকা হতো রান্নাঘরে। ড্রাইভারের মেয়ে এসে বসে বসে নাস্তা খেয়ে যাবে, এতোটা উদার গৃহকত্রী নিলা শিকদার নন। বাইরে দান করতে পারেন, তবে ঘরে বসে এসির বাতাস খাবে আর খানদানি খাবার খাবে, এটা ওনি মানতে পারতেন না। রাঁধুনি মর্জিনার কাজ ছিলো আফাফ আসলেই তাকে কাজে খাটানো। বোকা আফাফটা এরপরও নিদ্রের দেখা পাওয়ার লোভে নিজের মান খোয়াতে আসতো।

আফাফকে রাজি করিয়ে ফেলে ওর মা আঞ্জুম। তিনি তো এমনই স্বপ্ন দেখতেন। অস্বীকার করতে পারেন না, তিনি উচ্চাভিলাষী। না হলে, যে বয়সে মেয়েকে চোখে চোখে রাখার কথা সমাজের অধিকাংশ মায়েরা ভাবেন, সে বয়সে মেয়েকে শিকদার বাড়িতে যেতে বাঁধা না দিয়ে বরং কৌশলে উসকে দিতেন না। যদিও ওনার কাজটাতে ওনি নিজেই দ্বিধাগ্রস্থ ছিলেন। এটা কি আদৌও সম্ভব, তিনি যা স্বপ্ন দেখেন ২৫ হাজার টাকা বেতনের ড্রাইভারের স্ত্রী হয়ে!! তাঁর বহুকালের লালিত স্বপ্ন পূরণে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আফাফকে রাজি করিয়ে ফেললেন। স্বপ্নের জাল দৃঢ় হলো, ওনার ছেলেরাও আর্থিক সাহায্য পেয়ে বিলাসী জীবন কাটাবে পায়ের উপর পা তুলে। শিকদারদের তো আর অর্থের অভাব নেই।

আফতাব টুকটাক নেশা করতো আর সামান্য বাজির জুয়া খেলতো। বোনের এমন বিয়ে ঠিক হওয়ায় যেন সাদা পিঠের শকুনের ন্যায় রূপালি লালা ঝড়তে শুরু করলো মুখ থেকে। লটারি পেয়েছে যেন। আফাফের বিয়ের কিছুদিনের ব্যবধানেই সে বড় বড় অঙ্কের বাজি ধরতে শুরু করে(আর বরাবরই সে হেরে যায়। ভাগ্য অতি ভালো হলে জিততে পারে। তাও কোনো লাভ হয়না। লোভে আর নেশায় সেটা আবারও বাজি ধরে হেরে যায়) আর লোকাল দোকান ছেড়ে মদ কিনতে বড় বড় হোটেলে ঢুকতে শুরু করে। আহা বিদেশি বারবান!! ম্যানহাটন! শ্যাম্পেইন! ডম পেরিনিয়ন! ইটালিয়ান হোয়াইট ওয়াইন!
একটা বড়লোকের মেয়েও পটিয়ে ফেলে যার পিছনে টাকাও ঢালতো অনেক। ভদ্রমহিলার পছন্দ রুবিরঙা লাল মদ। রেড ওয়াইন! যেটা কিনা অনেকটা রুহ আফজার (পারশিয়ানে আত্মার মহৌষধ) মতো দেখাতো। তবে তার থেকে বেশি স্পার্কলিং।
আলীও ধীরে ধীরে বড় ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে শুরু করে।

আফাফের বিয়ে হলো নিদ্রের সাথে। নিদ্রও নিজের অবস্থানটা হারাতে চায়নি। ক্ষমতার লোভ যে ভয়ংকর নেশালো। আফাফ হলো নিদ্রের অবজ্ঞার পাত্রী, দাদুর স্নেহভাজন কেউ, নিলা শিকদারের চোখে শুধুই রান্নাঘরে সাহায্যকারী, বাড়ির সবার চোখে অতি সাধারণ কেউ, যাকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করার কিছু নেই আর আফাফের নিজের মা আর ভাইদের কাছে টাকা উৎপাদনের যন্ত্র। শুধু তিনজন ব্যক্তি ওকে বেশ ভালোবাসতো। তারা হলেন, নিদ্রের ছোট ভাই নিলাভ, ওদের চাচী আয়শা আর ওদের চাচাতো যমজ ভাইবোন নির আর নাহিনের মধ্যে নাহিনের পছন্দের ভাবি। বোন মনে করতো তাকে। যেহেতু নাহিন এদের একমাত্র বোন। আফাফ ওর শ্বশুর এবং চাচা শ্বশুর ওর প্রতি কী ধারণা পোষণ করেন তারা, কখনো বুঝতে পারেনি। দুজনকেই ওর গাছের মতো মনে হতো। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়িতে খুব কম কথা বলতেন তারা, এখন যেমন নিদ্র।

বাসর রাতে আফাফ যখন একরাশ ভয় আর উত্তেজনা নিয়ে পুলকিত মনে নিদ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলো, ওর যেন তখনও বিশ্বাস হয়নি ‘নিদ্র’, ছোট থেকে যাকে এক নজর দেখার জন্য ছটফট করতো ও, যাকে কল্পনার রাজপুত্র মনে করতো(রূপকথার বইয়ের পাতায় থাকতো তারা। যেখান থেকে বাস্তবে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়), সে এখন ওর স্বামী!! উত্তেজনায় হাত পা কাঁপছিলো, ঘামছিলো। মায়াবী চোখজোড়া স্বপ্ন বুনছিলো, অলীক চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলো। হ্যাঁ, তার একটা সংসার হয়েছে! তার একজন স্বামী আছে(তখনও নিদ্র পৃথিবীর সেরা পুরুষ আফাফের চোখে)! সে পরিপূর্ণ হবে, তার জীবন সংসারের উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছে খুব শীঘ্রই। নিদ্র কি তাকে ভালোবাসে? সে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না, তার মতো একটা মেয়ের এতো কিছু হয়েছে!
আফাফের কল্পনা থমকে গেলো নিদ্রের আগমনে। আফাফ গুটিয়ে নিলো নিজেকে। অহেতুক ঘোমটায় হাত দিয়ে ঠিক করে নিলো, যদিও সেটা ঠিকই ছিলো। আফাফ পুলকিত। নিদ্র ওর ঘোমটা তুলে কি বলবে?

কিন্তু আফাফের সমস্ত ভুল ভাঙলো নিদ্রের ওর দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে বেলকনিতে চলে যাওয়ায়। আফাফ হতাশ হলো। তবে নিজেকে তখনও সান্ত্বনা দিচ্ছে, হঠাৎ দাদুর প্রস্তাবে বিয়ে হওয়ায় নিদ্রও নিজেকে মানিয়ে গুছিয়ে নিতে সময় নিচ্ছে।
আফাফ লক্ষ্য করলো, নিদ্র অন্ধকার বেলকনিতে বসে সিগারেট টানছে। নিঃশব্দে! উদাস মনে! আফাফ বিছানা ছেড়ে নামেনি। ও বুঝতে পারছে না কি করা উচিত ওর। ঘন্টা দুয়েক পর নিদ্র মোবাইলের হোম স্ক্রিনে সময়টা দেখে নিয়ে বুঝতে পারলো, দাদু ঘুমিয়ে পড়েছে। নিদ্র যেভাবে রুমে ঢুকেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো আবার। আফাফ যেন রুমে উপস্থিত আসবাবপত্রের মতোই জড়বস্তু ছিলো।

#চলবে …

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here