রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী পর্বঃ৫৩

রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
পর্বঃ৫৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat

অপেক্ষা করা কারও জন্য হয় ভালোবাসার আবার কারও জন্য হয় বিরক্তির৷ তবে এই মুহুর্তে অপেক্ষা করা আরশির জন্য ভয়, বিষন্নতা আর অনিশ্চয়তার। পাওয়া, না পাওয়ার মাঝের অনিশ্চয়তার সাগরে ডুবে আছে আরশি। হয়তো এই অপেক্ষার মাধ্যমে জীবনটা আলোকিত হবে অথবা সব আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। আরশি কেবিনের বাহিরের একটা চেয়ারে বসে আছে। দু হাত কপালে দিয়ে মাথা নিচু করে আছে। চুল গুলো অগোছালো ভাবে ছোড়ানো। আর মাত্র আধঘন্টা পর আরশির প্রেগ্ন্যাসির রিপোর্ট দিবে। বুকে চিনচিনে ব্যথা করছে তার। রৌদ্র ফোন করেছে দু বার কিন্তু আরশি কল রিসিভ করেনি। রৌদ্রকে এই অনিশ্চিত আশার আলো দেখানোর ক্ষমতা তার নেই। মিথ্যা আশা দিয়ে রৌদ্রর মন ভাঙতে পারবে না আরশি।

“তুমি এখানে এভাবে বসে আছো কেন?”

কথাটা কানে আসতেই আরশি মাথা তুলে মানুষটার দিকে তাকালো। আরশিকে চেকআপ করা ডক্টর রুবি কৌতুহলী চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চশমা, সাদা এপ্রোনের নিচে খয়েরী রঙের শাড়ি গায়ে জড়ানো। কালো চুলের মাঝে কয়েকটা সাদা চুল গুলো যেন তার বয়সের জানান দিচ্ছে। আরশি মলিন মুখে বলল-

“রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি।”

ডক্টর রুবি আরশির মাথায় হাত দিয়ে বলল-

“আমার সাথে কেবিনে চলো। আমি এখন ফ্রি আছি তোমার সাথে বসে কথার ছলে একটু সময় কাটানো যাবে।”

আরশি একটা মলিন হাসি দিলো। ড.রুবি আরশির হাত ধরে তার কেবিনে নিয়ে গেল। আরশিকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও আরশির পাশে চেয়ার টেনে বসে পরলো। চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রেখে শান্ত গলায় বলল-

“তুমি আমার মেয়ের মতো তাই তোমাকে তুমি করেই বলছি। এখন বল তো তুমি প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টা নিয়ে এতো অস্থিরতায় আছো কেন? তোমার চোখে মুখে বিষন্নতার রেশ দেখা যাচ্ছে। তুমি কি কোনো কারনে বাচ্চাটা চাচ্ছো না!”

শেষের কথা শুনেই আরশির বুক ছ্যাত করে উঠলো। মনে হচ্ছে সদ্য গরম তেলে পরে যাওয়া আরশির হৃদয়টা পুড়ে ঝলসে খাঁ খাঁ করছে। যা পাওয়ার জন্য আরশির এতো ব্যকুলতা সেটা পেয়েও হারিয়ে ফেলার চিন্তা করাও কোনো বড়সড় আঘাতের চেয়ে কম না। আরশি উত্তেজিত হয়ে দ্রুত বলল-

“নাহ নাহ তা কেন চাইবো!”

“তাহলে তোমার মধ্যে এতো ভয় কেন? কিসের এতো জড়তা?”

আরশি কিছুটা সময় চুপ থেকে নিম্ন স্বরে বলল-

“কারন এটা সম্ভব না। সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। আমার হরমোনজনিত কিছু কারনে গর্ভধারণের চান্স খুবই কম।”

ড.রুবি ভ্রু কুচকে ফেললো। সন্দিহান কন্ঠে বলল-

“তাহলে তো এটা তোমার জন্য গুড লাক। কিন্তু তুমি এখানে উদাসীন হয়ে আছো কেন!”

আরশি কিছুটা নেড়েচেড়ে বসলো। ইতস্তত করে বলল-

“কারণ আমি আর আমার হাসবেন্ড দুজনেই সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম। তাই আপনার ধারনাটা আমার কাছে মিথ্যা আশ্বাস বলে মনে হচ্ছে। যেখানে আমার হাসবেন্ড আর আমি দুজনেই অক্ষম সেখানে আমার প্রেগ্ন্যাসির বিষয়টা নেহাতই একটা মিথ্যা আশার প্রদীপ। হয়তো কিছুক্ষনের মধ্যেই সেই প্রদীপের শিখা নিবে যাবে। হঠাৎ করে একটু মিথ্যা আশার আলো দেখে দিশেহারা হয়ে গেছি। নিজেকে সামলিয়ে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। একটু পরে সব আশা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে বলে ভয় পাচ্ছি।”

ড.রুবি গম্ভীর হয়ে গেলেন। চেয়ারে হেলান দিয়ে মনে মনে বেশ কিছুক্ষণ হিসেব নিকেশ করে বলল-

“তুমি কি শিউর?”

আরশি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। ড.রুবি বিস্ময়ের সাথে বলল-

“যদি তোমার কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমি তোমাদের গল্প শুনতে চাই! কিভাবে তোমাদের বিয়ে হয়েছে, দেখা হয়েছে সব।”

আরশি হাল্কা হাসলো। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে শুরু থেকে সব কিছু ডক্টরকে খুলে বলল। আরশির মুখে সব কিছু শোনার পর ড.রুবি মুচকি হেসে বলল-

“আমার যতটুকু মনে হচ্ছে তোমার হাসবেন্ড তোমাকে বিয়ে করার জন্য নিজেকে অক্ষম বলে তোমাদের সামনে তুলে ধরেছে। এখন বাকিটা তোমার রিপোর্ট দেওয়ার পরেই জানতে পারবে।”

আরশি আর কিছু বলল না। চুপচাপ আনমনে ভাবতে লাগলো সত্যিই কি রৌদ্র মিথ্যে বলেছে তাকে! আরশি তো কখনোই রৌদ্রর অক্ষমতার বিষয়টাকে গুরুত্ব দেয়নি। সে তো শুধু রৌদ্রকে বিশ্বাস করেছে, মন থেকে ভালোবেসেছে। কখনো তার ক্ষমতা, অক্ষমতা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেনি।

—————————

দুপুরের শেষ সময়। মাথার উপরের সূর্যটা পশ্চিম আকাশে হেলে পরছে। সূর্যের তাপ ধীরে ধীরে শীতল হয়ে আসছে। আরশি রিকশা থেকে নেমে গম্ভীর পায়ে বাসার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণ আগেই রৌদ্রকে মেসেজ দিয়ে বাসায় আসতে বলেছে আরশি। হয়তো এতক্ষণে রৌদ্র এসেও পরেছে। আরশি কলিং বেলে টিপ দেওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দরজা খুলে যায়।

” কোথায় ছিলে এতক্ষন? ফোন রিসিভ করছিলে না কেন? আর আমাকে বাসায় আসতে বললে কেন হুট করে?”

রৌদ্র দরজার কাছে দাঁড়িয়েই অস্থিরতার সাথে একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে আরশির দিকে। আরশি রৌদ্রর প্রশ্ন গুলোর কোনো জবাব না দিয়ে পাশ কেটে ভিতর চলে যায়। রৌদ্র অবাক চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। দরজা লাগিয়ে আরশির কাছে এসে আবারও জিজ্ঞেস করল-

“কি হলো কথা বলছো না কেন আরু? আর তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে তোমার?”

আরশি সাইড ব্যাগটা সোফায় রেখে রৌদ্র দিকে শান্ত চাহনিতে তাকালো। নির্লিপ্ততার সাথে জিজ্ঞেস করল-

“আপনি কি আমাকে কোনো কিছু নিয়ে মিথ্যা বলেছেন! আমার কাছে কিছু লুকিয়েছেন?”

আরশির প্রশ্ন শোনার সাথে সাথেই রৌদ্রর মাথায় হাজারো ভয় এসে হানা দিল। মস্তিষ্কের মধ্যে শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে “আরশি কি তাহলে কোনো ভাবে সত্যিটা জেনে গেছে?” রৌদ্র ভয় জড়ানো কন্ঠে বলল-

“কি বলছো তুমি! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

আরশি কোনো কথা না বলে ব্যাগ থেকে রিপোর্টের কাগজ বের করে রৌদ্রর হাতে দিল। রৌদ্র কাগজটা খুলে আরশির প্রেগন্যান্সির রিপোর্ট দেখে স্তব্ধ হয়ে যায়। আরশি মা হতে পারবে! আরশির মা হওয়ার ইচ্ছে পূরণ হয়েছে!! সত্যিই কি আরশি প্রেগন্যান্ট? রৌদ্র বিস্ফোরিত চোখে রিপোর্টটা বার বার দেখছে মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করছে। আরশির দিকে তাকিয়ে রৌদ্র ভয়ংকর রকমের বিস্ময় নিয়ে আরশির দু কাধে হাত রেখে হাল্কা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল-

“তুমি প্রেগন্যান্ট আরু? আমাদের বেবি হবে? সত্যি!”

আরশি নির্লিপ্ত ভাবে ছোট্ট করে উত্তর দিল-

“হুম সত্যি।”

আরশির কথার সাথে সাথেই রৌদ্র আরশিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মনে হচ্ছে এখনই আরশিকে নিজের বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নেবে। খুশিতে রৌদ্র চোখ দুটো চিকচিক করছে। প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে রৌদ্র বলতে লাগল-

“আমি অনেক খুশি হয়েছি আরু। আমি জানি না বাবা হওয়ার ফিলিংস কেমন হয়। আর এই মুহুর্তে আমি এমন অনুভব করছি আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি অনেক খুশি অনেক। তুমি মা হবে। তোমার পেটে আমাদের সন্তান আস্তে আস্তে বড় হবে। ছোট ছোট হাত পা থাকবে। এসব ভেবেই তো আমি খুব খুব খুব এক্সাইটেড রুদ্রাণী।”

রৌদ্র অগোছালো ভাবে একনাগাড়ে কথা গুলো বলল। সাথে সাথে চোখ থেকে কয়েক ফোটা অশ্রু গাল গড়িয়ে আরশির কাধের দিকের ওড়নায় পরলো। আরশির আগের মতোই স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। আরশি শান্ত গলায় বলল-

“আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বলেছিলেন তাই না রৌদ্র।”

রৌদ্রর হাতের বাধন হাল্কা হয়ে আসলো। আরশির কথা গুলো দমকা-ঝড়ো হাওয়ার মতো এসে রৌদ্র সকল আনন্দময় অনুভূতি গুলোকে লন্ডবন্ড করে দিল। বিষন্নতায় ছেয়ে গেল চারপাশ। রৌদ্রর মুখের হাসিখানি মিলিয়ে গেল তার লুকায়িত কথার অনুতাপে। খুশিতে চিকচিক করে ওঠা মুখ ফ্যাকাসে বর্ণের ধারণ করেছে। রৌদ্র আরশিকে ছেড়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। চোখ দুটোতে অনুতাপ আর ভয়ের খেলামেলা হচ্ছে। রৌদ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে আরশির ধৈর্যের বাধ ভাঙলো। রাগ, অভিমান আর ঘৃণায় আরশির চোখেমুখে কঠোরতা ফুটে উঠলো। রাগে গর্জে উঠে হুংকার দিয়ে বলল-

“মিথ্যা দিয়ে আমাদের সম্পর্ক শুরু করেছেন আপনি রৌদ্র! দু বছর ধরে আমাকে মিথ্যার জালে জড়িয়ে রেখেছেন? মিথ্যা দিয়ে তৈরি সম্পর্কের বাধনে আটকে রাখতে চেয়েছেন আমাকে!”

রাগে আরশির শরীর থরথর কাঁপছে। মুখ যেন হিংস্র বাঘিনীতে রূপান্তর হয়েছে। রৌদ্র আরশিকে শান্ত করার জন্য আরশির হাত ধরে অনুনয়ের স্বরে বলল-

“আরু প্লিজ শান্ত হও। ঠান্ডা মাথায় একবার আমার কথা শোনো আরু প্লিজ।”

আরশি এক ঝাটকায় রৌদ্র হাত সরিয়ে দেয়। রৌদ্রর থেকে দু কদম পেছনে সরিয়ে দাঁড়িয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলল-

“একদম আমাকে ছোঁবেন না বলে দিচ্ছি। মিথ্যা কথা বলে আমাকে ধোকায় রেখেছেন এতদিন আপনি! কিভাবে পারলেন আপনি এসব করতে রৌদ্র! আমার বিশ্বাস নিয়ে খেলেছেন আপনি। এতো বড় একটা মিথ্যা কথা বলার আগে একবারও কি আপনার বিবেকে বাধলো না! আমি তো আপনাকে মন থেকেই ভালোবেসেছি, বিশ্বাস করেছি। আপনি একবার বলায় আপনার সব কথাই সত্যি ভেবে মেনে নিয়েছি। কখনো আপনার অক্ষমতাকে নিয়ে নিজের মাথায় একটু চিন্তাও আনিনি। কখনো সন্তানের কথা আপনার সামনে মুখেও নেইনি আপনি কষ্ট পাবেন বলে। সব সময় নিজেকে শক্ত রেখেছি এই ভেবে যে দিন শেষে আপনার বুকেই আমার ঠাঁই মিলবে। একটা শক্তপোক্ত বিশ্বস্ত বুক। যেখানে নিজের সব কষ্ট গুলোকে তুচ্ছ বলে মনে হয়। যেখানে আছে আকাশ সমপরিমাণ পরিমাণ নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। কিন্তু নাহ আপনার কাছেই আমি ধোকা পেলাম। আপনি আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেছেন রৌদ্র।”

রৌদ্র অশ্রুসিক্ত চোখে আরশির দিকে তাকিয়ে আছে। আরশির দু চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পরছে। বিশুদ্ধ কোমল পানি। যে বিশুদ্ধ নোনাজল দেখেই প্রথমবার রৌদ্র আরশির প্রেমে পরেছিল কিছু সময়ের জন্য। আজ সেই বিশুদ্ধময়ীর নোনাজল গুলো তার বুকে তীরে মতো এসে বিধছে। ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে তার হৃদয়টা-কে। রৌদ্র আরশির দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই আরশি আবারও দূরে সরে যায়।

“খবরদার আমার কাছে আসবেন না আপনি। আমি থাকবো না এখানে। কোনো মিথ্যাবাদীর সাথে আমি থাকতে পারবো না।”

“আরু আমার কথা শোনো প্লিজ। আমি তোমাকে ধোকা দেইনি আরু। হ্যাঁ আমি মানছি আমি মিথ্যে বলেছি কিন্তু সেটা আমাদের ভালোর জন্য।”

আরশি রৌদ্রর কথার কোনো তোয়াক্কা না করে চোখের পানি মুছে নেয়। সোফা থেকে ব্যাগ নিয়ে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল-

“ভালো জন্য!! আমার বিশ্বাস ভেঙেছেন ভালোর জন্য!”

আরশি কথা গুলো বলেই হনহনিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

চলবে….

[দেরি করার জন্য দুঃখিত। রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাইকে।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here