#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ০৪ (বর্ধিতাংশ)
#৯.
সিলিভিয়ার কথার সারমর্ম বেশ দক্ষতার সাথে বুঝতে পারলো তেহভীন। মস্তিষ্ক যুক্তি সাজিয়ে জানালো; সিলিভিয়া এখনো ভুলভ্রান্তি ধারণার মধ্যে ডুবে আছে। সৃষ্টিকর্তা সবাইকে একিরকম ভাবে তৈরি করেন না। প্রত্যেককে আলাদাভাবে গুন দেওয়া হয়। এবং তাদের উচিত গুনটাকে ব্যাবহার করা।সৌন্দর্য দিয়ে সবকিছু বিচার করা যায় না। তেহভীন সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে প্রতিউত্তরে বলল,
—তুমি ভিতরের এবং বাইরের সৌন্দর্য বোঝো না!
বুঝলে সর্বপ্রথম তুমি নিজেকে প্রয়োরিটি দিতে। নিজেকে ভালবাসতে।অন্য লোকের কাছে নিজেকে ছোট করে প্রেজেন্ট করতে না।
তেহভীনের কথায় চমকে গেলো সিলিভিয়া। সে কখনো নিজেকে নিয়ে ভাবেনি।তার নিজের ভাবি সবসময় তার সাথে তার বোনের তুলনা করতো।কারণ সে সৌন্দর্যে তার চেয়ে এগিয়ে। এলাকায় কিছু মহিলা আছেন,যারা সুযোগ পেলে না না রকম বিদেশি প্রডাক্ট ইউস করে কৃত্রিমভাবে সৌন্দর্যকে আয়ত্তে আনার প্রস্তাব দেয়। অনেক অনলাইন পেজ,ক্রিমের নাম ও সাজেস্ট করে।এসব শুনলে মনটা বিষিয়ে যেতো সিলিভিয়ার।কিন্তু তার মা-বাবা, এবং ভাইয়ের পর এই প্রথম কেউ তাকে সাপোর্ট করছে।নাকি এসব তার ভুল ধারণা।মানুষ তো সুন্দরের প্রতি আকর্ষিত হয় বেশি। সিলিভিয়া আপত্তি করে বলল,
— আমাদের কান্ট্রির মানুষ শ্বেতাঙ্গ নারী-পুরুষদের প্রতি আকর্ষিত বেশি। নিশ্চয় তারা বুদ্ধিমান। তাদের চাওয়াটাও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় নিশ্চয়।
তেহভীন বাইরের দোকানপাটের উপর থেকে সরিয়ে সিলিভিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
— তোমাদের কান্ট্রির মানুষ বুদ্ধিমান নয় মূর্খ।
তাদেরকে আমি সাজেস্ট করতাম,ভিটিলিগো (লিউকোডার্মা) জ্বিনগত অবস্থা,অর্থাৎ যাদের ত্বকের পিগমেন্ট মেলানিন খুইয়ে তাদের ত্বককে শ্বেত করে ফেলে।তারাও তো সুন্দর। কিন্তু তোমাদের কান্ট্রির লোক তাদের রুগী বলে অখ্যায়িত করে।এটা খুব খারাপ লাগে আমার।
সিলিভিয়ার কৌতূহল মন চনমনিয়ে উঠে তেহভীনের কথায়। আজ তেহভীনকে যতোই দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে সিলিভিয়া। নিজেকে আর ছোট লাগছে না আজ।স্পেশাল স্পেশাল ফিল হচ্ছে।পড়াশোনার দিক দিয়ে সে যথেষ্ট কোয়ালিফাইড। তারপর মনটা মানুষের অহমিকা কথাবার্তায় মজে থাকতো। সিলিভিয়া অনুভব করছে তার তলপেটের ব্যাথাটা সয়ে গেছে। ব্যাথাটা অনুভব হলেও সে মুষড়ে পড়ছেনা। তেহভীনের জাদুকরি কথায় হয়তো ব্যাথা ভুলানো যায়।সিলিভিয়া মৃদ্যুহেসে বলল,
— আমাদের কান্ট্রির সম্পর্কে বেশ ভালোই ধারণা আয়ত্ত করেছে দেখছি।এর মানে কি? আপনি তো এই দেশের নাগরিক নন।
তেহভীন জোরেসোরে শ্বাস টেনে বলল,
— ওয়েল! ফার্স্ট ওফ অল আই ওয়েন্ট স্যে,এটা আমার মায়ের কান্ট্রি। এ দেশের সম্পর্কে আমি আংশিক বিষয় মায়ের কাছ থেকে জেনেছি। আর বাকি অংশ অনলাইনে নানা রকম এ দেশীয় প্ল্যাটফর্ম থেকে জেনেছি। কেন যেনো অদ্ভুত একটা টান অনুভব করি আমি এ দেশের জন্য।যেটা আমি নিজ দেশ, স্কটল্যান্ডে থেকে পায় না। আমার জন্ম,বেড়ে উঠা সব ওখানেই।তার পর কেন যেনো আমি উইক এ দেশের প্রতি।
তেহভীন কথাটা শেষ করলো।পরমুহূর্তে সিলিভিয়ার কাছ থেকে কোনপ্রকার জবাব আশা না করে বলল,
— নাউ,ইন্ট্রোডাকশন টাইম,মাইসেল্ফ
‘তেহভীন হায়াত’ সন ওফ মেথেউ এ্যাসফোর্ড। আমার নানাজান হায়াত উদ্দিনের নামানুসারে আমার পদবি রাখা হয়।আর রিলিজিয়নঃইসলাম। আমার পেশা কী সেটা চলে আসার সময় বলবো।
নাউ,ইউর টার্ন,টেল মি এভাউট ইউ।
সিলিভিয়া বিমূঢ় দৃষ্টিতে তেহভীনের কথা গুলো গিললো। যত শুনছে ততই শুনে যেতে ইচ্ছে করছে সিলিভিয়ার। কেমন ঘোরের ভেতরে চলে গিয়েছিলো এতক্ষণ সে। তেহভীনের পেশা সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ জাগলো সিলিভিয়ার মনে।
সিলিভিয়া আড়ষ্ট হয়ে জবাব দিলো,
— মাইসেল্ফ তানজিলা ফারাশ সিলিভিয়া।
গ্রেজুয়েশন শেষ করে, একটা টিউশনি নিয়েছি।চাকরির করার অপরচুনিটি এখনো হয়নি। তাই আপাততে বেকার বলা যায়।
তেহভীন কন্ঠস্বরে প্রকড় শব্দ তুলে হাসলো। রক্তিম আভাযুক্ত ঠোঁটজোড়ার মাঝে চকচকে শ্বেত দাঁতগুলো দৃশ্যমান। চোখের কালো মণি চিকচিক করছে।টানটান কপালে কৃষ্ণচুলের ছড়াছড়ি। সিলিভিয়া মুগ্ধ না হয়ে পারলো না তেহভীনের রূপ দেখে। কথার ফাঁকে সীমিত সময় কখন অতিক্রম হয়ে গেলো টেরই পেলো না সিলিভিয়া। তাদের আবাসিক এলাকায় অটো প্রবেশ করলো। কয়েকটা বিল্ডিং অতিক্রম করেই তাদের বাড়িটি। সিলিভিয়া দৃঢ়ভাবে নেমে গেলো অটো থেকে।অপাশ থেকে তেহভীন নেমে সিলিভিয়ার পাশেবেজে দাঁড়ালো। তখনি হন্তদন্ত হয়ে তেহভীনের ফোনটা উঠলো। তেহভীন স্ক্রিনে রাদিফের নাম্বার দেখে পিক করলো। বলল,
— বলো রাডিফ।
— ভাইয়া কোথায় তুমি? ফুফি মামা তোমাকে খুঁজছে।দারোয়ান আঙ্কেল বলছে তুমি সিলি আপুর সাথে গিয়েছো।এখন ফুফিকে কি বলবো?
তেহভীনের কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ ফুটে উঠে। বলল,
— বলো আমি ওয়াসরুমে।
রাদিফ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,
— আর ইউ ম্যাড ব্রো? তুমি ওয়াসরুমে থাকলে ফুফির ডাক শুনতে পেতে না? দেখো উনারা তোমার ব্যাপারে খুবই স্ট্রিক্ট তুমি জানো। তারপর ও কেন বাইরে গিয়েছো?
তেহভীন একটু বিরক্ত হলো মনে মনে।সেটা প্রকাশ না করে বলল,
— বলো আমি ছাদে। তুমি ছাদে যাও আমি আসছি।
তেহভীন পট করে ফোনের লাইনটা কেটে দিলো। সিলিভিয়া এতোক্ষণ তাদের কথোপকথন শুনছিলো। অটো চালককে তেহভীন আগেই হাতের ইশারায় থামিয়ে রেখেছিলো।ফোন কেটে তেহভীন মানিব্যাগ বের করে সিলিভিয়াকে বলল,
— আমার কাছে ডলার আছে।এটা তুমি রাখো।আর ট্যাক্সির বাড়াটা তুমি দিয়ে দাও। আমি এখনি চলে যাবো।
সিলিভিয়া আপত্তি জানিয়ে ডলারটা হাতে নিলো না। নিজের ব্যাগ থেকে টাকা বের করে যাওয়া আসার ভাড়া পরিশোধ করলো। তেহভীন মানলো না। ডলারটা সিলিভিয়ার হাতে গুঁজে দিয়ে অটোতে উঠলো, আর বলল,
— তুমি অসুস্থ। দুইদিন গ্যাপ দিয়ে তারপর এসো। তোমার সাথে কথা বলে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। তোমার এই বন্ধুটিকে মনে রেখো। যদি কোনদিন দেখা হয়? অবশ্যই সারপ্রাইজিং কিছু রাখবো তোমার জন্য।এজ এ ফ্রেন্ড। এট লাস্ট,গুডবায় প্রিটি লেডি।
সিলিভিয়া স্তম্ভিত হয়ে তেহভীনের কথাগুলো শ্রবণ করলো। বুকের ভেতর সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করতে লাগলো। কেমন তীক্ষ্ণ সূঁচালো সে ব্যাথা। তেহভীন হুট করে যেভাবে তার জীবনে এসেছিলো,ঠিক সেভাবেই হারিয়ে গেলো।
#১০.
জিনিয়া সবেমাত্র এলাকায় ঢুকেছিলো তার বোন জুলিয়ার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে। সিলিভিয়াকে অপরিচিত, বিদেশী একটা ছেলের সাথে দেখে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এসে আঁড়ালে দাঁড়ালো। দূর থেকে কথোপকথন কর্ণগোচর না হলেও তাদের কাছাকাছি দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকাটা সে অন্যকিছু আন্দাজ করলো। যখন তেহভীন সিলিভিয়ার ব্যাগে ডলার গুঁজে দিচ্ছিলো,সেসময় জিনিয়া বুদ্ধি করে নিজের ফোনটা বের করে কয়েকটা ছবি ক্লিক করে নিলো। অদ্ভুত পৈশাচিক হেসে সে ফোনটা নামালো। মৃদু শব্দে বলল,
— কালি,আচ্ছা নাগড় জুটিয়েছিস দেখছি।
দেখ আমি কি করি।
সিলিভিয়ার হঠাৎ আবারও তলপেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অনুচিত। তাই মৃদ্যু পায়ে হেঁটে সে বাড়িতে প্রবেশ করলো। সায়মন সোফায় বসেছিলো। সিলিভিয়াকে প্রবেশ করতে দেখে সে উঠে সিলিভিয়ার কাছে এগিয়ে গেলো। অনেকটা অস্থির হয়ে বলল,
— কি রে, তোকে এমন লাগছে কেন? শরীর খারাপ করছে?
— না ভাইয়া,ক্লান্ত লাগছে আজ একটু।
— জন্মদিনের অনুষ্ঠান কেমন খেলি?
সায়মনের কথায় সিলিভিয়ার মনে পড়লো সে শুধু একপিছ কেক আর নুডুলস খেয়েছিলো। রাতের আয়োজনে খাচ্চিটা মিস করলো। আরো দেরীতে আসলে নাহয় পেটভর্তি করা যেতো।সিলিভিয়া বলল,
— আয়োজন ভালো ছিলো ভাইয়া।
— আচ্ছা! তাহলে যা ফ্রেস হয়ে নে।
সিলিভিয়া মাথা নাড়িয়ে সায় জানিয়ে নিজের রুমের দিকে যেতে পদযুগল বাড়ালো। জুলিয়া তার রুমে বসে জুবানকে খাওয়াচ্ছিলো। সিলিভিয়ার চোখ সেখানে গিয়ে পড়ে।জুবান ফুফিকে দেখে হাসলো।সিলিভিয়াও প্রতিউত্তরে হাসলো।কিন্তু হঠাৎ সিলিভিয়ার হাসি উবে যায় জুলিয়ার তাচ্ছিল্য সূচক মুখ বাঁকানো দৃশ্য দেখে। মাথা গরম হয়ে যায় সিলিভিয়ার।ঝগড়া করতে এখন অনিহা বোধ করে সে।তাই চুপচাপ এড়িয়ে গেলো সে।
(চলবে)
এটা ছোট গল্প হিসেবে রাখলে কেমন হয় বলুন তো পাঠকরা।বেশি বড় পর্বগুলো আবার বিরক্তিকর হয় মনে হয়।