লাভ রেইন পর্ব-২৩

0
1941

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২৩

৫৮.
লোকালয়ের মাঝে তেহভীনের চোখ থুবড়ে গিয়ে পড়লো একটা অপরিচিত ছেলের উপর। অভিনব কায়দায় ছেলেটি দুইজন কাপলের মাঝখানে হাত গলিয়ে ফোন ধরে রেখেছে। ফোনটির অবস্থান দেখে তৎক্ষনাৎ তেহভীনের মস্তিষ্ক কিছু একটা তাকে সিগন্যাল পাঠালো। ঝট সিলিভিয়ার কাধ থেকে থুঁতনিটা আলাদা করলো। ক্ষিপ্রগতিতে অজ্ঞাত ব্যাক্তিটির উদ্দেশ্যে পদযুগল বাড়ালো। তেহভীনের সরে যাওয়ার গতি অস্বাভাবিক লাগাতে সিলিভিয়াও পেছন ফিরে তাকালো।ততক্ষণে অনেকটা আঁড়ালে গিয়ে তেহভীন একটা ছেলের শার্টের কলার ধরে হাতের ফোনটা কেড়ে নিয়ে নিলো।মুখের মাস্কটা সরিয়ে চেহারা উন্মুক্ত করলো। সিলিভিয়া এগিয়ে এসে ছেলেটাকে দেখে খানিকটা নয় বরং বেশিই অবাক হলো। ছেলেটাকে প্রায় বিভিন্ন সময় জেরিন্ডেলের সাথে দেখেছিলো সে। কিন্তু সে হঠাৎ এখানে?
তেহভীন ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখলো,দেখলো এতক্ষণ সিলিভিয়া আর তার মধ্যাকার সব দৃশ্য ভিডিও করা হয়েছে। প্রচণ্ড রেগে গেলো,কৌতূহলের বশে সে সম্পূর্ণ ফোন চ্যাক করে দেখলো তাতে সব সিলিভিয়ার একেক সময়, একেক জায়গায় অবস্থানকালের ছবি। এবার কপালে রগ সব ফুলে উঠলো তেহভীনের। জোরে একটা শ্বাস টেনে হাতের ফোনটা সজোরে নিচে ছুঁড়ে মারলো। তাতে কালো মলাটের ফোনটা ভেঙে ছুঁড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেলো। নিজেকে যতেষ্ট স্বাভাবিক রেখে অজ্ঞাত ছেলেটির দু’পায়ের মা’ঝ’খানে লাথি মেরে দিলো তেহভীন। ঠোঁট মেলে ভয়ানক একটা গালি বেরিয়ে আসতে চাইলে, সেটা সিলিভিয়ার জন্য আঁটকে ফেলে। সিলিভিয়া নিজেও তেহভীনের কাণ্ডে বিস্মিত হয়ে যায়। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে তেহভীন হাত বাড়িয়ে দিয়ে সিলিভিয়াকে আঁটকালো। সিলিভিয়া দেখলো অজ্ঞাত ছেলেটি পেটের নিচে হাত দিয়ে চেপে ধরে নিচের দিকে ঝুঁকে আছে। চোখমুখে তীব্র ব্যাথার আর্তনাদ। সিলিভিয়া কিছু না বুঝলেও,ভয়াবহ কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে।হয়তো ঘটমান বিষয়টা কি হতে পারে সেটা তার ধারণাতীত। সিলিভিয়া ছেলেটির দিকে চেয়ে বলল,

— তুমি এখানে? নিশ্চয় তোমার ফ্রেন্ডের কথাতে
আমার পিছুন পিছুন ঘুরছিলে? এখন দেখেছো তো তোমার অবস্থা?

ছেলেটি জবাব দিলো না।তেহভীন সিলিভিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লো,

— তুমি চেনো এই ছেলেকে?

— অবশ্যই চিনি।

— এনিথিং রং?

একজন ব্রিটিশ আমেরিকান ছেলের মুখে কথাটি শুনে তেহভীন পেছনে তাকালো,এরপর মাথা ডানে বামে নেড়ে ‘নো’ জানালো। ছেলেটি আর কথা বাড়ালো না। তৎক্ষনাৎ জায়গা প্রস্থান করলো। তেহভীন বলে উঠলো,

— চলো সিলভার।এখানে আর একমুহূর্তও নয়।

— কিন্তু…

তেহভীন সিলিভিয়ার একটা কথাও শুনলো হাত ধরে টেনে ল্যাবিরিন্থ হাউজের গ্রীন গ্রাউন্ড থেকে বেরিয়ে এলো। সিলিভিয়া আসার পথে পেছনে ফিরে ছেলেটিকে বলল,

— আমি সিউর,তোমার বন্ধু এখানে আশেপাশে আছে। তাকে বলে দিও সে যেনো আঁড়াল আঁড়ালে আমার সাথে গেইম না খেলে।তার যদি গেইম খেলতে ইচ্ছে করে তাহলে যেনো আমার মুখোমুখি হয়।

৫৯.

নিস্তব্ধ ঘরজুড়ে শীতল বাতাসের আনাগোনা। পোর্চ সাইডের ডোরটা হা করে মেলে রেখেছে সিলিভিয়া। গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে রেখেছে সে। মৃদুমন্দ শীত শরীর স্পর্শ তো করছেই তাকে। কফির মগে একটু পর পর ঠোঁট ছুঁইয়ে কফি পান করতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর পর তেহভীনের রুমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে সে। সন্ধ্যার দিকে ফিরে সে যে রুমের ভেতরে ঢুকেছে আর বের হয়নি তেহভীন। কতো রাগ তেহভীনের! যেটা আজ প্রথম দেখেছে সিলিভিয়া। যদিওবা রাগটার মূলকারণ এখনো জানতে পারেনি।তেহভীনের মুখের দিকে চেয়ে যতবার প্রশ্ন করেছে, ততবার তেহভীন সিলিভিয়ার গালটা ধরে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিয়েছে।একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি। এখনো অবধি সে নিস্তব্ধতা বিদ্যমান।হয়তো তেহভীন ঘুম।তাই সিলিভিয়া এক মগ কফি বানিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে সোফায় বসে নিজের কিছু ব্যাক্তিগত কাজ করতে লাগলো। মিনিট দশেক পর তেহভীন ঘুমঘুম চোখে উঠে এসে সিলিভিয়ার পাশ ঘেঁষে বসলো। আচমকা আতঙ্কিত হয়ে লাফিয়ে উঠলো সিলিভিয়া। হঠাৎ করে তেহভীনের উপস্থিতি সে আশা করে নি। কিছুটা দূরে সরে বসলে,তেহভীন দৃঢ়ভাবে সিলিভিয়ার কনিষ্ঠ আঙুল নিজের কনিষ্ঠ আঙুলের সাথে পেঁছিয়ে বলল,

— আমার পাশে বসলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না সিলভার। সো,বি ইজি।”

তেহভীনের কথায় চারপাশে মধুময় বাতাস অনুভব করে সিলিভিয়া। কি সুন্দর,শান্ত,এবং তীর্যক কন্ঠস্বর।কানের মধ্যে সূঁচের ন্যায় প্রবেশ করে, বার বার বাজতে থাকে। তেহভীন সিলিভিয়াকে ভাবনায় আচ্ছন্ন দেখে হালকা কেশে নিয়ে কফির মগটা হাতে তুলে বলল,

— এদিকে এসে বসো।আমি তোমাকে বিরক্ত করবো না।তোমার কাজ দেখবো শুধু। এসো।

সিলিভিয়া নিজের জড়তা কাটিয়ে দৃঢ়ভাবে তেহভীনের পাশে এসে বসলো। এতোক্ষণ যা-ও ভালো ছিলো,কিন্তু এখন হঠাৎ হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে সিলিভিয়ার। তেহভীন নিঃশব্দে হাসতে লাগলো সিলিভিয়ার আচরণ দেখে। তেহভীন যেই কফির মগে ঠোঁট বসাতে যাবে,তার আগেই সিলিভিয়া আঁতকে উঠা স্বরে বলে উঠে,

— এটা আমার খাওয়া তেহভীন।তুমি বসে,
আমি তোমার জন্য বানিয়ে আনছি।

— বানিয়ে আনতে হবে না সিলভার।
আমার জন্য এটাই বেস্ট। নেক্সট টাইম থেকে
আমরা যখনই একসাথে হবো,তখন এক মগ
থেকে কফি শেয়ার করে খাবো।

সিলিভিয়া কোন কথা বলার সাহস পেলো না। কন্ঠাস্বর কেমন যেনো বসে গিয়েছে তার। তাই চুপচাপ নিজের কাজটা করতে লাগলো। তেহভীন সিলিভিয়া দীঘল কালো চুল হাতে নিয়ে একবার দৈর্ঘ্য মেপে দেখছে। একবার নাকে কাছে এনে চুলের মিষ্টি ঘ্রাণ নিচ্ছে। কখনো ঠোঁটের নিকটে এনে সরিয়ে ফেলে,তো কখনো আঙুলের সাথে পেছানো শুরু করে। সিলিভিয়ার তেহভীনের এতসব শয়তানি খেয়াল করছে না,সে ব্যস্ত তার কাজে।অনেক্ষণ পর তেহভীন মনোযোগ স্ক্রিনে ছুঁড়লো,প্রসংশনীয় কন্ঠে বলে উঠলো,

—- ওয়াও! কোডিং করছো? ভেরী ইম্প্রেসিভ।

সিলিভিয়া চোখমুখ কুঁচকে বলল,

— এটা আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে।
আগে একটা আকর্ষণ কাজ করতো পোগ্রামগুলোর প্রতি। গত একমাস যাবত বিরক্তি লাগছে।

— ইউ নোউ,আমার প্রথমে বিরক্ত লাগতো।
কিন্তু পরে অভ্যস্ত হয়ে যায়।তোমার ও হয়ে যাবে।

— আর কোন ওয়ে নেই?

— অফকোর্স নেই। কম্পিউটার কোন ভাষা বুঝে না,যা বুঝে তা হচ্ছে কোড। যাকে বাইনারি ডিজিট বলা হয়,ডিজিট গুলো তো নিশ্চয় জানো।

— জিরো এন্ড ওয়ান!

— ইয়েস,এটাকে কম্পিউটারের ল্যাঙ্গুয়েজ ও বলা যায়। আর এসব সফটওয়্যার,গেমস,এপ্লিকেশন, ওয়েবসাইট যারা তৈরি করে দেয় তাদের কোডার বলে।

সিলিভিয়া কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— তুমি কোনটা করো?

—- গেমসের।

— ওহ, আচ্ছা তোমরা সব পাইলটরা দেখতে
এমন সুদর্শন? না-কি একমাত্র তুমিই এতো
বেশি সুন্দর?

তেহভীন সিলিভিয়ার কথা শুনে না হেসে পারলো না। হাসতে হাসতে বলল,

— বাকি পাইলটদের খবর তোমাকে দিচ্ছি না ডিয়ার। তুমি শুধু আমার খবর রাখো।

তেহভীনের কথায় সিলিভিয়াও হাসলো। বলল,

— রাগ কমেছে?

— আমি রেগেছিলাম কখন?

সিলিভিয়া আঁড়চোখে তেহভীনের মুখের
দিকে চেয়ে বলল,

— সন্ধ্যায়।

—সিলভার,একটা ছেলে তোমাকে সারাদিন ফলো করে করে ছবি তুলছিলো,আর তুমি সেটা টের পাও নি? কিভাবে সম্ভব? আমি তো আমার দিকে কেউ আঁড়চোখে তাঁকালেও সেটা ধরতে পারি।

সিলিভিয়া তেহভীনের সংশোধন করতে বলল,

— সারাদিন ফলো করছে সেটা আমি জানতাম তেহভীন।কিন্তু কারণটা কি বা সে কি করছিলো সেটা আমি জানতাম না। সে ছবি তুলছিলো? তাহলে,ব্যাপারটা তেমন সিরিয়াস না।

— কি বলছো তুমি সিলভার? তুমি জানো এখানকার সাইটগুলোতে ছবির এডিটিং কতো নিপুণ এবং দক্ষতার সাথে করতে পারে। যদি কোন খারাপ উদ্দেশ্য না থাকতো তাহলে ছবি তুলেছে কেন?

সিলিভিয়া এবার ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। বিষয়টাকে সে এভাবে ভেবে দেখেনি।ভাগ্যিস তেহভীন দেখতে পেয়েছে।নাহলে? ছিঃ! সিলিভিয়ার মুখের ভয়ের আচ দেখতে পেয়ে তেহভীন বলল,

— ভয় পেয়ো না।আমি আছি তোমার সাথে।

সিলিভিয়া মৌন থেকে শুনলো তেহভীনের কথাটা। এখন আছে! কিন্তু কিছুদিন পর তো আবারও নিজের গন্তব্যে ফিরে যাবো তেহভীন। তাহলে এখন পাশে আছি বলার দরকার কি?

৬০.

শাশুড়িকে ইদানীং বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে থাকতে খেয়াল করছে জুলিয়া। কেমন যেনো হঠাৎ করে কথাবার্তা শুরু করলে থামে না,আবার থামলে আর মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করা যাচ্ছেনা। রুজিনা আপনমনে নিজের কাজে ব্যস্ত।মনোযোগ সরাতে জুলিয়ে আচমকা কেশে উঠলো। সাথে সাথে রুজিনাও ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। পেছন ফিরে দেখলো জুলিয়া দাঁড়িয়ে আছে। তারপর ও রুজিনা কোন শব্দ খরচ করলেন না,নিজের কাজে ধ্যান দিলেন। জুলিয়া দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গিয়ে শাশুড়ির পাশে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে বললেন,

— মা আপনাকে চিন্তিত লাগছে কেন?

— কোথা চিন্তিত লাগছে? তুই চোখে বেশি দেখছিস। কিছু বলবি? না বললে চলে যা।

— হ্যাঁ,বলতেই তো এসেছি। মা আমার সমস্যাটা আল্লাহর রহমতে ভালো হয়েছে।

— যাক,আলহামদুলিল্লাহ শুনে স্বস্তি পেলাম। তবে এক্সারসাইজে যেনো অনিয়ম না হয়।দেখবি একদম সুস্থ হয়ে গিয়েছিস।

— আচ্ছা, মা আপনি কি নিয়ে চিন্তিত আমাকে
বলুন তো।এভাবে আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে না।

রুজিনা ভাবতে লাগলো,কথাটা সায়মনকেও বলা হয়নি।সে এখন শহরের বাইরে।ফিরবে সপ্তাহ খানেক পর।এদিকে এই সমস্যা। রুজিনা বলতেন লাগলেন,

— তোমার শশুড় তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে সিলিভিয়ার বিয়ে দিতে চাইছে। আমাকে বেশ প্রসার দিচ্ছে আমি যেনো সিলিভিয়াকে ফোন করে দেশে আসতে বলি। এরপর বিয়েটা হয়ে গেলে সিলিভিয়া সেই ছেলেকে সহ বিদেশ নিয়ে যাক। দেখেছো তার কাণ্ডজ্ঞান কেমন?

— এটা কি ঠিক হবে মা? সিলিভিয়া যদি এসব জানতে পারে? তাহলে অনেক কষ্ট পাবে।

— কষ্ট পাবে তা আর বলতে? রামিশের মতো একটা ছেলেকে সিলি প্রত্যাখান করেছে।তাহলে এই জুয়াড়ি কে সে মেনে নিবে? আমার তো চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে।তোমার শশুড় আঁটগাঁট বেঁধে নেমে পড়েছে ভাতিজার সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে।

— মা আপনি সিলিভিয়াকে ফোন করে দেখুন।সব জানান।সিলিভিয়া কি বলে সেটাও দেখুন। সিলিভিয়া যতেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে। কোন পরিস্থিতে কি করলে ভালো হয় সেটার ধারণা ওর কাছে বেশ পাওয়া যায়।

রুজিনা জুলিয়ার কথায় কেমন স্বস্তি পেলেন।এতদিন আকবরের জোড়াজুড়ি তে অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলো সে।এখন জুলিয়ার সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতেই কেমন হালকা লাগছে উনার। এবার সিলিভিয়ার সাথে কথা বলা বাকি।

(চলবে)

যারা মন দিয়ে পড়েন তারা রেসপন্স করুন একটু।
রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি। ভুল হলে সেটা পরে এডিট করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here