লাভ রেইন পর্ব-২৪

0
1926

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ২৪

৬১.
মন খারাপের দিনগুলো খুবই দীর্ঘ হয়। মনের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে রীতিমতো। একা থেকে থেকে প্রচণ্ড বিরক্তি এসে গিয়েছে নিজের প্রতি। দুইটি সুখকর দিন অতি দ্রুত চোখে পলকেই কেটে গিয়েছে। ভেতর থেকে অদৃশ্য আর্তনাদ চেঁচিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।অতি কষ্টের সাথে নিজেকে আঁকটানোর চেষ্টায় মত্ত সিলিভিয়া। দরজায় ছোট ছোট টুকা পড়লো হঠাৎ। সিলিভিয়া চুপ থেকে ফোনে দৃষ্টি তাক করে রাখলো।
সিলিভিয়ার সাড়া না পেয়ে তেহভীন দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। তেহভীনের উপস্থিতি ঠের পেয়ে সিলিভিয়া দরজার দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। তেহভীন এগিয়ে আসছল। কালো শার্ট-প্যান্টের সাথে কালো ব্যাগ,কালো ডায়ালের ঘড়ি।সর্বশরীরের মধ্যে শুধুমাত্র ক্লিন সেভ করা শ্বেতবর্ণ চোয়াল দৃশ্যমান। নারীদের আ’কৃষ্ট করার মূল হাতিয়ার অভিজাত পুরুষ্ট চোয়াল।ভাগ্যবান তেহভীন অভিজাতপূর্ণ এবং ব্যাক্তিসম্পন্ন একজন পুরুষ। সিলিভিয়া মৃদু্ হেসে বসা থেকে উঠলো। তেহভীন এগিয়ে এসে ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে বলল,

— সিলভার আমাকে বেরুতে হবে।

তেহভীনের কথায় সিলিভিয়ার মুখটা চুপসে যায় একদম। যেনো চেহারায় কেউ কালি মেখে দিয়েছে। তেহভীনের ও খারাপ লাগছে। বুকের ভেতরের অস্বাভাবিক ঝড়টা নিজেকেই সামলাতে হচ্ছে। সেখানে সিলিভিয়াকে সামলানোর দায়টাও তার।তেহভীন আলতোভাবে সিলিভিয়ার মাথায় হাত রেখে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,

— মন খারাপ করো না।এবার আমরা বেশি সময় কাটাতে পারিনি। পরবর্তী সময় যখন আসবো,তখন লম্বা একটা ছুটি নিয়ে আসবো। ডোন্ট ওয়ারি।

সিলিভিয়া জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে ভেতর থেকে উপচে আসা কান্নাটা থামাতে লাগলো। চোখের পানি আঁটকে রাখতে রাখতে নাক টানতে লাগলো। নিজের আচরণে প্রচণ্ড রাগ লাগছে। ষোল বছরের কিশোরীর ন্যায় আচরণ হয়ে যাচ্ছে এটা।তেহভীন মাথা নিচু করে হালকা বাঁকা করে তাকালো সিলিভিয়ার দিকে। তেহভীন হালকা গলায় বলল,

— ইয়্যু আর এ কিউট ক্যাট।

তেহভীন কথাটা বলে নিজেই হাসলো। কিন্তু সিলিভিয়ার মুখের আমাবস্যার আস্তরণ সরে গেলো না। এই পর্যায়ে তেহভীন মুখ গোমড়া করে ফেললো।সিলিভিয়ার মৌনতা তেহভীনকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছে এ মুহূর্তে। হঠাৎ তেহভীন বলে উঠলো,

— আই থিংক,ইয়্যু নিড এ কিস ফ্রম মি।

জাদুকরি সুন্দর কন্ঠে,ইংরেজি বাক্যটা কানের মধ্যে আচমকা ঝড় তুলল যেনো সিলিভিয়ার।চট করে দৃষ্টি তুলে তেহভীনের দিকে চাইলো সে।সাথে সাথে দৃষ্টি নামিয়ে পূনরায় নাক টানতে লাগলো। মুখশ্রীতে মুহূর্ত লালচে আভা ফুটে উঠে। তারপর নিজের যতেষ্ট সংযত করে সিলিভিয়া বলল,

— তেমন কিছু নয় তেহভীন।তোমাকে
মিস করবো খুব।

নিজের কন্ঠস্বর শুনে নিজেই হতবাক হয়ে গেলো সিলিভিয়া।কান্না আটকানোর চেষ্টা করার কারণে কন্ঠস্বর একদম ব্যাঙের কন্ঠস্বরের মতো শুনালো।এই প্রথম নিজের এমন একটা কন্ঠস্বর আবিষ্কার করলো সিলিভিয়া।তেহভীনের কথায় যতোটা না লজ্জা পেয়েছিলো,তারচেয়ে তিনগুণ নিজের কন্ঠ শুনে লজ্জা পেলো সিলিভিয়া।তার জড়তা আর লজ্জাবোধ বাড়াতে তেহভীন নিজেকে আঁটকাতে না পেরে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। সিলিভিয়া আর চুপ থাকতে পারলো না কান্না গিলে,সেও হেসে উঠলো।
তারপর তেহভীন অনেক আদেশ মূলক বাণী সিলিভিয়াকে বলতে বলতে তার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এরপরের মুহূর্তটা ছিলো অত্যন্ত দুষ্কর।
হৃদপিণ্ডের ছটফটানি, এবং চোখের যন্ত্রণা।
সবকিছুতে একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে যায় সে।

৬২.

মন খারাপের দমকাটা দূর করার জন্য ‘পিউপল’স পার্কের ঘুরাঘুরি করতে যায় সিলিভিয়া। সাথে খাওয়া দাওয়া এবং শপিংটাকেও রাখলো।পরিকল্পনা মাফিক সব কিছু কখনোই হয়ে যায়।পার্কে আসার আগে উদ্দেশ্যে ছিলো কেবল ঘুরাঘুরি করা।কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ স্থানে এসে সাইক্লিং এর ঝোঁকটা আপনা-আপনি উদয়ন হলো সিলিভিয়ার।দলেবলে শিক্ষার্থী, পরিবার-পরিজন, বন্ধুমহল, পরন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ গায়ে মাখিয়ে নিতে নিতে আড্ডায় মশগুল হয়ে আছে।ওহ,আজকে ফ্রাইডে,তাই কনসার্ট এবং প্লেয়িং ও চলছে এখানে।জমজমাট আয়োজন। সিলিভিয়া একাকী ঘুরাফেরা করার উদ্দেশ্যে এসেও অতোটা খারাপ লাগছে৷ কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো একটা মেয়েকে সাইকেল চালাতে দেখে। নাছোরবান্দা মনের ইচ্ছের অনুনয় রাখতে সিলিভিয়া মেয়েটির কাছ থেকে সাইলেক ধার নিলো। অমায়িক আচরনে সিলিভিয়াকে মুগ্ধ করে দিয়ে মেয়েটি নিমিষেই সাইকেল চালাতে দিয়ে দিলো মেয়েটিকে। মনের খায়েশ মিটিয়ে সিলিভিয়া সাইকেল চালিয়ে এদিক-ওদিক ছুটলো। অতঃপর মেয়েটির দিকে এগিয়ে এসে সাইকেল দিতে দিতে বলল,

— তোমার পরিচয় দাও।

মেয়েটি হেসে বলল,
— আমি জাইমা।তুমি?

— সিলিভিয়া। তুমি আমেরিকান?

— না, আমি পাকিস্তানি।এখানে পড়াশোনার
সূত্রে এসেছি। তুমি?

সিলিভিয়া স্মিত হেসে জবাবা দিলো,
— আমিও,

— তোমার কান্ট্রির নেইম বললে না তো।

— ওহ হ্যাঁ,আমি বাংলাদেশী।

জাইমা অদ্ভুত ভাবে উচ্ছ্বসিত হয়ে গেলো সিলিভিয়ার কথায়।আমোদ স্বরে বলল,

— ওয়াও! তুমি বেংলাদেশী,শুনে খুব আনন্দ লাগছে।আমার ইচ্ছে ছিলো কোন একদিন কোন বেঙালির সাথে কথা বলবো। আমরা কি বন্ধু হতে পারি?

— অবশ্যই।

একাকী সিলিভিয়া এবার একজন সঙ্গী পেলো।কিন্তু মনের মধ্যে শঙ্কাটা এখনো বিদ্যমান।তারপর চোখ-কান খোলা রাখার চুক্তিবদ্ধ হলো মনের সাথে।

পার্ক থেকে বের হওয়ার পথে অনেকদিন পর ড্যাবিয়ানকে দেখতে পেলো সিলিভিয়া। খানিকটা আতঙ্কিত হয় ড্যাবিয়ানকে দেখে সিলিভিয়া। ড্যাবিয়ানও হঠাৎ সিলিভিয়াকে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসতে লাগলো।কতোদিন ধরে সিলিভিয়াকে খুঁজছিলো সে।আমারা আর ক্যাডি নানাভাবে জিজ্ঞেস করেছিলো সিলিভিয়া কেন ডর্ম ছেড়েছে।কিন্তু আশানুরূপ কোন উত্তর তারা দেয়নি।পরে আর তাদের বিরক্ত ও করেনি সিলিভিয়া।
ড্যাবিয়ান এগিয়ে এসে জোরেশোরে
নিশ্বাস ফেলে বলল,

— সিলিইইভিয়া! কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে তুমি?
ডর্ম ছেড়েছিলে কেন? আমারা আর ক্যাডিকে কতো।জিজ্ঞেস করেছি তোমার কথা।

সিলিভিয়া পাশে দাঁড়ানো জাইমার দিকে চেয়ে, পূনরায় ড্যাবিয়ানের দিকে তাঁকালো।আর বলল,

— এমনিই ছেড়েছি ড্যাবিয়ান।গুরুতর কিছু নয়।
তুমি এখানে?

— আমি কনসার্ট দেখতে এসেছি।

— আচ্ছা তাহলে এনজয় করো।

সিলিভিয়া আর জাইমা চলে আসতে চাইলো।ড্যাবিয়ান বাঁধা প্রদান করে বলল,

— সিলিইইভিয়া! আজ আমার কাছে তোমাকে খাওয়ানোর জন্য যতেষ্ট ডলার আছে।প্লিজ চলে,কোথাও গিয়ে বসি?না করো না প্লিজ।

ড্যাবিয়ানের অনুরোধ সুরে বলা কথা ফেলতে পারলো না সিলিভিয়া।তাই বলল,
— ঠিক আছে, তবে আমার সাথে আমার বন্ধু জাইমা তাকেও নিয়ে যেতে চাই আমি

ড্যাবিয়ান বলল,
— ইট’স ওকে। চলে।

জাইমা নিঃসঙ্গ হওয়ার কারণে সিলিভিয়ার সাথে যাওয়ার সুযোগটা হাত ছাড়া করলো না। যাওয়ার আগে ধার নেওয়া সাইকেলটি একটা ছেলেকে ফিরিয়ে দিয়ে সেও হাঁটা ধরলো সিলিভিয়া আর ড্যাবিয়ানের সাথে।

পিউপল’স, পার্কের কাছে ‘বংগো বার্গার’ নামক হামবার্গার রেসট্রনে প্রবেশ করলো। এখানকার বার্গারের স্বাদটা খুবই ভালো লাগার মতো। তেহভীন ডিনারের জন্য এখান থেকেই বার্গার নিয়ে গিয়েছিলো গতকাল।খাওয়ার স্বাদটা এখনো মুখে লেগে আছে।সেজন্য আজকে এখানটায় এলো। খাওয়ার ফাঁকে জাইমার সাথে ড্যাবিয়ানে স্বল্প আলাপ,পরিচয় সব হলো। সর্বশেষ ট্রপিক ড্যাবিয়ান অনেক জোরাজুরি করলো সিলিভিয়াকে ডর্ম ছাড়ার কারণটা বলার জন্য। অতঃপর সিলিভিয়া উপায় না পেয়ে জেরিন্ডেলের করা আচরণের সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা ড্যাবিয়ানকে দিয়ে দেয়।

৬৩.

দিন পনেরো পার হয়ে যাওয়ার পরও তেহভীনের খোঁজখবর নেই।কেমন স্তব্দতা বিরাজমান তার আচরণে।যেনো পৃথিবীর দুর্গম প্রান্তে থাকছে সে,যেখানে নেটওয়ার্কের সাথে কারো কোন সম্পর্ক নেই।যার জন্য, একটা ফোন দিয়ে খবরটুকু পর্যন্ত নেওয়া যাচ্ছেনা।অভিমানের অস্রু চোখ জোড়াতে ভরপুর। অতি আক্ষেপের অথৈ সাগরে গা ডুবিয়ে রেখে সিলিভিয়া সিদ্ধান্ত নিলো আর তেহভীনের সাথে সে যোগাযোগ রাখবেনা।

গোটা একটা রাত প্লেন জার্নি কতোটা কষ্টকর সেটা একমাত্র যে এই পরিস্থিতিতে পড়েছে সেই জানে। দিনের বেলায় শুধুমাত্র দু’ঘন্টা ঘুম।চব্বিশঘণ্টায় শুধুমাত্র দু’ঘন্টা ঘুমা অনেকটা অবিশ্বাস্যকর ব্যাপার।এত কঠিন পানিশমেন্ট জীবনেও পায়নি তেহভীন। জীবনের প্রথম কঠিন পানিশমেন্ট তার ড্যাডের কাছ থেকে পাওয়া। কান্ট্রি ক্রস করার ব্যাপারটা কে যেনো তার ড্যাডের কানে তুলে দিয়েছিলো।যারফলে ক্যালিফের্নিয়া থেকে ফেরার পরদিনই মি.মেথেউ ওয়েটিং রুমে এসে ভীষণ বকাঝকা করলেন তেহভীনকে। বকাঝকা ব্যাপারটা তেমন গায়ে না মাখালেও দিনে মাত্র দু’ঘন্টা ঘুমানোর পানিশমেন্টটা আকস্মিক ভাবে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তেহভীন। বকাঝকা সহ্য করার মতো হলেও দৈনিক প্রয়োজনীয় ঘুমের সময়টা কেড়ে নেওয়াতে ভীষণ মন খারাপ হয় তার। তবে জার্নির মাঝের সময়ে যখনি খারাপ লাগে তখনি কো-পাইলটের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করেই কিছু সময়ের জন্য চোখ বুঁজে রাখে তেহভীন।তন্মধ্যে, সিলিভিয়ার নামক মানবীর কথা অসংখ্যবার মনে পড়ে।কি অদ্ভুত এক শক্তি, মানবীর কথা যতবার মনে পড়ে ততবার হৃদপিণ্ড চলকে কেঁপে উঠে তেহভীনের। আপনমনে বলতে লাগে, -” জানিনা কেমন আছো তুমি।তবে ভালো থাকো সর্বদা,এটাই কামনা।’

(চলবে)
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করুন প্লিজ।

সিলিভিয়ার কন্ঠস্বর শুনে কেউ মজা নিবেন না।কাহিনীটা আমার সাথে ঘটমান।😑😑

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here