লাভ রেইন পর্ব-৪১

0
1847

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৪১

১০১.

সন্ধ্যার নামার আগমুহূর্ত। সূর্য ডুবন্ত অবস্থায় নিজের তীক্ষ্ণ রশ্মি আঁড়ালে নামিয়ে দিয়ে মৃদু আলো দিয়ে পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে। সময় এবং মুহূর্তটা অদ্ভুত ভাবে সুন্দর দেখাচ্ছে। ছাদের উপর দাঁড়িয়ে তীর্যক চাহনি মেলে নিচের রমরমা আয়োজন দেখতে লাগলো সিলিভিয়া। আশেপাশের মেহমানের ফুসুরফাসুর কথবার্তার মাধ্যমে জানতে পারলো আজ এখানে তার আর মুমিনের বিয়ে আয়োজন হচ্ছে। তখন ভীষণ রাগ হলো সিলিভিয়ার তার বাবার উপর, ঘটা করে তাদের এখানে আমন্ত্রণ জানানোর রহস্য তাহলে এইসব। সিলিভিয়া নির্বাক চেয়ে থাকলো। তার কোনরূপ অনুভূতি হচ্ছেনা এখন। যখন শুনেছিলো তখন রাগ হয়েছিলো শুধু।কিন্তু এখন না কষ্ট হচ্ছে,না ভয় পাচ্ছে,আর না চিন্তায় আছে। কেমন চিন্তাহীন একটা সময়ে অবস্থান করছে সিলিভিয়া। এমন পরিস্থিতি অন্য কারো বেলায় হলে, সে উত্তেজিত হয়ে পড়তো। কিন্তু সিলিভিয়ার মন-মেজাজ অত্যন্ত শীতল।

ছাদের দরজার কাছে এসে সিলিভিয়াকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো জুলিয়া।অতঃপর দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে সিলিভিয়ার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

— এসব কি হচ্ছে শুনেছো সিলি?
ওই মুমিন,যে রোজ নেশা করে,জুয়া খেলে এমন
একটা ছেলের সাথে তোমার বিয়ে কিভাবে ঠিক করলো বাবা?

সিলিভিয়া জুলিয়ার দিকে ফিরে ঈষৎ হাসলো।এরপর বলল,

— বাবার কোন দোষ নেই ভাবি।
বড়’বাবার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়, নিজের স্বার্থ হাসিলে বাবাকে যেমন ইচ্ছে তেমন কাটাচ্ছে।

— এখানের স্বার্থ কি আছে সেটাই তো বুঝলাম না।

সিলিভিয়া হেসে সম্পূর্ণ শরীর ঘুরিয়ে জুলিয়ার দিকে ফিরে দাঁড়ালো।এরপর বলল,

— তুমি জানো আমাদের পাহাড়ের বিশাল একটা অংশ রয়েছে যেটা দাদার দেওয়া।সেটা বাবার ভাগের,আমার ভাগেরটা তো বিক্রি করে ফেলেছি। ভাইয়ারটা তো ভাইয়া চোখও দেয়না।যেভাবে দিয়েছে সেভাবে পড়ে আছে। বড়’বাবার ভাগের জমি তারা আগেই বিক্রি করে করে ফেলেছে,অবশেষে ওই পাহাড়ের অংশটার উপর লোভ ঢোকেছে এখন। তাই এতো আয়োজন।

জুলিয়া অত্যন্ত চিন্তিত বদনে বলল,

— এখন কি করবে?

— এক ঢিলে দুই পাখি মারবো।

জুলিয়া সিলিভিয়ার প্যাঁচঘুঁচময় কথার অর্থ বুঝলো না।শুধু চেয়ে রইলো। সিলিভিয়া সেটা দেখে বলল,

— ভাইয়া আসে’নি তাই না?

—- না,সায়মন তো এখানে আসতে চায়না।এবারে হুট করে আসলো ঠিক,তাও এ বাড়িতে আসে’নি। হয়তো তোমার, ‘ওর’ সাথে আছে। তেঁতুলিয়া বাজারে মনে হয়।

‘ওর’ কথাটা শুনে সিলিভিয়া হেসে উঠলো। বলল,

— তুমি ভাইয়াকে ফোন করে জানিয়ে দাও; আমার আর মুমিনের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে এখানে।
আর আমিও বাবার বিপক্ষে গিয়ে কিছু বলবো না,তাই বিয়েতে রাজি হয়েছি।

— তারমানে তুমি রাজি?

জুলিয়া অবাক হয়ে বলল।সিলিভিয়া বলল,

— যেটা বলেছি সেটা একটু করে দাও।

জুলিয়া দাঁড়ালো না।হন্তদন্ত হয়ে নিচের দিকে ছুটলো। সিলিভিয়া চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেললো। যাক,এমনিতেও পরিবারের জন্য তার আর তেহভীনের সম্পর্ক নিয়ে মনের মধ্যে একটা ভীতি ছিলো এতোটা মাস।এবার হয়তো ভীতিটা কমবে। মাঝখানে তেহভীনের দুর্ভেদ্য দৃষ্টি দিয়ে,ব্যাপারটা যেনো কোনরকম বুঝতে না পারে সেভাবেই সবকিছু করতে হবে ভাবলো সিলিভিয়া।

জুলিয়া যখন সায়মনকে ফোন দিলো, সায়মন তখন তেহভীনকে নিয়ে আনন্দধারা রিসোর্টের সামনে ঘুরাঘুরি করছিলো। গ্রীন ফরেস্টের মাঝে রিসোর্টের সুনিপুণ পথ,পরিবেশ দেখে পুলকিত হয় তেহভীনের মন। সায়মন হেঁটে হেঁটে নানা রকম জিনিসের নাম বাংলায় উচ্চারণ করে বলে দিচ্ছে। তেহভীন এমন অনেক কিছুর সাথে পরিচয় হলো এখানে এসে। সায়মন যখন কথাবার্তায় ব্যস্ত,ঠিক সেসময় ফোনটা বেজে উঠলো৷ জুলিয়ার নাম্বার দেখে সায়মন তৎক্ষনাৎ রিসিভ করলো। সায়মন কিছু বলার পূর্বে অত্যন্ত উত্তেজিত কন্ঠে জুলিয়া বলে উঠলো,

—- জুহানের আব্বু, সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে এখানে।
বাবা আর বড়’বাবা,বড়’মা সবাই মিলে মুমিনের সাথে সিলিভিয়ার বিয়ের আয়োজন করছে।লাইটিং,পেন্ডেল,মেহমানে ভরপুর হয়ে আছে এখানে। রাতের দিকে বিয়ের পড়ানো হবে শুনলাম,এখন সিলিভিয়াকে সাজাতে নিয়ে যাচ্ছে তারা।

জুলিয়া একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো,জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে সায়মনের উত্তরের অপেক্ষা করতে লাগলো। সায়মন তখনো বাকরূদ্ধ হয়ে তেহভীনের দিকে তাকিয়ে রইলো। সে’মুহূর্তে তেহভীন তাঁকালো সায়মনের দিকে। তেহভীনের দৃষ্টি দেখে সায়মনের ঘোর কাটলো, বলল,

— আরে সিলি কি করছে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে।
ওর তো চুপ মেরে থাকার কথা না। আর আমাকে আগে জানাওনি কেন?

—- আরে আগে জানাবো কি করে তারা তো আমাদের থেকে লুকাচ্ছে সবকিছু। একটু আগে বড়’মাকে বলতে শুনলাম মা’কে।মা প্রচণ্ড ক্ষেপেছেন।এদিকে বাবা কোন উত্তর দিচ্ছেন না।মা’ চিল্লাচিল্লি করছে,কিন্তু তিনি চুপচাপ। এদিকে সিলিও বাবার অমতে গিয়ে কিছু করতে চাইছে না।

— আরে মগেরমুল্লুক নাকি। আমার বোনের সাথে যা ইচ্ছে তা করতে পারে না তারা। আর আমার বাবাকে আর কি বলবো,ভাইয়ের কথার খেলাপ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়।তুমি এক কাজ করো সিলিকে বলো কোন একটা ঘরে গিয়ে দরজা আঁটকে বসে থাকতে। আমরা আসছি৷

ফোনট কাটতেই তেহভীন এগিয়ে এসে বলল,

— কোন সমস্যা ব্রাদার?

— অনেক বড় সমস্যা ব্রো।

সায়মন তেহভীনকে কিভাবে বুঝিয়ে বলবে বুঝতে পারছিলো না। তারপরও সে চেষ্টা চালিয়ে বলল,

—- আমার কাজিনের সাথে সিলিভিয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে হঠাৎ করে।এবং বিয়েটা রাতের দিকেই হবে বলে জানালো। অথচ,এ বিষয়ে আমরা কেউ আগে থেকে জানতাম না।

তেহভীনের একটু সময় লাগলো সায়মনের কথাটা বুঝতে। যখন বুঝলো তখন হালকা একটা ধাক্কা খেলো সে। সিলভারের বিয়ে,তাও অন্য কারো সাথে এই কথাটা কখনো তার মাথায় আসেনি। আজকে কথাটা শুনে বুকের ভেতর সূক্ষ্ম একটা খোঁচা অনুভব করলো। তেহভীন তৎক্ষনাৎ উদ্ধিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আর সিলভার? সিলভার কি বলেছে?

‘সিলভার’ নামটা সায়মন আগে না বুঝলেও এ মুহূর্তে বুঝতে পারলো।সিলিভিয়াকে এই মানুষটা সিলভার বলে ডাকে।সায়মনের হাসি চলে আসলো এই কঠিন মুহূর্তে। হাসি চেপে রেখে বলল,

— সেও রাজি।

তেহভীনের কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ পড়লো হঠাৎ। পকেট হাতরিয়ে ফোনটা বের করলো। ডায়াল লিস্টে গিয়ে সিলিভিয়ার ফোন কল দিলো। দুইবার রিং হওয়ার পর ফোনটা রিসিভ করলো সিলিভিয়া। তেহভীন সায়মনের সামনে থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। সিলিভিয়া তখন রুমে বসেছিলো,ফোন রিসিভ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদুস্বরে ডাকলো,

— তেহভীন!

তেহভীন মূল প্রসঙ্গ তুলে বলল,

— হোয়াট ইজ দ্যিজ সিলভার। ইউ গেটিং ম্যারেড আনাদার ম্যান।

সিলিভিয়া জবাব দিলো না।তেহভীন ঈষৎ হাসলো।
ভ্রূ দ্বয়ের মাঝে অবস্থিত ভাঁজ টানটান করে বলল,

—- তোমার ক্লেভারনেস দেখে আমি অবাক হয়েছি
সিলভার। তোমার চাওয়াটা আমাকে সরাসরি বললে কি হতো?

সিলিভিয়া মুখ কাচুমাচু করে জানালার বাইরে চেয়ে থাকলো।মুখের অবস্থা করুণ।এতো ধূর্ত একটা মানুষের সাথে চালাকি করাটা নেহাৎ বোকামি হলো তার।সিলিভিয়া ইনিয়েবিনিয়ে বলল,

— আমি চালাকি করছিনা তেহভীন।
আমি সত্যিই আমার বাবার সিদ্ধান্তকে অমান্য করতে পারবো না।

— সিরিয়াসলি? তুমি অমান্য করতে পারবে না,
আর আমি এতোদিন ধরে কি করছিলাম সিলভার?

সিলিভিয়া জবাবে কিছু বলতে পারলো না।মৌন থাকলো। তেহভীন ঘাড় ঘুরিয়ে একবার সায়মনের দিকে চেয়ে দৃষ্টি ফেরালো।এরপর আলতো স্বরে বলল,

— উইল ইউ ম্যারি মি সিলভার?

সিলিভিয়াও তেহভীনের মতো আলতো করে বলল,

— আ’ম অলওয়েজ এগ্রি টু ম্যারি ইউ।

তেহভীন হাসলো।এরপর বলল,

— এজন্য তোমার কাজিনের সাথে বিয়ে করছো খবরটা তোমার ভাইয়াকে পাঠিয়েছো তাই না?যাতে আমি শুনতে পাই।যেনো আমি রাগ করে তোমাকে বিয়ে করতে ফোর্স করি।

কথাগুলো বলেই উচ্চস্বরে হাসলো তেহভীন।এরপর বলল,

— তুমি রেডী হয়ে অপেক্ষা করো।আমি আর তোমার ব্রাদার আসছি।

তেহভীন ফোন কেটে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সিলিভিয়া যে তাকে হারানোর ভয়ে বিয়েটা করতে চাইছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তেহভীন নিজেও ইনসিকিউর ফীল করছিলো। মনে মনে এমন ভয়ের ইঙ্গিতের কারণেই আজ সে এখানে।এমন কিছু ঘটবে হয়তো সে আন্দজ করতে পেরেছিলো। সিলিভিয়ার সাথে বিয়ের কথাটা হওয়ার পর থেকে শরীর বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। তেহভীন নিঃশব্দে হাসলো,ফোনটা হাতে নিয়ে গ্রুপকল করলো তার মা এবং বোনের সাথে বিয়ের ব্যাপারে কথা বললো। তায়্যিবা ছেলের হঠাৎ বিয়েতে উপস্থিত থাকতে না পারার কারণে ভীষণ মন খারাপ করলেন ভেতরে ভেতরে,কিন্তু উপরে আমোদিত কন্ঠে বিয়ের অনুমতি দিয়ে দিলেন। সাথে এটাও জানালেন,সিলিভিয়াকে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়াতে ফিরে আসার পর বড়ো করে একটা রিসেপশন পার্টি দিবেন। তার আগে অবশ্যই যেনো রুবাইয়াতের কাছে চলে যান তারা।

১০২.

সিলিভিয়া প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত হয়ে অনেক জোরে চিৎকার দিলো একটা। জুলিয়া আর রুজিনা তখন সিলিভিয়ার রুমের দিকে এগিয়ে আসছিলো,সিলিভিয়ার চিৎকারে রুজিনা হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এলেন,সাথে জুলিয়া। সিলিভিয়ার হাসিমাখা চেহারা দেখে রুজিনা বিরক্ত হলেন। অদ্ভুত এতক্ষণ ধরে বড় ভাবি এবং বড় ভাইয়ের সাথে তর্ক করছিলেন শুধু বিয়েটা আঁটকাতে।আর মেয়ে এদিকে বিয়ের খুশীতে চেঁচাচ্ছে। জুলিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে সিলি? এভাবে চিৎকার দিলে কেন?

— ভাবি, ফাইনালি আমার বিয়েটা হতে যাচ্ছে,তাও আবার তেহভীনের সাথে। আমার এতোদিনের অপেক্ষা শেষ হবে ভা…

সিলিভিয়া দৌড়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর বলল,

— মা, তোমাদের বলা হয়নি,আমি একজন ভালোবাসি। তাকেই বিয়ে করতে চাই।তুমি বাবাকে বলে রাজি করাও না মা।

রুজিনা হতভম্ব হয়ে রইলো সিলিভিয়ার আচরণে।মেয়ের এমন আচরণ আজই প্রথম দেখলেন তিনি।কিন্তু কাকে ভালোবাসে সেটাই বুঝতে পারলো না।তিনি এমন মা নন যে মেয়ের পছন্দকে প্রত্যাখান করবেন,বরঞ্চ সিলিভিয়ার পছন্দ আছে শুনে চিন্তা মুক্ত হলেন। রুজিনা সিলিভিয়া মাথার উপর থেকে হাত নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

— ছেলের নাম কি বলেছিল? কি ভিন?

সিলিভিয়া৷ ভ্রুঁ কুঁচকে বলল,

— তেহভীন!

— এটা আবার কেমন নাম? উদ্ভট!

—নামের মতো নাম।মা তোমার
কোন আপত্তি নেই তো?

— আমার আপত্তি নেই মা। তোর খুশীতে আমি খুশী।
কিন্তু তোর বাবা? মনে হয়না রাজি হবে? বড়’ভাই তোর বাবার মাথা চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে।

— গোল্লায় যাক সব মা। আমি আর একমুহূর্ত এখানে থাকবো না।

সিলিভিয়ার কথার মাঝে সায়মনের কন্ঠস্বর শুনতে পেলো তারা। তড়িৎ গতিতে রুজিনা,সিলিভিয়া,জুলিয়া নিচে নেমে গেলো। নিচে নামার পর সিলিভিয়া শুধু সায়মনকে দেখতে পেলো।তেহভীনেরও আসার কথা ছিলো।কিন্তু তার বদলে একদল ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ দেখে সিলিভিয়া মৃদু হাসলো। পুলিশকে খবর দেওয়ার বুদ্ধিটা তেহভীনের সেটা নিশ্চিত সিলিভিয়া।কারণ, যা কিছু হোক পুলিশকে জানানোটা সঠিক মনে করে তেহভীন। মুনতাসীর শেখ, এবং মুমিন পুলিশ দেখে ভয়ে ঢোক গিললো। সায়মনের তুমুল চেঁচামেচির মাঝখানে তারা পিঠ বাঁচানোর জন্য চুপ মেরে রইলো। সকলের মাঝখানে গলা উঁচিয়ে সায়মন তার মা এবং বোনের দিকে চেয়ে বললো,

— মা, সিলি তোমরা তোমাদের ব্যাগ নিয়ে চলে এসো।এখানে আর একমুহূর্তও নয়। আমি এদের সবকটা কে জেলে ঢুকিয়ে দিবো।সাহস কতো,বিনা অনুমতিতে বিয়ের আয়োজব করে ফেলেছো।যেখানে আমরা কেউ মতামত দেয়নি।

মুনতাসীর শেখ বলে উঠলো,

— তোর ভুল হচ্ছে সায়মন,আমরা তোর বাবার অনুমতি নিয়েই এতসবের আয়োজন করেছি।শুধু শুধু তো আর করবো না। তোর বাবার দোষ, অনুমতি না দিলে আমরা কি আগাতাম?

— আপনি চুপ করুন।

আকবর বড়ভাইয়ের কথায় আশ্চর্য হয়ে যায়। কতোদিন ধরে সিলিভিয়াকে তাদের বাড়ির বউ করার জন্য অনুরোধ করে আসছিলো। আর আজ?দোষ তার হয়ে গেলো,

— ভাইয়া আমি কি এমনি এমনি অনুমতি দিয়েছি?
তোমরা বাপ-ছেলে মিলেই তো আমাকে নানা কথা বলেছিলে।সেগুলো ভুলে গেলে।

— কিছু ভুলিনি আমরা,তোর কথা শুনাই উচিত হয়নি। শুনেই আজ আমার মানসম্মান ডুবলো।এতো।আত্মীয় স্বজনের সামনে আমাকে ছোট করলি।
সায়মন তীব্র ঘৃণ্য চোখে চেয়ে বলল,

— ছোট মনের মানুষের আবার সম্মানের ভয়ও আছে?

— মুখ সামলে কথা বল।

সায়মন আর কথা বাড়ালো না। পুলিশ অফিসারকে বললেন এসবের একটা বিহিত করতে। পুলিশ অফিসার দেখলেন এটা একটা পারিবারিক ঝামেলা। এখানে আইনের কোন হাত নেই। হ্যাঁ, যদি বিয়ের জন্য কনেকে জোরজবরদস্তি করা হয় তাহলে তাদের এরেস্ট করতে পারেন। অফিসার শুধু বললেন,

— মি. সায়মন, আপনি আর আপনার ফ্যামিলির সবাইকে নিয়ে এখান থেকে চলে গেলে ভালো হয়। আর কোন উপায় নেই। উনারা বিয়ের দেওয়ার কথাটা একবারও বলেননি।

সায়মন মনে মনে বলল, ‘এ্যাঁহ বলেনি,বলবে কি করে? পুলিশ দেখে এতক্ষণে হয়তো তাদের প্যান্ট ভিজে গেছে। ‘

সিলিভিয়ার মাথা ধরে গেছে এসব দেখে। সে তার বাবার সামনে এগিয়ে এসে বলল,

— বাবা,তুমি এখনো এতকিছুর পর এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে? দয়া করে চলো, তুমি চাও আমি বিয়ে করি তাই না?

আকবর উপর-নীচ মাথা নাড়ালো। সিলিভিয়া বলল,

— অবশ্যই,আজই করবো,তোমার অনুমতি নিয়ে তোমার সামনেই আমি আমার ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করবো। দয়া করে চলো এখান থেকে।

আকবর হাসান ক্রুর চোখে ভাই এবং ভাইয়ের ছেলের দিকে চেয়ে গটগট পায়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। পেছন পেছন রুজিনা,সিলিভিয়া,জুলিয়া তিনজনে বেরিয়ে যায়।সায়মন সবার মুখের দিকে একচোট চাইলো, এরপর ঘরের মেঝে থু ফেলে বেরিয়ে আসলো। বাইরে এসে দেখলো সিলিভিয়া তারজন্য দাঁড়িয়ে আছে। সায়মনকে দেখতেই সিলিভিয়া এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— ভাইয়া, তেহভীন কোথায় আসে’নি?

সায়মন গম্ভীর স্বরে বলল,’ না!’

সিলিভিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়। তারপরও চুপচাপ সামনের দিকে এগোতে লাগলো। এখন আপাততে বাজার ধরতে পারলে হয়। এতোরাতে কোথায় যাবেন চিন্তা করতে করতে যখন আকবর সাহেব কাহিল হয়ে যাচ্ছিলো,তখন সমাধান একটা আছে বলে সায়মন তার বাবাকে আশ্বাস দিলো। অতঃপর তারা চলে গেলো তেঁতুলিয়া বাজারে।সেখান থেকে ভ্যানে করে পৌছে যাবে আনন্দধারা রিসোর্টে। পথিমধ্যে সায়মন প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসও কেনাকাটা করে নিলো৷

রিসোর্টের সিঁড়ির কাছে লম্বাটে শরীরের একটা যুবককে দেখে আকবর এবং রুজিনা দু’জনে চমকে গেলো। সাদা লাইটের মাঝে ফর্সা মুখটা জ্বলজ্বল করছে।সিলিভিয়া পেছন থেকে মাথা কাত করে তেহভীনের দিকে তাঁকালো। তেহভীনও মাথা হালকা কাত করলো। দু’জনে চোখাচোখি হতেই চট করে দৃষ্টি সরালো। তেহভীন সিঁড়ির কয়েক কদম নেমে এসে সুন্দর করে সালাম দিলো। রুজিনা ঝটপট সালাম নিয়ে সিলিভিয়ার দিকে তাকালো।সিলিভিয়ার দৃষ্টি তখন তেহভীনের দিকে। অবশেষে, উনি যা বুঝার বুঝে নিলেন। রিসোর্টের লিভিংরুমে তেহভীনের পরিচয়টা সায়মন দিলো তার বাবা-মাকে। আকবর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো তেহভীনকে। অপছন্দনীয় কিছু চোখে পড়লো না। জামাতা হিসেবে একদম একশো এ একশো।কিন্তু সমস্যা ছেলেটা বাংলা বলতে পারেনা,এদিকে আকবর ইংরেজীতে দুর্বল। তাই সায়মন কে ডেকে বলল,

— আমার বিশাল আপত্তি আছে এই বিয়েতে।

রুজিনা পাশ থেকে চোখ গরম করে তাঁকালো।

— কিসের আপত্তি বাবা?

— ছেলেটা তো বাংলা বলতে পারে না এখানেই তো
বিশাল সমস্যা।

সায়মনের রাগ উঠলো।তাই সে বলে উঠলো,

— সমস্যা আপনার, আমাদের না।দরকার হলে আপনি কোন কথাই বলবেন না।তারপরও না করবেন না। ছেলেটা যে ভালো সে বিষয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিত। আমার বোন যার কাছে ভালো থাকবে,আমি তার হাতেই আমার বোনকে তুলে দিবো৷

১০৩.

আহামরি কোন আয়োজন ছিলো আজকের বিয়েতে। ভ্যাপ্সা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যখন কাজী সাহেব বিয়ের কার্যক্রম শুরু হলো,তখন আকাশ কেঁপে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নেমে এলো। তীক্ষ্ণ গরমের তাপ চেপে গেলো ঠাণ্ডা শীতল বৃষ্টির স্রোতে। সিলিভিয়ার পরিবারের উপস্থিতি, আর তেহভীনের পরিবার অর্থাৎ তার মা, ভাই-বোন তাদের ভিডিও কলে রেখে ধর্মীয় মতে সিলিভিয়া আর তেহভীনের বিয়েটা হয়ে গেলো। হুট করে আয়োজন হওয়াতে তাদের রেজিস্ট্রি হয়নি।তায়্যিবা বললেন, স্কটল্যান্ডে ফিরলে তাদের দু’জনের রেজিস্ট্রি উনি করিয়ে নিবেন। এতসব কিছুর মাঝে তেহভীন তার ড্যাডকে ভীষণভাবে মিস করছিলো। অনেক ভালোবাসে সে তার ড্যাডকে।লাইফের সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট মোমেন্টে তার ড্যাডের অনুপস্থিতি ভীষণ পুড়াচ্ছে তেহভীনকে। সিলিভিয়া দেখলো তেহভীন কেমন চুপচাপ হয়ে সিঁড়ির কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বসে রইলো। সিলিভিয়া বিরক্ত করলো না তাকে,সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। তাই সিলিভিয়া অনেক সাহস জুগিয়ে সিঁড়ির বাঁ পাশে ছোটখাটো একটা নদী। সেখানের ঘাটের দিকে পা বাড়ালো। তেহভীন ভিজছে, সে কিভাবে ভেতরে আয়েশ করে শুয়ে থাকবে। ভাবনা টা আর সফল হলো না সিলিভিয়ার। তার আগে পুরুষালী কন্ঠের ডাকে পা জোড়া থেমে যায়। তেহভীন ডাকলো তাকে। সিলিভিয়া এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালে তেহভীন হাত ধরে টেনে এনে সিলিভিয়াকে নিজের কোলে বসালো। এরপর ঘাড়ে থুঁতনি রেখে চোখ বুঁজে রাখলো। অনেকক্ষণ এভাবেই থাকলো তারা। তারপর তেহভীনের মন খারাপের রেশটা আপনাআপনি কেটে গেলো। তেহভীন সিলিভিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখে বলল,

— আ’ম সো হ্যাপি সিলভার।
অবশেষে আমরা এক হয়ে গেলাম।তুমি হ্যাপি?

— তোমার চেয়ে বেশি।

তেহভীন সিলিভিয়ার গালটা টেনে দিয়ে বলল,

— এজন্যই তখন ড্রামা করছিলে আমার সাথে।

— তুমি কিভাবে বুঝেছিলে?

— একচুয়েলি, বুঝিনি। আমি তোমাকে ভালোভাবে চিনি। তুমি কোন পরিস্থিতিতে কি করতে পারো সে সম্পর্কে আমার ধারণা আছে শুধুমাত্র।

সিলিভিয়া লজ্জা পেলো খুব তারপরও সেটা অপ্রকাশিত রেখে বলল,

— একচুয়েলি, একজন ফাঁকিবাজ মানুষকে
আঁটকাতে বিয়েটা করতে চেয়েছি। নাহলে এতোটাও প্রয়োজন ছিলো না।

—-ডোন্ট ওয়ারি! তোমার যেটা প্রয়োজন সেটা
তোমাকে এই মোমেন্টে দিচ্ছি ওয়েট।

আচমকা তেহভীন মাথাটা সিলিভিয়ার মুখের কাছে নেমে এলো। সিলিভিয়ার ঠোঁটের কাছাকাছি নিজের ঠোঁটজোড়া এনে সিলিভিয়ার কোমল ওষ্ঠজোড়া নিজের দখলে নিয়ে এলো। অকস্মাৎ, পুরুষালী ওষ্ঠের ভাঁজে নিজের ঠোঁটকে মিলিয়ে যেতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলো সিলিভিয়া।প্রিয় মানুষটির দেওয়া প্রথম আদুরে পরশ, চোখজোড়া লাগামহীন হয়ে নিভে গেলো।শুধু অনুভব করলো তেহভীনের উষ্ণ নিঃশ্বাস তার শ্যামবর্ণ ত্বকে ল্যাপ্টে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর পর।দৃঢ়,গভীর স্পর্শে মস্তিষ্ক ইঙ্গিত দিলো প্রিয়’ পুরুষের ছোঁয়ায় যেনো এ মুহূর্তটাতে আচ্ছন্ন থাকে।

(চলবে)

তেহভীন -সিলিভিয়ার বিয়ের পরের সংসার,বাচ্চাকাচ্চা। এসব পর্বও লাগবে আপনাদের? 😒 নীরব পাঠকগুলা একটু রেসপন্স করিয়েন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here