লাভ রেইন পর্ব-৪৬

0
2239

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৪৬

১১৩.

ইউ.কে এর সবচেয়ে ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট হচ্ছে হেথ্রো।জাতীয় হেথ্রো এয়ারপোর্টের অধীন হতে বৈমানিক ক্যাপ্টেন ব্যাজ অর্জন করেছিলো তেহভীন। সেকেন্ড ফ্লোরে পাইলট ইন-কমান্ড,ক্যাপ্টেন পাইলট,কো-পাইলট,নেভিগেটর এবং অন্যান্যদের স্থায়ী এয়ারলাইন্স অফিস রয়েছে। নাইট ফ্লাইটের ডিউটি শেষে তেহভীন অফিসে এসেছে তার ড্যাডের সাথে সাক্ষাৎ করতে।সাথে তার ফোইস আইডির হাজিরাটাও দিয়ে দিবে,যেহেতু সে এতদিন ছুটিতে ছিলো।অধিনায়ক হিসেবে তেহভীনের সম্মান অনেক।তার চেয়ে জুনিয়র পদে থাকা অন্যান্য অফিসাররা সম্মানের সহিতে তাকে গুড মর্নিং জানাচ্ছে।
দশ বছরের চুক্তিতে সইয়ের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হয় তেহভীন।শর্ত অনুযায়ী দশ বছরের মধ্যে অধিনায়কের যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। চার বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে অধিনায়ক হওয়ার যোগ্যতা এবং ক্যাপ্টেন ব্যাজ অর্জন করে সে।
ফেইস আইডির হাজিরা শেষে হাতে আরো অল্প সময় বাঁচিয়ে রেখে তার ড্যাডের কেবিনে নক করলো।’এয়ার চিপ মার্শাল’ এটি সবচে উচ্চপদস্থ। ভেতর থেকে ভরাট কন্ঠে ভেতরে যেতেই আহবান জানালো মি.মেথেউ এ্যাসপোর্ড। তেহভীন ভেতরে প্রবেশ করলো। ডিভাইনে তার ড্যাডের সাথে আরো একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। তেহভীন চিনে লোকটিকে। তিনি স্কোয়াড্রন লিডার ‘কেইন জ্যাজ’।

তেহভীন কে দেখে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো মি.মেথেউ। এগিয়ে এসে সৌজন্যের সহিতে ছোট পুত্রকে জড়িয়ে ধরলেন। উচ্চতায় সমান হওয়াতে বাবা-ছেলের আলিঙ্গনে একটুও সমস্যা হয়নি। মি.কেইনের সাথেও তেহভীনের হাই-হ্যালো আলাপ হয়। কনকনে ঠাণ্ডায় আচ্ছন্ন কক্ষ বসে থাকলেও তেহভীনের মনের এক কোণে ভয়ের আশ্রয় রয়েছে।ড্যাড ভদ্রলোকটির সামনে হাসিখুশী মুখে আলাপ করলেও,লোকটি যাওয়ার সাথে সাথে হয়তো দ্বিগুন পরিমান গম্ভীর হয়ে যাবেন।মি.মেথেউ কথার ফাঁকে ছেলের দিকে নজর দিলো।নির্ঘুমে ফ্লাইট উড্ডয়নের ফলে চোখজোড়া রক্তাক্ত লাল হয়ে আছে।একটা স্ট্রং কফি নিলেই চোখের রক্তিম আভাটা চলে যাবে।কিন্তু ঘুমটা বেশি প্রয়োজন,মি.মেথেউ হাত তুলে তেহভীনকে নিজের বেডরুমে যেতে বললেন।তেহভীন স্মিত হেসে জানালো,নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে ঘুমাবে। মি.কেইন বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়ার পর পরেই মি.মেথেউ এর মুখে গম্ভীর ভাব ফুটে উঠলো।তেহভীন চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার ড্যাড নীরবতা ভেঙে বললেন,

— তো, এবারের আট দিনের ছুটি কোথায় কাটিয়েছো? এডিনবার্গে যাওনি সিউর।

তেহভীন চেপে না রেখে বললো,
— বেংলাডেশে,

মি.মেথেউ পি.সি. তে চোখ রাখলেন,বললেন-

— আমি আন্দাজ করেছিলাম তুমি বেংলাডেশে।
আচ্ছা তুমি কি এখনো সিরিয়াস ওই মেয়ের প্রতি?

তেহভীন ঘুমে জড়িয়ে আসা চোখদুটো টান টান করে মেলে তার ড্যাডের মুখের দিকে সুগভীর চোখে তাকালো।গম্ভীর্যের আড়ালে আজ হঠাৎ তার ড্যাডের মুখে অকৃত্রিম উচ্ছ্বাসের ছোঁয়া পেলো।তেহভীন কিছুটা সময় নীরবে থেকে বলল,

— ড্যাড, আমি বিয়ে করেছি।

মি.মেথেউ থমথম দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন,
কথাটা যেনো তার বিশ্বাস হয়নি।তার সবচেয়ে বাধ্য সন্তানটি তাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে। কথাটা কী সত্যি?নাকি ছেলে মজা করছে তার সাথে,সেটা ভাবতে লাগলো। মি.মেথেউ হেসে উঠলেন,গমগম স্বরে বললেন,

— মজা করছো মাই সন?

— মজা করছি না ড্যাড,আ’ম সিরিয়াসলি
সেয়িং ড্যাড,রিলিজিয়াসলি নাও সিলভার ইজ মাই ওয়াইফ।

মি.মেথেউ তেহভীনের কথায় মনে মনে কষ্ট পেলেন।এতোটা আগলে রাখার পরও,অবশেষে ছেলে নিজের মনের কথাটা শুনেছে। সেখানে ড্যাডের কোন অস্তিত্ব নেই। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,

— অর লিগ্যালি? তুমি রিলিজিয়াসলি বিয়ে করেছো ভালো কথা। কিন্তু লিগ্যালি? লিগ্যালি পেপার্স ছাড়া এখানে বিয়ে অবৈধ৷

তেহভীন অসহায় হয়ে পড়লো কথাটা শুনে,লিগ্যালি পেপার্স তৈরি করে বিয়ে করার সময়টা তার হাতে ছিলো না তখন।হঠাৎ মনে পড়লো, তার ড্যাড ইসলাম রিলিজিয়ন মানেন না সেজন্যই লিগ্যাল পেপার্সের কথা বলছেন।কিন্তু সে বুদ্ধির বয়স থেকে ইসলামিক মাইন্ডে বড় হয়েছে।তারা নানার কাছ থেকে সর্বপ্রথম ইসলাম শিক্ষা পেয়েছিলো তারা। এরপর এসেছে তাদের অন্যান্য কালচার। এ পর্যায়ে এসে তেহভীন ঈষৎ হাসলো।বলল,

— ড্যাড,ডোন্ট ফরগেট আ’ম স্টিল মুসলিম।এন্ড আল’সো মাই মম এন্ড ব্রাদার।

তেহভীনের কথাগুলো ভীষণ গায়ে লাগলো মি.মেথেউ হালকা হাসলেন,এবং বললেন,

— অর টামান্না?

তেহভীন ভেবেছিলো বহুদিন পুরনো চেপে রাখা কথাটা কখনো তার ড্যাডের সামনে তুলবেনা।কিন্তু পরিস্থিতির হাতে পড়ে কথাটা আজ বলতে বাধ্য হলো তেহভীন।

— সিস্টার ইজ ইউর এডাপ্টেড ডটর।

তড়িৎ বেগে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন মি.মেথেউ।আশ্চর্যান্বিত দৃষ্টিপাত করলেন তেহভীনের দিকে।তেহভীনের ঠোঁটের কোণে এক অদৃশ্য সূক্ষ্ম হাসির আবছা রেখা। এতো বছর ধরে চেপে রাখা কথাটি তেহভীন কিভাবে জানলো সেটাই তো বুঝতে পারছেন না তিনি।তামান্নাকে যখন দত্তক নেওয়া হয়েছিলো তখন তেহভীনের জন্ম হয়নি,আর তানজিদের বয়স মাত্র দেড় বছর। একটা কন্যসন্তানের আশা ছিলো তখন তায়্যিবা এবং মি.মেথেউ এর। সুভাগ্যের জোড়ে তাদের কন্যাসন্তান পৃথিবীর বুকে আসলেও স্থায়ীভাবে ঠাঁই হয়নি। এই দুঃখ,যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ কিভাবে ঘটাবেন,কিভাবে তায়্যিবাকে সামলাবেন এ নিয়ে ভয়ে এবং সংশয়ে ছিলেন তিনি।দিশেহারা হয়ে তায়্যিবা জানার পূর্বেই একজন অসুস্থ স্কটিশ দাম্পত্তির কাছ থেকে তামান্নাকে এডাপ্ট করেন,এবং তাদের সুচিকিৎসার খরচ তিনি বহন করার কথা দেন। নিজের মৃত কন্যা সন্তানের মুখ শুধুই মি.মেথেউ দেখেছিলেন। এসবের মাঝে তানজিদের ন্যানি এসবের সাক্ষী হয়ে ছিলেন।এতসবের মাঝে তিনি প্রশ্ন করলে, মি.মেথেউ কাউকে এ ব্যাপারে না জানানোর অনুরোধ করেন।এখন তেহভীন কিভাবে জানলো ভাবতেই শরীর খারাপ হতে লাগলো মি.মেথেউ এর। সবচেয়ে বড়কথা তায়্যিবা এবং তামান্না যদি জানতে পারেন।এতোবড় সত্য কথা। তাদের চোখে চরম বিশ্বাসঘাতক হিসেবে গন্য হতে হবে তাঁকে।তেহভীন স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো,ফাঁদটা জায়গা মতো পাতানো হয়েছে। একটা কথা আছে, ‘তোমার গোপন কথা যতক্ষণ তোমার কাছে আছে ততক্ষণ তুমি স্বাধীন,যদি এই গোপন কথা অন্যকে জানাও তাহলে তুমি এবং তোমার কথা উভয়ে অন্যের কাছে বন্দী।’
এখানে বিষয়টা কি দাঁড়ালো? তেহভীন ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে বলল,

— ড্যাড, আই থ্যিংক আমাদের উচিত সিস্টারকে এন্ড মমকে জানিয়ে দেওয়া…

— নো!

— হোয়াই নো ড্যাড? দিনের পর দিন মম এবং সিস্টারকে এভাবে অন্ধকারের মুখে রাখা ঠিক হচ্ছে না আমাদের। উই শ্যুড..

— প্লিজ টেহভীন।তোমার ড্যাডের অনুরোধ টামান্না এন্ড টায়্যিবাকে এসবের কিছু জানিয়ো না।প্লিজ, ড্যাডের এই রিকুয়েষ্টটা রাখো।আমি তোমার লিগ্যালি ম্যারেজ সার্টিফেটের ব্যবস্থা করছি।

তেহভীন ফিচেল হাসলো শুধু।তার ভেতরটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে তার ড্যাডের মুখ দেখে।নিজের স্বর্থের জন্য আজ তার ড্যাডের দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করে ফেলেছে। সিলিভিয়াকেও ছাড়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। তেহভীন তার ড্যাডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসার সময়,হঠাৎ মি.মেথেউ বলে উঠলেন,

— তুমি এতো কিছু কিভাবে জেনেছো টেহভীন?

তেহভীন তার ড্যাডের দিকে ফিরে বলল,

— হসপিটালের সব পেপার্স আমি ন্যানির কাছ থেকে চুরি করেছি ড্যাড।স্যরি,বাট মাই কিউরিয়াস মাইন্ড ওয়েন্টড টু নোউ এভ্রিথিং দ্যান।

মি.মেথেউ বসা থেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলেন। নিঃশব্দে উনার কেবিনে থাকা বেডরুমে চলে গেলেন এবং দরজাটা আঁটকে দিলেন। তেহভীনের খারাপ লাগলো ভীষণ,যদিও এসব করার কোন পরিকল্পনা ছিলো না তার। কিন্তু হঠাৎ দুদিন আগে বিষয়গুলো ব্যাপারে মাথায় আসতেই এই ফাঁদটা পেতেছে সে। তেহভীনের সবাইকে প্রয়োজন, ভালোবাসার জন্য তার ড্যাডের ভালোবাসা উপেক্ষা করার মতো শক্তি তার নেই।তাই বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতিটা নিয়ন্ত্রণ করেছে সে।

১১৪.

সবেমাত্র নিজের ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তেহভীন।সিলিভিয়াকে ভীষণভাবে মিস করছে সে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। এয়ার ফ্রেসনারটা হাতে নিয়ে স্প্রে করে দিলো। এরপর চললো লম্বা একটা শাওয়ার নিতে। ফ্রেস হয়ে এসে উদাম গায়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। শান্তির একটা ঘুম প্রয়োজন তার,পরিপূর্ণ শান্তির জন্য সিলিভিয়ার ফোনে ফোন দিলো। কন্টেক্ট নাম্বার দেখে সিলিভিয়া চিনে নিবে তাকে,সে আর হোয়াটসঅ্যাপ এ ঢুকলো না সে।
ফোন কানে ঠেকিয়ে রাখলো,তখনি ডোরবেলটা বেজে উঠলো। হঠাৎ অসময়ে ডোরবেল বাজায় অবাক হলো সে।সচরাচর তার এই ফ্ল্যাটে তার ড্যাড আর তামান্না ছাড়া কেউ আসে না,আর আসার হলে তাকে অবশ্যই ইনফর্ম করে তারপর আসে।ফোনটা কানের সাথে ঠেকিয়ে রেখেই দরজাটা খুললো।তখনি অল্পবয়সী এক যুবতীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেহভীনের শীতল দৃষ্টি কঠোর হলো। কপাল কুঁচকে আগত মেয়েটির দিকে প্রশ্নাত্বক চাহনিতে তাকালো।মেয়েটি হালকা হেসে রিনরিনে স্বরে বললো,

— আ’ম এইজি জ্যাজ! ইউর কলিগ।
ক্যান উই গেট এ্যাকুয়েন্টেড?

তেহভীন সিলিভিয়ার ফোন রিসিভ করার অপেক্ষায় ছিলো। মেয়েটির কথায় চোখ তুলে তাকালেও,সিলিভিয়া কন্ঠ শুনে আর প্রত্যুত্তর করলো না। হালকা কেশে মেয়েটির দিকে চেয়ে বলল,

— নো থ্যাংক’স!

বলেই মেয়েটির মুখের উপর দরজাটা বন্ধ করে দিলো।যদিও তেহভীন চিনতে পেরেছে মেয়েটি কে। তাই আর সেদিকে মাথা ঘামালো না। ফোনের দিকে মনোযোগ দিয়ে বললো,

— কেমন আছো সিলভার?

— ভালো, তুমি?

— মি টু! কি করো?

—- মেমোরিয়াল গ্লেডে বসে আছি জাইমার সাথে।
তুমি?

— নাথিং,ঘুমাবো একটু পর।

— ঘুমাও তাহলে।

— সিলভার?

— ইয়েস! বলো!

— তুমি যে মেডিসিন খেয়েছো আমাকে
জিজ্ঞেস করেছো?

সিলিভিয়া চমকে উঠলো, বললো-

— তুমি জানো?

— অফকোর্স, জানি। শুনো, তোমার অজান্তে
আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।

— আমার অজান্তে? কি?

অবাক হয় সিলিভিয়া।তেহভীন বললো,

— এখন না, তবে সময় আসলে তুমি নিজেই
বুঝতে পারবে। এন্ড আ’ম স্যরি।

— স্যরি ফর হোয়াট তেহভীন? কি করেছো বলো?
আমার ভয় হচ্ছে।

— ভয় পেও না।তবে…

তেহভীন আর কিছু বললো না। ঘুমে চোখ বুজে আসছিলো তার।তাই ফোন কেটে সাইলেন্ট মুডে রেখে দিলো৷ ঘুমটা তার জন্য ভীষণ প্রয়োজন। আজকের দিনের শুরুটা কিভাবে, কি করে শুরু হয়েছে সব ভাবতে ভাতবে চোখ বুজে ফেললো। সবচেয়ে আনন্দের ঘটনা হচ্ছে তার ড্যাডকে জব্দ করাটা। নিজের উপর ভীষণ সেটিস্ফাইড হলো তেহভীন।

(চলবে)
রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here