লাভ রেইন পর্ব-৪৫

0
2049

#লাভ_রেইন
#তারিন_জান্নাত
#পর্বসংখ্যাঃ৪৫

১১১.

শুধুমাত্র ওয়ান ইউনিট স্প্রিটি ছিলো জুসে। বাকি সব মিথ্যা বানোয়াট কথা ছিলো। শুধু শুধু তেহভীনকে বোকা বানাতে গিয়ে অত্যন্ত এক গম্ভীর পরিস্থিতিতে পড়লো সিলিভিয়া। তেহভীনের কোল থেকে এক ঝাটকায় নেমে দাঁড়িয়ে পড়ে সিলিভিয়া।তেহভীন তখন একটু নয়,অনেকটাই অবাক হয়। তার ধারণা ছিলো এতো এতো পেগ ড্রাগের প্রভাবে সিলিভিয়া রুখে দাঁড়াতেও পারবে না। জরুরি ট্রিটমেন্টের জন্য হসপিটালাইস করতে হবে।কিন্তু সিলিভিয়া স্ট্রংলি দাঁড়িয়ে তেহভীনের দিকে চেয়ে দূরান্ত হাসছে।সুগভীর চোখে আপাদমস্তক সিলিভিয়ার দিকে চেয়ে মূল কাহিনী আন্দাজ করতে পারলো তেহভীন। ফুস করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেও,ক্ষোভটা থেকে গেলো। সিলিভিয়ার ডানবাহু খামচে ধরে কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করলো,

—- হুয়াট ইজ দ্যিজ সিলভার?

সিলিভিয়া মনে মনে অনেক কথা সাজালো, কিন্তু মুখ ফসকে বললো,

— তুমি ঠিকাছো?

— আমি ঠিক আছি,আমার কি হবে?
তোমার কি আমাকে মনে পড়েছে?

তেহভীন কথাটা বলেই গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসে পড়লো। সিলিভিয়া তেহভীনের অভিমানে ভরা মুখ দেখে গাড়ির মধ্যে তেহভীনের ঘা ঘেঁষে বসলো। তেহভীন শক্ত হয়ে বসে রইলো।সিলিভিয়া বলল,

— সামান্য জুস আর ড্রাগের এতোটা পাওয়ার নেই তোমাকে আমার মন থেকে মুছে ফেলবে।আ’ম স্যরি। আসলে তোমাকে অনেকদিন ধরে বোকা বানানোর চেষ্টা করছিলান।সাকসেস হচ্ছিলাম না।আজ ঝটপট একটা সুযোগ পেয়ে…

তেহভীন চোখ রাঙিয়ে তাকালো। রাগান্বিত চোখ দেখে মিঁইয়ে গেলো সিলিভিয়া। দৃষ্টি নিচু করে ফেললো। অনেকটা সময় দু’জনে চুপ থাকলো।যখন দেখলো তেহভীন কথা বলছে না,তখন হাল ছেড়ে দেয় সিলিভিয়া।হঠাৎ মনে পড়লো, তেহভীন রেগে গেলে একদম চুপ হয়ে যায়।বোম মেরেও কথা বলানো যায় না। সিলিভিয়ার অন্যমনস্ক হয়ে জানালার বাইরে দৃষ্টি রাখলো। তখন যে লোকটি ডাবল ডাবল পেগের ড্রাগ জুসে মেশানোর অর্ডার করছিলো তখন সিলিভিয়া পাশেই ছিলো। লোকটিকে যখন জিজ্ঞেস করছিলো এই জুস কার জন্য,তখন লোকটি ভীষণভাবে রেগে যান।কেন যেনো সিলিভিয়ার মনটা এভাবে চোখের সামনে কারো ক্ষতি হওয়াটা সহ্য করতে পারলো না।এই এড়িয়াটা ভালোভাবে দেখে নিলো,একদম নিরিবিলি।তাই বারটেন্ডারের লোকটিকে আরেকটা জুস মেক করতে বলে। অন্য লোকটির যখন ফোন আসে তখনি সিলিভিয়া জুসটি তার হাতে থাকা জুসের সাথে এক্সচেঞ্জ করে ফেলে, ব্যাপারটা এতোই দ্রুত ঘটছিলো যে কেউ টেরও পেলো না।পাশের বিনে জুসটি ফেলে দিলো।জুসের মধ্যে একটা স্মুথি ভাব আছে যেটার জন্য সকলের জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
বারটেন্ডারকে সময় না দিয়ে অন্যলোকের অর্ডাকৃত জুসটি কয়েক চুমুকে খেয়ে ফেলে সিলিভিয়া।আর লোকদুটি ভেবেছে সিলিভিয়া সত্যিই সিলিভিয়া ওই হার্মফুল জুসটা খেয়ে ফেলেছে। আর তখনি তারা ক্রোধান্বিত হয়ে সিলিভিয়াকে শাষাতে থাকে,তাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয় তেহভীন।

সিলিভিয়া হতাশ চোখে পূনরায় তাকালো তেহভীনের দিকে।কেমন যন্ত্রমানবের মতো বসে আছে।মজাটা একটু বেশিই করে ফেলেছে সিলিভিয়া, বুঝতে পেরে আরো হাঁসফাঁস করতে লাগলো। একটা সময় তারা নিজেদের স্যুইটে চলে আসলো। তখনো তেহভীন কথা বললো না। সিলিভিয়ার ধম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সহ্য করতে না পেরে তেহভীনকে পেছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। তেহভীন ততোটাও কঠিন হৃদয়ের ব্যাক্তি নয়,যে প্রিয়তমার কান্না শুনেও শক্ত হয়ে থাকতে পারবে।সেও সিলিভিয়াকে সামনে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো।কিন্তু স্বভাবগত সমস্যার কারণে একটা শব্দও মুখ থেকে বের হলো না। সিলিভিয়া তেহভীনের বুকে ঠাঁই পেয়ে তুষ্ট হয়ে যায়,রাগ কমলে তেহভীন নিজ থেকে কথা বলবে। বাইরে থেকে ফেরার কারণে ফ্রেস হওয়ার দরকার ছিলো,কিন্তু তাদের মধ্যকার কাতরতাপূর্ণ সময়টাকে দূরে ঠেলে দিয়ে পূনরায় ভালোবাসা’ময় মুহূর্তে ডুবে গেলো।সিক্ত স্পর্শ ভুলিয়ে দিলো ঘন্টাখানেক পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা।

১১২.

ঘন্টাখানেক পূর্বে ক্যালিফোর্নিয়াতে ফিরেছে তেহভীন আর সিলিভিয়া। সিলিভিয়া নিজের এ্যাপার্টমেন্টে ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।অনেকদিন পর নিজের কামরায় এসে মনটা পুলকিত হয় তার।সাথে আবার তেহভীনের চলে যাওয়াটা ভীষণ খারাপ লাগছে। এখন সময়টা মধ্যদুপুর।তেহভীনের স্কটল্যান্ডের ফ্লাইট সন্ধ্যায়।এই মাঝখানের স্বল্প সময় আছে তেহভীন তার কাছে। আবার কবে ফিরবে,কবে দেখা হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। তেহভীন এখন শাওয়ার নিচ্ছে,সিলিভিয়া বসে বসে হতাশ চোখে ওয়াসরুমের ডোরের দিকে চেয়ে থাকলো।হঠাৎ,মনে পড়লো সিলিভিয়া বার্থকন্ট্রোল পিল নেয়নি।তড়িৎ গতিতে ব্যাগ হাতে নিয়ে ইমার্জেন্সি পিলটা হাতে নিয়ে ঝটপট তেহভীন দেখার আগে খেয়ে নিলো।যদিও তেহভীনের সাথে বিশেষ কোন আলোচনায় হয়নি এই বিষয়ে তারপরও তেহভীনকে না জানিয়েই কাজটা করলো সিলিভিয়া। কাল থেকে এখনো অবধি কথা বলেনি তেহভীন।রাগটা এইভানে নেভালো সিলিভিশা।
কিন্তু সিলিভিয়ার অজান্তে,অগোচরে সূক্ষ্ম হাসলো তেহভীন। তার যা করার তা সে ইতিমধ্যে করে ফেলেছে।বাকিটা সময়ের উপর ছেড়ে দিলো। সময় সবকিছু করে ফেলবে এই আশা রাখলো।

ওয়াসরুম থেকে বের হতেই সিলিভিয়াকে চোখে পড়লো তেহভীনের। সিলিভিয়া তার দিকেই চেয়ে ছিলো এতক্ষণ। তেহভীন এক পলক চেয়ে চুল মুছতে মুছতে সিলিভিয়ার পাশে বসলো। সিলিভিয়ার কাঁধে মাথা পর্যন্ত রাখলো।কিন্তু কথা বললো না। সিলিভিয়া এবার রাগ দমাতে না পেরে এক ঝটকায় মাথাটা কাঁধ থেকে সরিয়ে নিলো।তেহভীন শক্তকরে সিলিভিয়ার কাঁধ চেপে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে বলল,

— ডোন্ট মুভ!

শব্দ দুটো শুনে তেহভীনের দিকে তাকালো। মুহূর্তের মধ্যে ধম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম করলো।তেহভীন সোজা এ্যাটাক করলো ঠোঁটে। রীতিমতো কালকের রাগটাই যেনো ঝাড়ছে মনে হলো সিলিভিয়ার৷খানিকটা সময় পর কোমল ছোঁয়া পেলো সে। তেহভীনের বাহুতে মাথা এলিয়ে দিলো সিলিভিয়া। এই মানুষটার ছোঁয়া,কথা,খেয়ার করা, একান্ত মুহূর্তে অসভ্যতামি করা সব ভালো লাগে তার। এতোটা সুখ তার কপালে আছে জানা ছিলো না তার। সিলিভিয়া চোখ বন্ধ রেখে হাতদুটো তুলে চেপে ধরলো তেহভীনের মশৃণ, শ্বেত দু’গাল।

অনেকক্ষণ পর তারা একে অপরের থেকে আলাদা হলো।তেহভীনের স্নিগ্ধ, সতেজ, নিষ্পাপ মুখটা দেখে মনটা জুড়ে গেলো তার।
তেহভীন সিলিভিয়ার চোখের দিকে তাকালো। এই চোখে সে এই মুহূর্তে আনন্দ দেখতে পাচ্ছে। গত পনেরো ঘন্টা সে সিলিভিয়ার সাথে একটুও কথা বলেনি।একটু কথা বলানোর জন্য কতোকিছু করেছিলো সে,তেহভীন শুধু নীরবে সব উপভোগ করছিলো।বুঝতে দেয়নি সিলিভিয়ার এসব পাগলামি তার কতো ভালো লাগছে।এই পাগলামিগুলা একসময় যখন তারা দু’দেশের দু’প্রান্তে থাকতে তখন ভীষণভাবে তাকে পুড়াবে।তখন চাইলেইও পাশাপাশি বসে কথা বলতে পারবে না,ছুঁতে পারবে না।কিভাবে যে মানসিকভানে নিজে শান্ত রাখবে সেটাই ভাবছে তেহভীন।
সিলিভিয়ার নরম তুলতুলে গালে শক্তভাবে হাত রেখে তেহভীন বলে উঠলো,

—- আর কখনো এরকম মজা করবে না আমার সাথে। রিমেম্বার ! আমি কিন্তু নেক্সট-টাইম তোমাকে আর ক্ষমা করবো না।

সিলিভিয়া ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো।তেহভীন হেসে দিয়ে বলল,

— ইয়্যূ উইল ড্রাইভ মি ক্রেজি সিলভার৷

এতক্ষণে তেহভীনের মুখে হাসি দেখে সিলিভিয়াও হাসলো। বুক থেকে বড়সড় একটা পাথর নেমে গেলো। প্রশান্তির বাতাস এসে মনের আঙিনায় কড়া নাড়লো।

বিকেলের শেষভাগের সময়টা খুব দ্রুতই প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে যায়। তেমনি মিলিয়ে গেলো তেহভীনের ছুটির দিনগুলো। তেহভীন চলে যাবে কথাটা যতবার সিলিভিয়ার মনে আসছে ততবার দলা পাকিয়ে কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। একসময় নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে হিচকি তুলে কাঁদতে থাকলো। লম্বা কোরিডোরল তখন টিমটিমে আলো। তেহভীন তার হাতঘড়িরটা খুঁজে না পেয়ে সিলিভিয়ার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,

— সিলভার,আমার ওয়াচটা দেখেছো? খুঁজে পাচ্ছিনা।

সিলিভিয়া তখন হাত তুলে হাতের তালুতে তেহভীনের ঘড়িটাকে দৃশ্যমান করলো। ঘড়িটা দেখে স্মিত হাসলো তেহভীন।হাত বাড়িয়ে দিলো,যেনো সিলিভিয়া ঘড়িটা তাকে পড়িয়ে দেয়।সিলিভিয়া সন্তপর্ণে ঘড়িটা পড়িয়ে দিলো,হিচকি তুলা কান্না আঁটকাতে আঁটকাতে বলল,

— তুমি যদি এবারে যোগাযোগ না রাখো,দ্যান আই সোয়্যের আমি ভুলে যাবো তুমি আমার হাজবেন্ড।

—- ভেরী ইজি? ভুলতে পারবে?

— পারবো,

—– আমি ভুলতে দিবো না।এখন তোমার চোখে টিয়ার্স মুছো। আমার খারাপ লাগছে।

সিলিভিয়া মুছলো না। তেহভীন মুছে দিলো সিলিভিয়ার চোখের পানি। নিচে গাড়ি ওয়েট করছে।তেহভীন নিজের ব্যাগটা কাঁধে তুলে সিলিভিয়ার কাছাকাছি এসে কিছু সময় ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকলো। কিছু সূক্ষ্ম গভীন ছোঁয়া সিলিভিয়ার মন খারাপি দূর করে দিলো।তেহভীন সিলিভিয়াকে বুকের কাছ থেকে সরিয়ে এলোমেলো চুল ঠিক করে দিয়ে বলল,

— ডোন্ট ক্রাই। আমি আবারও আসবো। প্লিজ মন দিয়ে স্টাডি করো। এখন তোমাকে আর আমাকে নিয়ে ইনসিকিউর ফীল করতে হবে না।নাউ, আ’ম টুটালি ইউর সিলভার! লাভ ইউ!

কপালে চুমু দিয়ে সিলিভিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলো তেহভীন।প্রতিবার প্রচণ্ড মন খারাপ থাকতো তেহভীনের। কিন্তু এবার মন খারাপটা তেমন নেই। কারণ সিলিভিয়া এখন পরিপূর্ণভাবে তার। সামনে তাদের রিলেশন আরো স্ট্রং হবে। এবার দেখবে তার ড্যাড কি করে তাদের রিলেশন মেনে না নেই। অনেক গভীর একটা দূর্বলতা আছে তেহভীনের ড্যাডের।মূলত সেই দূর্বলতাকে কাজে লাগাবে তেহভীন। একটা মানুষের নীরব, চেপে রাখা আকুতি হয়তো এবার কমবে।মাঝখানে সিলিভিয়াকে সেকরিফাইস করতে হবে। তবে আগে সেটা কোন ব্যাপার নয়।রিলেশনটা পার্মেনেন্টলি হয়ে গেলে সিলিভিয়ার সব সামলে নিবে এটাই তেহভীনের বিশ্বাস।

(চলবে)

তেহভীনকে একটু বোকা আর ভয় দেখাতে চেয়েছিলাম।অনেকদিনের ইচ্ছে।আপনারা কি ভেবেছিলেন?😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here