লাল_ছাতি অন্তিম_পর্ব

লাল_ছাতি
অন্তিম_পর্ব

নূরের কথা শুনে পারমীতা ভনিতা ছেড়ে বললো,
“আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ার সম্পর্কটা শুধু কলিগ কিংবা বন্ধুর স্বামী হিসেবে নয়। আমি রিদওয়ান ভাইয়াকে তোর বিয়ের অনেক অনেক আগ থেকে চিনি। ইভেন তোর আমার বন্ধুত্বেরও বহুআগ থেকে। আমাদের সম্পর্কটা তেমন নয়, যেমনটা তুই মনে করছিস”

নূরের ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে আসে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সে। পারমীতা কফির মগের দিকে চেয়ে বলে,
“রাফিনকে মনে আছে তোর?”
“হ্যা, রিদওয়ানের ফ্রেন্ড। এখন মিশনে আছে। আমার সাথে ওর পরিচয় হয়েছে দু মাস আগে। দেশে এসেছিলো।”
“রিদওয়ান ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার হাসবেন্ড।আমার আর রিদওয়ান ভাইয়ার পরিচয় রাফিনের মাধ্যমে। ইভেন আমাদের বিয়ের সাক্ষী ও রিদওয়ান ভাই। রাফিনের খুব ভাল তিনজন বন্ধু, আশিক ভাই, মুকিত ভাই আর রিদওয়ান ভাই। তখন আমি মাত্র আঠারো পেরিয়েছে। রাফিন হারিয়ে যায় নি, পাগল মানুষ তো কখন কি করে তার ঠিক নেই। একদিন হুট করে আমাকে এসে বলেছিলো ও আমাকে বিয়ে করবে। প্রোপার বিয়ে, ওর নাকি ইচ্ছে পালিয়ে বিয়ে করার। আঠারো বছরের কিশোরীর আবেগ ও তখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। বাবাকে বললে হাত পা ভেঙে ফেলতো তাই আমরা লুকিয়ে কাজী অফিসে বিয়ে করি। কিন্তু সমস্যা একটাই ছিলো ও আর্মিতে ছিলো। ওদের একটা বয়স না হলে বিয়ের পার্মিশন পায় না। ওর আর আমার বিয়েটা শুধু রিদওয়ান ভাই, আশিক ভাই এবং মুকিত ভাই ই জানতো। রিদওয়ান ভাই আমার ভাই হিসেবে সাক্ষী দিয়েছিলেন। রাফিন প্রোমোশন পায়, ক্যাপ্টেন হয়। তখন আমি বলেছিলাম, এবার যেনো ও বিয়ের কথাটা বলে। কিন্তু তার সময় পায় না, তার আগেই ও মিশনে চলে যায়। ছয়মাস, একবছর পর আসতো। আজ আমাদের বিয়ের প্রায় সাত বছর হয়ে গিয়েছে অথচ এই ব্যাপারটা গোপন। লাস্ট দুমাস আগে রাফিন এসেছিলো। আমাদের মাঝে খুব বড় ঝামেলা হয়, ঝগড়া হয়। আর কতো লুকিয়ে রাখবো বলতো। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তখন রাফিন আমাকে কথা দেয় এবার আসলেই সে আমার এবং তার বাসায় কথা বলবে। বিয়ের কথাটা বলতে পারবে না। কারণ এতে তার চাকরি সাসপেন্ড হতে পারে। কেউ জানলে খুব বাঝে একটা পরিস্থিতিতে পড়বে, তাই আমি কখনো কাউকে জানাই নি আমি বিবাহিত। ওই রিদওয়ান ভাইকে বলে যায় যেনো আমার দিকে খেয়াল রাখে। আমার চাকরিটাও ওর কথায় রিদওয়ান ভাই ম্যানেজ করে দেয়”

পারমীতা থামলো, তার কন্ঠ জড়িয়ে যাচ্ছে, সে একটু পানি খেলো তারপর বললো,
“সবটা আবার ঠিক হয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু ও মিশোন এ যাওয়ার পর থেকেই আমি ওর খোজ পাচ্ছি না। না ফোন, না ইন্টারনেট, না সোস্যাল নেটওয়ার্ক। আমি কোনো ভাবেই ওর সাথে কন্ট্যাক্ট করতে পারছি না। এর মাঝেই আমি জানতে পারি আমি প্রেগ্ন্যান্ট। আমার বাচ্চা অবৈধ নয়। আমি কি করবো, কাকে বলবো, কোথায় যাব কিচ্ছু বুঝছি না। মুকিত ভাই, আশিক ভাই ও দেশে নেই। রিদওয়ান ভাইকে জানানো বাদে আমার কাছে কোনো উপায় ছিলো না। সেই রাতে আমি পাগল হয়ে গেছিলাম, আমার যেনো জ্ঞান শুন্য হয়ে গিয়েছিলো। তাই তো রাত তিনটার সময় রিদওয়ান ভাইকে ফোন করেছি যেনো কোনো ভাবে রাফিনের সাথে যোগাযোগ করেন। রাফিনের সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ হচ্ছিলো না , আমি আর এই স্ট্রেস নিতে পারছিলাম না। কোথায় যাবো কি করবো, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাচ্চাটাকে এবোর্ট করবো। কিন্তু রিদওয়ান ভাই সেটা হতে দিলেন না। কারণ বাচ্চাটা নাকি আমার একার নয়; আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছি, আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হবে বাচ্চার বাবা কে আমি কি বলবো? উনি তখন বলেছিলেন সে আর তুই নাকি আমার বাচ্চাকে দত্তক নিবেন। বিশ্বাস কর নূর, আমার কোনো ইচ্ছে নেই তোদের সম্পর্কে তৃতীয় পার্সন হবার। আমি হয়তো তোকে বলতে পারতাম। রিদওয়ান ভাই ও তোকে বলতে পারতো। কিন্তু শুধুমাত্র রাফিনের জন্য রিদওয়ান ভাই কখনো কাউকে বলেও নি সে আমাকে চিনে। কারণ কিভাবে চিনে সেটার ব্যাখ্যা সে দিতে পারবে না। সে রাফিনকে কথা দিয়েছে। ইভেন আমাদের বিয়ের কথাটা এই তিনজন কাউকেই বলে নি, নিজেদের পরিবারের কাউকেও না। কারণ এটা একবার কেউ জানতে পারলে রাফিনের চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। তুই যখন রিদওয়ান ভাইকে বারবার আমাদের সম্পর্কের কথা বলছিলি, তখন আমি বলেছি সে যেনো তোকে সব বলে দেয়, সে আমাকে একটা কথাই বলেছে রাফিনের সাথে একবার যোগাযোগ হলেই সে তোকে সব বলে দিবে। রিদওয়ান ভাই এর কোনো দোষ নেই নূর। আমি আর পারছিলাম না, চোখের সামনে তোর আর ভাইয়ার সম্পর্কটা ভাঙতে দেখতে পারছিলাম না। তাই আমি তোকে সব খুলে বললাম। রিদওয়ান ভাইয়া সত্যি তোকে ছাড়া কষ্ট পাচ্ছে। নারী মানেই যেমন অর্থলোভী নয়, অনুরূপ পুরুষ মানেই প্রতারক নয়”

পারমীতা কন্ঠ কাঁপছে। শব্দগুলো আটকে আসছে গলায়। দলা পাঁকিয়ে কান্না পাচ্ছে, চোখ ছলছল করছে। কান্না খুব ছোয়াছুয়ি রোগ, তাইতো নুরের ও চোখ জ্বলছে। পারমিতার জন্য তার কষ্ট লাগছে। লাগবে, এটা খুব স্বাভাবিক। মেয়েটির তো দোষ নেই, সে শুধু ভরসা করেছে। ভালোবেসেছে। ভালোবাসা ব্যাধিটাই সাংঘাতিক। একবার এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে জীবনের দিক বদলে যায়। মানুষ পাগলামি করে, তার প্রমাণ পারমীতা। নুর নিপুন ভাবে তার চোখ মুছে নিলো। জড়তা ঝেড়ে বললো,
“বুঝলাম, তোদের কোনো দোষ নেই। পরিস্থিতি তোদের একটা কঠিন খেলার সামনে এনে দিয়েছে। কিন্তু আমাকে ও বাড়ি যাবার জন্য রিকুয়েস্টটা করবি না পারমীতা। আমার আবদার এটা। আমি ও বাড়ি ফিরছি না”
“কিন্তু”
“কোনো কিন্তু না, পারমীতা আমি একটা মেয়ে হয়তো তোর জায়গায় থাকলে আমিও একই কাজ করতাম। নিজের স্বামীর কথা ভেবে আমি হয়তো লুকিয়ে যেতাম। কিন্তু রিদওয়ান আর আমি স্বামী স্ত্রী। হ্যা, হয়তো ওর বন্ধু ওর বহু পুরোনো বন্ধু। ওদের বন্ধুত্ব আঠারো বছরের। মানছি। কিন্তু সম্পর্কগুলো না খুব নমনীয়। প্রতিটা সম্পর্কের একটা আলাদা জায়গা আছে। আমি কি করতাম বলতো, মানছি আমি সন্দেহপ্রবণ, কিন্তু আমি তো তাই বিশ্বাস করবো যা দেখবো। আমি খুব বাজে বিহেভ করেছি তোর সাথে মানছি। কিন্তু কেনো করেছি? কারণ আমার ভয় হচ্ছিলো। রিদওয়ানকে হারানোর ভয়। আমি ওকে জিজ্ঞেস ও করেছি। কিন্তু ও সময়ের কথা বলেছে। কিন্তু আমি তো আমার মস্তিষ্ককে শান্ত করতে পারছিলাম না। পুড়ছিলাম ভেতর থেকে। আজ যদি তোর ভাই আমার সামনে এসে এই কথা গুলো বলতো তাহলে হয়তো আমার অভিমানটা ভেঙ্গে যেতো। ওকে বুঝতে হবে কোন সম্পর্কটা কেমন। এতোকাল ব্যাচেলর ছিলো তাই সেভাবেই এখনো জীবন কাটাবে এটা তো সম্ভব না। সম্পর্কের মূল্য ওকে বুঝতে হবে। বিশ্বাস ভালো কিন্তু আমি অন্ধবিশ্বাস করতে পারবো না। আমি তো মানুষ, আমার ও সন্দেহ হয়। ও আমাকে ঠকাইয় নি কিন্তু কথাতো লুকিয়েছে। তাই ওকে শাস্তি পেতে হবে। তাই ও বাড়ি আমি যাচ্ছি না। হারানোর ভয়টা কি, সেটা ওরও একটু বোঝা উচিত। একটা স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক হবে স্বচ্ছ, এখানে কোনো লুকোচুরির জায়গা নেই”

পারমীতা চুপ করে থাকলো। তার হাতে যা ছিলো সে করেছে। এখন রিদওয়ানের পালা নূরের মান ভাঙ্গানোর। নূর উঠে দাঁড়ালো। পারমীতাকে উবারে উঠিয়ে দিলো সে। আকাশে মেঘ করেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। ভিজে যাবে পিচের রাস্তা, ধূলোগুলো ধুয়ে যাবে। এমন যদি উপায় থাকতো, মনের আক্ষেপ, রাগ, অভিমান, কষ্ট, বিষাদগুলো ধুয়ে যেতো। কতই না ভাল হতো। ইট পাথরের শহরের মতো মনের শহরেও শীতল পরশ বয়ে যেতো__________

পারমীতা বাসায় পৌছায় সন্ধ্যায়। উবারের মধ্যে শরীর গুলিয়ে এসেছিলো তার। মা হওয়াটা কতোটা কষ্টের হারে হারে টের পাচ্ছে পারমীতা। বাচ্চাটার অবস্থা ভালো নয়। চিন্তা, উত্তেজনা তার বাচ্চার উপর ও প্রভাব ফেলছে। ডাক্তার বলেছেন হাসিখুশি থাকতে। কিন্তু হাসিখুশি কি সত্যি থাকা যায় এই সময়? যে পরিস্থিতিতে সে রয়েছে তাতে কি সত্যি খুশি থাকাটা সম্ভব, উত্তর জানা নেই পারমীতার। মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু ওই যে আত্নহত্যা মহাপাপ। তাই আটকে যায় বারবার। নূর তো রিদওয়ানকে প্রশ্ন করতে পারছে, সে তো সেটাও করার উপায় পাচ্ছে না। আচ্ছা, ভালোবাসা বা বিশ্বাস করাটা কি অপরাধ?

ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বাসায় ঢোকে পারমীতা। ঢুকতেই পা আটকে যায় তার। বসার ঘরে তিনটে মানুষ বসে আছে। একজন উনত্রিশ বছরের পুরুষ এবং পঞ্চাশোর্ধ এক দম্পতি। পারমীতা সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার নড়ার শক্তিটুকু নেই, পারমীতাকে দেখেই পুরুষটি এগিয়ে এলো তার দিকে। সেই সুদর্শন পুরুষ, যার প্রেমে একটি আঠারো বছরের কিশোরী ভেসেছিলো আবেগে। বিয়ে নামক সত্যিটা গোপন করে রেখেছিলো এই সাতটি বছর। মিহি কন্ঠে পুরুষটি বললো,
“পারমীতা”

এই নামটি বিগত দেড়মাস যাবৎ শুনে নি পারমীতা। একরাশ অভিমান ভর করলো, কালো নয়নে। বাক্যবিহীন চলে গেলো নিজ রুমে। রাফিনও পেছন পেছন ছুটলো। কোনোমতে ঠেলে ঢুকে পারমীতার ঘরে। পারমীতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তার দম আটকে আসছে। দু মাস পর রাফিন ফিরেছে। এই কদিন কতোটা মানসিক যন্ত্রনাতে ছিলো পারমীতা সেটা শুধু সেই জানে। রাফিন কাতর কন্ঠে বললো,
“পারমীতা আমার কথাটা শুনো?”
“শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না”

ঠান্ডা কন্ঠে কথাটা বলে পারমীতা, রাফিন তবুও এগিয়ে যায়। নিজের বউ এর মান যে তার ভাঙ্গাতে হবে। পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। জোর করে তার দিকে ফেরায় পারমীতাকে। আবেগপ্রবন কন্ঠে বলে,
“প্লিজ, পারমীতা। জানি তোমার অভিমান হয়েছে। কিন্তু আমি সত্যি অপারগ ছিলাম। গত পরশু আমার সাথে রিদওয়ান যোগাযোগ করে। আমি তখন ই টিকিট কাটি। এই দেড়টা মাস আমার কাছে ফোনটাও ছিলো না। আমি সত্যি জানতাম না। পারো, লক্ষিটি আমার দিকে একটু তাকাও”

পারমীতার চোখ আজ বাঁধ মানছে না। হু হু করে উঠে সে। জড়ানো স্বরে বলে,
“কোথায় ছিলে তুমি? জানো কতোটা অসহায় হয়ে গিয়েছিলাম। কেউ ছিলো না আমার পাশে। শুধু রিদওয়ান ভাই। আমাকে সাহায্য করতে যেয়ে তার সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু তোমার কথা রাখতে। আর এদিকে তুমি নিরুদ্দেশ”
“সরি, সরি পারমীতা। আমি নিজেই যাবো ভাবীর কাছে ক্ষমা চাইতে। আমার জন্য তোমরা এতো কষ্ট পেয়েছো। সরি”

পারমীতা কাঁদছে, ভিজে যাচ্ছে রাফিনের সাদা শার্ট। কিন্তু সে আকড়ে রয়েছে তার বউ কে। তার জীবনের সেই নারীকে যাকে সাতবছর বাদে আরোও একবার বিয়ে করবে সে। এখন আর লুকোচুরি নেই; না নিজেদের মাঝে, না সমাজের সামনে____________

পরদিন,
পড়ন্ত বিকেলে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে নূর। কিন্তু রিক্সার যেকোনো আকাল পড়েছে ঢাকা শহরে। এর মাঝেই ঝুম ঝুম করে বৃষ্টি নামলো পিচের রাস্তায়। এক পশলা বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে গেলো নূর। এখন হুট হাট এক পশলা বৃষ্টি হয় তাও প্রবল ধারায়। নূর বের হবার সময় ছাতা নিতে ভুলে গিয়েছিলো। হাতের ব্যাগটা দিয়ে মাথা ঢাকতে যাবে, খেয়াল করলো বৃষ্টি থেমে গেছে। অবাক নয়নে তাকাতেই দেখলো কেউ একটা লাল ছাতিও তার মাথায় ধরে আছে। লাল ছাতি দেখেই বুকটা ধক করে উঠলো। রিদওয়ানের সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো সেদিন এমন ই একটা ছাতি হাতে সে অপেক্ষা করছিলো নূরের। নূর পাশে তাকাতেই দেখলো রিদওয়ান ছাতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিনের দৃশ্যটা যেনো জীবন্ত মনে হলো। রিদওয়ান বিগত দুদিন বহুবার ফোন দিয়েছে, কিন্তু নূর ধরে নি। অভিমানে তাকে ব্লক করে দিয়েছিলো। দু সপ্তাহে যে লোক মাত্র পাঁচবার ফোন দেয় তার হুট করে আদিক্ষেতা ভালো লাগে নি নূরের। লোক তাও থেমে থাকে নি, তার মাকে বুহুবার ফোন দিয়েছে। যেনো একটিবার নূর তার সাথে কথা বলে। কিন্তু নূর কথা বলে নি। ভেবেছিলো হয়তো তার অভিমানে ভাঙ্গাতে রিদওয়ান নিজে আসবে। এবং আজ সত্যি রিদওয়ান এসেছে। মনে মনে তো ঠিক করে রেখেছে রিদওয়ান এলেও সে ফিরে যাবে না। কিছুদিন তাকেও কষ্ট দিবে। কষ্ট পেতে কেমন লাগে সেটা তো জানা উচিত। হারানোর ভয়টা কেমন তা তো জানা উচিত। নিজের বোকামীর জন্য সে নূর এবং তার উভয়কে কতোটা কষ্ট দিয়েছে। রিদওয়ানকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলো সে, বৃষ্টির মধ্যে হাটা শুরু করলে হাত টেনে ধরে রিদওয়ান। আকুল কন্ঠে বলে,
“আমার এক্সপ্লেনেশনটা তো শুনো, এরপর যদি তোমার মনে হয় আমার দোষ তাহলে চলে যেও।“
“কেনো সময় চলে এসেছে নাকি?”

ঘুরেই শান্ত কন্ঠে কথাটা বলে নূর। রিদওয়ান এগিয়ে বলে,
“বিশ্বাস করো আমি কখনো তোমাকে ঠকাই নি”
“লুকিয়েছো তো? সেটা কি ঠকানো নয়?”
“তুমি যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নিবো, কিন্তু তবুও আমার কথাটা তো শুনো।“
“শুনে কি হবে বলো তো রিদওয়ান? আমাকে পারমীতা সব বলেছে। তুমি রাফিনকে কথা দিয়েছো তাই আমাকে বলোনি, আচ্ছা আমি কি এতো ইনসেন্সিটিভ? আমাকে বন্ধু ভেবেই তুমি বলতে। রিদওয়ান, স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা স্বচ্ছ হতে হয়। এতে লুকোচুরি মানেই সন্দেহের বীজ বোনা। আজ একই জিনিসটা আমি করলে তুমি কি করতে? সন্দেহ করতে না? হ্যা আমি মানছি আমার তোমার কথা শোনার পর তোমার উপর বিশ্বাস রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু বিশ্বাস তো মুখের কথা নয়, আমাদের সম্পর্কটা যেভাবে থেমে ছিলো তাতে কি আমার মনে সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক নয়? বলো”
“নূর, সেই মূহুর্তে তোমার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার মতো কোনো ওয়ে আমার কাছে ছিলো না। আমি ভেবেছিলাম রাফিনের সাথে যোগাযোগ হলেই আমি তোমাকে সব জানিয়ে দিবো। এখন রাফিন দেশে এসেছে, আমি চাইলেই তোমার সাথে তার কথা বলিয়ে দিতে পারবো। আমার আর পারমীতার মাঝে যে কোনো সম্পর্ক নেই সেটার প্রমাণ বা সাক্ষী যাই বলো না কেনো তাই রাফিন। আমি বুঝতে পারছিলাম না, আমি কিভাবে তোমাকে সত্যিটা বলবো, তুমি আদৌ বুঝবে কিনা, তুমি বিশ্বাস করবে কি না। যেখানে রাফিনকে আমার অবিবাহিত বন্ধু হিসেবে আমি দু মাস আগেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে সেখানে এই সত্যিটা আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো সেটাই বুঝতে পারছিলাম না। একেই আমাদের সম্পর্কটা একটা এমন জায়গায় ছিলো যেখানে আমরা একসাথে তো ছিলাম কিন্তু একে অপরের ছিলাম না। অবশ্য এখানে দোষটা আমার। আমি সময় নিতে চাচ্ছিলাম। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের আগে আমি নিজেদের মাঝে একটা বন্ধুত্ব, বিশ্বাস তৈরি করতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখো, আমার বোকামির জন্য সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো।“

রিদওয়ানের কথা যৌক্তিক, সন্দেহ জিনিসটা এতোটাই জটিল যে তা মানুষের বিশ্বাসকে কাঁচের মতো পাতলা করে দেয়। তাই তো সেদিন মাথা গরম করে রাস্তায় যা তা বলে দিয়েছিলো সে পারমীতাকে। রিদওয়ান নূরের হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“আমি জানি, আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। তুমি যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নিবো। শুধু এবারের মতো আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কখনো আমি তোমার থেকে কিচ্ছু লুকাবো না। কোনো লুকোচুরি রাখবো না আমাদের ভেতর। প্লিজ আমাকে ক্ষমা দাও। তুমি যদি বলো আমি কান ধরে উঠবস করতেও রাজি। প্লিজ বাড়ি চলো। তুমি বাদে বাড়িটা খা খা করে। খুব কষ্ট হয়, অজান্তেই যে ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়।”

রিদওয়ানের কথায় হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় নূরের। এতোদিনের অপেক্ষার প্রহর যেনো আজ শেষ হলো। এতোদিনের ক্লান্ত কানজোড়া যেনো মধুর কথাটা শুনতে পেলো। হাজারো অনুভূত মনের কোনায় রংধনু আকে৷ বরফ শীতল অভিমান গলতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিহি স্বরে বলে,
“বেশ, ক্ষমা করলাম। কিন্তু এটাই প্রথম, এটাই শেষ। এর পর কিন্তু আর ক্ষমা হবে না”

নূরের কথাটা শুনেই জড়িয়ে ধরলো তাকে রিদওয়ান। এতদিন বাদে তৃষ্ণার্ত বুকটা যেনো তৃপ্তি পেলো। খরা বুকে একপশলা বৃষ্টি নামলো শান্তি রুপে। নূরের অভিমানের বরফকুন্ড যেনো গলে গেলো রিদওয়ানের উষ্ণ পরশে। মাঝে মাঝে আমরা সত্যি বুঝিনা সামনের মানুষটিকে। আশেপাশের বিরুপ পরিবেশ আমাদের নিবৃত্ত হৃদইয়ে নানা সন্দেহের বীজ বুনে। সন্দেহটা প্রবল হয় যখন সামনের মানুষটি কথা লুকিয়ে যায়। যেমনটা হয়েছিলো রিদওয়ান এবং নূরের ক্ষেত্রে। রিদওয়ানের লুকোচুরি এবং নূরের সন্দেহ তাদের সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যেকোনো সম্পর্কই খুব নমনীয় হয়, লুকোচুরি সে নমনীয় সম্পর্কে ফাটল তৈরি করে। সন্দেহ সেই ফাটলকে দৃঢ় করে। এই প্রতিকূলতাকে হার মানাবার একটাই উপায় তা হলো, স্বচ্ছতা। সম্পর্ক যত স্বচ্ছ হয় সেই সম্পর্ক ততো মজবুত হয়। কারন স্বচ্ছতাই সম্পর্কের লাল ছাতি_______

।।সমাপ্ত।।

[আসসালামু আলাইকুম, #লাল_ছাতি গল্পটি আজ শেষ করলাম। অনুগল্প হিসেবে লিখতে চেয়েছিলম তাই পাঁচ পর্বেই শেষ করলাম। কেমন লাগলো কমেন্টে জানাবেন। ইনশাআল্লাহ বড় গল্প নিয়ে আগামী শুক্রবার ফিরবো। রিচেক করার সময় পাই নি, তাই দয়া করে লেখার ভূল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দয়া করে কার্টেসি ব্যাতীত কপি করবেন না]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here