বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :১৯

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :১৯

আয়নার সামনে সেহের খুব গভীর মন দিয়ে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছে। কি ভাবছে তার জানার আগ্রহে লিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে।অনেকক্ষণ চেয়ে রইল কিন্তু কোন হাবভাব বুঝতে পারলো না।কোনপ্রকার কূলকিনারা না পেয়ে নীরবতা ভেঙে বলল,”সত্যি সত্যি আজ রাতটা এখানে কাটাবে? ”
সেহের ভ্রু কুঞ্চিত করে একবার লিয়ার দিকে তাকাল।পরক্ষণেই সামনে ফিরে চুলে ব্রাশ চালাতে চালাতে উত্তর দিলো ,”হ্যাঁ তা নয় কি! আমি তোমাকে মিথ্যা বলছি? শুধু আজ কেন এখন থেকে এই ঘরটায়ই থাকবো ”
“আর ভাই? ভাই মানবে! দুদিন হলো বিয়ে হয়েছে এখনি আলাদা হতে চাইছ। ”
“আলাদা হবো কি? আমরা তো আলাদাই।শুনো তোমার ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটা একটা ডিল।তোমার ভাই বিয়েটা শুধু নিজের পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্য করেছে।আর আমি কোন এক চাপে পড়ে।সুতরাং আমাদের এক সাথে থাকার কোন শক্ত কারণ দেখছি না।এক বাড়িতে থাকছি তাই অনেক । ”
“কিন্তু আমার কেন জানো মনে হয় ভাই লাইক’স ইউ”
সেহের ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে উত্তর দেয় ,”তাই? কই আমার তো মনে হয় না।তাছাড়া তুমিই তো বলেছিলে তোমার ভাই অন্য কাউকে ভালোবাসে ।”
লিয়া মাথা নাড়িয়ে ভাবুক স্বরে উত্তর দিলো ,”তাও ঠিক। তো আজ রাত তোমার সাথে তোমার রুমে থাকছি তাই তো? ”
“হুম ,কেন কোন সন্দেহ? ….কাল ভার্সিটিতে যেতে হবে ভাবতেই মাথায় বাড়ি পড়ছে।”
“তা কেন? ”
“বিয়ে! বিয়েটাই নষ্টের মূল।পুরো শহর জানে আমি তোমার ভাইয়ের বউ।ভার্সিটিতে গেলে তোমার ভাইয়ের উপর ক্রাশিত মেয়েরা আমাকে চোখের আগুনে ভস্ম করবে।এতো দিন তাদের পিয়ন সেজে যেই মানুষটাকে চিঠি দিয়েছি শেষমেশ কিনা সেই মানুষটা্র বউ হয়ে গেছি? যাকে এতোদিন ভাইয়া ভাইয়া বলেছি ,এখন তাকে সাইয়া সাইয়া বলবো? ”
“হ্যাঁ বলবে! ”
“আরে লিয়া তোমার গলার স্বর পাল্টাল কি করে? ”
পুরুষালি গলার ভাঁজ পেয়ে সেহের ফিক করে হেসে লিয়ার দিকে ঘাড় ফিরে তাকায়।লিয়া হাত উঁচু করে মুখ শাট অফ দেখিয়ে দরজার দিকে ইশারা করল।ভ্রু কুঞ্চিত করে সেহের দরজার দিকে তাকায়। আরহাম কপাল ভাঁজ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে।ভারী স্বরে বলল ,”রাত হয়েছে ,ঘরে চলো! ”
সেহের শুনেও না শুনার মত মুখ ফিরিয়ে নিলো।বলল,”ঘরেই তো আছি! ”
“আমাদের রুমে চলো ”
“আমাদের নামক কোন রুম নেই যা আছে আলাদা আলাদা । আমার আর আপনার।যার যার তার তার! ”
“তো তুমি যাবে না? ”
সেহের না শোনার ভঙ্গিমা করে মুখ ফিরিয়ে নিলো ।আরহাম বাঁকা হেসে বলল,”ওকে ফাইন, তোমার যা ইচ্ছে তাই হোক ”
এক মুহূর্ত দেরী না করে বড়বড় পা ফেলে সেহেরের মুখোমুখি দাড়ায়।সেহের কিছু বুঝে উঠার আগেই টপ করে কোলে তুলে ঝড়ের গতিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে । লিয়ানা ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে। খানিক পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনা মাথার উপর দিয়ে গেল।

সেহের দাঁত কিড়কিড় করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম তোয়াক্কা না করে নিজের রুমের দিকে বড় বড় পা ফেলছে। সেহের কঠিন গলায় বলল,”এসব কি হচ্ছে ছাড়ুন আমাকে। আমি ঘুমাবো”
“তোমাকে বাঁধা দিয়েছে কে? রুমে গিয়ে ঘুমিও”
“আমি আমার রুমে ঘুমাবো।শুনেছেন আপনি? ”
“এখন থেকে এটাই তোমার রুম”
“নাম মাত্র বিয়েকে এভাবে সিরিয়াসলি নেওয়ার কোন মানে দেখছি না। এটা একটা ডিল! জাস্ট ডিল । ”
“বিয়েটা যেভাবেই হোক! নাও ইউ আর মাই ওয়াইফ ।তোমাকে আমার সাথে- ই থাকতে হবে।সারাদিন ব্যস্ত থাকায় স্পেস দিয়েছি।নিজেকে গুছিয়ে নিতে।বাই দ্যা ওয়ে কাল থেকে সামনের ঘরটায় তালা ঝুলবে।”
সেহের অগ্নি দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই চুপ করিয়ে আরহাম বলে উঠে,”ডোন্ট ওয়ারী! তোমার সকল প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র টাইমলি শিফট হয়ে যাবে। ”
সেহের গাল ফুলিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।আরহাম সেহেরকে বিছানায় ধপ করে ফেলে দরজা দিকে পা বাড়ায়।সেহের ব্যথাতুর স্বরে চিৎকার করে বলে,”মারবেন যেহেতু একবারেই মেরে ফেলুন । এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মারছেন কেন? আহ আমার কোমড় । ”
আরহাম দরজা লক করে সেহেরের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে ,”জানে মারবো কে বলেছে? শুনো মেয়ে তোমাকে বিষে মারবো না , তিলে তিলে মধুতে আহত করবো! ”
সেহের ভেংচি কেটে ব্যথাতুর সুর টেনে কোমড়ে হাত বুলাতে থাকে।আরহাম সেহেরের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,”দেখি কোথায় লেগেছে! ”
সেহের সরে যেয়ে বাজখাঁই আওয়াজে বলল,”ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়ে সোহাগ দেখানোর প্রয়োজন নেই! দূরে সরুন । ”
আরহাম মানল না। উল্টো জোর করে সেহেরকে নিজের কাছে টানল।বিছানায় শক্ত ভাবে উপুড় করে শুয়িয়ে কোমরে বাম লাগিয়ে মালিশ করে দিচ্ছে। সেহের রাগে লজ্জায় উঠতে চাইলো কিন্তু আরহামের শক্ত আওয়াজ ,”ব্যাথা যেহেতু আমি দিয়েছি তা নিবারণ আমি- ই করবো ”
আরহামের জিদের সাথে না পেড়ে সেহের মুখ ফুলিয়ে শুয়ে থাকে।রাত ধীরে ধীরে গভীর হচ্ছে।অন্ধকার ঘনিয়ে।খোলা জানালা মাড়িয়ে শীতল হাওয়া আসছে।সেহের আবেশে চোখ বুঝে আছে।আরহামের স্পর্শ গুলো গায়ে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।আদুরে স্পর্শ গুলো শরীরকে ছুঁয়ে মনকে স্নিগ্ধ করছে।মাথাটাও ভনভন করছে।কেমন জানো নেশা নেশা! এটাকেই বুঝি প্রেমে মাতাল হওয়া বলে? সেহের ভাবল!
সেহেরের ধ্যান ফিরতেই তড়িঘড়ি করে উঠে বসে। ভেসে চলা মেঘ থেকে ধপাস করে মাটিতে।নিজের মনে এলোমেলো অগোছালো ভাবনার প্রতি আফসোস ,লজ্জা হলো।সে এসব কি ভাবছে? যেই মানুষটার জন্য এতো কিছু ঘটলো তার প্রতি দুর্বল হচ্ছে? মনের নিকৃষ্ট চিন্তাধারার প্রতি দয়া হলো ।নিজেকে সামলে শাড়ী ঠিক করতে করতে দূরে সরে বলল,”ছুঁবেন না আমাকে। আপনার স্পর্শ আমার অসহ্য লাগে। ”
আরহাম সেহেরকে কাছে টেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”লাগুক! হাজার বার ছুঁবো আর তোমাকেও সহ্য করতে হবে।”
সেহের হিংস্র সিংহীর মত আরহামের দিকে তাকিয়ে।আরহাম সেহেরের চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বলে,”আজ অবধি আমার দিকে এভাবে তাকানোর সাহস কেউ করেনি ”
“করেনি ,কারণ আপনি কাউকে সে সাহস আজ অবধি দেননি তাই”
“তোমাকে দিয়েছি নিশ্চয় এর পেছনে বিশেষ কোন কারণ আছে।”
আরহাম থামল । সেহের চোখ উঠিয়ে ডাগর ডাগর চোখ করে আরহামের দিকে তাকিয়ে।আরহাম আগের মত একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভারী স্বরে বলল” কজ ইউ আর ভেরী ভেরী স্পেশাল ফর মি! ”
মুহূতেই সেহেরের সব রাগ জেদ মাটিতে পড়ল। বুকটা ধুক করে উঠল।কেন এমন হচ্ছে? আরহামের কথায় তার উপর কেন এতোটা প্রভাব ফেলে? কেন?

গভীর রাত।ঘড়ির কাটা গড়িয়ে তিনের দিক।সেহেরের ঘুম ভাঙে পুরুষালি কান্নার আওয়াজে।নিভু নিভু ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসে।অন্ধকার ঘরটায় ড্রিম লাইটের আবছা আলো।ধীরেধীরে কান্নার আওয়াজটা প্রখর হয়। সেহেরের চোখ থেকে ঘুম ছুটে।খেয়াল করে শোনে আওয়াজটা তার পাশ থেকে আসছে।তবে কি আরহাম কান্না করছে? সেহের দ্রুত ল্যাম্প অন করে।আরহাম বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে আর মুখে কিছু একটা বিরবির করছে।সেহের ভয় পেল। আরহামকে কয়েকবার ডাকল কিছু কোন পরিবর্তন হলো না।আরহাম প্রচণ্ড ঘামছে।শরীর থর থর করে কাঁপছে।সেহের উপায় না পেয়ে আরহামের দিক ঝুঁকল। শোনার চেষ্টা করল আরহাম কি বলতে চাইছে ।আরহাম থেমে থেমে ভীতু স্বরে বলছে,”ওরা মাকে মেরে ফেলবে ….. রক্ত ,আগুন…. মা ….বাবা ….”
সেহের আরহামের কথা আগাগোড়া বুঝল না।ধীরেধীরে আরহাম হাইপার হচ্ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলছে। গলার নীচু স্বর চিৎকারে পরিণত হচ্ছে।সেহের ভীষণ ভয় পেল।কোন উপায় না পেয়ে আরহামকে জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে ডাকল।
“আরহাম ,চোখ খুলুন এখানে কেউ নেই ,আরহাম!!!! ”
আরহাম চট করে চোখ খুলল।তড়াক করে উঠে বসে বড় বড় শ্বাস ফেলল। কপাল মুখ পুরো শরীর ঘামে একাকার। সেহের দ্রুত গ্লাস ভর্তি পানিটা আরহামের হাতে দিলো । আরহাম অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। কিন্তু শরীর তখনো থরথর কাঁপছে।সেহের আরহামের সামনে বসে আরহামের হাতে হত রেখে বলল,”আপনি ঠিক আছেন? ”
আরহাম চোখের ইশারায় হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো ।সেহের আবার নরম স্বরে বলল,”কেউ নেই।রিলাক্স! দুঃস্বপ্ন ছিল। ”
আরহাম উত্তর দিলো না।সেহের অনুভব করল আরহামের হাত তখনো কাঁপছে । ভাবনাহীন সেহের কোনকিছু না ভেবে নিজে থেকে আরহামকে গভীর ভাবে জড়িয়ে ধরে।আরহাম আবেশে চোখ বুঝে নেয়।সেহেরের গায়ের ঘ্রাণ টেনে মনকে শান্ত করার চেষ্টা করে । সেহের পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বলে,”এখানে আমরা ছাড়া অন্য কেউ নেই ”
বেশকিছুক্ষণ দু’জন এভাবে জড়িয়ে থাকে।সেহের ছুটে যেতে চাইলে । আরহাম আবার সেহেরকে জড়িয়ে ধরে কাতর স্বরে আবদার করে ,”এভাবে পুরোটা রাত কাটিয়ে দিলে হয় না? প্লিজ! ”
সেহেরের মায়া হলো । ভীষণ মায়া।পাশে শুয়ে গভীর ভাবে আরহামকে জড়িয়ে ধরলো।চাদরটা গায়ে টানল।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল । একই চাদরের নিচে দুজন রাত কাটাল। ভালোবাসা প্রেমময় মুহূর্ত তৈরি করে, কিন্তু কিছু কিছু পরিস্থিতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে!!!

চলবে….❣️

প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন । ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here