লীলাবালি🌺 পর্ব-৩১

0
1314

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩১
আফনান লারা
.
সকাল হবার পর কুসুম চুপিচুপি বালিশটা আগের জায়গায় রেখে এসেছিল নাহলে অর্ণবের বাবা আবার ওকে ঝাড়তেন এ কারণে।অর্ণব তখনও ঘুমাচ্ছিল।বালিশটা রেখে সে অর্ণবের কাছাকাছি বসে হাত দিয়ে ওর কপালের উপর থেকে ছোটচুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো।মন চায় এভাবেই ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ে থাকতে।
-‘আচ্ছা উনি সবসময় পাঞ্জাবি কেনো পরেন?যদিও তাকে পাঞ্জাবিতে অনেক ভালো লাগে।’

মা অর্ণবকে দেখতে এসে দেখলেন কুসুম হাঁটু গেড়ে বসে গভীর মনযোগে অর্ণবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে
বাবাকে ফিসফিস করে ডেকে দেখালেন দৃশ্যটা।

-‘দেখলে কত সুন্দর করে দেখছে আমাদের ছেলেটাকে।কত ভালোবাসে ওকে।আমাদের ছেলেটা সেটা বুঝতে চায়না’

-“বুঝবে একদিন।সেদিন না জানি দেরি হয়ে যায়’

অর্ণব জেগে গেলে ওকে দেখে বকা দেবে সে ভয়ে নিঃশব্দে চলে আসলো কুসুম ওখান থেকে।অর্ণব ঘুম থেকে ওঠার পর যখন চুপচাপ নাস্তা করছিল বাবা তখন টিভিতে সময় সংবাদ দেখছিলেন।সুযোগ পেয়ে অর্ণব বলে ফেললো সে আজ ঢাকায় ফিরে যাবে।রেজাল্ট প্লাস চাকরি আছে ওখানে।ঈদের ছুটিতে এসেছিল সে।
বাবা টিভিতে চোখ রাখা অবস্থায় উত্তর দিলেন যেতে পারে।
অর্ণব তো মহাখুশি হলো।কিন্তু তার খুশিতে পানি ঢেলে দিলো বাবার বলা দ্বিতীয় লাইন।বাবা বললেন কুসুমকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে।

-“ওকে নেওয়া যাবেনা।’

বাবা এবার মাথা ঘুরালেন।গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন কেন নেওয়া যাবেনা।

-‘আমি থাকি মেসে।সেখানে ও কি করে থাকবে?আলাদা বাসা নিতে হলে আমায় আলাদা চাকরি খুঁজতে হবে।আলাদা বাড়িতে ভাড়া অনেক বেশি।তাছাড়া ও এখনও ছোট।কোনো কিছু বোঝেনা।একা কি করে থাকবে?কাজের কারণে আমি থাকবো সারাদিন বাহিরে।ও একা একা কি করে দিন কাটাবে?’

বাবা টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।পাঞ্জাবি টেনেটুনে ঠিক করে সোজা হয়ে বললেন,’কুসুমকে না নেওয়ার হাজারটা কারণ দেখালে।এবার ওকে নেওয়ার একটা কারণ আমি তোমায় দেখাই।ও তোমার স্ত্রী।বিয়ে হয়েছে পরশু।ওকে তুমি সাথে করে নিয়ে যাবে যেখানে যাবে সেখানেই।’

অর্ণব বাবার পেঁচে পড়ে বললো,’আচ্ছা আমি নতুন বাসায় উঠলে নিয়ে যাবো’

-‘আমার টাকার অভাব?দরকার হলে তোর বাসা ভাড়ার টাকা আমি দেবো।’

-‘আমি ওকে এখন নিচ্ছিনা মানে নিচ্ছিনা।আমার এখন অনেক ব্যস্ততা।তোমরা কি চাও ও একা থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ুক?আমি সারাদিন বাহিরে থাকি।বাসায় রাতের দশটা ছাড়া ফেরা হবেনা আমার কোনোদিন।তাহলে ও একা একটা মেয়ে কি করে থাকবে একটা বাসায়?’

বাবা আর কিছু বললেননা।চলে গেছেন।অর্ণব রুমে আসলো ব্যাগ গুছাবে বলে।দেখলো কুসুম আগে থেকে সব গুছিয়ে রেখেছে।সব পরিপাটি করে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে এখন সে।
অর্ণব ব্যাগটা নিয়ে বললো,’আসি’

কথাটা বলে সে চলে যাওয়া ধরতেই কুসুম এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো সেসময়ে।ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে।মুখ দিয়ে কিছু বলতেও পারছেনা।অর্ণব ওর চোখের দিকে তাকালোনা।মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে রেখেছে।কুসুম হাত বাড়িয়ে অর্ণবের পাঞ্জাবির বোতামগুলো ঠিক করে লাগিয়ে দিতে দিতে বললো,’আপনি বাসা কবে নিবেন?’

উত্তরে অর্ণব কিছু বললোনা।বোতাম লাগানো শেষে কুসুম শুধু শুধু বোতামে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।অর্ণব কুসুমের হাতটাকে বুক থেকে সরিয়ে পাশ কেটে চলে গেলো।এরপর আম্মাকে জড়িয়ে ধরে মিশু ভাবীর দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে চলে গেলো সে।কুসুম পিছু পিছু অনেকটা পথ ছুটে গেলো। অর্ণব বুঝতে পেরে থেমে পেছনে তাকালো।

-‘আমি সারাদিন একা থেকে রাত দশটায় আপনার মুখ দেখলেও একাকিত্ব ভুলে যাবো।আমাকে নিয়ে যাবেন?’

-‘যাও,বাড়ি ফিরে যাও! টইটই করে ঘুরাফিরা করবেনা।যাও বলছি!’

কুসুম অর্ণবের ধমক শুনে চোখ মুছতে মুছতে দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির দিকে।
অর্ণবের খারাপ লাগলো।কিন্তু যাকে দুদিন সহ্য করতে ঘুম চলে গিয়েছিল তাকে দিনের পর দিন কি করে সহ্য করা যেতো?
বাসের টিকেট কাউন্টারে এসে টিকিট কেটে উইন্ডো সিট দেখে বসলো অর্ণব।
কুসুমের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া ভাসছে তার চোখের সামনে।এই মেয়েটা অনেক অল্পতে কষ্ট পায়।
ভাল হয়েছে রেখে এসেছি তা নাহলে আমার সাথে থেকে প্রতিদিন কষ্ট পেতো।

ফোন বন্ধ করে রেখেছে অর্ণব। সে যে ঢাকায় ফিরছে এ কথা কাউকে জানায়নি।
কুমিল্লা আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেলো।মেসে ফিরে ফোন অন করেছে এবার।
অন করার দশ মিনিট পর বেজে উঠলো ফোন।অর্ণব ভাবলো জুথির কল।পেছনে তাকিয়ে ফোনের স্ক্রিনে চেয়ে দেখলো মিশু ভাবীর কল।
সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করলো সে।

-“আসসালামু আলাইকুম’

-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।কুসুম?’

-“পৌঁছে গেছেন?’

-“হ্যাঁ মাত্র’

-“খেয়েছেন কিছু?’

-“না।রাতে খাব।এখন তো বিকেল, এখন কি খাবো?’

-“চা বিসকুট ‘

-“এত এডভাইস দিতে হবেনা।বাই’

-“আচ্ছা আমি আর মিশু ভাবীর ফোন থেকে আপনাকে ফোন দেবোনা’

-‘দিও না।’

-“আপনার বাবা আমাকে একটা ফোন কিনে এনে দিয়েছে।ওটা থেকে ফোন দেবো’

-“এত আদর!!আমাকে ফোন দিয়েছিল ভার্সিটিতে উঠার পর।বাহ রে বাহ!!’

অর্ণব ফোন রেখে পাশে তাকাতেই দেখলো মৃদুল দাঁত কেলিয়ে ওকে দেখছে আর আঙ্গুল ফল খাচ্ছে।খেতে খেতে বললো,’তোর বউ তোরে কত্ত ভালোবাসে।পৌঁছানোর সাথপ সাথে ফোন দিলো।আহা ওমন বউকে রেখে এলি কেন?’

-‘ওকে আনলে আমার আর রাতে ঘুমের স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিতে হতো।যাইহোক,আমি অফিসে যাচ্ছি।এই কদিনে কি অবস্থা হয়েছে দেখে আসতে হবে।’

অর্ণব ব্যাগ রেখে পানি মুখে দিয়ে চললো তার অফিসের দিকে।অফিসে এসে বসতেই একের পর এক এসে শুভেচ্ছা জানানো শুরু করেছে।মানে ওদের খবরটা কে দিলো?

-‘আমি স্যার!”

অর্ণব সামনে তাকিয়ে দেখলো জুথি হাসিমুখে তাকিয়ে আছে।হাতে ফুলের তোড়া।এগিয়ে এসে অর্ণবকে দিয়ে বললো,’আপনার জন্য স্যার’

অর্ণব জুথির এমন ব্যবহার আশা করেনি।ফুলের তোড়াটা একপাশে রেখে বললো,’ভালো আছেন?’

-‘অনেক”

-‘চা খাবেন?বা কফি?’

-‘খাওয়ালে খাই’

অর্ণব একটা ছেলেকে ডাক দিলো কফি আনার জন্য সেসময়ে জুথি বললো,’আগের রেস্টুরেন্টে বসে খেতে সমস্যা? আপনার স্ত্রী রাগ করবে?’

-“না সেটা নয়।আসলে অনেক কাজ তো আমার।তাছাড়া আমি চাইনা আর কখনও আমাদের একজন আরেকজনের দেখা হোক।শুধু শুধু অতীত মনে করে কষ্ট লাগবে।’

জুথি হাসি দিয়ে চলে গেলো।বাহিরে এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে সে।অর্ণব কাগজপত্র ঠিক করে রেখে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।জুথি হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আবারও হাসি দিয়ে তাকালো।অর্ণব জিজ্ঞেস করলো কুমিল্লা থেকে এখানে একা এসেছে নাকি কেউ দিয়ে গেলো।

-‘আমি একাই এসেছি।সমস্যা আর কই?
বাকি জীবনটা তো একাই কাটাতে হবে’

সেসময়ে রিকশা একটা ধরিয়ে দিলো অর্ণব।জুথি সেটাতে গিয়ে বসলো।রিকশা চলে যাবার সময় অর্ণব থামাতে বলে এগিয়ে এসে জুথির বাম হাতটা টেনেনধরলো।হাতটাকে ব্লেড দিয়ে কেটেছে জুথি।এতক্ষণ খেয়াল করেনি সে।যখন জুথি উঠতে গেলো রিকশায় তখন নজরে পড়লো ওর।জুথি হাতটা সরিয়ে নিয়ে বললো,’আসি”

-“এটা কেন করলেন?দাঁড়ান মামা’

অর্ণব জুথির সাথে রিকশায় উঠে পড়লো।জুথির হাতটা টেনে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,’আপনাকে আমি ম্যাচিউর ভাবতাম।কিন্তু না! আপনি তো কুসুমের চেয়েও কম না।বরং ওর চেয়ে বেশি মাত্রার বাচ্চামো করে বসলেন।’

জুথি মুখটা মলিন করে বললো,ওকে এতো মিস করেন?’

অর্ণব কথার উত্তর না দিয়ে একটা ফার্মেসীর দোকানের সামনে থামলো।সেখান থেকে মলম কিনে রিকশায় এসে বসে দেখলো জুথি কাঁদছে।
নিরবে ওর হাতে মলম লাগিয়ে অর্ণব রিকশা থেকে নেমে যাওয়া ধরতেই জুথি হাত ধরে থামিয়ে বললো,’প্লিজ।একটা কফি।আর চাইবোনা’

অর্ণব নামলোনা।বসে থাকলো।জুথি হাতটা ওড়না দিয়ে ঢেকে বললো,’এটা তো বাহিরের ক্ষত।এর চেয়ে বেশি যে কষ্ট পেলাম সেটার মলম কই পাওয়া যাবে?আচ্ছা, আপনাকে বলতে হবেনা।আমি জানি সেটা কই পাওয়া যাবে।সেটা হলেন আপনি।অন্তত ফ্রেন্ড হিসেবে থাকবেন?যেমনটা আগে ছিলাম?’

-‘সেদিন কি বলেছিলেন?আমি যেন আর কখনও আপনার চোখে চোখ না রাখি।কল না রিসিভ করি!আপনি একা সব পারবেন। তাহলে এখন এসব কি?’

-“মুখে বলতে সহজবোধ হলেও তা পালন করতে গিয়ে আজ আমার এই হাল হলো।আচ্ছা আমি কি দোষ করেছিলাম বলতে পারেন?

অর্ণব চুপ করে আছে।জুথি সামনের দিকে ফিরে বললো,”হুম।আম্মু ঠিক বলেছে।যে আমার না,তার কাছাকাছি থাকলে আমার এত কষ্ট হবে যে ঐ মানুষটা যার তার থেকে ছিনিয়ে আনার মনোভাব সৃষ্টি হতে পারে।কিন্তু আমি তো তা চাইনা।আমি এই মাসেই চলে যেতাম আম্মুর কাছে।কিন্তু আমাদের প্রথম ইনকোর্স পরীক্ষা সামনে।যেতে পারছিনা।কি করি!আপনার থেকে দূরে থাকা অভ্যাস ছিল না আমার।পারছিনা।সময় তো দিবেন?’

-‘আমাকে দূর্বল করে দিচ্ছেন আপনি।আমার দিকটা একবারও কেউ ভেবেছে?আমি কিসের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছি??
আমি কত কষ্টে আছি?পুরুষ মানুষ বলে আমি কষ্ট প্রকাশ করতে পারছিনা।ভেতরে ভেতরে বুকটা পুড়ে যায় আমার।
তা কেউ বোঝে?না আপনি বোঝেন আর না কুসুম বোঝে।
সবাই তাদের ব্যাথা অনুভব করে।কেউ আমার ব্যাথা অনুভব করে না, করতেও চায়না।যদি সামর্থ্য থাকতো সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম আমি।আর পারছিনা টানাপোড়নে আটকে থাকতে।শরীর খারাপ হয়ে গেছে আমার এমন বিস্বাদের দুটো দিন যাপন করে।আর কটা দিন এমন ভাবে কাটিয়ে যেতে হবে কে জানে।এর ভেতর আপনি নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন।ভেবেছিলাম আপনি অন্তত আমায় বুঝবেন!’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here