লীলাবালি🌺 পর্ব-৩২

0
1330

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩২
আফনান লারা
.
আগেরবার যে দিনে তারা কফি খেতে এসেছিল আজ ও সেদিন।মঙ্গলবার।
অথচ আগেরবার তাদের মনে যে অনুভূতি ছিল সেটা আজ থাকার পরেও কেমন যেন বিলীয়মান।
ওয়েটার ভুল করে পাশের একটা কাপলের রিলেশনশিপ এ্যানিভার্সারির কেকটা ওদের টেবিলে রেখে চলে গেলো। কেকটাতে লেখা “ভালোবাসা চিরন্তন ‘

জুথি কেকটার দিকে চেয়ে ছিল গভীর মনযোগে।অর্ণব ওয়েটারকে ডেকে কেক নিয়ে যেতে বলে দিয়েছে।এরপর তাদের কফি অর্ডার করে চুপ করে থাকলো আগের মতন জুথি পাশের রোডটার দিকে গ্লাসের উপর দিয়ে চেয়ে থেকে বললো,’এই মেয়েটা সে না যাকে আপনি কখনও বিয়েই করতে চাননি?’

-“হুম’

-‘আর এখন সে আপনার স্ত্রী।ভাগ্যের চাকা কখন ঘোরে আসলে কেউ বলতে পারেনা’

অর্ণবের বড় ভাইয়া বিদেশ থেকে ফিরবে এই মাসেই।ইচ্ছে ছিল ঈদের আগেই আসার কিন্তু দেরি হয়ে গেলো।মিশু ভাবী তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবেন এমন অবস্থা তার।
কুসুম শুধু তার খুশি দেখছে।তিনি সব কাজ সেরে বললেন পার্লারে যাবেন।সাতদিনের কিসের একটা ট্রিটমেন্ট করাবেন এতে করে নাকি গোটা এক মাস স্কিন ভাল থাকে।কুসুম বললো সেও করবে কিন্তু মিশু ভাবী বললেন ওর স্কিন এমনেই সুন্দর।নতুন করে ঘঁষামাজার প্রয়োজন নেই।কুসুমের সারাটা দিন একা লাগলো।মা আর মিশু ভাবী ঘরের কাজ করেন।ওকে রান্নার কাজ করতে দেননা।শুধু ঘরটা গুছাতে দেয়।কিন্তু সেটা তো অল্প সময়ে শেষ হয়ে যায়।টিভি দেখতেও ভাল লাগেনা।শুধু অর্ণবের কথা মাথায় ঘুরপাক খায়।মিশু ভাবীকে বলেছিল ওকে ফোন চালানো শিখিয়ে দিতে কিন্তু ভাইয়া আসবে বলে তিনি মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।কোনোমতে ফোনে টিপাটিপি করে ছবি তুলতে পারলেও কাউকে কল করা শিখলোনা কুসুম।শেষে বাধ্য হয়ে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে।বাবা সানন্দে ওকে ফোনে কল করা শিখিয়ে দিলেন।শুরুতে অনেক কঠিন মনে হলেও পরে শিখে গেলো সে।তারপর অর্ণবের ফোন নাম্বারটাও সেভ করে দিলেন তিনি।ওকে দেখিয়ে বললেন এটাতে টাচ করলে কল যাবে।কুসুম মাথা নাড়িয়ে ছুটে চলে আসলো রুমে।
অর্ণব সবে কফিতে চুমুক দিয়েছিল সেসময়ে আননউন নাম্বার থেকে হঠাৎ কল আসায় কফি রেখে রিসিভ করলো।
-‘আসসালামু আলাইকুম।কে বলছেন?’

-“ওয়ালাইকুম আসসালাম।আমি বলছি’

-“এটা আবার কার নাম্বার?’

-“আমার নিজস্ব।’

-‘এ্যাহ!!যেভাবে বলতেছো যেন সম্পত্তি!!হাহাহা!’

অর্ণবকে কুসুমের সাথে কথা বলতে যেয়ে খিলখিল করে হাসতে দেখে জুথির কষ্ট লাগলো।কফি রেখে চলে গেলো সে।অর্ণব খেয়ালই করলোনা।সে কুসুমের কথা নিয়ে হাসতে হাসতে শেষ।হাসি থামিয়ে বললো,’রাখছি।’

ফোন রেখে সামনে তাকিয়ে জুথিকে না দেখে
ওকে খুঁজতে এদিক ওদিকে চোখ বুলিয়েও কোথাও নজরে আসলোনা।
বুঝে নিলো চলে গেছে।বিল পে করে অর্ণব এবার সোজা মেসে ফিরে আসলো।
সাগর ভাইয়ার আসার কথা সেও জানে।তাকে যে যেতে হবে এটাও জানে।
একদিন থেকে চলে আসবে তাই ভেবে রেখেছে আগে থেকে।বিছানায় বসে চাকরির একটা সাজেশন বই হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলো সে।মৃদুল নেই।আড্ডাতে গেছে।অর্ণবেরও যাওয়ার কথা।কিন্তু গেলেই সবাই বিয়ের কথাটা তুলবে।যেতে ভয় হয় উত্তর দেবার।
দিতে দিতে তিক্ততা এসে গেছে। এক মাস এসব থেকে দূরে থাকলে সবার মন থেকে চলে যাবে অর্ণব বিয়ে করেছে।
বন্ধুদের কথা থেকে বাঁচা অনেক কঠিন তাই আপাতত মন ঠিক হবা অবধি দূরে থাকবে।
ওমা আবার ও কল!সেই নাম্বারটা থেকেই।অর্ণব বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলো।তারপর চুপ করে রইলো।কুসুম বললো,”একটা আছেনা? চেহারা দেখা যায়।ঐ যে মিশু ভাবী বলেন ভাইয়ার সাথে।সেটা কি করে দেয়?আপনার বাবাকে বললাম, বাবাও নাকি জানেনা।’

-“আলহামদুলিল্লাহ্‌। জানতে হবেনা’

-“শিখিয়ে দিননা।আমি দেখবো আপনাকে’

-“তোমার সাহস তো কম না!বাই।আর একবার কল করলে ব্লক করে দেবো।ব্লক মানে কি সেটা বাবাকে জিজ্ঞেস করো গিয়ে।’

অর্ণব লাইনটা কেটে দিলো।কুসুম ফোন রেখে ভাবলো ফোনের সব বাটনে একবার করে টিপে দেখবে।কাজ হলে হবে।নাহলে হবেনা।টিপে দেখতে তো সমস্যা নেই।এমনটা করার পর দেখলো ফোনই বন্ধ হয়ে গেছে।
ওমা অনই হচ্ছেনা।গোটা দিনটা শেষ হয়ে গেলো।
কুসুমের আর কোনো কল না পেয়ে অর্ণব ভাবলো ব্লকের অর্থ জেনে হয়ত ভয় পেয়ে আর কল করেনি।কিন্তু সে তো জানেনা তার বউ ফোন নষ্ট করে বসে আছে। বাবা ফোন নিয়ে বাজারে গেছেন ঠিক করাতে।কুসুম মন খারাপ করে প্রহর গুনছে কখন অর্ণবের সাথে কথা বলতে পারবে আবার।
মা সেসময়ে অর্ণবকে ফোন দিয়েছিলেন।

-‘মা কেমন আছো?’

-“ভাল।সাগর আসবে তো তাই কাজ বেড়ে গেলো।তুই কেমন আছিস?রাতে খেয়েছিস?’

-“হুম।”

মা চুপ করে রইলো।অর্ণব বললো,’কুসুম কোথায়?’

-‘আছে।কথা বলবি?’

-‘না না।এমনি জিজ্ঞেস করলাম।আচ্ছা রাখি ‘

কুসুম ওপাশ থেকে শুনতে পেলো।মনে মনে খুশি হলো অর্ণব ওর কথা জিজ্ঞেস করেছে শুনে।খুশিতে গদগদ হয়ে পেছনে তাকাতেই মিশু ভাবীক দেখে এক ঝটকা খেলো।উনি তো রুপসী হয়ে বাড়ি ফিরেছেন।চোখ ফেরানো যাচ্ছেনা।
সানগ্লাস হটিয়ে বললেন,’কেমন লাগে আমাকে?’

-‘অস্থির! ‘

কুসুমের কথা শুনে ভাবী লজ্জায় লাল হয়ে তার রুমে চলে গেলো।কুসুম তার পিছু পিছু গিয়ে বললো ছবি দেখা যায় সেরকম কল কি করে করে সেটা শিখবে।ভাবী বললেন ইমো একাউন্ট খুলতে হবে।পরে একদিন খুলে দেবেন।
কুসুম তাই মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো রুমে।কাল এই বিছানায় অর্ণব ছিল আর আজ নেই।পুরো রুমটা যেন তার অপেক্ষা করছে।অথচ তিনি আমার কথা জিজ্ঞেস করলেও কথা বলতে চাইলেন না।কি হতো বললে?’

বাবা বাড়িতে এসে কুসুমকে ডেকে বললেন ফোন নিয়ে যেতে।ঠিক করে এনেছেব।কুসুম ছুটে গিয়ে ফোন নিয়ে আসলো।কি যে ভালো লাগছে তার।এবার অর্ণবকে সে ফোন দেবে।বিছানার মাঝখানে গোল হয়ে বসে ফোন টিপে অর্ণবের নাম্বার খুঁজতে লাগলো।বাবা একটা ফুলের ইমুজি দিয়ে সেভ করেছেন যাতে কুসুম জলদি খুঁজতে পারে।

অর্ণবদের মেসের সামনে একটা বাড়ির ছাদে বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে।সেখানে #লীলাবালি গানটা চলছিল।গানটা কানে আসতেই অর্ণবের ঐদিনটার কথা মনে পড়ে গেছে।বই বন্ধ করে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে জানালার পর্দা টেনে দিলো সে।গানটা খুব জোরে শোনা যাচ্ছে।মনে হলো অর্ণব তার চোখের সামনে সেদিনের সম্পূর্ন দৃশটা আবারও দেখছে।মাথা ব্যাথা করছে এবার।মেসে সে একা।মাথা ব্যথা গিয়ে এবার মাথা ঘুরছিল।
ঠিক সেসময়ে ফোন বাজলো।ঘোর থেকে বেরিয়ে ফোনের কাছে এসে দেখলো সেই পরিচিত নাম্বার।স্বাভাবিক হয়ে বসে ফোন কানে ধরলো সে।

-‘ভালো আছেন?’

-“না।বিয়ে হয়েছে বলে আর ভালো নেই।শরীর খারাপ।মনে হয় বেশিদিন বাঁচবোনা’

-“আমি থাকলে মাথায় ঠাণ্ডা তেল মালিশ করে দিতাম,বাতাস করতাম,চা বানিয়ে খাওয়াতাম’

-“তাও তোমায় আমি এখানে আনবোনা’

-“দেখলেন?আমি না থাকলেও আপনার শরীর খারাপ হয়’

অর্ণব চুপ করে রইলো।কুসুম আবার বললো,’কি খেয়েছেন রাতে?’

-‘পাউরুটি কলা।’

-“ওগুলো কি রাতের খাবার নাকি!ভাত খাবেননা?’

-“ওসব বাদ দাও।তুমি ব্লকের মানে জেনেই বুঝি কল করলেনা বিকাল থেকে?’

-“নাহ।আমি আসলে কি যেন ভুল করেছিলাম।ফোন নষ্ট হয়ে গেছিলো পরে আপনার বাবা বাজারে নিয়ে ঠিক করে আনলেন’

-“তোমাকে না বললাম বাঁদরামি করবানা বেশি?ঠিক হয়েছে।ফোন আবার নষ্ট হলে কথা বলা হাওয়া হয়ে যাবে এক্কেরে।’

-‘আপনি আমায় মনে করেছিলেন?আপনি চাচ্ছিলেন আমি আবার ফোন দেই?’

-“একদম না।ব্লক করে দিব।আর ফোন দিবানা।আমাকে আমার কাজে মন দিতে দাও।এভাবে জ্বালালে আমি কাজে মন দিতে পারবোনা’

-‘আমি সকালে,দুপুরে,বিকেলে আর রাতে ফোন দিব।এর বেশি দিবোনা সত্যি।’

-“আর বাকি আছে সময়ের?😒উফ!
আমি এই মেয়েটাকে শাস্তি দিতে পারছিনা কেন?জীবনে কত মেয়েকে ব্লক দিলাম, এরে ব্লক দিতে পারছিনা কেন!’

-‘আচ্ছা আমি ঘুমোই।আপনি ও ঘুমান।এবার নিশ্চয় আপনার ভাল ঘুম হবে?আমি নেই।আছে ভূত!’

-‘কেউ নেই।আমি একা।ভূত বলতে কিছু হয়না।মৃদুল এসে পড়বে এখন।তুমি আমায় ভয় না দেখিয়ে নিজেকে বাঁচাও।আমার রুমটা যে ঠাণ্ডা তার উপর বাগিচা সামনে।ভূত না জানি গ্রিল ভেদ করে এসে তোমার গলা চেপে ধরে।’

কুসুম এক চিৎকার করে উঠলো সঙ্গে সঙ্গে।কল কেটে গেছে।অর্ণব ও ভয় পেয়ে গেছে।কল কাটা গেলো দেখে চিন্তায় পড়ে সে নিজ থেকে কল দিলো কুসুমকে।কুসুম কলটা ধরে বললো,’আমাকে কেন ভয় দেখাচ্ছেন?আপনি তো ছেলে।আপনাকে ভয় দেখালে তো আর আপনি ভয় পাবেননা।কিন্তু আমাকে ভয় দেখালে আমি তো ভয় পাবো।এখন আমার ভয় করছে।কেন ভয় দেখালেন?’

-“বারান্দার পর্দা টেনে ঘুমাও।আইছে আমাকে ভয় দেখাতে।একদম ঠিক হইছে।খুশি হইছি আমি।ভূতদের সাথে বসে বসে আড্ডা দেও এবার।আক্কল হোক তোমার’

কথা শেষ করে অর্ণব দেখলো রাত বারোটা বাজে।আশ্চর্য হয়ে ঘড়ির দিকে দু মিনিট তাকিয়ে রইলো সে।যে মেয়েটাকে দু চোখে দেখতে পারেনা তার সাথে কিনা নব প্রেমিকের মতন রাত জেগে এত সময় ধরে কথা বললো!অবাক করার মতন বিষয় হলো কথার ছলে অর্ণব নিজ থেকেই ফোন করেছে।
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here