লীলাবালি🌺 পর্ব-৩৬

0
1278

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩৬
আফনান লারা
.
কুসুম হাওয়াই মিঠাইটা শেষ দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল যখন সেসময়ে অর্ণব ঘুমাচ্ছিলো।ওর ঘুম যেন না ভাঙ্গে তার কারণে সে রুমে ঢোকেনি।এদিকে সবার রুমের দরজা বন্ধ।কারেন্ট নেই বলে টিভিও দেখা যাবেনা।তাই কুসুম টিভির ক্যাবিনেট থেকে কিছু ম্যাগাজিন বের করে ওগুলো নিয়ে ফ্লোরে গোল হয়ে বসলো।সবগুলোতে মডেলের ছবি আর গাদা গাদা ইংরেজীতে রচনা।কুসুম ওগুলোতে হাত বুলিয়ে ভাবছে যারা পড়াশুনা জানে তারা কতইনা ভাগ্যবান।
পড়াশুনা কত বড় উন্নতিতে আসে যারা জানেনা তারাই বোঝে।
-‘ইশ যদি আমি একটুখানি পড়াশুনা জানতাম তাহলে হয়ত এখন এগুলো পড়তে পারতাম।সুন্দর সুন্দর মেয়েগুলোর পাশে নিশ্চয় তাদের ব্যাপারে কথা লেখা আছে।আচ্ছা আমি কি এখন পড়তে পারবোনা?চাইলে?

-‘হ্যাঁ নিশ্চয় পারবে!’

অর্ণবের বাবার কথা শুনে কুসুম ঘাঁড় ঘোরালো।তিনি বললেন এই মহৎ কাজ একমাত্র অর্ণবই করবে।তার নির্দেশ তিনি দিবেন।অর্ণব ভালো শেখাতে পারে।
এসএসসি পাশের পর অনেক ছাত্রছাত্রী সে পড়িয়েছে।বিশেষ করে বাংলা ব্যাকরণ। কুসুমকে পড়াতে তার বেশি সময় লাগবেনা।কুসুমের মুখে বিশ্ব জয় করবার মতন হাসি প্রথমবার ফুটলেও শেষকক্ষণে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।
বাবা জিজ্ঞেস করলেন কি কারণে সে মুখটা ফ্যাকাসে করে ফেলেছে।
কুসুম জবাব দিলোনা।তার জবাব হয়ত বাবাও জানেন।আর তা হলো অর্ণব ওকে পছন্দ করেনা,পড়ালেখা শেখাতে যাবে কোন দুঃখে?তাছাড়া ও তো এখানেই থাকেনা।
“”””””কত কারণ আছে কুসুমের মন খারাপের।ওর মন খারাপের কারণ হাজারটা থাকলেও, ওর মন ভালো করবার একটা কারণ তিনি খুঁজে পেলেনা না””””””
মেয়েটা কেন এত কষ্ট পাবে?তার কি দোষ?যদি ওকে পছন্দই না করে তাহলে কেন অর্ণব ওকে বিয়েটা করলো?সব গোলকধাঁধার মতন ঘুরপাক খাচ্ছে।
আচ্ছা কুসুম তুমি জানো অর্ণব তোমায় কি কারণে সেদিন এত ব্যস্ত হয়ে বিয়ে করেছিল?’

কুসুম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আমার কারণেই,পুরোটা বাধ্য হয়েই’

বাবা ওর কথার মানে বুঝলেননা।চলে গেছেন বাড়ি থেকে মসজিদের দিকে।
কুসুম ওদের রুমের দরজার কাছে এসে অর্ণবকে দেখছে।বালিশ বুকে জড়িয়ে ঘুমোয় সে।সে কি মায়া তার মুখে।
এই মায়া প্রথম যেদিন সে দেখেছিল সেদিনই বুঝেছিল তার এত বছরের অপেক্ষা সার্থক।
পা টিপে টিপে অর্ণবের কাছে এসে বসে দেখছে এবার।
-‘যখন তিনি আমায় পড়াবেন তখন কতই না ভালো সময় আসবে আমার জন্য।ভাবতেই ভালো লাগা কাজ করে।পড়াতে বসলে না জানি কত ভালে লাগবে।’

এবার ওর চোখ গেলো অর্ণবের হাতের উপরের পশমগুলোর দিকে।আস্তে করে ওগুলোতে হাত লাগাতেই ওর খুব হাসি পেলো।অর্ণবকে না জানিয়ে তার হাতের পশম ধরেছে কেমন একটা লুকোচুরি ভাব চলে এসেছে বলে হাসিটা একটু জোরে আওয়াজ করেই বেরিয়ে গেলো মুখ থেকে।অর্ণব জেগে গেছে ওর হাসির আওয়াজে।কুসুম মুখে হাত দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো।অর্ণব উঠে বসে ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলেও এখনও ঘোর থেকে বের হতে পারেনি সে।
কুসুম এক পা এক পা করে বেরিয়ে যাচ্ছে ওখান থেকে।ঠিক সেসময়ে অর্ণবের ধমক শুনে থেমে গেলো।

-“আমি ঘুমালে সেটা থেকে তুলে দেবার জন্য তোমাকে কেউ টাকা দেয়?ঘুম থেকে হুট করে তোলা একেবারে ভালো অভ্যাস না।এটা আর কোনোদিন যদি করছো তো ধুরুম করে কিল বসিয়ে দেবো পিঠে।আমাকে যতটা সহজসরল মনে করো আমি অতোটাও না।যথেষ্ট রাগ আমার ভেতরে আছে।আর তোমার প্রতি তো আমার মনে সেই শুরু থেকেই রাগের গোডাউন তৈরি হয়ে আছে।’

-“আমি তো আপনাকে সহজসরল ভাবিনা।’

-“সে যাই ভাবো!’

-“কিছুই ভাবিনা’

-“উফ!যাবে এখান থেকে??যাও!আমাকে ঘুমাতে দাও।জেগে থাকলে জ্বালাবে,তারপর ঘুমালে সেখান থেকে উঠিয়ে আবার জ্বালাবে’
—–
কুসুম রান্নাঘরের দিকে গেছে খাওয়ার কিছু আছে কিনা দেখবে বলে।দুপুরে ভাত কম খেয়েছিল বলে খিধে পেয়ে গেছে এখন।
এসময়ে রান্নাঘরে এসে যে দৃশ্য সে দেখলো তাতে মাথা ঘুরে গেছে।
সাগর সরে দাঁড়ালো,মিশু ও মুখ ঘুরে অন্যদিকে ফিরে গেছে।কুসুম ওখান থেকে ছুটলো রুমের দিকে।অর্ণব সবেমাত্র বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িছিল অজু করে নামাজ পড়তে যাবে বলে।কুসুম ছুটে এসে রুমে ঢুকতেই ওর সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে গেলো।
অর্ণবের মনে হলো গলার নিচের হাঁড়টা মনে হয় ভেঙ্গে দু টুকরে হয়ে গেছে।গলা মুছতে মুছতে কুসুমের দিকে তাকালো সে।কুসুম ব্রু কুঁচকে কপাল ঘঁষছে ওর দিকে চেয়ে।

-“কি??তোমাকে না বললাম আমাকে এত জ্বালাবে না।এত জোরে ধাক্কা দিলে কেন?বাঘে তাড়া করেছিল তোমায়?কম বয়সে আমার হাঁড়ভাঙ্গতে চাও?কি শক্ত কপাল তোমার!’

-“শক্ত তো আপনার গলার নিচের হাঁড়টা।আমার কপাল দেবে গেছে দেখুন একবার’

-“টসটসে মাংস যুক্ত দেহে বাড়ি দিলে সেটা দেবে গিয়ে আবার আগের মতন ফুলে ওঠে।এই আর এমন কি!ঘরে ভূত দেখে ওমন ছুটছো নাকি আবারও ইচ্ছে করে আমাকে জ্বালাতে ধাক্কা দিলে?’

-‘কককককক…’

-“তোতলাও ক্যান? ক তে কি?’

-“কিছুনা’

-“দেখি সরো’

অর্ণব কুসুমকে সরিয়ে রুম থেকে বের হতেই দেখলো মিশু আর সাগর মিটমিট করে হাসতে হাসতে তাদের রুমে চলে যাচ্ছে।
অর্ণব পেছনে তাকালো এবার।কুসুম জিভে কামড় দিয়ে বারান্দার দিকে দৌড় মেরেছে।
-‘কি এক ঝামেলা!ভাইয়া এসব কি শুরু করলো!বাচ্চা মেয়েটার সামনে ইজ্জতের আর কিছু অবশিষ্ট থাকলোনা।কি ভাবছে!কি দেখছে কে জানে!এগুলো দেখে দেখে শিখবে তারপর আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকবে আশায়!’

-‘এই এদিকে এসো’

ডাক শুনে বারান্দা থেকে এসে কুসুম মাথা নিচু করে অর্ণবের সামনে দাঁড়ালো।

-‘আসরের নামাজ পড়ো গিয়ে।’

-“আজান দেওয়ার পরই পড়েছি আমি’

-‘তাহলে যাও ছাদ থেকে আমার গামছা নিয়ে এসো।’

কুসুম মাথা নাড়িয়ে চলে গেছে।ওকে কাজে ব্যস্ত রাখলে যা কিছু দেখেছে ওসব ভুলে যাবে একেবারে।মনে না থাকাই ভালো।’

কুসুম অর্ণবের গামছাটা মাথায় দিয়ে পুরো ছাদে ঘুরছে।অর্ণব অজু করে বসেছিল গামছার জন্য।ও এখনও আসছেনা দেখে সে নিজেই ছাদের দিকে গেলো এবার।ওখানে এসে দেখলো কুসুম রেলিংয়ে উঠে লিচুগাছের ঢাল ধরে ফুল নেওয়ার চেষ্টা করছে।অর্ণব ভয় পেয়ে ছুটে এসে ওর হাত ধরে বললো,’মাথা গেছে তোমার?এখান থেকে পড়লে তো মরবা!’

-“আমি এত সহজে মরবোনা।বয়স কম না?মানুষ তো মরে বৃদ্ধ হলে’

অর্ণব কুসুমকে নিচে নামালো হাত টেনে।এরপর ওর মাথা থেকে নিজের গামছাটা নিয়ে বললো,’জোয়ানরাও মরে।পার্থক্য আয়ুর।যার আয়ু যতদিন সে ততদিন বাঁচে।আয়ুকাল ঠিক করে রাখেন আল্লাহ”

কুসুম পিছু পিছু আসতে আসতে বললো, তো আমার আয়ু যদি এখন শেষ হয়ে যায় আমি এখন মরে যাবো এমনি এমনি?’

অর্ণব থেমে গিয়ে ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,’এত মরার কথা বলছো কেন?মরার শখ জাগছে তোমার? কেন এতো জ্বালাও?”

কুসুম অর্ণবের মুখে জমে থাকা পানি দেখছিল।চিলেকোঠার ফাঁক দিয়ে যে বিকালের রোদ ছিল তা এসে পড়ছিল ওর মুখে।ওর কোনো কথাই সে কানে নিলোনা।আগ্রহ দিয়েছিল শুধু ওকে দেখার খাতিরে।
অর্ণব চলে গেলো।কুসুম ও চলেছে।
অর্ণব কুসুমের মাথা থেকে গামছা নিয়ে কখন যে নিজের মাথায় রেখেছিল তা জানতোনা।কুসুম বিষয়টা খেয়াল করে ফিক করে হেসে ফেললো।পুনরায় আবার থেমে কুসমের দিকে তাকিয়ে বকতে যেতেই রান্নাঘরের পাশে ভেসিনের মিররে চোখ পড়ে দেখলো গামছা ওর মাথায়।

চুপচাপ গামছটাকে হাতে নিয়ে চলে গেলো সে।
কুসুম হাসতে হাসতে ওর সাথে রুমে ঢুকেছে।অর্ণব মুখ মুছে টুপি পরে চলে গেলো।
আশ্চর্য হলো কুসুমও ওর সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছে।অর্ণব আর সহ্য করতে পারছেনা।কুসুমকে ধমকাতে ধমকাতে এখন আর ধমক আসলোনা।ওর দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো ও অনুকরণ কেন করছে।

-“কই আমি অনুকরণ করছি?আমি তো বেগমদের বাড়িতে যাচ্ছি ওকে ডাকতে।আপনিই তো শুধু পেছনে তাকিয়ে দেখেন আমি আসছি কিনা’

অর্ণবের গাল লাল হয়ে গেলো কথাটা শুনে।চোখ নামিয়ে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে।
কুসুম বেগমদের বাড়িতে এসে ওর নাম ধরে ডাকলো কয়েকবার।বেগমের সাথে কিছু সময় কথা বললো ওর বাড়ির লোকদের নিয়ে।।বেগম অনেকবার করে কিছু মুখে দিতে বলেছে কিন্তু কুসুম মানেনি।
সে চলে আসার আগে বেগমের ভাই বের হয়েছিলো ঘর থেকে।
তবে সে কিছু বলেনি শুধু কুসুমকে খারাপ নজরে দেখছিল।কুসুম সেটা বুঝতে পেরে বেগমকে জলদি বাড়িতে আসার কথা বলে তাড়াহুড়ো করে চলে আসলো ওখান থেকে।
ঐ ছেলেটাও এদিকেই আসছে।কুসুমের এবার ভয় হলো।মনে পড়ে গেলো রাখালের সেই চাহনির কথা।
ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।বাড়ি কতদূরে মনে হলো।পথ যেন শেষই হয়না।
ওদিকে ছেলেটা মশকরা করে বললো,’কে গো তুমি?এই এলাকায় নতুন?বিয়ে হইছে তোমার?’

কুসুম কিছু না বলে ছুটছে।অর্ণব সেসময়ে নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিল।সে দূরে ক্ষেতের কিণারা দিয়ে আসছিল বলে ছেলেটাকে খেয়াল করেছে কুসুমকে ফলো করতে দেখে।
তাই সে জলদি করে হেঁটে ঐ ছেলেটার পথ আটকে দাঁড়ালো।
ছেলেটা ওকে চিনতে পেরে বললো,”কেমন আছেন অর্ণব ভাইয়া?’

-“বেশ ভালো।ওরে চিনো তুমি?’

কুসুম একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল।অর্ণবকে দেখে সেসময়ে থেমে গিয়েছিল সে।
ছেলেটা জবাবে বললো চেনেনা।

-“ও আমার বউ হয়।আর কিছু জানতে চাও?’

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে চলে গেছে কিছু না বলেই।কুসুম মুচকি হেসে কিছু বলার আগেই অর্ণব কাছে এসে বললো,’তোমাকে না বললাম এমন টইটই করে ঘুরে বেড়াবেনা?তুমি জানো এখানে কত খারাপ মানুষ আছে?নিজে সেল্ফ ডিফেন্সের আগামাথাও জানেনা।
সবসময় আমি থাকবো বাঁচানোর জন্য?’

-‘থেকে আসছেন তো’

কুসুমের বলা শেষ কথাটা শুনে অর্ণব আবারও তার কথা হারিয়ে ফেলেছে।
-‘এই মেয়েটা কেন এত বিশ্বাস করে?তার মনে কি ভয় নেই?বা আমাকে অপছন্দ করতে ইচ্ছা করেনা?এত করে বকাঝকা করি।অপমান করি তারপরেও ঘুরেফিরে মুগ্ধতার চোখে তাকিয়ে থাকবে সবসময়।যেন এর আগে আমার মুখ থেকে সে মিষ্টি কথা শুনেছে।অথচ আজ পর্যন্ত আমি একটা মিষ্টি কথাও তাকে বলিনি!মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বলতে যে আমায় এত বিশ্বাস করতে হবেনা।আমি সবসময় থাকবোনা এমন বিপদে বাঁচাতে।’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here