লীলাবালি🌺 পর্ব-৩৯

0
1226

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩৯
আফনান লারা
.
পরেরদিন সকালবেলায় ঘুম থেকে উঠেই অর্ণব হাজির তার কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে।সেখানে বসে কাগজপত্র দেখাশুনা করছিল।কদিন ধরে ভালোমতন সময়ই দেওয়া হয়না।কাল রাতের স্বপ্নটা যেন আর ভয় না জাগায় তার জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখছে সে।
জুথির একবার খোঁজ নিয়েছিল মৃদুলকে দিয়ে।ওকে নাকি রিলিজ দেওয়া হয়েছে।এখন বাসায় চলে গেছে।গিয়ে দেখা উচিত মনে হলো কিন্তু জুথির চোখে চোখ রাখতে কেমন যেন লাগে।ঐ কেমন লাগাতে মিশে আছে অপরাধ বোধ,কষ্ট,অসহায়ত্ব।প্রথম বোধটা জুথির প্রতি আর বাকি দুটো বোধ নিজের।
সকাল থেকে অফিসের কাজেই ডুবে ছিল সে।বেলা বারোটা বাজার পর নিজের মনকে শক্ত করে তুললো জুথিকে দেখতে যাবে বলে।কিছু আপেল কিনে রিকশা নিলো জুথিদের বাসায় যাবার জন্য।
মিনিট বিশেকের ভেতরে এসেও গেছে।মৃদুলকে নাকি জুথির বাবা ছাড়ছেননা।জুথির প্রতি ওর এত কেয়ার,দৌড়ঝাঁপে তিনি প্রসন্ন হয়েছেন বেশ।মৃদুল তো জুথিকে অর্ণবের প্রাক্তন মনে করে,নিজের প্রাক্তন ভাবী মনে করে সব করে যাচ্ছে।অথচ তিনি ভেবে বসে আছেন সে বুঝি জুথিকে পছন্দ করে।
অর্ণব বাসায় এসে মৃদুলকে সোফাতে বসা দেখলো।ফলগুলো টেবিলে রেখে সে জিজ্ঞেস করলো জুথির বাবা কোথায়।মৃদুল জানালো তিনি বাহিরে গেছেন।জুথি তার রুমেই।গিয়ে দেখতে পারে।অর্ণব তাই সেদিকে গেলো।মৃদুলকেও আসতে বললো।একা একটা মেয়ের রুমে ঢুকতে কেমন একটা বোধ হয়।জুথি সম্পর্কে তার কিছু হয়না এখন।যদি ঘটনাটা বিয়ের আগে হতো তাহলে পরিস্থিতি অন্য কথা বলতো।দরজা আস্তে আস্তে খোলার পর সে দেখলো অন্ধকারে ছেয়ে আছে সম্পূর্ণ রুম।
মৃদুল এগিয়ে এসে আলো জ্বালিয়ে বললো,’কতবার বলেছি রুম অন্ধকার করবে না’

সঙ্গে সঙ্গে জবাব আসলো’জাহান্নামে যান আর আমাকে একা থাকতে দিন ‘

ঝাড়ি শুনে মৃদুলের মুখের কথা হাওয়া।জুথি তার কথা বন্ধ করে ফেলেছে মৃদুলের সাথে হঠাৎ অর্ণবকে দেখে।অর্ণব মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,’আমার বন্ধু দিনরাত এক করে আপনার খেয়াল রাখছে তার এই প্রতিদান দিলেন?’

-‘এরকম কেয়ার আমার ভালো লাগেনা।যে কেয়ার মনে বিরক্তি সৃষ্টি করে সে কেয়ার আমার প্রয়োজন নেই।আপনার যাবার সময় উনাকেও নিয়ে যাবেন।এখানে থাকলে আমার মাথা খাবে।সারাদিন আপেল খাও,কমলা খাও। পানি খাও!’

-‘কিরে? এসব সত্যি?’

মৃদুল মাথার চুল ঠিক করে বললো,’দোষ করেছি বলেই তো জাহান্নামে যেতে বলে দিলো।আর কি বলবো আমি!’

অর্ণবের ফোন বাজছে।মৃদুলকে রেখে বাহিরে বেরিয়ে ফোন কানে ধরতেই সাগর ভাইয়ার গলা শুনলো।

-‘অর্ণব তুই কোথায়?’

-‘কেন ভাইয়া?আমি তো কাজের জন্য এক জায়গায় এসেছি।কি হলো?সব ঠিক আছে তো?”

-“আমি তোর ভাবীকে নিয়ে ঢাকা এসেছি,আমার শ্বশুরবাড়ি যাবো।তো সঙ্গে কুসুম ও এসেছে।বাবা বললেন ওকে তোর কাছে রেখে যেতে।তুই এসে নিয়ে যাবি নাকি আমি সোজা ফার্মগেট চলে যেতাম?’

-‘কি বলছো!কুসুমকে কেন এনেছো?’

-‘আমি জানতাম তুই এটা বলবি।বাবা শুধু শুধু মেয়েটাকে আমার সঙ্গে দিলেন।আচ্ছা সমস্যা নেই।আমার শ্বশুর বাড়ি তো ভালোই। যৌথ পরিবার,কত মানুষ।
ওখানে থাকলে ওর ভালই লাগবে।বেশিদিন থাকবো ও না।পাঁচ /ছয়দিন থেকে আবার আমরা কুমিল্লা চলে যাব।তাহলে ওকে আমাদের সাথে নিয়ে যাই,কি বলিস?’

-‘নাহ!তোমরা স্টেশনে অপেক্ষা করো। আমি আসতেছি ওকে নিতে”
—-
মিশুর ছোট ভাই শামীম এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।
বয়স অনুযায়ী তার চরিত্র কতটা উন্নত তা এলাকা ছেড়ে পুরো ঐ গোটা স্থানের মানুষেরা জানে।এরই মধ্যে দুটো মেয়ে নিয়ে ভেগে গিয়েছিল সে।তার আচরণে মিশু ভাবী সহ তাদের গোটা গুষ্টি মহা চিন্তায় থাকে সবসময়।এইখবর অর্ণব ও জানে।কুুসমকে পেলে শামীম এত বড় সুযোগ হাত ছাড়া করবেনা এটা ভেবেই অর্ণব কুসুমকে ঐ বাসায় যেতে দিলোনা।
স্টেশন আসতে আধ ঘণ্টা সময় লেগে গেছে।ভাইয়াকে কল করে অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলো তাদেরকে।কুসুম বোরকা পরে এসেছিল এখানে।যে দুচোখ তার দেখা যায় তা খুশিতে টলমল করছিল।সে খুশি,কারণ অর্ণব তাকে নিতে এসেছে।

-‘কি হতো কুুসম আমাদের সঙ্গে গেলে?’

-“না থাক ভাইয়া।তোমরা যাও’

-“তুই থাকিস মেসে।কুুসুমকে মেসে কি করে নিবি?’

-“ওসব আমি ভেবে একটা উপায় বের করবো।তোমরা যাও’
—–
ভাইয়া আর ভাবী চলে গেছেন।কুসুম কাছে এসে বললো,’আমি সকাল থেকে অনেকবার ফোন করেছিলাম আপনাকে।ধরলেন না যে?’

-“এমনি’

-“কোথায় যাব এখন?’

অর্ণব কিছু বললোনা।রিকশা থামিয়ে উঠতে বললো ওকে।দুজনে চুপচাপ বসে আছে এখন।পথ থেমে থাকলেও রিকশা চলছে।কুসুম ঢাকার বড় বড় অট্টালিকা দেখছিল অবাক চোখে।অর্ণব নিজেও জানে মেসে ওয়াইফ এলাউ করবেনা।আপাতত একটা হোটেলে উঠবে দুজন তারপর যা হবার হবে।
বিশাল এ শহরে কুসুমের আপন বলতে একমাত্র অর্ণব।এত বড় শহর দেখতে পাবার সুযোগ পেলেও কুসুম সেটা বেশি সময় কাজে লাগায়নি।তার চোখ ঐ মানুষটার দিকে।শুরু থেকে অর্ণবের দায়িত্বগুলোকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসাটাতেই সে মন দিয়ে বুঝে এসেছে।এর বাহিরে যে অধিকার অর্ণব ওকে দেয়নি আজ পর্যন্ত সেটা বুঝতে চায়নি কুসুম।মাথাতেই আনেনি আজ।
অর্ণবের পিছু পিছু রিকশা থেকে নেমে হেঁটে চলেছে।সে যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে চলে যাবে।অর্ণব একটা হোটেলের রুম নিলো।রুমটাতে আসার পর কুসুম বললো,’রান্নাঘর নেই?’

-‘এটা হোটেল।এখানে রান্নাঘর আসবে কেন?’

-“তো আপনি বাসা নিবেননা?’

-“এত সহজ না।
বাবার সাথে কথা বলতে হবে।সময় করে তোমায় কাল কুমিল্লা দিয়ে আসবো আমি’

কুসুমের মন আবার খারাপ হয়ে গেলো।ভেবেছিল আর ফিরতে হবেনা।অর্ণবের সাথে থাকা হবে সবসময়।কিন্তু সে তো তাড়াহুড়োয় আছে কখন আবার দিয়ে আসবে তাকে।এক রাশ মন খারাপের ঝুড়ি নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে নিচে তাকিয়েছে সে।পাঁচতলায় তারা।নিচের মানুষ গুলোকে কেমন ছোট লাগে দেখতে।
অর্ণব বাবাকে কল করেছে দুবার।বাবা ধরেননি।তাই সে ফ্রেশ হতে চলে গেছে।কুসুম তার বোরকাটা খুলে বিছানায় বসে থাকলো।অর্ণব ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ব্যস্ত হয়ে তোয়ালে খুঁজছে।
শেষে একটা কাপড় পেয়ে টেনে মুখ মুছলো।মোছা শেষে মাথা তুলে দেখলো এটা কুসুমের পরনের শাড়ীটার আঁচল ছিল।অর্ণব আঁচলটা ছেড়ে দিয়ে বললো,’সরি।আমি ভাবলাম গামছা’

কুসুম আঁচল টেনে চুপ করে আছে।বাবা এবার নিজে ফোন করেছেন।অর্ণব রিসিভ করে বললো কুুসুমকে সে কাল দিয়ে যাবে।

-‘দিয়ে যাবি মানে?এত নাটক করার কি দরকার ছিল?সাগরের সাথে ওকে মিশুর বাপের বাড়ি যেতে দিতি।তুই আবার কুসুমকে থামিয়ে দিতে গেলি কেন?শামীম তো ভালো ছেলে।কত ভালো সেটা আমিও জানি,তুইও জানোস।তাহলে তোর কিসের ভয়?কুসুমরে তো দু চোখে দেখতে পারিস না’

অর্ণব চুপ করে আছে।বাবা আবার বললেন,’হয় সাগরের শ্বশুর বাড়ি ওরে দিয়ে আসবি নাহয় বাসা ভাঁড়া নিবি।টাকার প্রয়োজন হবার কথা না।তোর বিকাশ চেক কর গিয়ে।আমি এক মাসের বাসা ভাঁড়ার টাকা এডভান্স পাঠিয়ে দিয়েছি।আমার কুসুম মাকে ভাল রাখতে তোর আর কিছুর প্রয়োজন আছে?
যাই করিস না কেন! কুমিল্লা ওকে নিয়ে ফিরতে পারবিনা আগামী রোজার ঈদ ছাড়া’

অর্ণব ফোন রেখে দিলো রাগ করে।নোটিফিকেশন চেক করে দেখলো বাবা সত্যি সত্যি টাকা পাঠিয়ে দিয়েছন।
কুসুম চুপিসারে দেখছিল অর্ণবকে।
অর্ণব মাথার চুল টেনে কিছুক্ষন বসে থাকলো তারপর মৃদুলের নাম্বার ডায়াল করে কল করলো।বাসা ভাঁড়ার ব্যাপারে ওর কাছে ভালো আইডিয়া পাওয়া যাবে।

-‘আচ্ছা আমি একটা কথা বলবো?’

-“না’

-“আপনার যেহেতু সমস্যা অনেক আমি এখানে আসায় তাহলে আমি বরং মিশু ভাবীর বাসায় চলে যাই?ওদের বাসা চেনেন আপনি?’

-“না।ঐ বাসায় তোমায় যেতে হবেনা’

-“কেন?’

-‘কারণ ওখানে রাখালের মতন ছেলে আছে।এবার বলো যাবে??’

-“না না থাক।’

-‘ওয়েট। হ্যালো মৃদুল?ভাই বিপদে পড়েছি আমি।কুসুম, ভাইয়া ভাবীর সঙ্গে ঢাকায় এসেছে।তো তারা চলে গেছে ফার্মগেট।এদিকে কুসুমকে নিয়ে তো আমি আর মেসে উঠতে পারবোনা’

-‘স্যার ভালো আছেন?’

-“আশ্চর্য! তোরে এতক্ষণ কি বললাম?তুই আমাকে স্যার বলছিস কেন?’

-“ওকে স্যার।আমি রচনা জমা দেবো কালকেই।ডোন্ট ওয়ারি’

-“চুপ!কি বলিস এসব?’

-“স্যার আসলে আমি মৃন্ময়ীর বাসায় তো।ঐ যে ফার্স্ট ইয়ারের মৃন্ময়ী?চিনছেন?চিনার কথা তো!’

-ওহ!বুঝলাম।তুই এখনও ঐ বাসায়?ফ্রি হয়ে কল দিস।দরকার আছে আমার।’

মৃদুল লাইন কেটে দিয়েছে।জুথি হেলান দিয়ে বসেছিল।মৃদুলের কথা শেষ হওয়ায় বললো,’কিসের জন্য কল করেছিলেন স্যার?কোন স্যার কল করেছিলেন?’

-“ঐ আমাদের রাজনীতি তত্ত্বের স্যার।তুমি চিনবেনা।আচ্ছা রেস্ট নাও।আমি যাই’

মৃদুল চলে যাওয়া ধরতেই জুথি বললো দাঁড়াতে।
এরপর নড়েচড়ে বসে বললো,’থ্যাংকস!’

-“জাহান্নামে যেতে বলে এখন থ্যাংকস?’

-“না আসলে তখন মেজাজ খারাপ ছিল আমার।সরি।তবে আর আসবেননা।আমি একা থাকতে চাই।নিজের সাথে নিজেই কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করতে চাই’

-“উইথ বিয়ার?’

জুথি মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।মৃদুল যেতে যেতে বললো,’তবে তাই হোক।থাকুন একা।আমি কিন্তু বিছানার তলা থেকে সব বোতল নিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছি।গুড নুন’
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here