লীলাবালি🌺 পর্ব-৩৮

0
1195

#লীলাবালি🌺
#পর্ব_৩৮
আফনান লারা
.
অর্ণব কিছু সময় ধরে ভাবছিল কল করবে নাকি করবেনা।ফোনটাকে উল্টে পাল্টে ঘুরাচ্ছিল তাই ভেবে।কুসুম ও সেসময়ে ফোন নিয়েছিল কল করবে বলে।অর্ণবের আগেই সে আজকেও কলটা করেছে।অর্ণব সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে হ্যালো বললো।
কুসুম সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাতে খেয়েছে কিনা।

-‘হুম।তুমি খেয়েছো?এখন তো বলবে বমি পায়’

-“না খাইনি।পরে খাবো।মিননয়ি আপু ভাল আছে?’

-“হুম’

-“কি হয়েছিল তাঁর?’

-‘তোমার এত জেনে কি হবে?ঘুমাও।’

-‘আচ্ছা উনাকে নিয়ে কিছু বলছিনা।কবে আসবেন আবার?’

-‘আর আসবোনা।নেক্সট টাইম রোজার ঈদে আসা হবে।’

-“ওহ!বাসা নিবেন কবে?’

-‘তোমার এত তাড়া কেন এখানে আসার?আমার বাবা মায়ের সাথে থাকো।তাদের খেয়াল রাখো।’

রাগ করে অর্ণব কল কেটে দিছে।কুসুমকে আজ তার স্বার্থপর মনে হলো।কেন সে বারবার এখানে আসতে চায়?

‘তাকে এখানে আনলে আমার কাজে মনই বসবেনা।সবসময় জ্বালাতন করে সময় নষ্ট করবে আমার।মানুষ বাসায় ফিরে মানসিক শান্তির জন্য।আর আমি ওরে এখানে আনলে মানসিক অশান্তুিতে ভুগবো।দরকার নেই জেনে শুনে প্যারা ঘরে তোলার।’

সুন্দর ফ্ল্যাট।একটি তিনতলা দালানের দোতলায় সেটা।
কাঠের দরজাটা চাবি দিয়ে খুললে চোখের সামনে দেখি ভেতরে বেশ বড়সড় একটা রুম।সেটা হয়ত সোফার রুম।তবে ওখানে সোফা নেই,নিচে তোষক বিছানো,তাতে রঙিন বিছানার চাদর আর রঙিন কভারের কিছু কুশান।পাশেই একটা সবুজ গাছ টব সমেত।সেই রুমটার ডান পাশে গেলে ফ্লোর থেকে ছাদ ছুঁই ছুঁই গ্রিলের দরজা।সেটা খুললে ছোট আকারের মোটামুটি চলার মতন একটা বারান্দা।ঐ রুমটার পরে আরও তিনটে রুম দেখা গেলো।বাম পাশেরটা রান্নাঘর,দুই তাকের সংমিলিত ছোটখাটো বটে।বাকি দুটো রুম বেডের।
ঐ দুটোর মাঝে সুন্দর একটা বেডরুম দেখা গেলো গোলাপি রঙের চাদর বেছানো।দুচোখ প্রথমে সেদিকেই গেছে।
রুমটা পরিপাটি ছিল।বিছানার পাশে কাঠের ঝকঝক করা ওয়ারড্রব একটা। সেটার পাশ ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী।এলোমেলো কোঁকড়া চুল তার গোটা পিঠ জুড়ে।লাল রঙের শাড়ীর আঁচল ফেলা হলেও তার কারণে ঐ চুল ঢাকা গেলোনা।
মেয়েটা হঠাৎ ঘুরে আমার দিকে ফিরলো।কি তার চোখ!এক টুকু কাজল মাখা ছিলনা অথচ আমি তার চোখে কাজলের ভান্ডার দেখতে পাচ্ছি।
তার ছোট চোখগুলো যেন বড় লাগলো।ডাগর ডাগর।হাতে দুটো বালা।স্বর্নের।
হঠাৎ দেখতে পেলাম আমার হাতে একটা রক্তজবা,এটা কখন নিলাম জানিনা,বুঝলাম ও না।
তবে আরও দেখতে পাচ্ছি ঐ তরুণীর কান স্পর্শ করে তার পাশের চুলগুলোকে কানের ওপারে নিয়ে দিয়েছি আমি।এরপর হাতের সেই ফুলটা কানে গুজে দিয়েছি।
তরুণীর চোখ আমার চোখ বরাবর।
আশ্চর্য! বোধ হয় আমি তার ঠোঁটের দিকে তাকালাম।হঠাৎ করে সে মাথা নিচু করে ফেলেছে আমার চাহনি দেখে।তার ঐ ঠোঁটে যেন জবার পাপড়ি ডলে দেওয়া।আমার হাত কাঁপে।আমি তাকে ছোঁয়ার সাহস পাচ্ছিনা।হাত অনবরত কাঁপছে কেন।কি হচ্ছে আমার!!
চোখটা এক সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে পুনরায় যখন খুললাম তখন আমি সেই তরুণীকে সামনে দেখলামনা।কষ্ট হলো মনে।ভীষণ কষ্ট।আমি তাকে পাগলের মতন খুঁজতে গিয়ে হাতে সেই জবাটার সবুজ রঙের পাতা আবিষ্কার করলাম।তার মানে সে সত্যি এখানে ছিল আমার সামনে??
এরপরই ঐ বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ানো সেই মেয়েটাকে আমি আবারও দেখলাম।সে হাসছে আর আমাকে তার কাছে ডাকছে।আমি তার সামনে অবধি এসেও পড়েছি।হাতটা ধরে বললাম তার একটি বিশেষ নাম।
কি নাম ছিল যেন!!

রাত দুইটা পাঁচ মিনিটে এসে স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো হঠাৎ।হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় শ্বাস নিতে নিতে অর্ণব বুকে হাত দিলো।শীতের রাতে কিনা ঘেমে পাঞ্জাবি ভিজে গেছে।গরমে পাঞ্জাবিটা খুলে ফেললো সে।স্বপ্নে কাকে দেখলাম??
হুম ওটা কুুসুম ছিল! কিন্তু কি নামে ডেকেছিলাম তাকে??মনে পড়ছেনা।তাকে ওমন করে কেন দেখছিলাম।তাকে ছুঁতে চেয়েছিলাম!!এসব কেন আসলো মনে!!’

মৃদুল ও জেগে গেছে অর্ণবকে এমন করে উঠে যেতে দেখে।আলো জ্বালিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো সে।মৃদুলকে দেখে অর্ণব হাঁপ ছাড়ালো এরপর জিজ্ঞেস করলো জুথির কি অবস্থা।মৃদুল জানালো আসার সময় দেখেছে ঘুমাচ্ছিল।

-‘কি দেখলি যে একেবারে পাঞ্জাবি খুলে ফেললি ?কেউ তোরে আগুনে ফেলছে নাকি?’

-“সেটার চেয়েও মারাত্মক! যাকে সহ্য করতে পারিনা তাকে ছুঁতে যাচ্ছিলাম একটুর জন্য’

-“হাহাহা!!এগুলো ভাবিস তাহলে?মানুষ দিনে যেটা ভাবে কিন্তু ইগনর করে সেই ভাবনাটাই রাতে স্বপ্নে সিনেমার পর্দার মতন শো করে।তোর হয়েছে ঠিক তাই!’

-“সেটা নয়।আমি কেন কুসুমকে নিয়ে ওসব ভাববো?জানিনা কেন এমনটা দেখলাম।ঘুমা এখন’

অর্ণব শুয়ে পড়লো আবার।
ওদিকে কুসুম জেগে বসে আছে।বিয়ের আগের দিনগুলো যেভাবে একা কাটতো,অর্ণবের অপেক্ষা ছিল।এখনও তাই।তফাৎটা হলো বিয়ে হয়েছে।সে বিবাহিত। অথচ বিবাহিত ছাড়া আর কিছু বলতে সে পারেনা।বিয়ে হওয়া আর না হওয়া একই রকম মনে হয়।অর্ণব তাকে কি পরিমাণ অপছন্দ করে তা তো সে জানতো।কিন্তু সে তো পছন্দ করে।চেয়েছিল আর কখনও কাউকে নিজের স্বামীর জায়গা দেবেনা।যার কারণে ঐদিন সে সবার চোখ এড়িয়ে কবুল বলেছিল।অথচ যার থেকে লুকানো সে দেখে ফেললো।
স্বাক্ষী হিসেবে দেখলেন কাজী ও।
যা সে ভেবেছিল তা কেন হলোনা?অর্ণবের স্ত্রী হয়ে ভারত চলে যেতে পারতো সে।দায়বদ্ধতা রাখতোনা কোনোদিন।কিন্তু অর্ণব যেটা করলো সেটাতে এই বিয়েটা সমাজের সামনে এসে পড়েছে।তিনি চাইলেই পারতেন অস্বীকৃতি জানাতে।কেন সেটা না করে এটাকে সবার সামনে তুলে ধরলেন?এখন নিজে কষ্ট পান সবসময়।আমিও কষ্ট পাই।কিন্তু ভারত চলে গেলে যে কষ্টে থাকতাম এখনও একই কষ্টে আছি।প্রিয় মানুষটাই আমার থেকে দূরে থাকতে চান।পালিয়ে বেড়ান।যেন আমার জীবনে হ্যাঁ আর না এর কোনো পার্থক্য নেই।আমি যেটা ভালো নামে পাই আসলে সেটা খারাপই।

“””””কাগজ কে দো পাংখ লেকে উড়া চালা যায় রে
জাহান নাহি জানা থা ইয়ে ওয়াহিন চালা হ্যায় রে
উমর কা ইয়ে তানা-বানা সমাজ না পায়ে রে
জুবান পে জো মোহ-মায়া, নামক লাগায়ে রে
কে দেখে না, ভালে না, জানে না দায়ে রে
দিশা হারা কেমন বোকা মনটা রে!
দিশা হারা কেমন বোকা মনটা রে মানে:
কত বোকা এই দিশাহীন হৃদয়।””””””

গানটা চলছিল জুথির ফোনে।ঘুম আসেনা বলে ইউটিউবে ঢুকতেই গানটা সামনে এসে গেলো।
অর্ণব ফেসবুকে ঢুকতেই দেখলো জুথির শেয়ার করা সেই গানের ভিডিও।গানটা সেও প্লে করেছে।
ওদিকে কুসুম ছাদে এসে বসার পর নিজের মুখে গানটা গাইছিল।একটা সখী শিখিয়েছিল এই গানটা।কত বার যে ভারতে সে এই গানটা গেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছিল।

“”””””ফতেহ কারে কিলে সারা, ভেদ যায়ে দেওয়ারেইন
প্রেম কই সেন্ড লাগে রে লাগে
আগর মাগর বাড়ি বাড়ি জিয়া কো ইউন উছলে
জিয়া নাহি গেন্ড লাগে..

মাটি কো ইয়ে চন্দন সা মাঠে পে সাজায়ে রে
জুবান পে জো মোহ মায়া নামক লাগায়ে রে
কে দেখে না ভালে না জানে না দায়ে
দিশা হারা কেমন বোকা মনটা রে””””””

কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেললো কুসুম।
তারপর আবার হুট করেই হাসলো। হাসতে হাসতে বললো,’আমি সত্যি বোকা!আমার মন বোকা!’

কুসুমের ফোন বাজছে।মা বলতো যাকে স্বপ্নে দেখবি সে যদি তোর পরিচিত কেউ হয় তবে তার সঙ্গে যত দ্রুত উচিত কথা বলবি।তাহলেই স্বপ্নটা ভুলতে পারবি।
তা ভেবে কুসুমকে অর্ণব কল করেছে এই সময়ে।কুসুম জানেনা।সে ঠাণ্ডার মাঝে ছাদে বসে আকাশ দেখছিল। আজ বাগিচার ভয় তাকে ধরছেনা।কষ্টের সামনে ভয় হার মেনেছে।
সে জানেনা অর্ণব তাকে এই মূহুর্তে মনে করতে পারে।চোখ মুছতে মুছতে ঘরে চলে আসলো।রুমে এসে ফোনটাকে দেখতে যেয়ে মিসড্ কলের নোটিফিকেশান পেলেও বুঝতে পারলো না এর মানে।কিন্তু অর্ণবের নাম্বার উঠে আছে দেখে কল করলো সে।অর্ণব জেগে ছিল তখন।কল আসায় ধরে বললো,’ঘুমাওনি?’

-“আসেনা।আপনি ঘুমাননি?’

-“জেগে গেলাম হঠাৎ।কল করেছিলান ধরোনি যে?’

-“আমি…. আমি একটু বারান্দায় বসে ছিলাম।’

-‘আচ্ছা ঘুমাও’

অর্ণব আবার ফোন রেখে দিয়েছে।কুসুম সব ভুলে হাসলো অর্ণবের সাথে কথা বলতে পেরে।।খুশিতে শুয়ে পড়েছে সে।
অর্ণব চোখ বন্ধ করলেই সেই স্বপ্নে ঘটে যাওয়া ঘটনা আবার দেখে ফেলে।চোখ বন্ধই করতে ইচ্ছে করছেনা।মৃদুল উপুড় হয়ে শুয়ে গভীর নিদ্রায় আছে।আর এদিকে অর্ণবের চোখে বিন্দু পরিমাণ ঘুম নেই।না জানি এই স্বপ্নের রেশ আর কতক্ষণ থাকবে।ভালো লাগছেনা কিছু।যেন স্বপ্নের বাকি অংশ দেখার জন্য চোখ ডাকছে।কিন্তু দেখার সাহস নেই ওর।ভয় লাগে।স্বপ্নের উপর তো আর নিজের কন্ট্রল থাকেনা।যে স্বপ্ন সে দেখবে তাতে যদি এমন কিছু দেখে যেটা সে চাইবেনা।ভয়ের কারণে উঠে বসে পড়লো আবারও।
সে আজ পর্যন্ত কুসুমকে ছোঁয়ার কথা ভুল করেও ভাবেনি। -‘তবে মৃদুল যে বললো যা ভাবি তাই দেখি?
কিন্তু আমি তো কিছুই ভাবিনি!’

মৃদুল হঠাৎ মাথা তুলে বললো,’কে বলেছে তুই ভেবেছিস?’

অর্ণব মৃদুলের দিকে ফিরে তাকালো।সে উঠে চশমা খুঁজছে।ভোর রাতে উঠে পড়তে বসা ওর পুরোনো অভ্যাস।অর্ণব প্রশ্ন করলো,’ তাহলে কে ভেবেছে?’

-”তোর মন ভেবেছে’

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here