#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্বঃ-৩৬
মাথা ব্যাথা ক্লান্ততে মানহার ঘুমে চোখ বুজে আসছে৷ খুধায় পেট মোচড়াচ্ছে তার৷ মানহা হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসে রইলো।
চোখে ঘুমে রাজ্যে প্রবেশ করার আগেই হঠাৎ পায়ে হাটার শব্দে মানহা সজাগ হয়ে গেলো। এখন নিশ্চয়ই ইলহাম এসেছে, ইলহামই তো আসবে আর নয় তো কে আসবে। ইলহাম মানুষ কেমন তা মানহার জানা নেই। বিয়ের প্রথম দিন আবার স্বামীর অধিকার খাটাবে না তো? ভাবতে ভাবতেই মানহার মাথা যন্ত্রণা আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।
রুমে এসে ইলহাম দরজা আটকে দিলো। মোমের আবছা আলো আবছা অন্ধকারে মানহা দেখতে পেলো না। ইলহাম ধীরে ধীরে মানহার কাছে আসছে, মানহা চমকে তাকালো এটা ইলহাম নয়৷ এটা ওয়াহাব। মানহা চোখের ভুল ভেবে চোখ হাত দিয়ে ডলে আবার তাকালো, সে ভুল দেখছে না এটা ওয়াহাবই।
মানহা নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওয়াহাব খাটের কাছে এসে দাড়িয়ে রইলো। মানহা গলা তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে, গলা দিয়ে শব্দ বের করতে পারছে না।
মানহার কিছু বলার, অপেক্ষায় ওয়াহাব দাঁড়িয়ে আছে। মানহা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে, রাজ্যের প্রশ্ন মনে নিয়ে বসে আছে অথচ মুখ ফুটে কিছু বলছে না।
ওয়াহাব মানহাকে সময় দিলো, মানহা নিজে থেকে যে পর্যন্ত প্রশ্ন না করবে, ওয়াহাব ও কিছু বলবে না৷
ওয়াহাব মাথার পাগরী টা টেবিলের পাশে রেখে হাত ঘড়িটা খুলতে শুরু করলো এমন সময় মানহা অস্ফুট গলায় বললো, ” আপনি? ”
ওয়াহাব মনে মনে হাসলো, অতঃপর বললো, ” অন্য কারো থাকার কথা নাকি? ”
মানহা চুপ করে তাকিয়ে রইলো, ওয়াহাব বললো, ” আমার রুমে আপনি কার সাথে বাসায় ঘর করতে চান? বলুন?”
মানহা অবাক হয়ে বললো ” এটা আপনার ঘর?”
” হুঁ।”
” কিন্তু আমার বিয়ে তো ইলহামের সাথে…”
ওয়াহাব হাতে হাত ভাজ করে বললো, ” আপনার বিয়ে আমার সাথে হয়েছে৷ আইনত আপনি আমার স্ত্রী আমি আপনার স্বামী।”
মানহা অবাক হয়ে বললো, ” কিহহ! আপনি মিথ্যা বলছেন৷ ”
” বিশ্বাস না হলে সবাই কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। ”
মানহা কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ” তাহলে সে দিন আপনার চেম্বারে আপনি আমাকে রিজেক্ট কেনো করে ছিলেন? কেনো আপনি বলেন নি.. ”
ওয়াহাব অবুঝ মুখ করে বললো, ” আমি কখন রিজেক্ট করলাম, আমি তো বলেছি আপনার মান্টালি প্রব্লেম আছে৷ ”
মানহা দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” কেনো বলেন নি সে দিন, ডাঃ ইলহামের সাথে নয় আপনার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
” ইলহাম ডাক্তার নয়। ইলহাম পুলিশ অফিসার৷ ডাক্তার আমি৷ এখন যদি আপনার বুঝতে সমস্যা হয় তাহলে সেটা আপনার প্রব্লেম। ”
মানহা ওয়াহাবের শেরওয়ানির কলার চেপে বললো, ” আমার দোষ তাই না। ”
” আলবাদ আপনার দোষ। এখন আমার কলার ছাড়ুন। ”
মানহা চেঁচিয়ে বললো, ” ছাড়বো না। ”
ওয়াহাব দুষ্টুমি করে বললো, ” আজকে বাসর রাত চেঁচাবেন না প্লিজ, সবাই খারাপ ভাববে৷ ”
মানহা ওয়াহাবের কলার আরো চেপে ধরে বললো, ” চুপ। কেনো সে দিন চেম্বারে বলেন নি, আপনার সাথেই আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে, আমাকে মানষিক রোগীর উপাধি দিয়ে দিলেন। ” বলেই মানহা ঢুকরে কেঁদে দিলো।
ওয়াহাব অবাক হয়ে মানহার কান্নার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুরোটা বিষয় মানহাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য করলেও মানহা মানুষিক ভাবে ডিপ্রেশড হয়ে যাবে ওয়াহব তা ভাবে নি।
ওয়াহাব মানহাকে জরিয়ে ধরতে যাবে, ঠিক তখনি মানহা কোমরের থেকে ওয়াহাবের হাতটা ছিটকে সরিয়ে দিলো। মানহা কান্না করতে করতে ওয়াহাবের কলার ধরে ঝাকিয়ে বললো,
” কেনো এভাবে আমার সাথে গেইম খেললেন আপনি, বলুন। আমার স্বপ্ন গুলো টুকরো করে কেনো দিয়ে ছিলেন৷ কেনো এমন নাটক করলেন আপনি..”
” তুমি বিষয় টা জানতে না, আমি তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়ে ছিলাম..”
” কিসের সারপ্রাইজ? এই কদিন আমি কতটা মানুষীক অশান্তিতে ছিলাম জানেন? আপনার প্রত্যাখ্যান আমাকে প্রতিটা মূহুর্তে কত বিষিয়েছে জানেন? জানেন না। এক মূহুর্তের জন্য তো মনে হয়ে ছিলো আমি মারা-ই যাবো। ”
” মানহা..” বলেই ওহাব মানহাকে বুকে জরিয়ে নিলো। মানহা ছোটার জন্য ওয়াহাবকে কিল, ঘুষি দিচ্ছে, তবুও ওয়াহাব মানহা কে ছাড়লো না।
মানহা ওয়াহাবের বুকে মাথা রেখে আগের মতোই কেঁদেই চলেছে। কান্নার এক পর্যায়ে মানহার হেঁচকি উঠেছে গেছে।
মানহা ওয়াহাবের কাছ থেকে ছুটে সরে গেলো।
হেঁচকি তুলে কান্না করতে করতে মানহা কোন মতে বললো,
” আজকের পর থেকে আমাকে ছোঁবেন না। আর কথাও বলবেন না। মনে থাকে যেনো। ”
বলেই মানহা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
ওয়াহাব মানহার যাবার পানে তাকিয়ে রইলো। তার কারনেই আজ মানহা এতোটা মানুষিক কষ্ট সাফার করেছে, মানহার রাগ অভিমান করাটা যথেষ্ট স্বাভাবিক। মানহা কে চমকে দিতে গিয়ে যতটা সে কষ্ট দিয়েছে, তা কি ভাবে সে?
ওয়াহাব আগেই বুঝে ছিলো মানহা অভিমান করে আছে। তবে এতোটা অভিমান, অভিযোগ জমিয়ে রেখে তা ওয়াহাব নিজেও বুঝে উঠতে পারে নি।
————————————————–
” তানিয়া! ”
ঘুমন্ত শিহাবের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তানিয়া। হঠাৎ নিজের নাম শুনতেই সামনে তাকালো সে, তার সামনে স্বামী নামক পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে, যিনি ক্যারিয়ার গড়ার জন্য স্ত্রী – ছেলেকে একা ফেলে বিদেশ পারি জমিয়ে ছিলো। এক বার ভাবেও নি ছোট্ট ছেলেটার কথা..
তানিয়া উত্তর দিলো না, শিহাবের মাথায় হাত বুলাতে মনোযোগ দিলো। শাহেদ ভেতরে আসতে আসতে বললো..
” শিহাব ঘুমিয়ে পড়েছে? ”
” দেখতেই তো পারছো শিহাব ঘুমিয়ে পড়েছে। তাহলে এতো কথা বলছো কেনো?”
শাহেদ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো। এগোবে কি না বুঝতে পারছে না৷ সে গেলে তানিয়া উঠে চলে যেতে পারে ভাবতে ভাবতেই শাহেদ খায়েটের পাশের চেয়ারে বসতে গেলো। তানিয়া বিরক্ত হয়ে বললো,
” এখনে বসছো কেনো?শিহাবের রুমে তোমার থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।”
” জানি। ” বলেই শাহেদ মুচকি হাসি দিয়ে বসে পড়লো।
তানিয়া শাহেদের হাসি দেখে চমকে বললো,
” হাসছো কেনো? হাসার কি হলো এখানে?”
” না এমনি। অতীতের কথা মনে পড়ে গেলো। ”
তানিয়া আর কিছু বললো না বালিশে হেলান দিয়ে বসে রইলো।
শাহেদ যখন ফোর্থ ইয়ারের পড়ে তখন তানিয়া দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। শাহেদ সিনিয়ার হওয়াতে সবাই তাকে চিনতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন পড়ার তেমন চাপ ও ছিলো না। তবে শাহেদ ছিলো বেশ একটিভ ছাত্র। আর তানিয়া ছিলো প্রচুর চঞ্চল, চারু কারু কলা বিভাগের মেয়েরা ছিলো সিনিয়ার দের মূল আকর্ষণ। ভার্সিটির প্রগ্রামের নাটকে প্রথম দেখা হয় তাদের। তানিয়া যখন তার চারু কলা ক্লাস করতো, শাহেদ ঠিক এভাবেই আড়ি পেতে তাকিয়ে থাকতো। কতো বার লুকিয়ে তানিয়াকে দেখতে গিয়ে বন্ধুদের কাছে ধরা পড়েছে, তার কোন হিসেব নেই। ভাবতে ভাবতেই শাহেদ মনে মনে আবার হাসলো,
শাহেদ তানিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে তানিয়া শিহাবের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমের ঘোরে চলে যাচ্ছে। এক সময় তানিয়া ঘুমে তলিয়ে গেলো।
শাহেদ তানিয়ার গভীর ঘুমের অপেক্ষা করলো, অনেক টা সময় পার হতেই চুপি চুপি তানিয়া কপালে একটা চুমু একে দিলো। সাথে শিহাবের ও….
————————————————–
বারান্দার এক কোনে মানহা বসে আছে, শাড়ির আঁচল মুখে চেপে হেঁচকি শব্দ আড়াল করছে। কিন্তু চোখের জল আর মন কি বাধ মানে…
কুসুমতি ভিলায় মানহা অনেক বার এসেছে, শিহাব কে পড়াতে। তাই তার বারান্দা অচেনা নয়, ড্রইংরুম ছাড়া সব রুমের লাইট প্রায় অফ করা।
নতুন বউয়ের কান্না শুনলে মেহমান, বাসার সবাই কি ভাববে তা কল্পনা করেই মানহা শাড়ির আঁচল চেপে কান্না নিবারন করার কেষ্টা করছে।
হঠাৎ কাধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে মানহা চমকে উঠলো। দু হাত দিয়ে চোখ মুছে বললো,
” কে?”
” আমি ওয়াহাব। চা খাবেন? ” বলেই ওয়াহাব কাপটা এগিয়ে দিলো।
মানহা নিলো না, ওয়াহাব কাপটা ট্রি টেবিলে রেখে বললো,
” বাইরে বসে থাকতে দেখলে, সবাই সমালোচনা করবে। ভেতরে..”
” আপনার সাথে একই রুমে থাকার কোন ইচ্ছে আমার নেই। এক বিছানায় তো নয়ই। ”
” থাকতে হবে না এবার চলুন। ”
মানহা শ্বাস ফেলে, রুমের দিকে গেলো…
।
।
চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই ❤️