শঙ্খচিল পর্বঃ-৫৪

0
1837

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-৫৪

ডালিম গাছের সরু ডাল টা অনেক টাই বাকিয়ে গেছে, ছোট ডালিমটা অনেকটাই বড় হয়ে গেছে, ডালিমের ভারের কারনেই হয়তো ডাল টা বাঁকিয়ে গেছে। তানহা লাল টক টিকে ডালিমটার দিকে তাকিয়ে আছে। এতো দিন সে, ডালিম গাছের ডাল টার দিকে খেয়ালই করে নি, কি যেনো মনে করে তাকাতেই তানহার ডালিম গাছটার দিকে চোখ পড়লো।
মুকুল সাহেব মারা গিয়েছেন আজ তিন দিন হলো। তিন দিন তানহা চেহারায় বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে, অতিরিক্ত কান্না কাটির কারনে তানহার চোখের নিচে কালো দাগ জমেছে, চেহারাটা ধূসর সাদা হয়ে গেছে৷ তানহা খাটের কোনে মাথা দিয়ে ফ্লোরে বসে আছে এবং আনমনে কি যেনো ভাবছে,

” তানহা। ”

হঠাৎ কারো ডাক শুনে তানহার ধ্যান ভাংলো। তানহার চোখ মুছে সামনে তাকিয়ে দেখলো ইলহাম দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম ধীরে ধীরে তানহার পাশে গিয়ে বসলো। তানহা বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে, ইলহাম তানহার উদ্দেশ্য বললো, ” আগামীকাল আপনার কি পরিক্ষা?”

তানহা চমকে বললো, ” কৃষি শিক্ষা। কেনো বলুন তো?”

” কৃষি শিক্ষা, খুব কঠিন বিষয় না। আমার ধারণা, এক বার রিভাইস ই যথেষ্ট। ”

” আমি এই মূহুর্তে পড়ার মতো পরিস্থিতি তে নেই। ”

” জানি। তবে পরিক্ষাটা আপনাকে দিতে হবে তানহা। আমি চাই না আপনি ফেইল করেন। এক বছর ড্রপ দিন৷ অন্তত পাশ নম্বর উঠিয়ে আসবেন। ”

” আমার জায়গায় আপনি থাকলে কি করতেন? ”

” যা বললাম তাই করতাম। বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ চিরকাল বেঁচে থাকে না। আপনি আমিও এক দিন সৃষ্টিকর্তার কাছে চলে যাবো। যে টুকু সময় বেঁচে আছেন নিজের সম্মান, মানুষীক পরিস্থিতি নিজেকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে তানহা। পরিক্ষা গুলো দিন। বাকিটা সৃষ্টি কর্তার ইচ্ছা। ”

তানহা অবাক হয়ে, ইলহামার দিকে তাকিয়ে আছে। এই তিন দিন ইলহাম তাদের বসাতেই ছিলো, সবাই কে মেন্টালি সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ছেলে না হয়েও ছেলের দ্বায়িত্ব পূরণ করেছে, শোকের মধ্যেও তানহার দৃষ্টি উপেক্ষা করতে পারে নি। ইলহাম তানহার পাশের থেকে উঠতে উঠতে বললো,
” আশা করি আপনি আমার কথা বুঝতে পেরেছেন। ” বলেই পাঞ্জাবিটা ঝেড়ে ইলহাম উঠে চলে গেলো।

———————————————-

” মানহা তুমি তিন দিন ধরে কিছু ঠিক মতো খাও নি, প্লিজ একটু খেয়ে নাও। না হলে আরো দূর্বল হয়ে পড়বে। “।
বলতে বলতেই ওয়াহাব স্যুপের চামুচটা মানহার মুখের পানে তুলে ধরলো। মানহা অরুচি নিয়ে বললো,
” বিশ্বাস করুন ওয়াহাব আমার একদম খেতে ইচ্ছে করছে না। ”

” জানি মানহা। আপনার মানুষীক স্থিতি আমি উপলব্ধি করতে পারছি। একটু খেয়ে নিন।” ওয়াহাবের জোরা জুরিতে মানহা এক চামুচ স্যুপ খেলো। আগের মতোই মানহার ভেতটা কেমন অদ্ভুত লগছে। ইচ্ছে হচ্ছে অন্ধকার রুমে চুপ করে বসে থাকতে।
মানহার ইচ্ছেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই পূরণ হলো। ইমারজেন্সি ফোন কল আসতেই ওয়াহাব পাঞ্জাবি পড়েই হাসপাতালে চলে গেলো। মানহা স্যুপের বাটির দিকে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পরক্ষণেই মনে পড়লো, দাদী তো কিছু খায় নি, তিন বেলা ঠিক কতো ঔষধ না খেলে দাদীর হার্টে সমস্যা আরো বেরে যেতে পারে।

মানহা খাবারের ট্রে টা হাতে নিয়ে দাদীর রুমে প্রবেশ করলো, দাদী জায়নামাজে বসে মুনাজাতে কান্না করছেন। অনেক ক্ষন সময় দাদীর অপেক্ষায় বসে থাকার পর দাদীর মুখে খাবার তুলে দিলো মানহা, শেহতাজ বেগম খেতে না চাইলে মানহা, অসুস্থতার কথা বলে কোন মতে খাইয়ে ঔষধ খাওয়ালো। অতঃপর মানহা দাদীর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে রইলো। জানালার পানে তাকিয়ে বললো,
” ছোট বেলায় মা চলে যাবার পর, বাবাই আমাদের মানুষ করেছেন, আমাদের কথা ভেবে বিয়ে পর্যন্ত করেন নি, সৃষ্টি কর্তা আমাদের অনাথ বানিয়ে দিলেন। বাবা নামক বট গাছটা এখন আর নেই…”

।।।।।।।।।।।।

সকাল নয় টা বাজে। তানিয়া রহিমা খালার সাথে মিলে সকালের নাস্তা তৈরি করলো, তানিয়া শিহাবের উদ্দেশ্য বললো, ” শিহাব, তানহা আন্টি কে নাস্তা খেতে ডাক দাও। ”

শিহাব তার মায়ের কথা মতো তানহার রুমে গেলো, তানহা অস্ফুট কন্ঠে পড়ার চেষ্টা করছে, শিহাব তানহার কাছে গিয়ে বললো, ” আপনাকে আম্মু নাস্তা খেতে যেতে বলেছে। ”

তানহা অবাক হয়ে বললো, ” তানিয়া আপু?”

” হুম৷ ” বলেই শিহাব রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। তানহা রেডি হয়ে বাইরে যেতেই দেখলো তানিয়া মানহা কে খাইয়ে দিচ্ছে। তানহা কে দেখে তানিয়া বললো,
” তোমার পরিক্ষা তুমি তাড়াতাড়ি বসে পড়ো। ঠিক মতো না খেলে কিন্তু পরিক্ষা দিতে কষ্টা লাগবে। ”

তানহা বসে কোন মতে নাস্তা করে নিলো। চার দিন আগেই সে বাবার থেকে দো’আ নিয়ে পরিক্ষা দিতে গিয়ে ছিলো অথচ আজ তার কেউ নেই। ভাবতেই নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তানহার। তার বাবার আর নেই, এটাই এখন চরম সত্যি ।
মানুষ সত্যি টাকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না অথচ মিথ্যা টাকে কত সহজেই মেনে নেয়।

” আপনি রেডি তানহা? ”

তানহা সামনে তাকিয়ে দেখলো ইলহাম হাতে হ্যালমেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তানহা মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বললো। অতঃপর ইলহাম বললো,
” তাহলে চলুন আপনাকে ঝিগাতলা পর্যন্ত দিয়ে আসি। ভাবি আমি তানহা কে ড্রপ করে দিলে কি তুমি মাইন্ড করবে। ”

মানহা মাথা দুলিয়ে না বলল। ইলহাম বেড়িয়ে পড়লো, তানহা ইলহামের পেছনে বসে আছে ইলহাম আপন মনে বাইক চালিয়েই যাচ্ছে, কোন কথা বলছে না। বাইক থামলো ঠিক তানহার পরিক্ষার কলেজের সামনে। তানহা বাইক থেকে নেমে, ” থ্যাংক ইউ। ” বলেই ভেতরে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনি
তানহা থমকে দাড়ালো। তানহা পূর্ন রায় গিয়ে বললো,
” একটা কথা বলবো? ”

ইলহাম অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ” হুঁ!”

” আপনাকে আরো একবার ধন্যবাদ। আমাকে অনুপ্রেরণা দেওয়ার জন্য। আমি সত্যি ভীষণ ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আপনার কথা গুলো শুনেই পরিক্ষা দিতে এসেছি। ”

ইলহাম হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে, মুখে হাসি টেনে বললো, ” অল দা বেস্ট। আর কিন্তু বেশি সময় বাকি নেই। ”
তানহা দ্রুত কলেজে ঢুকে গেলো।
ইলহাম তানহার যাবার পানে তাকিয়ে, রইলো।

দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলো দের মাস মাস। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে আগের থেকে, পলাশি বাজারের বাড়িটা কিছুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে তাড়া, ধানমন্ডি দুইয়ে কোন এক স্থানে নতুন বাসা ভাড়া নিয়েছে। তানহার পরিক্ষা আজ শেষ।
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়, বৃষ্টি থাকার কারনে তানহার বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগেছে বাসায় ফিরতে।
বাসায় ঢুকে তানহা খানিকটা চমকে গেলো, বাসা মেহমান এসেছে৷ তার বড় বোনের শ্বশুর -শ্বাশুড়ি বসার রুমে বসে আছে। কিছু একটা নিয়েই আলাপ আলোচনা করছেন তারা।
হঠাৎ তানহা কে দেখা মাত্রই সবাই চুপ হয়ে গেলো। তানহা একটু অবাক হলেও, সালাম দিয়ে রুমে চলে এলো। আজ তার মনটা ভালো নেই। আকাশের মতো তার মনেও মেঘ জমেছে। অথচ মেঘ জমার কারন সে নিজেই বুঝতে পারছে না।
ফ্রেশ হয়ে, তানহা কলেজ ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই ক্ষানিকটা চমকে গেলো, কারন তার সামনে মানহা দাঁড়িয়ে আছে হাতে একটা গাড়ো লাল রংয়ের শাড়ি৷

মানহা হন্ত দন্ত হয়ে বললো, ” দ্রুত এদিক আয় তোকে শাড়িটা পড়িয়ে দেই! ”

তানহা অবাক হয়ে বললো ” শাড়ি? কেনো হঠাৎ? ”

মানহা শাড়ির ভাজ খুলতে খুলতে বললো, ” কিছুক্ষণ বাদেই তোর আর ইলহামের বিয়ে। বাইরে সবাই তোর রেডি হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ”

তানহা বিস্ময় নিয়ে বললো, ” কিন্তু ইলহাম তো আমায় ভালোবাসে না আপু। ”

” ভালোবাসে কি না আমি পুরোপুরি শিওর না। তোর চলে আসার দিনই আমি ইলহামের সাথে কথা বলেছিলাম, তোকে নিয়ে একবার ভেবে দেখতে বলেছিলাম । ইলহাম সে দিন চুপ করে ছিলো। হয়তো আগেই ভেবে রেখেছিলো তোকে বিয়ে করবে৷ কিন্তু হঠাৎ বাবার চলে যাওয়া, তোর পরিক্ষা সব মিলিয়ে ইলহাম এতো দিন কিছু বলে নি। ”

তানহা অবাক হয়ে, শুনেই চলেছে মানহা কিছুক্ষণের মধ্যেই তানহা কে শাড়ি টা পড়িয়ে দিলো, অতঃপর হালকা সাজিয়ে দিলো৷
বাবা মারা যাবার পর তানহার চেহারাটা একে বারেই মলিন হয়ে গিয়েছিলো। লাল শাড়িতে লাল টুক টুকে লাগছে বোনটাকে। মানহার চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। তানহাকে নিয়ে মানহা বসার রুমে চলে গেলো, তানহা ওয়াহাবের মায়ের কাছে বসতেই কুসুম বেগম তানহা কে গয়না পড়িয়ে দিলেন। অতঃপর বললেন,
” মানহার মতো তুমিও লক্ষি মন্ত হয়ে থেকো৷ আমার উশৃংখল ছেলেটার পাশে থেকো সব সময়। ”

তানহা এক বার ইলহামের দিকে তাকালো, ইলহাম মায়ের কথা শুনে লজ্জায় মাথা নিচু করে আছে। শাহেদের সাথে কাজি সাহেব বাসায় প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষনের মধ্যেই তানহা এবং ইলহামের বিয়ে সম্পন্ন হলো৷ শেহতাজ বেগম নাতজামাইয়ের হাতে আংটি পড়িয়ে দো’আ করলেন।
মানহা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছে, ওয়াহাব মানহা কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো…


চলবে
আমার গ্রুপে জয়েন হবার অনুরোধ রইলো 👇
RUHI JAHAN MAYA-রুহি জাহান মায়ার গল্প ঝুড়ি

[ আগামীকাল আমার ইংরেজি এক্সাম, আপনাদের খুশির জন্য পর্বটা দিলাম৷ সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন।
৫৫/শেষ পর্ব শুক্রবার সন্ধ্যায় পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ ]
গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here