শঙ্খচিল পর্বঃ-৫৫ শেষ পর্ব

0
2053

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

৫৫/শেষ পর্ব-

রাত বারোটা কি সারে বারোটা বাজে, বারান্দা থেকে বেলী ফুলের তীব্র গন্ধ রুমে প্রবেশ করছে। দমকা হাওয়ায় এলো মেলো হয়ে, জানালার পর্দা গুলো উড়ছে। মনে হয়, আজ রাতেও এক পশলা বৃষ্টি হবে। মূহুর্তে মেঘের গুড়ুম গুড়ুম ডাকে তানহার ধ্যান ভাংলো। ইলহামের রুমে সিগারেটের পটকা গন্ধ তার একদম ভালো লাগছিলো না, বাধ্য হয়েই তানহা জম পড়া জানালা গুলো খুলে দিয়েছে। তানহা একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, বারোটা বেজে উনিশ মিনিট। তানহার একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, তানহা বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো।
যদিও সে জানে তার এখন ঘুম আসবে না। খট করে দরজা খোলার শব্দে তানহা একটা চোখ মেলে একবার তাকালো। ইলহাম এসেছে, তানহা আবারো চোখ বুজে ঘুমের ভান ধরে বসে রইলো।

ইলহাম পাঞ্জাবি থেকে সিগারেটের পেকেট, লাইটার আর ফোনটা বিছানার পাশে রেখে দিলো। ওয়াশ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসেই ইলহাম দেখলো, তানহা বিছনার আরেক পাশে আগের ভংগিমায় ঘুমিয়ে আছে। ইলহাম কিছু একটা ভেবে তানহার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। তানহার মাথায় বিলি কেটে দিতেই তানহা মুখ ফসকে বললো, ” আমার মাথায় উঁকুন নেই। এক্কে বারে ফ্রেশশশ… ”

পরক্ষনেই তানহা জ্বিভ কামড়ে তাকালো। ইলহাম হাসছে, তানহা ঠোঁট ফুলিয়ে লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। ইলহাম হাসতে হাসতে বললো,
” আমি জানতাম তুমি ঘুমাও নি। ”

তানহা ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,” ধ্যাত। কিভাবে বুঝলেন? ”

” বুদ্ধিমান মানুষের জন্য খেয়াল টাই যথেষ্ট। তুমি ডান দিকে শুয়ে ছিলে, ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ডান৷ দু এক মিনিটে হাতের চুড়ি তো আবার উধাও হবার কথা নয়। ”

তানহা হাতের দিকে তাকালো। ইলহাম ওয়াশ রুমে যাবার পরেই সুযোগ বুঝে যে চুড়ি গুলো খুলে টেবিলে রেখে ছিলো। তানহা লজ্জায় মাথা নিচু করে বসে আছে, ইলহাম হাতে হাত ভাজ করে বললো,
” এতো নাটক করার কারন টা কি ম্যাডাম? ”

” কিছু না। ঘুমান৷ ”
বলেই তানহা শুতে যাবে ঠিক তখনি ইলহাম তানহার হাত টা খপ করে ধরে বললো,

” ঘুমিয়ে বাসর রাত টা ওয়েস্ট করতে চাই না। ”

তানহা চমকিয়ে বললো, ” মানে?”

” বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, আর পাশে নতুন বউ৷ আমার ঘুম আসবে না। ” বলেই হাতে চুমু দিলো।

তানহা আমতা আমতা করে বললো ” তাহলে আমি ঘুমাই আপনি বসে থাকেন। ”

ইলহাম তানহার ঠোঁটের আংগুল ছুঁইয়ে বললো, শশশ..

———————————————-
বাইরে এখনো ঝিরিঝিরি ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। তানহা ইলহামের বুকে গুটি শুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে, ইলহাম তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, সযত্নে তানহাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ইলহাম পোশাক ঠিক করে, সতর্কতা নিয়ে পা টিপে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো।
প্লেটে খাবার বেড়ে দ্রুত গতিতে বাসার নিচে নেমে এলো, কুসুমমতি ভিলার পেছনে ক্ষানিকটা দূরে পুরাত একতালা বিল্ডিংয়ে। কাঠের পুরনো দরজাটার তালা খুলে ঘুট ঘুটে অন্ধকারে প্রবেশ করলো ইলহাম। পকেট থেকে লাইটার টা বের করে, আগুনের আলোয় শিঁড়ি বেয়ে ইলহাম মাটির এগারো ফুট নিচে নামলো।

লাইট জ্বালানি সামনে তাকাতেই দেখলো, ব্লাক কোবরা চেয়ারের সাথে আগের মতোই কারেন্টের শিকলে বাধা অবস্থায় বসে আছে৷ একটু নড়তেই কারেন্টের ঝটকায় ছট ফট করে উঠছে৷ ইলহাম কারেন্টের সুইচ অফ করে মুখে থেকে টেপ টা সরাতেই ব্লাক কোবরা বললো,

” শুয়োরের বাচ্চা আমার আগেই তোর ওপর সন্দেহ হয়েছিলো৷ মানহার বৌ-ভাতে, তানহার অসুস্থ তার সময় তুই আমাকে ধরে তে এসেছিলি, ব্লাস্টার্ড। ছাড় আমাকে! ”

ইলহাম কান চুলকিয়ে বললো, ” উফফ শ্বশুর মশাই। আর কতো গালি দেবেন। এখন আপনার মেয়ে জামাই আমি। আমাদের বিয়ের রোস্ট, পোলাও খেয়ে নিন।” বলেই ইলহাম প্লেট টা এগিয়ে দিলো।

হাতের সাহায্য প্লেট টা ফেলে দিয়ে,মুকুল সাহেব অর্থাৎ ব্লাক কোবরা বললো,
” চুপ কর, *কির পোলা। এখান থেকে ছুটতে পারলে তোকে আগে জবাই দিবো। আমার মেয়ে জানতে পারলে তোর সাথে জীবনেও সংসার করবে না৷ ”

ইলহাম হাই দিয়ে বললো, ” বাসর রাতটা সেরে আপনাকে বিয়ের খাবার খাওয়াতে এসেছি। তার চেয়ে বড় কথা তানহা-মানহা জানে, আপনি চল্লিশ দিন আগেই পগারপার হয়ে গেছেন। ”
বলেই ইলহাম বাঁকা হাসলো৷ ব্লাক কোবরা বিস্ময় নিয়ে বললো,
” কিহহহ! ”

ইলহাম হাতে হাত ভাজ করে বললো, ” নন্দু ভাইয়ের পানিতে ছোট একটা ক্যাপসুল চিপ মিলিয়ে দিয়েছিলাম। নন্দু ভাইকে ট্রেস করে আপনার ডেরায় গিয়ে আপনার অর্ধেক চ্যালা কে মেরে আপনাকে তুলে এনেছি। সেদিন রাতেই, আপনার সাইজের একটা লাশ কিনে আপনার শার্ট, প্যান্ট আংটি পড়িয়ে ব্রেক সিস্টেম ছাড়া নষ্ট গাড়ির ভেতরে বসিয়ে দিয়েছিলাম৷ গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দেয়ালে ধাক্কা লেগে যখন ইঞ্জিন ব্লাস্ট হয়ে ছিলো তানহা নিজের চোখে তখন আপনাকে সরি আপনাকে আজানো আধ পোড়া লাশটার পড়া পোশাক আংটি দেখে নিজের বাবা কে চিহ্নিত করেছিলো। এইযে আপনার ডেড সার্টিফিকেট।”

বলেই মুকুল সাহেবের দিকে ছুড়ে মারলো, রাগে ক্ষোভে চক্ষ দুটো জ্বল জ্বল করছে। চোখ দিয়ে অচিরেই গড়িয়ে পানি পড়ছে। চেয়ার সহ কাঁপছে, ইলহাম থপ করে চেয়ারটা ধরে বললো,
” কষ্ট হচ্ছে খুব? কষ্ট হচ্ছে? আমারো অনেক কষ্ট হয়েছিলো যখন তুই নির্দোষ মেয়ে কে তরপিয়ে তরপিয়ে মেরে ছিলি। ”

মুকুল সাহেব অবাক হয়ে বললো, ” তুই কোন মেয়ের কথা বলছিস?”

” অনামিকা। আমার ভালোবাসা।”

মুকুল সাহেব ক্ষানিকটা পরে খে খে করে হেসে বললো, ” তাহলে তুই ওই ওই খা*কি টার প্রেমিক। ”

ইলহাম সজোরে ঘুষি মেরে বললো, ” মুখ সামলে কথা বল। মাটির এগারো ফুট নিচে তোকে সমাধী দিলেও মাছিটাও টের পাবে না। কি দোষ ছিলো অনামিকার বল..”

মুকুল সাহেব আগের মতোই হেসে বললো, ” অনামিকার চাচাত ভাই আমার সাথেই চাকরি করতো। এক অনুষ্ঠানে অনামিকা কে দেখে, ভোগ করার সাধ হয়ে ছিলো। আমার চ্যালা দের দিয়ে ওকে তুলি নিয়ে গিয়ে ছিলাম। কাজ শেষে মেয়ে টাকে দুবাই পাঁচার করে দিবো, কিন্তু তুই তোল পাড় করা শুরু করলি,আমার ছেলে পুলেদের তুলে এনে টর্চার করলি তোর ওপর বিরক্ত হয়ে-ই মেয়েটাকে আমার ছেলেদের হাতে তুলে দিলাম। এক রাতেই ছেলে পুলে গুলো মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেলো। মরা মেয়েটাকে তো আর পাঁচার করতে পারি না, তাই বস্তায় ভরে মিরপুর ব্রিজে ফেলে দিয়ে আসতে বলেছিলাম। ”

ইলহাম পূর্নরায় কয়েক টা ঘুষি দিয়ে বললো ” শালা, হারামি বাচ্চা তোর কি বিবেকে বাঁধলো না।মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এগুলো করতে।”

ব্লাক কোবরা হেসে বললো, ” আমার কাজই তো এটা। তাই তো আমি আন্ডার ওয়াল্ডের মাফিয়া কিং, ব্লাক কোবরা। ”

” তোর মেয়েরা যখন জানবে তো কুকীর্তির কথা একবার ভেবেছিস ওদের কেমন লাগবে। জন্মের এতো বছর পর যখন জানবে ওদের জন্ম দাতা পিতা, নারী ব্যাবসায়ী, নারী পাঁচার কারী, খুন, মাদক এমন কোন বে-আইনী কাজ নেই যে ওদের বাবা না করে। ”

” এতো বছর জানে নি আর জানবেও না। ওরা জানার আগেই আমি নিজেকে শেষ করে ফেলবো। ”
বলেই কারেন্টের সুইচ অন করে নিজেই শক নেওয়া শুরু করলো। ইলহাম দ্রুত সুইচ টা অফ করে দিয়ে বললো।

” তোকে এতো সহজে আমি মারতে দেবো না। মাটির এগারো ফুট নিচে, তুই আস্তে আস্তে মরবি, যখন সূর্যের আলো দেখতে পাবি না। এক বেলা শুকনো রুটি খেয়ে,পানির অভাবে তুই ধুকে ধুকে মরবি। ” বলেই ইলহাম বাতি নিভিয়ে চলে এলো।

তিন বছর পর………

কেটে গেছে তিনটা বছর, পরিবর্তন হয়েছে অনেক কিছু। মানহা একজন ইন্টার্নিশিপ ডাক্তার, তানহার কোল জুরে এসেছে ফুট ফুঁটে একটা মেয়ে, তার নাম ‘অনামিকানহা ইলহাম’
বদলেছে শহরের অবস্থা, তবে ব্লাক কোবরার অবস্থা বদলায় নি। আজও সে অন্ধকার কুটুরীতেই বদ্ধ।
হঠাৎ কারো পায়ের শব্দ পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো ব্লাক কোবরা, ভাংগা কন্ঠে বললো,
” আমি আর বাঁচতে চাই না। আমাকে মেরে ফেলো ইলহাম। আমি আমার কর্মের শাস্তি পেয়েছি। ”

ইলহাম সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে বললো, ” মুক্তি পাবেন। ”

মুকুল সাহেব কন্ঠ উঁচিয়ে বললো, ” আমি মুক্তি পাবো?আমি সূর্যের আলো দেখবো। আমি প্রান ভরে শ্বাস নেবো। ”

” উহু। কিছুক্ষনের মধ্যেই এই পুরাতন বিল্ডিংয়ে ভাংগা হবে৷ আপনার পাপের টাকা দিয়ে তৈরি হবে, ‘অনামিকানহা ওয়ামান হস্পিটাল’ শত শত মহিলাকে আপনার বড় মেয়ে চিকিৎসা দেবে। আর এই এগারো ফুট গভীর জায়গাটাও ইট সুরকির সাথে ভেংগে গুরিয়ে যাবে। সাথে সাথে আপনিও পাবেন চিরন্তন মুক্তি। ”

বলেই শেষ বারের মতো ইলহাম তার প্রেমিকার খুনি কে চিরন্তন বিদায় দিয়ে বেরিয়ে এলো। বের হতে হতে ইলহাম আরেক টা সিগারেট জ্বালালো। এটা তার শেষ ধূমপান এর পরে আর কখনো সে সিগারেট ছুঁবে না।

কুসুম বেগম, মতি সাহেব, মানহা, ওয়াহাব, তানহা ইলহাম, শাহেদ, তানিয়া সবাই উপস্থিত হয়েছে। প্রজেক্ট ‘ অনামিকানহা ওয়ামান হস্পিটাল ‘ তৈরির কাজ শুরু। বুলডুজ্বার মেশিন দিয়ে পুরাতন বিল্ডিং ভাংগা হচ্ছে, কয়ক মিনিটেই গুরিয়ে গেলো সব৷ মুক্তির স্বাদ পেলো মুকুল সাহেব, তবে মৃত্যুর।

সমাজে বঞ্চিত মহিলাদের চিকিৎসা দেওয়ার স্বপ্নটা ওয়াহাব মানহার পূরণ হবে খুব শীগ্রই। ভাবতেই মানহা ওয়াহাবের হাতটা শক্ত করে ধরলো।
ইলহাম তার মেয়ে অনামিকানহার গালে চুমু দিয়ে বললো, ” #শঙ্খচিলের উদ্দেশ্য টা পূরণ হয়েছে। #শঙ্খচিল আজ নতুন জীবন পেলো। ”

তানহা অবাক হয়ে বললো, ” মানে?”

——————- শুভ সমাপ্তি —————–

গল্প টা কেমন লেগেছে অবশ্যই জানাবেন। আমি ভীষণ অসুস্থ, পরিবারের ওপর থেকে বিপদ কাটছেই না। সবাই প্লিজ দোয়া করবেন।
মানুষীক ভাবে শক্ত হয়ে,খুব শীগ্রই নতুন গল্প নিয়ে আসবো৷ ইনশাআল্লাহ। ভালো লাগলে গল্পটা,শেয়ার করবেন।
সবাই ভালো থাকবেন, আসালামু আলাইকুম 🌹

সম্পূর্ণ গল্পের লিংক 👇
https://www.facebook.com/100071778201752/posts/154571683612104/?app=fbl

আমার গ্রুপ লিংক -https://www.facebook.com/groups/346259796841444/?ref=শেয়ার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here