#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্বঃ–৪৪
বাইরে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে, ট্রেনের জানালার ফাঁকে ফাঁকে বৃষ্টির পানির ফোটা মানহার গায়ে লাগছে। মানহা অন্ধকারে বাইরের দৃশ্য দেখছে। অন্ধকারে প্রকৃতির স্নান কি ভয়ংকর সুন্দর তা মানহা না দেখলে, জানতে পারতো না। মানহা জানালার ফাঁকে হাত দিতেই ওয়াহাব মানহার হাত টা খপ করে ধরে ফেললো। মানহা অবাক হয়ে বললো, ” এটা কি হলো?”
” মনে আছে এর আগের বারের কথা?”
মানহা পিট পিট করে তাকিয়ে বললো, ” উহু।”
” বৃষ্টিতে ভিজে কি জ্বর বাধিয়ে ছিলেন। ভাগ্যক্রমে আপনাকে কল দিয়ে ছিলাম তাই তো জানতে পেরেছি। ”
” একটু খানি ধরলে কিছু হবে না। ”
” উহু৷ একটুও না। ”
” জাস্ট একটু ছুঁয়ে দেখবো৷ ”
ওয়াহাব মুচকি হেসে বললো, ” একটু৷ বেশি না। ”
বলেই ওয়াহাব মানহার নাক টপে দিলো। মানহা একটু হাত ভিজিয়ে নিজের মুখে পানির ছিটা দিলো। বিন্দু বিন্দু পানি মানহার মুখে লেপ্টে আছে। মানহার গালে লপ্টে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি ওয়াহাব ছুঁয়ে মিলিয়ে দিচ্ছে। মানহা চোখ বন্ধ করে, ওয়াহাবের স্পর্শ অনুভব করছে৷
একটা কথা বললবো, ” হুম। ”
” চলুন না একটু দরজার কাছে যাই। ”
” রাত বারোটা বাজে এখন। ”
” হুম ভালোই হয়েছে৷ লোকজনের ভীর নেই। চলুন না। প্লিজ৷ ”
ওয়াহাব একটু ভেবে বললো,” উমমম, যাবো৷ তবে আমাকে একটা গান শোনাতে হবে৷”
মানহা চমকে গিয়ে বললো ” গান। ”
” হুম। শুনেছি আপনি নাকি খুব ভালো গান গাইতে পারেন। ”
মানহা স্মিথ হেসে বললো, ” আচ্ছা। ”
ওয়াহাব মানহা কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলো, আগের মতো এখন আর ভাপসা গরম নেই৷ বরং বাতাসে এখন উষ্ম লাগছে। মানহা গায়ে ঠিক মতো ওরনা জরিয়ে নিলো। ওয়াহাব চশমা টা ঠিক করে বললো,
” ঠান্ডা লাগছে? ”
” একটু একটু৷ ”
” চলুন চা খাই। ”
” আচ্ছা। কিন্তু এতো রাতে কি চা পাবো? ”
” গিয়ে দেখতে পারি৷ ”
ওয়াহাব মানহা কেবিন পেরিয়ে ট্রেনের কেন্টিনের দিকে গেলো। হলুদ লাইটে রুমটা, আবছা আবছা লাগছে, আঠারো-কুড়ি বছরের একটা ছেলে বসে বসে ঝিমুচ্ছে। ওয়াহাব টেবিলে খট খট শব্দ করতেই ছেলেটা হক চকিয়ে উঠে বললো,
” স্যার স্যার, কি লাগবে বলেন। ”
” দুটো আদা চা, আর দুটো টোস বিস্কুট। ”
” আর কিছু লাগবে স্যার? ”
” না। লাইট অন করলেই হবে। ”
” স্যার রাতের বেলা এই লাইট চলে। আর লাইটের ব্যাবস্থা নাই৷”
” তাহলে আর কি করার। চা, আর বিস্কুট তাড়াতাড়ি পেলেই হবে। ”
” ঠিক আছে স্যার। আপনারা বসুন। ”
মানহা জানার পাশের একটা টেবিলে গিয়ে বসলো। বিপরীত চেয়ারে ওয়াহাব ও বসলো। বাতাসে মানহার চুল গুলো উড়ছে, আবছা আলোয় ওয়াহাব মনোযোগ দিয়ে মানহাকে পর্য্যবেক্ষন করছে।
হঠাৎ ছেলেটা চা আর বিস্কুট নিয়ে এলো। ওয়াহাব পকেট থেকে টাকা বের করে বিল দিলো, ছেলেটা খুশি হয়ে বললো,
” আর কিছু লাগলে বলবেন স্যার। ”
ওয়াহাব ” আচ্ছা। ” বলতেই ছেলেটা চলে গেলো। মানহা টেবিলের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,
” টোস বিস্কুট কেনো?”
ওয়াহাব একটা টোস বিস্কুট নিয়ে চায়ে ডুবিয়ে ধরে বললো, ” মনে আছে আমাদের প্রথম পরিচয়ের কথা। এমনই এক গভীর রাতে কেন্টিনে বসে চা খেয়েছিলাম দুজনে। ”
মানহা মুচকি হেসে বললো, ” হ্যাঁ৷ সে দিন খুব খুধা লেগেছিলো। ক্যান্টিনে কিছু না থাকায় টোস বিস্কুট দিয়ে কোনমতে চালিয়ে নিয়েছিলাম। ”
ওয়াহাব চায়ে ভেজা টোস বিস্কুটা মুখে পুরে বললো, ” আমারো টোস বিস্কুট দিয়ে চা খেতে ইচ্ছে করেছিলো, কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি তাই ভাবলাম, বউয়ের সাথেই না হয় খাওয়া যাক।
মানহা স্মিথ হেসে, ট্রেতে রাখা টোস বিস্কুট টা চায়ে ভেজাতে শুরু করলো।
————————————————–
ঘরটা ধোঁয়ায় ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, ধোঁয়া টা আগুনের না, পোড়া সিগারেটের। জানালা কাঁচে দিয়ে বাইরের আলো রুমে প্রবেশ করতে পারছে না, ধোঁয়ার কারনে।
ইলহাম জোরে জোরে কাশি দিয়ে জানালাটা খুলে দিলো। ঠিক তখনি হু হু করে সব সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে বাইরে চলে গেলো।
বাসা খালি থাকায় সে বেশ আনন্দে সিগারেট টানতে পারছে। অন্যান্য সদস্য থাকলে স্বাধীন ভাবে এতো গুলো সিগারেট খেতে পারতো না সে, ইলহাম সেন্টার টেবিলে ল্যাপটপ রেখে রান্না ঘরে গেলো ব্লাক কফি বানাতে। কফির পানি চুলোতে বসাতেই, হঠাৎ কল এলো তার৷
জরুরি কল ভেবে ইলহাম হন্ত দন্ত হয়ে ল্যাপটপের কাছে এলো। একটা আন নোন নম্বর থেকে কল এসেছে, তার পার্সোনাল ফোনে৷ কে হতে পারে ভাবতে ই ইলহাম ফোনটা রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে বললো,
” হ্যাঁলো ইলহাম বলছেন। ”
” হ্যাঁ। কে আপনি। ”
তানহা নিরাষ হয়ে বললো, ” আমাকে চেনেন নি?আমি তানহা। ”
ইলহাম অবাক হয়ে বললো, ” তানহা? ”
” হুম। কেমন আছেন?”
” ভালো। আপনি?”
” ভালো না। আমার জ্বর হয়েছে।”
ইলহাম ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বললো,
” ও আচ্ছা। ঔষধ খান। ”
তানহা অবাক হয়ে বললো, ” আমার কেনো জ্বর হয়েছে জানতে চাইবেন না?”
” না। এখন ফোন রাখছি। “বলেই ইলহাম ফোনটা কঁটে দিলো।
ইলহাম এক দৃষ্টিতে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রতিটি মূহুর্ত ইলহাম নন্দু ভাইয়ের লোকেশন ট্রেস করে যাচ্ছে। গতো তিন দিন ধরে নন্দু ভাই কারওয়ান বাজারের পড়ে আছে। হঠাৎ রাত সারে বারোটা বাজে অন্য লোকেশনে যবার কারণ টা কি? কার কাছে যাচ্ছে নন্দু ভাই? ব্লাক কোবড়া।
নন্দু ভাই ধরা খাবার তিন দিনের মাথায় ব্লাক কোবরার কাছে যাবে। ব্লেক কোবড়ার মতো ডার্ক মাফিয়া এতো কাঁচা কাজ করবে না।
ভাবতে ভাবতেই নন্দু ভাইয়ের লোকেশন আর চেঞ্জ হচ্ছে না। দেখে ইলহাম অবাক হলো, নন্দু ভাই কি তার গন্তব্যর লোকেশনে চলে এসেছে? ইলহাম লোকেশনের দিকে তাকিয়ে থেমকে গেলো কারন, জায়গাটা আর কোথাও না…..
।।।।।
হঠাৎ ইলহামের এই আচারন তানহা একদম মেনে নিতে পারছে না। লোকটা এতো কঠিন মনের মানুষ কেনো? তানহা বললো, তার জ্বর এসেছে তবুও এই লোকটা তার কথা জানতে চাইলো না। শুনতেও চাইলো না।
তানহার খুব কান্না পাচ্ছে, ইচ্ছে করছে ফ্লোরে গড়া গড়ি খেয়ে কান্না করতে।
কেনো এই পাশান লোকটা তার কথা শুনলো না। কেনো। চাপা রাগটা তানহার মাথায় যেনো ঝেকে বসে রইলো ,তানহার ইচ্ছে করছে ইলহামেরর কলার চেপে জিজ্ঞেস করতে, কেনো এই লোকট তাকে এতো অবহেলা করে। কাছে টেনে নিয়েও দূরে ঠেলে দেয়৷ কি দোষ করেছে সে?
তানহা চাপা কান্না করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। কেউ তার কান্না দেখলো না। না কেউ অনুভব করলো তার যন্ত্রণা টা। শুধু সাক্ষি হলো এই চার দেয়াল আর ডালিম গাছের সরু তাজা ডালের ডালিম টা।
———————————————————–
“— শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে।
তোমারই সুরটি আমার মুখের পরে,বুকের পরে।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,পড়ুক ঝরে।
নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে
পড়ুক প্রাণে।
নিশিদিন এই জীবনের সুখের পরে, দুখের পরে।
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,পড়ুক ঝরে।—”
” আপু ঠিকই বলেছিলো আপনি সত্যি খুব ভালো গাইতে পারেন।”
মানহা স্মিথ হেলো, ট্রেনে দরজায় হেলান দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার আনন্দ টা আজ প্রথম বার উপভোগ করছে সে। শেষ কবে ঢাকার বাইরে গিয়েছিলো তাও ঠিক মনে পড়ছেনা মানহার৷ মানহা হাই দিয়ে বললো,
” প্রচুর ঘুম পাচ্ছে আমার। চলুন কেবিনে যাই। ”
” চলুন। বলেই মানহা হাটা শুরু করলো ওয়াহাব মানহা কে থামিয়ে দিয়ে বললো, ” দাঁড়ান। ”
মানহা চমকে বললো, ” কি হলো? ”
ওয়াহাব কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মানহা কোলে তুলে নিলো। মানহা হতবম্ব হয়ে, ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওয়াহাবের ঠোঁটের কোনের হাসির চিহ্ন। ওয়াহাব গুটি গুটি পায়ে কেবিনের দিকে গেলো।
ট্রেন খুলনা শহরে গিয়ে থামলো ভোর ছয় টায়। ট্রেন স্টেশনে আসার পূর্বেই তানিয়ার ঘুম ভেংগে গেছে, সে তাড়াহুড়ো করে শিহাব এবং শাহেদ কে ডাক দিলো৷ শিহাব ঘুম থেকে উঠে, চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,
” মা আমরা কি নানু বাড়ি চলে এসেছি?”
” হ্যাঁ শিহাব। ট্রেন থামলেই আমরা নেমে,যাবো। ”
ওয়াহাব মানহার লাগেজ গুছিয়ে কেবিন থেকে নামতেই দেখলো, বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন থামার অপেক্ষায়৷ মিনিট পাঁচেক পর ট্রেন ধীরে ধীরে থামতেই। সবাই নেমে পড়লো।
ওয়াহাব দের বাসাটা গ্রাম এবং শহরের মাঝা মাঝি জায়গায়, যেতে খুব বেশি সময় লাগে না। স্টেশন থেকে সবাই গাড়িতে করে বাসায় পৌছালো, সকাল…
।
।
চলবে
RUHI JAHAN MAYA-রুহি জাহান মায়ার গল্প ঝুড়ি
Story by Ruhi jahan
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই, গঠন মূলক মন্তব্য আশা
করছি….