শরতের বৃষ্টি পর্ব-১৪

0
2234

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–১৪

দুপুর একটা। পুরো শহর জুড়ে রোদ্র লুকোচুরি খেলছে। গরমে ঘাম ছুটে যাচ্ছে ক্লান্ত শহরবাসীর। কলেজের ক্লাস রুমে আঁখি ঘেমে একাকার। রুম ঝাড়ু দিতে দিতে ঘাম ছুটে গেছে ওর। শরীরে ধুলোবালি লেগে আছে। পরিস্কার ড্রেসে ময়লা লেগে আছে। ছোট ছোট চুলগুলো গালে ঘামের সাথে লেপটে আছে। ছোট চুলগুলো সামনে এসে ওকে বিরক্ত করছে। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চুলগুলো সরাচ্ছে। জীবনে ঝাড়ু দেয়নি আজ ওকে একেবারে ছাড়ুদার বানিয়ে দিয়েছে সাজ্জাদ। আঁখি রেগে ফিক্কা মেরে ঝাড়ু ফেলে দিলো। কোমরে হাত দিয়ে রেগে ওদিক ওদিক পাইচারি করছে। কি করে যে এখান থেকে মুক্তি পাবে ভেবেই পাচ্ছেনা। শুধু স্যারের কথা বলেছে বলে, না হলে ওই সাজ্জাদের কথায় কিছুতেই ও ঝাড়ু দিতো না। এবার রেগে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। অনেক করেছে আর করতে পারবেনা। আঁখি ক্লাস রুম থেকে বের হতেই মাঠে সাজ্জাদকে দেখতে পেলো। রোদ্রের তাপে পুরো চেহার ঘেমে আছে। শরীরের চকলেট কালার জ্যাকেটটা খুলে চেয়ারের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে। গরমের কারনে পরনের আকাশী কালার গেঞ্জি টা গায়ের সাথে লেপটে আছে। ওর সব বন্ধুরাও আছে। সাজ্জাদ মুচকি হেসে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে সবার সাথে কথা বলছে। সাজ্জাদের হাসিটা আসলেই চমৎকার। যে কেউ ওর হাসির প্রেমে পড়তে বাধ্য। এটা ভাবতেই আঁখির ধ্যান ভাঙলো। পরক্ষনেই মনে মনে বললো। “এসব কি ভাবছি? মি. সাজগাজ কখনই সুন্দর না। যার ব্যবহার সুন্দর না সে কখনই সুন্দর হতে পারে না।”
এসব বলেই আঁখি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিলো। আস্তে আস্তে সামনে আগাতে লাগলো। মনে মনে আল্লাহ কে ডাকতে লাগলো যেনো সাজ্জাদ ওকে না দেখে। যদি সামনে পড়ে তো আবার ওকে কি না কি শাস্তি দেয়। এটা ভেবেই আঁখি ভয়ে ভয়ে সামনে আগাতে লাগলো। কিছুটা সামনে আগাতেই পিছন থেকে সাজ্জাদের কর্কশ সর শুনতে পেলো।

“ওই মেয়ে কোথায় যাচ্ছো?”

আঁখি সাজ্জাদের কথা শুনে থমকে দাড়িয়ে গেলো। এতক্ষণ এই ভয়টাই ও পাচ্ছিলো। হালকা ডোক গিলে কথাটা শুনেও না শুনার ভান করে সামনে পা ফেললো। সাজ্জাদ চেয়ার ছেড়ে রেগে দাঁড়িয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেঁপে রেগে বললো।

“দাড়াও! আর একপাও নড়বে না!”

আঁখি ভয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলো এবার কি করা যায়? দৌড় দিবে? যদি দৌড় দেয় তবে যদি দৌড়ে ধরে ফেলে? তখন তো আরও লজ্জা পেতে হবে। কি করবে এবার? বিভিন্ন চিন্তা ভাবনা করে আঁখি চুপচাপ দাড়িয়ে রইলো। সাজ্জাদ পিছন থেকে রেগে বললো।

“এদিকে এসো!”

আঁখির এবার খুব রাগ হলো। এসবের মানে কি? সকাল থেকে কাজ করেছে এখনও ওকে দিয়ে কাজ করাবে? আঁখি রেগে সাজ্জাদের দিকে ফিরলো। সাজ্জাদের পাশে চেয়ারে বসে অর্নব, রনি, আশিক দাঁত কেলিয়ে হাসছে। আঁখি কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওদের দিকে আগাতে লাগলো। রোদের কারনে সাজ্জাদের ফর্সা চেহারা লাল হয়ে আছে। চুলগুলো এলো মেলো চুলগুলো কপালে পরে আছে। সাজ্জাদকে দেখতে ভালোই লাগছে। আঁখি কে আসতে দেখেই সাজ্জাদ ভাব নিয়ে হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে চেয়ারে বসলো। সাজ্জাদের ভাব দেখে আঁখির গা জ্বলে যাচ্ছে। কোনো মতে দাঁতে দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছে। অগত্যা সাজ্জাদ আঁখির দিকে তাকিয়ে বললো।

“মিস চক্ষু! তুমি কার পারমিশন নিয়ে বাড়ি যাচ্ছো?”

নামটা শুনেই আঁখি কপাল কুচকে এলো। ওর কত সুন্দর একটা নাম আর সাজ্জাদ ওর নামের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে। পাশে ওরা সবাই নাম শুনে হাসছে। আঁখি ভ্রু কুচকে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলো। বলে কি এই ছেলে? ও কি ওদের টিচার নাকি কলেজের ভিপি যে ওর পারমিশন নিয়ে যেতে হবে? আঁখি এক ভ্রু উচিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে বললো।

“মি. সাজগাজ! আপনি নিজেকে আমাদের টিচার ভাবেন?”

ওর কথ শুনে রনি অর্নব আর আশিক শব্দ করে হেসে উঠলো। সাজ্জাদ সবার দিকে রেগে তাকাতেই ওরা থেমো গেলো। আঁখি ওদের কাহিনী দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। সাজ্জাদ রেগে আঁখির দিকে তাকাতেই আঁখি সাহস নিয়ে বললো।

“আপনি ভুলেও এটা ভাববেন না। আপনি আমাকে হুকুম করার কেউ না। আপনি চাইলে স্যারকে ডাকতে পারেন। আমিও বলবো সকাল থেকে কাজ করেছি। আমাকে জোর করে কাজ করানোর যোগ্যতা আপনি রাখেন না।”

সাহস করে কথাটা বলেই আঁখি তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। সাজ্জাদ এখনও অবাক হয়ে আছে। কেউ ওর সামনে এভাবে কথা বলেনা আর এই মেয়েটা ওকে এত কিছু বলে গেলো। সাজ্জাদ রেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই দেখলো আঁখি অনেক দূরে চলে গেছে। সাজ্জাদ পাশে তাকাতেই দেখলো ওর বন্ধুরা ঠোঁট চেপে হাসছে। সাজ্জাদ রেগে সবাইকে জোরে এক ধমক দিলো। ওর ধমক খেয়ে সবাই চুপ চাপ হয়ে গেলো। রনি সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে ভাবুক হয়ে বললো।

“দোস্ত! এত সুন্দর মেয়েটার সাথে এত ঝগড়া করোছ কিভাবে? তোর হৃদয় কাঁপে না?”

সাজ্জাদ রেগে ওর দিকে তাকাতেই ও শিশ বাজিয়ে অন্য দিকে যেতে বললো।

“বুঝে শুনে ঝগরা করিছ। দেখিস মেয়েটা আবার তোর ভাগ্যে না লেখা থাকে!”

রনির কথা শুনে সাজ্জাদ থমকে ওর দিকে তাকালো। কি বলছে রনি? ও তো এসব স্বপ্নেও আনেনি। এই দজ্জাল মেয়েকে বানাবে ওর বৌ? মরে গেলেও না। যদি ওকে কোটি টাকাও দেয় তবুও ও বিয়ে করবে না। এই মেয়ে ঘরের বাইরে থেকেই ওকে জ্বালিয়ে মারছে আর রুমে এলে তো ও শেষ। আঁখি কে ওর রুমে ভেবেই সাজ্জাদ ঢোক গিললো।

—————————–

সম্পর্ক ভালোবাসা মানুষের মনের ব্যপার। জোর করে তা কখনই অর্জন করা যায়না৷ সব কিছুর ওপর জোর করলেও মানুষের মনের উপর জোর করা যায়না। যে যেমন থাকতে ভালোবাসে তাকে সেভাবেই রাখতে দেওয়া ভালো। জোর করে হয়তো মানুষের উপরটা বদলানো যায় কিন্তু মানুষের ভিতরকে বদলানো যায়না। কারো মনের উপর জোর করে কিছু করানো মানেই মানুষটাকে ভিতর থেকে মেরে পেলা। বেলকনিতে দোলনায় বসে আছে সাজ্জাদ। নিশ্চুপ রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি করবে? জাকরি ওর করতে ইচ্ছে করছে না। আর ওর বাবার মতে বিয়ে করতেই হবে। বিয়ে করলে তো চাকরি করতেই হবে। বিয়ে করতে একেবারেই ইচ্ছে করছে না সাজ্জাদের। বিয়ে মানেই ওর রুমে আরেক মানুষের বসবাস। ওর জীবনের পুরোটা জুড়েই ওই মেয়ের দখলদারী থাকবে। এই যুগের মেয়েরা কখনই শ্বশুর শাশুড়ির সাথে থাকতে চায়না। বউয়ের মন পেতে হলে মা বাবা বোনের কাছে খারাপ। বিয়ে মানেই বড় সংসার ভেঙে ভাগ হয়ে যাওয়া। সম্পর্কের অটুট বন্ধন ছিন্ন হওয়া। ও ওর বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে ও বউয়ের কথা শুনলে ওর মা বাবার কি হবে? এখন বেশির ভাগ সময়েই পরিবার আলাদা হয়ে যায়। টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা যায়না। সংসারে শুরু হয় তুমুল ঝগড়া। এসব ভেবেই সাজ্জাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। পাশে তাকাতেই বেলকনির দেয়ালে চোখ পড়লো। সাজ্জাদ দেখলো এখনও কালো রং পুরোপুরি উঠেনি হালকা লেগে আছে। আবারও নতুন করে রং করতে হবে। আঁখির কথা মনে হতেই সাজ্জাদের চেহারা রাগি রূপ ধারন করলো। এই মেয়েটা আজ ওর বন্ধুদের সামনে ওকে অপমান করেছে। সাজ্জাদ দুপুরের কথা ভাবতে ছিলো। হঠাৎ করেই সাদিয়া বেলকনিতে এসে বললো।

“ভাইয়া! তোকে বাবা ডাকছে।”

সাদিয়ার কথা শুনে সাজ্জাদ ওর দিকে তাকালো। ও বুঝতে পেরেছে ওর বাবা কেনো ডাকছে। সাজ্জাদের ভ্রু কুচকে এলো। বিরক্ত নিয়ে সাদিয়া কে বললো।

“বাবা এমন করছে কেনো রে? আমার বিয়ে নিয়ে তার মাথা ব্যাথা কেনো বুঝতে পারছিনা। তুই কিছু জানোছ?”

সাদিয়া চোখ নাচিয়ে দোলনায় সাজ্জাদের পাশে বসে পড়লো। মুচকি হেসে ওর ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো।

“বলতে পারি বললে কি দিবি বল?”

সাজ্জাদ অবাক হয়ে ওর বোনের দিকে তাকালো। ওকে ভালো করে পরখ করে বললো।

“এই! তুইও ঘুষ চাচ্ছিস্?”

সাজ্জাদের কথা শুনে সাদিয়া হালকা করে কাশলো। রাগি চোখে ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো।

“এটা মোটেও ঘুষ না। আমি তো শুধু বকশিস চাচ্ছি। বোন হয়ে বড় ভাইয়ের কাছে এটা চাইতে পারি। এবার ব্যাপারটা শুনতে চাইলে কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ দিয়ে দে! না হলে আমি যাচ্ছি। তোকে শুনতে হবেনা।”

কথাটা বলেই সাদিয়া দোলনা থেকে উঠতে লাগলো। সাজ্জাদ ওকে বসিয়ে দিয়ে বললো।

“এত তাড়াহুড়ো করছিস কেনো? ১০০টাকা দিবো তাড়াতাড়ি বল!”

একশ টাকার কথা শুনেই সাদিয়া ভ্রু কুচকে তাকালো। মাত্র একশ টাকা? সাদিয়া ঠোঁট উল্টে ওর ভাইকে বললো।

“মাত্র একশ? ভাইয়া তুই আস্ত কিপ্টা। এত কিপ্টামি করলে চলে? একমাত্র বোন হিসেবেও তো পাঁচশো টাকা দিতে পারোছ। এত বড় খবর পাঁচশো টাকা না দিলে বলবো না।”

“আমি কি চাকরি করি? এভাবে বুকের উপর পারা দিয়ে টাকা নেস? আচ্ছা যা দিবো এবার বল!”

“আম্মু বাবাকে বলছে তোকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে। বাড়িতে বউ এলেই নাকি তুই ঠিক হবি। আড্ডা ছেড়ে চাকরিও করবি আবার বাসায় ও থাকবি।”

সাজ্জাদ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। তার মানে এটা ওর মায়ের কাজ? ওর মাকে ধরলেই এর সমাধান হবে। সাজ্জাদ পৌশাচিক হাসি দিলো। সাদিয়া উঠতে বললো।

“এখন চল! বাবা অপেক্ষা করছে। টাকা সকালে দিয়ে দিছ। যেনো বলতে না হয়।”

কতাটা বলেই সাদিয়া সামনে চললো। সাজ্জাদ ওর পিছনে চললো। ড্রইংরুম যেতেই দেখলো আশরাফ খান সোফায় বসে আছেন। তার পাশে মিসেস শাহনাজ বসে আছে। সাজ্জাদ গিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়লো। আশরাফ খান নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

” তোমার জাকরির কি খবর? একমাস সময় নিয়েছিলে, সময় শেষ হয়ে আসছে। আমি মেয়ে দেখাও শুরু করেছি।”

সাজ্জাদ কিছুই বললো না চুপচাপ বসে রইলো। আশরাফ খান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন।

“চুপ থাকলেই সব কিছু থেমে যাবেনা। এবার বিয়ে করতেই হবে তোমাকে। সব কিছুর জন্য প্রস্তুত থেকো।”

কথাটা বলেই চুপচাপ উঠে চলে গেলেন। সাজ্জাদ চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইলো। কি করবে ও? ভাবতে ভাবতে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

ইনশাআল্লাহ চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here