শরতের বৃষ্টি পর্ব-১৬

0
2675

#শরতের_বৃষ্টি
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–১৬

আঁখি ভয়ে চোখ বন্ধ করে লোকটার হাত চেঁপে ধরে আছে। লোকটি অবাক চোখে আঁখির দিকে তাকিয়ে আছে। আঁখি কে পৃথিবীর অপরূপ সৌন্দর্য্যের অধিকারী বলতে ইচ্ছে করছে তার। আঁখি কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতেই নিজেকে এক অচেনা ব্যক্তির বাহুডোরে দেখেতে পেলো। ও কেমন যেনো অস্বস্তি বোধ করলো। ছেলেটি ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাতে ওর আরও খারাপ লাগছে। আখির মতে ছেলেটি মধ্যম বয়সের হবে। তবে বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছরের হবে। ছেলেটি যে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে আর চোখ ফেরানোর নাম নিচ্ছেনা। ওকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যাবেক্ষন করছে। আঁখি বিরক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করেবললো। ” শালা কিভাবে দেখেছো দেখো? মনে হচ্ছে মেয়ে মানুষ জীবনে দেখেনি। চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে। লাত্থি দিয়ে উগান্ডা পাঠিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।” কথাটা বলেই আঁখি সামনে তাকাতেই দেখলো সাজ্জাদ হাত মুঠ করে রাগি চোখে ওদের দিকে চেয়ে আছে। আঁখি সাজ্জাদের রাগের কারন বুঝতে পারলো না। হালকা ঢোক গিলে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটা এখনও ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আঁখি অসহায় ফেস করে ফেললো। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। এখানে আবার পরেছে এক ঝামেলায়। আখি হালকা কাশি দিয়ে জোর পূর্বক হেসে ছেলেটিকে বললো।

“এই যে মিস? সরি মি. আমাকে কি কোলে রাখার চাকরি নিয়েছেন? যদি নিয়ে থাকেন তবে আজকের মতো ডিউটি শেষ করুন। আমায় যেতে হবে তাড়া আছে।”

আঁখির কথা শুনে ছেলেটির ধ্যান ভাংলো। ওহ বলে আঁখিকে দাড় করিয়ে দিলো। ছেলেটি হয়তো এতক্ষণ ভুলেই গিয়েছিলো একটা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আঁখি ছাড়া পেয়েই সামনে আগাতে লাগলো। ছেলেটি ওর সামনে রাস্তা আটকে দাঁড়ালো। ছেলেটার রাস্তা আটকে দাড়ানোর কারন বুঝতে পারলো না আঁখি। ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।

“আমি আপনাকে পরে যাওয়া থেকে বাঁচালাম আর আপনি কিছু না বলে চলে যাচ্ছেন? একবার তো থ্যাংকস্ বলতে পারতেন!”

আঁখি অবাক হয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো। ছেলেটির কথা শুনে ও আকাশ থেকে পড়লো। বলে কি এই ছেলে? নিজে ধাক্কা দিয়ে ধরেছে আবার থ্যাংকস্ চাচ্ছে? ওতো থ্যাংকস্ না বরং থাপ্পড় ভাবে পায়। আঁখি ভ্রু কুচকে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো।

“আপনার মাথায় কি গ্যাস্টিকের প্রবলেম আছে? আপনি নিজে ধাক্কা দিয়ে আবার থ্যাংকস্ চাচ্ছেন? আপনার সাহস দেখে তো আমি শিহরিত!”

আঁখি চোখ নাড়িয়ে সুন্দর করে কথা বলছে। ছেলেটি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওর কথা শুনছে। ওর হাত চোখ নাড়িয়ে কথা বলা দেখে ছেলেটি বারবার মুগ্ধ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আঁখি চোখও কথা বলছে। আঁখির কথা শুনে ছেলেটির এই গানটাই আঁখি কে গেয়ে শোনাতে ইচ্ছে করছে। ” চোখ যে মনের কথা বলে।” কিন্তু এই সময়ে গান শোনানোর প্রবল ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখে আঁখি কে দেকায় মন দিলো। ওদিকে সাজ্জাদ রেগে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে ওর চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। ছেলেটিকে তাকাতে দেখে আঁখি বিরক্ত নিয়ে অন্য দিকে তাকালো। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো।

“আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন। দেখতে যেমন সুন্দর কথাগুলোও তেমন সুন্দর। বাই দ্যা ওয়ে এই বিল্ডিংয়ে কি বেড়াতে এসেছেন?”

ছেলেটা যে মেয়ে পটাতে এক্সপার্ট তা আখি বুঝে গেছে। কিন্তু ও তো পটার মেয়ে না। এইসব ছেলেদের প্রেমে ও কখনই পড়েনা। ওর ভয় হয়, প্রেমে পড়ে যদি ওর হাত পা ভেঙে যায়? ওর এসব ফালতু কথা শুনতে একটুও ভালো লাগেনা। আঁখি রেগে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো।

“ফালতু কথা কম বলবেন। সবাইকে আপনার মতো মেহমান ভাবেন? আমি মোটেও বেড়াতে আসিনি। এই বিল্ডিংয়ে থাকি! আমার বাবা ফ্লাট কিনেছে।”

ছেলেটি আঁখির কথা শুনে এক আকাশ খুশি হলো। তা ওর চোখে মুখেই স্পষ্ট। ছেলিটি খুশিতে গদগদ হয়ে বললো।

“তাই নাকি? হাই! আমি নিরব! এই বিল্ডিংয়ের নিচতলার আশিকুর রহমানের ছেলে।”

কথাটা বলেই নিরব হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। আঁখি ভ্রু কুচকে তাকালো। তার মানে এই ছেলেটি আশিক আংকেলের ছেলে। নিপা আপুর বড় ভাই। যার কথা সারাদিন নিপা আপু বলে! নিপা আপুর সাথে ওর সম্পর্কটা খুব ভালো তাই ভদ্রতার খাতিরে মুচকি হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলো আঁখি। সাজ্জাদ এবার কিছুতেই নিজের রাগ কন্টোল করতে পারছেনা। রেগে ওদের দুজনের মাঝ দিয়ে গেলো। তাতে ওরা দুজনেই হাত ছেড়ে দিলো। সাজ্জাদ একটু সামনে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকালো। আঁখি ওর দিকে তাকাতেই দেখলো সাজ্জাদ রেগে চোখ লাল করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আঁখি ভয়ে আঁকুপাঁকু করতে লাগলো। সাজ্জাদের রাগের কারনটাই বুঝতে পারছেনা। সাজ্জাদ কি ওকে নিয়ে জেলাস? পরক্ষনেই ভাবলো এটা কি আকাশ কুসুম ভাবছে ও? সাজ্জাদ শুধুই ওকে শত্রু ভাবে বন্ধু না। সাজ্জাদ নিজের রাগকে দমিয়ে নিরবের কাছে গিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো।

“কেমন আছেন? এসব ছোট মেয়েদের সাথে কি কথা বলছেন? চলেন বাসায় চলেন!”

নিরব একেবারেই যেতে চায়নি ওর মন বলছিলো আঁখির সাথে দাড়িয়ে একটু কথা বলতে কিন্তু সাজ্জাদ ওকে এক প্রকার জোর করেই নিয়ে গেলো। সাজ্জাদের এমন করার কারন আঁখি বুঝতে পারলোনা। ও কিছুনা বলে ভাবতে ভাবতে কলেজের দিকে চললো।

——————————

আঁখি তাড়াতাড়ি রিকশায় করে কলেজে যাচ্ছে। রিকশায় বসে বসে ভাবছে ও খুব দেরি করে ফেলেছে। এতক্ষণে হয়তো প্রভাতফেরি শেষ করে চলে এসেছে। প্রভাতফেরি শব্দের আভিধানিক অর্থ প্রভাতে উদ্বোধনী সংগীত গেয়ে জনগণকে জাগানো। মূলত একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতে গান গেয়ে ফুল দিয়ে ভাষাশহীদদের শ্রদ্ধা জানানোর যাত্রা-ই প্রভাতফেরি নামে পরিচিত। প্রভাতফেরি প্রথমবারের মতো পালিত হয় ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। সব ছাত্র সংগঠনের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে এই দিনটিতে বিশেষ কার্যক্রম পালন করা হয়। ওই দিন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব ভোরে ছাত্রাবাসগুলো থেকে বের হয়ে খালি পায়ে ফুল হাতে, কেউ ফুল ছাড়াই একুশের গান গাইতে গাইতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে শহীদদের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর তারা আসেন শহীদ মিনারে। এভাবেই প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহীদ দিবস পালন শুরু করেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষাশহীদদের রক্তে সেই রাজপথে জুতা পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন না এমন চিন্তা থেকেই খালি পায়ে প্রভাতফেরির প্রথা চালু হয়েছিল।

প্রভাতফেরির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো সংগীত। একুশের প্রথম গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক। গানটির প্রথম চরণ “ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না” ৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আরমানিটোলা ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় গানটি প্রথম গাওয়া হয়। গানটির সুরকার ছিলেন গাজীউল হক নিজেই। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী ও প্রথম শহীদ দিবসে প্রভাতফেরিতে ভাষাসংগ্রামী প্রকৌশলী মোশারেফ উদ্দিন আহমদের “মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল/ভাষা বাঁচাবার তরে/আজিকে স্মরিও তারে” গানটি গাওয়া হয়। এটি প্রভাতফেরির প্রথম গান। সুর করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। বর্তমানে যে গানটি প্রভাতফেরির সমার্থক হয়ে উঠেছে সেই
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি” গানটি ১৯৫৩ সালে রচিত হলেও প্রভাতফেরিতে গান গাওয়া শুরু হয়েছিল ১৯৫৮ সালে। গানটি রচনা করেন সেসময়ের তরুণ ছাত্র আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। এটি মূলত একটি কবিতা যার নাম “একুশে ফেব্রুয়ারি’’। গানটিতে সর্বপ্রথম সুরারোপ করেন আবদুল লতিফ। গানটির বর্তমান সুরটি করেন আলতাফ মাহমুদ। এই সুরেই গানটি মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং প্রভাতফেরির গান হিসেবে সর্বস্তরের মানুষ গানটিকে আপন করে নেন।

আঁখি কলেজের কাছে যেতেই বুঝলো প্রবাতফেরি শেষ। কলেজের গেইটে সামনে যেতেই আঁখি জাঁকজমক ভাবে সাজানো দেখলো। সব কিছু খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আঁখি মুগ্ধ হয়ে সব এক এক করে পর্যাবেক্ষন করছে। আঁখি কলেজের সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত ছিলো হঠাৎ করে আশে পাশে চোখ পরতেই দেখলো সবাই ওর দিকে কেমন করে তাকাচ্ছে। আঁখি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে কলেজের ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলো অনেক অচেনা অজানা লোক। ওর পরিচিত কাউকেই পাচ্ছেনা। এত ভীরে পরিচিত কাউকে খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। এর মাঝেই পাশে তাকাতেই দেখলো সাজ্জাদের বন্ধুরা। আঁখিকে দেখেই অর্নব মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করলো।

“কি ব্যাপার আঁখি? একা কেনো? তোমার বান্ধবী আসেনি?”

“ভাইয়া আমার দেরি হয়ে গিয়েছিলো। এখানে এসেই তখন থেকে ওকেই খুঁজছি কিন্তু পাচ্ছি না।”

মুচকি হেসে কথাটা বললো আঁখি। প্রতিউওরে মুচকি হাসলো অর্নব। কলেজে এসেই ওর চোখ আনিকাকে খুঁজছে কিন্তু এখনও ওর চোখ সেই প্রশান্তি লাভ করতে পারেনি। ওর মন আনিকাকে দেখার জন্য আঁকুপাঁকু করছে। তখন থেকেই ভাবছে ওকে কখন দেখবে। অর্নব আনিকাকে খুঁজতে বেড়িয়ে পড়লো। রনি আঁখির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো।

“তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”

প্রতিউওরে আঁখি জোর পূর্বক হাসলো। আশিক ওর দিকে তাকিয়ে বললো।

“আখি সাজ্জাদকে দেখেছো? এখনও আসছেনা কেনো বুঝতে পারছিনা।”

আঁখি কিছু বলতে যাবে তার আগেই রনি সামনে ইশারা করে বললো।

“এই যে সাহেব আসছে।”

রনির ইশারা অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলো সাজ্জাদ জোরে বাইক চালিয়ে আসছে। চোখে কালো সানগ্লাস, বাতাসের কারনে চুলগুলো উড়ছে। কালো জ্যাকেটটাও বাতাসে উড়ছে। সাজ্জাদ কে একদম হিরোর মতো লাগছে। মনে হচ্ছে হরোইন বিপদে পড়েছেআর হিরো বাইক নিয়ে তাকে বাচাতে হাজির। আঁখির এসব ভাবনার মাঝেই সাজ্জাদ ওর পাশে এসে বাইক থামিয়েছে। আঁখি ওকে দেখে হালকা সরে গেলো। সাজ্জাদ সানগ্লাসটা খুলে সামনে গেঞ্জিতে ঝুলিয়ে রাখলো। স্টাইল মেরে জ্যাকেটটা ঠিক করে নেমে পড়লো। আঁখি মুখ বাকিয়ে ওকান থেকে সরে গেলো। আখি যেখানে যাচ্ছে সেখানেই সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। অচেনা ছেলেগুলো হা করে তাকিয়ে আছে। অনেকে ইভটিজিংও করছে। আঁখি খুব অস্বস্তি বোধ করলো। ও বুঝে পায়না ওভাবে দেখার কি আছে। ছেলেরা এমনেি মেয়ে দেখলেই ওদের এটা বলতেই হবে। একটু ভালো হলে কি হয়? আঁখি এসব ভাবতে ছিলো হঠাৎ করে বুঝতে পারলো কেউ ওর খোঁপা খুলে দিয়েছে। ওর ঘন কালো চুল পুরো পিঠ জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো। কে এমন কাজ করতে পারে, তা আঁখি বুঝতে পারলোনা। আঁখি পিছনে ফিরে কিছু বলতে যাবে তারআগেই ওর কানের কাছে এক পরিচিত কন্ঠ স্বরে বলে উঠলো।

“এটা সৌন্দর্য প্রদর্শনের জায়গা না। সৌন্দর্য শুধু নিজের আর পারশোনাল কারো জন্যই বরাদ্দ!”

ইনশাআল্লাহ চলবে…….

( সবার ধারনাই ভূল হলো। লোকটি সাজ্জাদ না, নিরব! নতুন ক্যারেক্টার।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here