শিউলিবেলা
খাদিজা আরুশি আরু
পর্বঃ ৬
৮
আশ্রমের গেটের সামনে আয়ানকে দেখে অবাক হলো অরিত্রী, তবে নিজেকে স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি এখানে? আন্টি ঠিক আছে তো?”
আয়ান আমতা আমতা করে বললো,
-“আজ তোমায় খুঁজতে তোমাদের বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম তখন অতসীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিলো। মনে হয় বেশ রাগ করেছে…”
অরিত্রী কিছু বললো না, কেবল নিরবে আয়ানের মন বোঝার চেষ্টা করলো। বেশি কিছুক্ষণ নিরবতার পর জিজ্ঞেস করলো,
-“আপুকে এখনো ভালোবাসো?”
আয়ান কোনোপ্রকার ভণিতা না করেই উত্তর দিলো,
-“হ্যাঁ, ভালোবাসি। অতসী আমার প্রথম প্রেম, তাকে ভুলে যাবার সাধ্য আমার নেই। কিন্তু…”
-“কিন্তু?”
-“অতসীর কাছে সম্পর্কের চেয়ে তার ক্যারিয়ার বড়। ওর আর আমার কোনো ভবিষ্যত ছিলো না আর না কখনো হতে পারে। আমাকে এভাবেই জীবন পার করতে হবে। তোমার বোন আমার জীবনটা শেষ করে দিলো…”
অরিত্রী আয়ান আর অতসীর ব্যাপারে বিস্তারিত না জানলেও ওর ধারনা যেহেতু সম্পর্কটা অতসী ভেঙ্গেছে সেহেতু দোষটা তারই। কিন্তু নিজের বোন বলে কিছু বলতে পারে না সে। আরো কিছুক্ষণ নিরবতার পর আয়ান বললো,
-“আমি ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছি অরিত্রী…”
কিছুটা অবাক হলো অরিত্রী, ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় যাচ্ছ আয়ান?”
-“বরগুনা… অনেক চেষ্টার পর এ চাকরিটা পেয়েছি, পোস্টিং যেখানেই হোক চাকরিটা আমাকে করতেই হবে। তবে মাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে…”
-“আন্টিকে কে দেখবেন? তুমি চলে গেলে তো আন্টি একদম একা…”
আমার এক খালাতো বোন আছে, নাম মিতালি। ওর স্বামী মারা গেছে দুই মাস হলো। এখনই শ্বশুরবাড়িতে কথা শুনতে হচ্ছে… তাছাড়া বাচ্চাও নেই যে শ্বশুরবাড়িতে খুঁটি মজবুত হবে। ওই বাড়িতে থাকতে চাচ্ছে না ও, আমি মায়ের কাছে এসে থাকার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলো। বুঝতেই পারছো, যখন যাবার কোনো জায়গা থাকে না তখন সবকিছুতেই রাজি হতে হয়।”
সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো অরিত্রী, তারপর বললো,
-“টাকা-পয়সা কিছু আছে? বরগুনা যাবে যে থাকবে কোথায়?”
-“আমার এক বন্ধু আছে বরগুনায় থাকে। ওর বাড়ির ছাদের ঘরটা ফাঁকা, তো সেখানেই উঠছি আপাতত। অগ্রীম কিছু দিতে হবে না, প্রথম মাসে বেতন পেয়েই ভাড়া দেব।”
আয়ান নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, শুনে ভালো লাগলো অরিত্রীর। ব্যাগ থেকে পনেরোশ টাকা বের করে আয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“শেষবারের মতো টাকা দিচ্ছি, আর যেনো দিতে না হয় তার ব্যবস্থা করতেই তো চেনা শহর ছেড়ে যাচ্ছ…”
আয়ান কিছু বলে না, কেবল শান্তভাবে অরিত্রীর হাত থেকে টাকাটা নেয়।
৯
মাঝরাত অবধি বিছানায় গড়াগড়ি করেও ঘুম এলো না অরিত্রীর, মাথার কাছের জানলাটা খুলতেই শিউলি ফুলের সুবাস এসে লাগলো নামে। মুহূর্তেই অরিত্রীর মনোজগৎ মুগ্ধতায় ভরে গেলো। সময় নিয়ে সাজলো সে, তারপর শিউলি গাছতলায় গিয়ে বসলো। হঠাও মনে হলো, একটা বই সঙ্গে থাকলে মন্দ হতো না। তবে এই জায়গাটা ছেড়ে যেতে মন চাইছিলো না তাই অরিত্রী আলস্যে গা এলিয়ে দিলো ঘাসের ওপর। কখন চোখের কার্নিশে ঘুম এসে হানা দিলো জানা নেই অরিত্রীর, তবে তার ঘুম ভাঙলো ফজরের আজানের মধুর ধ্বনিতে এবং ঝরে পরা শিউলি ফুলের স্পর্শে। উঠে বসতেই দেখলো, গায়ে একটা জাম রঙের চাদর জড়ানো। অরিত্রীর যতোদূর মনে পড়লো সে রাতে আসার সময় কোনো চাদর আনে নি সঙ্গে, তাছাড়া এ চাদরটা তাদের বাসার কারো নয়। অরিত্রী চাদরটা খুলে পাশে রাখতেই চোখে পড়লো আগের দিনের মতো একটা ঝুড়ি, তবে আজকের ঝুড়িতে ফুল নেই আছে কেবল একটি চিঠি। তাতে লেখা,
“ওগো পূর্ণিমার মোহময় চন্দ্রিমা,
তোমারো আলোকে আলোকিত এ ধরা
শিউলিতলায় ওই কে যায়,
আলোক বৃষ্টিতে নিজেরে ভেজায়!
রাতের আঁধারে এ কোন মায়ায়,
আমায় ফেলিলে আজীবনের দোটানায়!
অতসী,
আপনাকে না দেখে থাকাটা বড্ড বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে আমার জন্য, লুকিয়ে দেখবার লোভ সামলাতে না পেরে কাল রাতে এসেছিলাম এক পলক দেখতে। তবে বিধাতা আমার উপর সুপ্রসন্ন না হলে কাল রাতের স্বর্গীয় দৃশ্যটি কখনোই দেখা হতো না আমার। শিউলিতলায় দাঁড়ানো আপনাকে আমার জীবন্ত শিউলিফুল মনে হচ্ছিলো। অতীতে আমার পছন্দের জিনিস কারো পছন্দ হলে আমার রাগ হতো, মনে হতো যা আমার তা কেবল আমারই। অন্যজন তা পছন্দ করবে কেনো? কিন্তু কালরাত প্রথমবারের মতো আপনার শিউলিফুল পছন্দ তা জানার পরও আমার রাগ হলো না। বরং মনে হলো, আপনার সঙ্গে নিজের পছন্দ ভাগ করে নিতে পেরে আমার অতৃপ্ত মন তৃপ্ত হয়েছে। দেখুন না, আপনি ঘুমাচ্ছিলেন, আর আমি আপনার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে দু-তিন লাইন পঙ্কতিও লিখে ফেললাম। আমি কিন্তু মোটেও কবি ধাঁচের লোক নই, একটু অন্তর্মুখী ধরনের মানুষ আমি। আমাকে কি আপনার ব্যস্ত জীবনে একটু জায়গা দেবেন?”
চিঠিটা ভাজ করে খালি ঝুড়িটায় রাখলো অরিত্রী, সঙ্গে সঙ্গেই চাপা দীর্ঘশ্বাসটা বাতাসে মিলালো। চাদরটা ভাজ করে বাড়ির ভেতরে গেলো অরিত্রী, নামাজ পড়ে অতসীর ঘরে গেলো আগের দিনের ঝুড়িগুলো নিয়ে। অতসী তখন জেগেই ছিলো, কোনো একটা এ্যাডের স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করছে সে। তিনটে ঝুড়িহাতে অরিত্রীকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি রে, শিক্ষকতা ছেড়ে কি ফুল বেচার সিদ্ধান্ত নিলি? ঝুড়ি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস এই ভোরবেলায়?”
অরিত্রী আগের দুটো চিরকুট আর আজকের চিঠিটা অতসীর সামনে রেখে বললো,
-“তোমার কোনো এক ভক্ত ঝুড়ি ভর্তি করে শিউলিফুল পাঠিয়েছিলো। ফুলগুলো আমি শুকিয়ে রেখে দিয়েছি, তুমি চাইলে নিতে পারো। এ চিরকুট আর চিঠিটা ছিলো ফুলের সঙ্গে।”
হাতের চাদরটা এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“এ চাদরটাও তোমার জন্যই।”
চাদরটা দেবার সময় অরিত্রীর ভীষণ মন খারাপ করছিলো, সে টের পাচ্ছিলো তার ভেতরকার স্বত্তা চিৎকার করে বলছে, “ভুল করে হলেও মানুষটা তাকে অতসী ভেবে চাদরটা দিয়েছে। এটা তার, অতসীর নয়।” তবুও বাহিরে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো, অতসীর কথা বলার অপেক্ষা করলো। স্ক্রিপ্ট থেকে মুখ তুলে অতসী অরিত্রীর দিকে পূর্ণদৃষ্টি ফেললো এবার, শান্তস্বরে বললো,
-“আমি প্রতিদিন কতো কতো উপহার পাই তু জানিস? তোর সে সম্পর্কে ধারনা অবধি নেই। আমার উপহার পাওয়া ডায়মন্ড সেট কতোগুলো জানিস? সেই আমি কি না সস্তা কতোগুলো ফুল আর চিঠি গ্রহন করবো? শোন, এরপর থেকে এসব উপহার আসলে ফেলে দিবি। যে আমাকে ওই টোকানো শিউলিফুলের মতো সস্তা ভাবে তার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।”
অরিত্রী কিছু বলে না, জিনিসগুলো নিয়ে বের হবার জন্য পা বাড়ায়। অতসী আবার বলে,
-“তোর তো আমার অন্যের জিনিস নেয়ার অভ্যাস আছে, তাছাড়া তোর মন তো সস্তা জিনিসেই ভরে যায়। চাইলে এই সস্তা লোকটাকেও নিজের জন্য রেখে দিতে পারিস, হয়তো তোদের মন মানসিকতা মেলে যাবে।”
কথাটা বলে হাসলো অতসী, অরিত্রী কিছু না বলেই নিজের ঘরে চলে এলো। সকাল সকাল কোনো ঝামেলা করতে চায় না সে।
নিজের ঘরে এসে অরিত্রীর মনে হলো, তার বুক থেকে অনেক বড় বোঝা নেমে গেছে। অতসী বেনামী চিরকুটদাতাকে চায় না, তারমানে সে প্রতিদিন চিরকুটগুলো নিতে পারবে। তবে মনে মনে কষ্ট পেলে মানুষটার জন্য, অতসীর কারনে মানুষটা কষ্ট পাবে। অতসী লোকটাকে সস্তা বলাতে অরিত্রীর ভীষণ খারাপ লেগেছে, কেউ ফুল ভালোবাসলেই সস্তা হয়ে যায় নাকি! হঠাৎ অরিত্রীর মনে হলো, যদি সত্যিই এ মানুষটাকে সে নিজের জন্য রেখে দিতে পারতো! তবে নিশ্চয়ই সে রেখে দিতো একে নিজের কাছে। যার চিন্তাধারা এতো সুন্দর, যে ঘুমন্ত অরিত্রীকে পেয়ে কোনো অসভ্যতা না করে কবিতা রচনা করে সে আর যাই হোক সস্তা মানুষ হতেই পারে না। অরিত্রীর সিদ্ধান্ত নিলো, কখনো এ লোকটার মুখোমুখি হলে সে বলবে, “আপু আপনাকে ভালোবাসে না, তবে আমি আপনাকে ভালোবাসি। আমাকে সেদিন রাতে শিউলিতলায় ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে আপনার শিউলিফুল বলে ভ্রম হয়েছিলো। আপনি কি আমাকে আপনার জীবন বৃক্ষের শিউলিফুল হবার সুযোগ দেবেন?” হঠাৎ নিজের চিন্তায় নিজেই অবাক হলো অরিত্রী, তার কেনো হঠাৎ মনে হলো যে সে চিঠিদাতাকে ভালোবাসে! এটা তো ক্ষণিকের ভালোলাগাও হতে পারে, ভালোবাসাই ভাবতে হলো কেনো? কোনো উত্তর পায় না অরিত্রী, কিন্তু তার মনোবাগানে শীতল হাওয়া বাহিত হয়। চাদরটা বুকে জড়িয়ে জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে দীর্ঘক্ষণ। আজ যেনো তার কোনো তাড়া নেই…
চলবে…