#শুকতারা (পর্ব-১৭)
#হালিমা রহমান
তেঁতুলগাছের পাশে খাবারের আয়োজন। রান্না শেষে খাবারগুলো বাটিতে বেড়ে দেওয়ার দায়িত্ব হেলাল বাবুর্চির উপর পড়লো। বাবুর্চি, মমিন শেখের চেনা-জানা লোক। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়।হেলাল বাবুর্চি বিশ্বাসের মান রেখেছেন।দায়িত্ব নিয়ে মেপে মেপে খাবার বাড়ছেন সিরামিকের বাটিতে। কোনো টেবিলে খাবার যেন কম না হয়। তেঁতুল গাছের পিছনেই দু-একটা কুকুর খাবারের আশায় ঘুরাঘুরি করছে।এদিকের মানুষ কুকুর-বিড়ালের প্রতি সদয় নয়। এঁটো-কাঁটা,ময়লা, কুকুর-বিড়ালকে দেয় না।অবশ্য কৃপণতার পিছনে কারণ আছে।খাবার দিলেই এরা যন্ত্রণা করে বেশি। সময়ে-অসময়ে ঘরের পিছনে ঘুরঘুর করে।গ্রামের বাড়িতে বেশিরভাগ রান্নাঘর ঘরের পিছনে থাকে।লোকচক্ষুর আড়ালে টিনের দরজা ঠেলে খাবারে মুখ দেয়।কখনো আবার গোপনে উঠোনের হাঁস-মুরগীর খোপে মুখ দেয়। ছোট ছানাদের মাথা কামড়ে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলে। তাই এদিকের মানুষজন এদেরকে প্রশ্রয় ফেয় না।
শীর্ণ কালো কুকুরটার দিকে একটা হাঁড় ছুঁড়ে মারলেন হেলাল বাবুর্চি। খাবার বন্টনের সময় বিরক্ত করছিলো এরা। সামান্য হাঁড়ে প্রাণীটাকে শান্ত করে আবারো কাজে মনোযোগ দিলেন। এবারের খাবারগুলো বরপক্ষের টেবিলে যাবে।একটুও এদিক-ওদিক হলে চলবে না।
সূচিদের বাড়িতে আজ অনেক মানুষ। ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই। খাওয়া-দাওয়ার পরে সবাই একনজর বউ দেখে যাচ্ছে। খাটের মাঝেই সূচি বসা।বেনারসী গায়ে দিয়ে সেজেগুজে পটের বিবির মতো বসে আছে। কপালে টিকলী,হাতে চুড়ি,নাকে নোকল,গলায় হার। বিয়ে বাড়ির সাজগোজের সাথে তাল মিলিয়ে গলায় একটা স্বর্ণের চেইন ও এক জোড়া স্বর্ণের দুল আছে কানে।এদিকে বিউটি পার্লারের অভাব। কাজী বাড়ি থেকে দেওয়া শাড়ি-গয়না দিয়ে সূচিকে বাড়িতেই সাজানো হয়েছে।গতবারের মতো এবারেও সাজগোজের দায়িত্ব রত্নার উপর পড়েছে। রত্নার আনাড়ি হাত। ওতো বাহুল্য নেই। বিয়ের কনে হিসেবে একদম সাধারণ সাজ-সজ্জা। টানা দু-ঘন্টা পরিশ্রমের পর রত্নার মুখে হাসি ফুটেছে।সূচিকে আজ ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে।চোখের কাজল,ঠোঁটের লিপস্টিক,গায়ের শাড়ি-গয়না,চুলের খোঁপা, মাথার উপরে খোঁপা ঢেকে দেওয়া ঘোমটা—- সূচিকে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। রত্না প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বান্ধবীর দিকে সরে বসে ফিসফিস করে বলেঃ” এতোদিন এই রূপ কই ছিল? আজকে মনে হইতাছে তোর পেটে বিয়ার পানি পড়ছে। ফয়সাল ভাই আজকে শ্যাষ।”
নিজের গলার এপাশ-ওপাশে ডান হাত টেনে দিয়ে শেষ হওয়ার কায়দাটা দেখিয়ে দেয় রত্না।সূচি মুখ টিপে হাসে।রত্নাটা খুবই বদ।
বাড়ির পাশের মামী-কাকিরা সূচির খাটে আস্তানা গেড়েছে। ফিসফিস করে কথা বলছে সবাই। সব আলোচনার কেন্দ্র কাজী ফয়সাল। বাইরের স্টেজে জামাই সেজে চুপ করে বসে আছে।গায়ে তার শেরওয়ানি, মাথায় পাগড়ি।হাতে রুমাল আছে নাকি নেই তা কল্পনা করতে পারে না সূচি। মনে আজেবাজে চিন্তা আসে। এই দিন-দুপুরে এসব উদ্ভট চিন্তা-ভাবনার কথা মাথায় আসতেই শিউরে উঠে সূচি।ভাগ্যিস মনের কথা মানুষ শুনতে পায় না। সূচির মন গহীনের কথা মানুষ জানলে খবর ছিল।সূচি লজ্জায় মাথাই তুলতে পারতো না।দিনদিন খুব নির্লজ্জ হয়ে উঠছে মেয়েটা।
ভাবি মহলের সাথে সূচির চিরদিনের ভাব।এই সখ্যতা বয়সের সীমা-রেখায় বাঁধা যায়নি কোনোদিন। অন্তরঙ্গ সইয়ের মতো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে এরা হাজার রকম কথা বলছে। এখানে জয়া ভাবি বাদে সবাই আছে। জয়া অপেক্ষাকৃত বয়সে বড়। তাছাড়া,দায়িত্বজ্ঞান তার বেশি। সূচিকে ধরে বসে থাকলে চলবে না।ও-ঘরে সাহিদা বেগমের সাথে কী যেন করছে সে। মনি-চম্পা সূচির গা ঘেষে বসে রসিকতা করতে ছাড়ে না। সেই কখন থেকে সূচির কানের কাছে বকবক করছে দুজনে।সব বড় মানুষদের রসিকতা। সূচির দু-গাল,নাকের পাটা লাল হয় লজ্জায়।কান দিয়ে ধোঁয়া বের হয় এদের কথা শুনে। মনি ভাবিকে আস্তে করে খোঁচা দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” বড়দের কথা আর বলো না।তোমরা যতোটা ভাবছো,ততোটা বড় হইনি আমি।আল্লাহর ওয়াস্তে মুখে লাগাম টানো।”
মনি লাগাম টানে না।সূচির কথা চম্পার কানে চালান করে দিয়ে আরো বেশি কথা বলে। ছোট সূচিকে বড়দের কথা বলে বিব্রত করে মুখ টিপে হাসে। সূচির হয়েছে জ্বালা। না পারে কিছু বলতে,না পারে সইতে। কোনো মেয়েকে জব্দ করতে চাইলে বিয়ের আসরে কনের জায়গায় বসিয়ে দেওয়া উচিত। পুতুলের মতো সেজেগুজে চুপচাপ বসে সবকিছু হজম করার মতো যন্ত্রণা, এ পৃথিবীতে আর হয় না।
কনের মনে যতো আনন্দ,যতো আগ্রহ; বাইরে বসে থাকা বরের মনে ততোই নিরানন্দ,ততোই অনাগ্রহ।ঝড়ের আগের গুমোট পরিবেশ যেমন অসহ্য হয়,ফয়সালের মনের অবস্থা ঠিক তেমন। এতো আনন্দ,এতো আয়োজন কাঁটার মতো ফুটছে।শরীরের বহমান রক্তের সাথে কেউ এক খাবলা রাগ মিশিয়ে দিয়েছে যেন।ফয়সালের গায়ের রঙ ফর্সা।রাগলে গাল দুটো,নাকের আশপাশ রাঙা হয়ে যায় একদম। ফয়সাল রাঙা হয় রাগে,ও-ঘরে সূচি রাঙা হয় লজ্জায়।বড়ই অদ্ভুত কান্ড। ভাগ্যিস মনের কথা অন্তর্যামী ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না। ফয়সালের মনের কথা যদি অন্য কেউ জানতে পারতো,তবে হয়তো কাজী বাড়িতে সূচির পা পড়তো না কখনো।
সামনের বিশাল থালা থেকে খাবলা-খাবলি করে খাবার খেয়েছে সবাই।বিয়ে বাড়িতে এ এক অন্যরকম আনন্দ। বিয়ে উপলক্ষে চকচকে একটা থালা কেনা হয়েছে। সেখানেই সাজানো পোলাও, ডিম,আস্ত মুরগী, গরুর মাংস, খাসির মাংস,মাছ ভাজা,সালাদ। ফয়সালের বন্ধু-বান্ধব চেটেপুটে খায়। খাবারটা এরা ভালোই বানিয়েছে। খাবার শেষে শসার টুকরা, টমেটোর টুকরা তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে তপু। খেতে খেতে আঁড়চোখে তাকায় বন্ধুর দিকে।ফয়সালের ম্লান মুখ। ভালোভাবে তাকালেই খট করে চোখে বাজে। এবাড়ির মানুষ চোখ মেলে একবারও দেখেনি? ভেবে ভেবে অবাক না হয়ে পারে না তপু।
ফয়সাল নামমাত্র খেয়েছে।দু-এক লোকমা পোলাও,একটুখানি ডিম। গলা দিয়ে খাবার নামে না। গিলতে কষ্ট হয়।এঁটো হাতে বসে আছে ফয়সাল।হাত ধোয়ার ব্যবস্থা নেই এখানে। স্টেজ থেকে দূরে প্লাস্টিকের ড্রামে পানির ব্যবস্থা আছে।সবাই খাবার শেষে উঠে হাত ধুয়ে আসছে।ফয়সাল পারে না।নতুন জামাই বলে কথা।
শাড়ির আঁচলে কাঁধ ঢেকে, ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে,টুকটুক করে হেঁটে আসে রত্না। রত্নার পাশেই লিলি,রনি।একজনের হাতে পিরিচ,আরেক জনের হাতে গামলা।ভীড় ঠেলে রত্না টুপ করে বসে পড়ে ফয়সালের সামনে। রত্নার গা থেকে আসা গন্ধরাজের ঘ্রাণে মাথা চক্কর দেয় ফয়সালের। মনে হয় যেন গন্ধরাজের বাগানটাই পায়ের কাছে এসে বসে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে ফুলটাকে ছুঁয়ে দেয়ার অপেক্ষা মাত্র। পানের বরজে হাওয়া লাগলে সতেজ পানপাতা যেমন কাঁপে,তেমন করে ফয়সালও কাঁপে। রত্নার দিকে আঁড়চোখে চেয়ে চোখ জুড়ায়। গোলাপী রঙা গাল,লাল টুকটুকে ঠোঁট,কাঁধে ফেলে রাখা হাত খোঁপা, খোঁপায় গুজে দেওয়া দুটো টকটকে লাল গোলাপ— শিহরণ জাগে ফয়সালের মনে।পৃথিবীর সব মেয়ে সুন্দর,শুধু তার বউটাই অসুন্দর। সবার দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগে,অথচ বউয়ের দিকে মুখ তুলে চাইতেও ইচ্ছা করে না। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিসটাই মানুষের মন। এর কোনো কূল-কিনারা নেই।
” দুলাভাই,হাত ধুইবেন না?”
ফয়সালের ঘোর কাটে।সচেতন হয়ে বলেঃ” হ্যাঁ, হাত ধোয়া দরকার।কিন্তু উঠতে পারছি না।একটু ব্যবস্থা করে দাও তো রত্না।”
রত্না মুচকি হাসে। ফয়সালের মনে শিহরণ জাগে।বেশ হাসতে জানে মেয়েটা। রনির হাত থেকে গামলা নেয় রত্না।ফয়সালের ডান হাত টেনে নিজের হাতে পানি ঢেলে সযত্নে ধুইয়ে দেয়। বিয়েতে বউয়ের বোন-বান্ধবীরা এমন করে।এর চল বহুদিন ধরেই আছে। রত্না হাসিমুখে ঘসে ঘসে হাত ধোয়ায় বটে কিন্তু ও- ধারের মানুষটার মনে বয়ে যাওয়া টর্নেডো আঁচ করতে পারে না।ফয়সালের মনে হাহাকার। এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে রত্নার সুন্দর হাত দুটোর দিকে।কি সুন্দর আঙুল! চেহারা দেখা লাগে না, রত্নার হাত দুটো দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।আদর করে একটু চেপে ধরলেই যেন চামড়া ফেটে রক্ত গড়াবে। ফয়সাল রত্নার হাতের দিকে চেয়ে থাকে।মনে মনে বাজে তীব্র আফসোসের সুর,” চিরদিনের জন্যে ও হাত দুটো আমার হতে পারতো।ওই হাত দুটোর অধিকার আমি পেতে পারতাম।হলো না,কিছুই হলো না। পৃথিবীতে সুখ বলতে কিছু নেই।”
লিলি হাতের পিরিচ বাড়িয়ে দেয় সামনে।রত্না নতুন তোয়ালেতে ফয়সালের হাত মুছে। প্রসন্ন গলায় বলেঃ” দুলাভাই,পিরিচ ভরার দায়িত্ব আপনের।”
” একটুখানি হাত ধুইয়েই পিরিচ ভরতে চাইছেন? আপনার মতো ধান্দাবাজ আর দেখিনি”— পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটে তপু।সালাদের শসা,টমেটো এখনো হাতে।
” হাত ধোয়াইলে পিরিচ ভইরা দিতে হয়। এগুলা জানেন না? ”
” তাহলে আমার হাতটাও ধুইয়ে দেন।”
” আপনে আমার দুলাভাই?”
” না,বেয়াই। সব যত্ন-আত্তি দুলাইভাইরা পাবে? বেয়াইদের জন্য কিছু নাই?”
” আছে।বেয়াইরা দুলাভাইগো চাইতে বেশি ভাগীদার। তাই এই ছোট্ট গামলা আর এক গ্লাস পানিয়ে তাগো হাত ধোয়ান যায় না।আপনের লেগা ওইখানে এক ড্রাম পানি আছে।আপনে ওইখানে যান। হাত ক্যান,পুরা শরীর ধুইতে পারবেন।”
এদের কথা-বার্তা ভালো লাগছে না ফয়সালের।পকেট থেকে টাকা বের করে পিরিচে সাজিয়ে দেয়। মাথা ধরে গেছে, একটু শান্তিতে চোখ বুঝতে পারলে ভালো হতো।
লিলি খুশিমনে পিরিচ নিয়ে পা বাড়ায়।রত্নাও শাড়ির আঁচল টেনে উঠে দাঁড়ায়। যাওয়ার আগে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলেঃ” আপনে অনেক ভালো দুলাভাই।আপনের মতো ভালো মানুষ সব ঘরে দরকার।দোয়া করি সুখী হন।বছর ঘুরার আগেই আপনাগো ঘরে সোনা-মানিকেরা ট্যা ট্যা করুক।”
মুখ টিপে হাসে রত্না। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যায়।ফয়সাল বিরক্ত হয়।নিজের উপরেও রাগ করে।মেয়েটা এতো বড় সর্বনাশী কথা বলার সাহস পেল কোথায়? রত্নাকে গলা শক্ত করে দুটো ধমক দিলেই চলতো।চুপ করে থাকাটা একদম উচিৎ হয়নি।
খাটের এক কোণে বসেছিল হুমায়রা।রোমেলা বানু আসেননি।কাজী বাড়ি থেকে অভিভাবক হিসেবে হুমায়রাকে পাঠানো হয়েছে।শত হলেও বাড়ির বড় বউ সে।দায়িত্ব একটা রয়েই যায়।
দরজার ও-পাশ থেকে হুমায়রাকে ডাক দেয় অন্তু। স্নিগ্ধ গলায় বলেঃ” মেজ ভাবি,আসব?”
হুমায়রা সূচির খাটে বসা। আশেপাশে মহিলা মহল।অন্তুর কন্ঠ শুনে চম্পা,রত্না,মনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় হুমায়রার দিকে।হুমায়রা একটু বিব্রত হয়। নিচু গলায় বলেঃ” আমার দেবর।আমি একটু আসতাছি।”
দ্রুতপায়ে উঠে দরজার কাছে যায় হুমায়রা। নিচু গলায় প্রশ্ন করেঃ” কিছু দরকার,অন্তু?”
” আমি তো একটু পরেই চলে যাব।তাই ভাবলাম নতুন ভাবির সাথে একটু দেখা করে যাই।”
” একটু পরেই চইলা যাইবা মানে?”
” ছুটি নেই ভাবি। স্কুলে মডেল টেস্ট চলে।কালকে পরীক্ষা।”
” তাই বইলা কালকেই যাইবা! আম্মা রাগ করব।”
” আমি কাকিমাকে বুঝিয়ে বলব।পরীক্ষা শেষে এক সপ্তাহ বন্ধ আছে।তখন ঘুরে যাব একবার।”
ঘরে নিস্তব্ধতা। হুমায়রা ও অন্তুর কথোপকথন সবাই কান পেতে শুনছে। অন্তুর যাওয়ার কথা শুনে চম্পা হুমায়রাকে ডেকে বলেঃ” ঘরে আসতে বলেন ভাবি। যাওয়ার আগে বউ দেইখা যাক।”
হুমায়রার পিছনে ঘরে ঢুকে অন্তু।ডান হাতের তর্জনী আঙুলে চশমা ঠেলে দেয় নাকের উপর।মনি চেয়ার টেনে দিয়েছে।ভদ্রতা বজায় রেখে সেখানেই বসে অন্তু।হাসিমুখে সালাম দেয় সূচিকে।
” আসসালামু আলাইকুম, ভাবি।”
” অন্তু,সূচিরে ভাবি ডাইকো না। ও তোমার ছোট।সূচি,এইটা তোমার ভাসুর।”
সূচি বিব্রত হয়।ঘোমটার ফাঁক দিয়ে একপলক দেখে।অন্তুর সাথে চোখাচোখি হয়। সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নেয় সূচি। এতো সেই লোক! পৌষ মেলায় দেখা সেই বিড়ালের মালিক। এই লোকটা ভাসুর! মানে ফয়সালের বড় ভাই! সূচি লজ্জায় মরে যায়।সেদিন কত কটু কথা বলে ফেলেছিল! এখন না চিনতে পারলেই হয়।
অন্তু বোধহয় চিনতে পারেনি।প্রসন্ন গলায় বলেঃ” ভালো আছো,সূচি?”
সূচি উপর-নিচে মাথা দোলায়।অস্ফুটস্বরে বলেঃ” জ্বী,আলহামদুলিল্লাহ। ”
পাঁচ মিনিট বসে টুকটাক কথা বলে অন্তু।কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পায়নি। সূচিও লজ্জা পাচ্ছে,অন্তুও বিব্রতবোধ করে। সামান্য আলাপচারিতা শেষে উঠে দাঁড়ায় অন্তু।হুমায়রাকে বলে দরজার বাইরে পা বাড়ায়। সূচি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।যাক, ব্যাটা চিনতে পারেনি।বাঁচা গেল।
বাইরে হৈ চৈ।বড়রা কথা বলছে।রমিজ শিকদারের কন্ঠ কানে আসছে।মমিন শেখকে তাড়া দিচ্ছেন।ব্যস্ত গলায় বলছেনঃ” বেলা থাকতেই বেরোতে হবে বেয়াই সাহেব। বুবু বলেছে নতুন বউ নিয়ে সন্ধ্যার আগেই বেড়িয়ে যেতে।আয়োজনটা যদি একটু তাড়াতাড়ি….
সূচির বুকের রক্ত ছলকে উঠে। তবে কি বিদায়ের ঘন্টা বেজেই গেল? সূচির গলা শুকিয়ে আসে। আতিপাতি করে মাকে খোঁজে।কাল রাতের পর থেকে মায়ের সাথে বসে দু-দন্ড কথা বলার ফুরসৎ মেলেনি। আশা ছিল বড় আপার সাথে দেখা করবে।কিন্তু তা আর হলো না। বিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনো অসাধ্য।সূচির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।ঘোমটার আড়াল থেকে পুরো ঘরে চোখ বুলায়। সেই কোন কালের পুরোনো আলনা, একটা কাঠের টেবিল,টেবিলের উপরে ক্লাসের বইগুলো। নিজের বইগুলোর প্রতি কোনোদিন ভালোবাসা ছিল না।সূচির।পরীক্ষা ছাড়া ছুঁয়ে দেখতেও ইচ্ছা হতো না।আজ একটু ছুঁয়ে দেওয়ার বাসনা জাগে মনে।পুরোনো বইগুলোকে বুকে চেপে ধরতে ইচ্ছা হয়। বাচ্চাদের মতো আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।ও বাড়িতে তো এসব নেই। এগুলো সূচির নিত্যদিনের পরমাত্মীয়। ছেড়ে যেতে কষ্ট হয় সূচির।খুঁটির সাথে টাঙানো আয়নার দিকে চেয়ে হু হু করে কেঁদে উঠে সূচি। টপটপ করে পানির ফোঁটা ঝরে পড়ে কোলের উপর।আজকের পরে আয়নায় কে মুখ দেখবে? ঘরের কাজ ফেলে এ-ঘরে আসার সময় পাবে মা? কতদিন মোছা হবে না আয়নাটা।টেবিলের উপরে সূচির প্রসাধনী সামগ্রী পড়ে আছে।একটা পাউডার,চিরুনি,কাজল,লিপস্টিক,অর্ধেক শেষ হওয়া ক্রিম।এগুলো বহু আদরের জিনিস।আজ থেকে এদেরকে কে যত্নে রাখবে? এগুলো এমনিই পড়ে থাকবে? সূচি না থাকলে এই ঘরটা খালি পড়ে থাকবে? এগুলো কিছুই নেওয়া যাবে না সাথে? আজন্ম পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এতোই সহজ! ভেবে ভেবে আর পারে না সূচি।জানলা দিয়ে লেবুর ঘ্রাণ ভেসে আসে। সূচি প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নেয়। বাতাবি লেবুর ঘ্রাণ বুকে জমিয়ে রাখে।ও-বাড়িতে এমন সুগন্ধি লেবু হয়? লেবুর পাশাপাশি আরো অনেক ঘ্রাণ নাকে আসে সূচির।ঘ্রাণগুলোকে আলাদা আলাদা নাম দিতে পারে।গন্ধরাজের ঘ্রানটা আসছে রত্নার গা থেকে।ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ আসছে মনি ভাবির শাড়ির ভাঁজ থেকে।কড়া প্যারাসুট নারিকেল তেলের ঘ্রাণ আসছে চম্পা ভাবির থেকে।ভাবি সবসময় চুলগুলোকে তেলে ভিজিয়ে রাখে। কড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে রনির গা থেকে।মায়ের গায়ের গন্ধটা খুঁজে পায় না সূচি।মায়ের গা থেকে একেক সময় একেক ঘ্রাণ আসে।রান্নাঘর থেকে উঠে আসার পরে পাওয়া যায় মশলার ঘ্রাণ।জিরা,গরম মশলা, হলুদ-মরিচ– সবকিছুর সাথে মা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় একদম। গোসলের পর আসে ডেটল সাবানের ঘ্রাণ। মা একদম সাবানের ফেনা তুলে গোসল করে।বিকালে কাঁথা সেলাই করার সময় আবার মায়ের গা থেকে ভিন্ন ঘ্রাণ আসে।তখন পাওয়া যায় তীব্র জর্দার ঘ্রাণ।মা কড়া জর্দা দিয়ে পান চিবোয়।মা আশেপাশে থাকলেই হরেক রকম ঘ্রাণ আসে।এগুলো মায়ের ঘ্রাণ। সূচির চোখ ভরে আসে।অনবরত পানি পড়ে কোলের উপর।মাথায় ঘোমটা তোলা বলে কেউ দেখে না।আশেপাশে এতো মানুষ থাকার পরেও কেউ বুঝতে পারলো না ঘরে তীব্র সুনামি চলছে। সূচির মন সায়রের তীব্র ঢেউগুলো স্থানচ্যুত। ভাঙন চলছে সেখানে। সূচি কাঁদে।বহুদিনের লালিত বড় স্বপ্নটা পূর্ণ হলো ঠিকই কিন্তু স্বপ্ন পূরণে কোনো সুখ নেই। এখানে কেবল বিষাদ আর বিষাদ।
________________________
মাঝারি আকারের ঘর। সূচির ঘরের মতো ছোট নয়। খাট,আলনা, টেবিল, ড্রেসিংটেবিল, ওয়ারড্রব রাখার পরেও বেশ ভালোই জায়গা আছে।দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্বচ্ছন্দে নামাজ পড়া যাবে। খাটের বিপরীতে আয়না। খাটের মাঝে বসে মুখ তুললেই আয়নায় চোখ যায়।আয়নার দিকে চোখ পড়লেই গা ঘিনঘিন করে।স্বচ্ছ কাঁচের উপর এক আঙুল ময়লা।ওটার সামনে দাঁড়িয়ে আর যা হোক নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যাবে না।দেয়ালগুলোর চার কোণেও ময়লা। মাকড়সা বাসা বেঁধেছে সযত্নে। সাদা রঙা দেয়ালে বিশ্রি দেখায়। সূচির গা গুলিয়ে আসে। সূচি অগোছালো কিন্তু নোংরা নয়। সূচির বিছানার চাদর এলোমেলো থাকে ঠিকই কিন্তু টিনের উপরে কখনো মাকড়সা বাসা বাঁধার সুযোগ পায়নি।টেবিলে উপর বইগুলো এলোমেলো থাকে ঠিকই কিন্তু আয়নার উপর একফোঁটা ধুলো জমতে দেয়নি কখনো।
কালো রঙের ফ্লোর ময়লায় সাদা হয়ে আছে। ইহকালে এখানে পানি পড়েছে নাকি সন্দেহ।ওয়ারড্রবের উপর একগাদা জিনিসপত্র। শেভিং ক্রিম,বাসক সিরাপ,নাপা সিরাপ,ট্যাবলেটের ঝুড়ি, কীটনাশক,আঠা,চার্জার– হাবিজাবি আরো বহুকিছু একটা আরেকটার গায়ে চেপে রাখা। ঘর সাজানোর সময় বোধহয় দয়া করে কেউ জিনিসগুলোকে ঠেলে রেখেছে একপাশে। ওয়ারড্রবের উপরে হাত ছুঁইয়ে দিলেও রাজ্যের ধুলো-ময়লা হাতে চলে আসবে তা নিশ্চিত।টেবিলের উপর একটা পানিভরা জগ,একটা কাঁচের গ্লাস।তার পাশেই একটা খাতা-কলম। সেখানেও ধুলা। ওপাশের জানলাটা সারা সন্ধ্যা খোলা ছিল বোধহয়। হাওয়ার সাথে বাইরের ধুলাবালি সব টেবিলে এসে আশ্রয় নিয়েছে।সূচির সারা শরীর ঘিনঘিন করে।মনে হচ্ছে কোনো ব্যাচেলরের মেসে এসেছে।ফয়সাল এতো নোংরা? ছিঃ! ঘর তো নয় যেন গোয়ালঘর।নতুন বউ বলে বসে আছে সূচি।নাহয় এক্ষুণি সাবান পানি নিয়ে সব ঘসে ঘসে পরিষ্কার করতো।
ঘড়িতে সাড়ে দশটা বাজে।কাল রাতে ঘুম হয়নি।আজ সারাদিনে পিঠ ঠেকানোর সময় পায়নি।ঘুমে সূচির দু-চোখ ভেঙে আসে।ফয়সাল আসেনি এখনো।সূচিকে এঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে গেছে বোধহয়।বাহির থেকে কোনো শব্দ আসছে না। ঘরের ভিতরেও গাঢ় নিস্তব্ধতা। শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।সূচি হাই তোলে। একটু ঘোমটা তুলে হাঁটুতে মুখ গুজে দেয়। শাড়ি-গয়নায় এক মন ভারী লাগছে নিজেকে। এগুলো পাল্টে পাতলা শাড়ি পরার ইচ্ছা ছিল সূচির।হুমায়রাও অবশ্য এই কথাটা বলেছিল। কিন্তু রোমেলা বানু দিলেন না। হুমায়রার কথাকে পাত্তা না দিয়ে বললেনঃ” বউ মানুষ আরো কতক্ষণ থাকুক বউ সাইজ্জা। পরে পাল্টাইবনি।”
সূচি দমে যায়।এতো সেজেগুজে থাকতে আর ভালো লাগছে না।সেই সকাল থেকে পটের বিবি সেজে বসে আছে।শরীরের আরাম বলতেও একটা কথা আছে। গরম পানিতে গোসল করে একটা পাতলা সুতির শাড়ি পরতে পারলে বেশ হতো।গরমে অস্থির লাগছে খুব।সূচির তো আর মেম সাহেবদের শরীর নয়,এখানে সবকিছু সহ্য হয় না।
একা একা বসে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যায় কয়েক ঘন্টা আগের কথা।কয়েক ঘন্টা আগেও সূচি ও-বাড়িতে ছিল।সাড়ে পাঁচটায় বেরিয়েছে বরপক্ষ। বিদায় বেলার কথা মনে করে আবারো কাঁদে সূচি। সবাই কি রকম জড়িয়ে ধরে কাঁদলো! চম্পা ভাবি,মনি ভাবি,জয়া ভাবি,রত্না,লিলি, আলেয়া দাদি, বাবা — সবাই কাঁদলো। সূচিও কেঁদেছে।আগে কখনো বাবার বুকে মাথা গুজে কাঁদার সুযোগ হয়নি।আজ হয়েছে।আসার সময় বাবা কাঁদতে কাঁদতে জড়িয়ে ধরলো।সূচিই কেঁদে বুক ভাসিয়ে দিলো।মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদার সুযোগ হয়নি। মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞান ফেরা অবধি কেউ অপেক্ষা করেনি।সূচিকে নিয়ে চলে এসেছে।আসার আগে রনিকেও চোখ মুছতে দেখেছে সূচি।দূরে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতায় চোখ মুছছিলো।ওকেও জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিলো সূচির।ছোট ভাইয়ের জায়গায় ওই রনিই বসা।
সূচিদের বাড়ি থেকে ফয়সালদের বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়।তাই গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়নি।অবশ্য গাড়ি চলার রাস্তা নেই এখানে।সব আঁকা-বাঁকা মেঠো পথ। সুপারি গাছের ছায়ায় ঘেরা সরু পথ।বর-কনের জন্য অটোরিকশার ব্যবস্থা করা হয়েছে।প্লাস্টিকের ফুল-লতা, পাতা দিয়ে সাজানো নতুন অটোরিকশা। ফয়সালের হাত আগলে সূচি যখন রিকশায় উঠলো, তখন শেষবেলা।আকাশ রাঙিয়ে সূর্য ডোবার পায়তারা করছে। জায়গায় জায়গায় কুয়াশারা বসার স্থান ঠিক করছে।পাতা ঝরা রিক্ত দিনে ফয়সালের হাত ধরে বাড়ি ছাড়লো সূচি। দিন-দুনিয়া অন্ধকার করে কেঁদেছে আসার আগে।ফয়সালের ধমক শোনা গেছে গাড়ির ভিতর।দু-একবার নিচু গলায় বলেছেঃ” আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো।এতো কান্নাকাটির কী আছে?”
ভূমিদের বাড়ির সামনে দিয়ে ফয়সালদের বাড়িতে আসতে হয়।রাস্তায় ঘন সুপারি গাছ ও কাঁটা গাছ দেখেই সূচি বুঝতে পারলো এখনই বড় আপার বাড়ি দেখা যাবে।সূচি মাথা গলায় বাইরে। টিনের বেড়া, লম্বা হিজল গাছের ডাল দেখা যায় দূর থেকেই। সূচি আগ্রহ নিয়ে মুখ বাড়ায়।চলন্ত রেলের জানলায় যেমন যাত্রীরা মুখ বাড়ায়,ঠিক তেমনি সূচিও মুখ বাড়ায়।হতাশ হয় না সূচি।বড় আপাকে দেখতে পায়।বেড়ার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।ইশতি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে আপাকে ধরেই। গাড়ি ছুটে চলে। সূচি চলতি গাড়ি থেকেই হাত বাড়িয়ে ইশারা দেয়।বড় আপাকে শুধু হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেয়,”আপা আমি যাচ্ছি।”
বড় আপা বিনিময়ে কী বললো তা বোঝা গেল না।তার আগেই সূচিকে নিয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে।
এবাড়িতে আসার পর থেকে বসেই আছে সূচি।প্রথমে বসেছিল শ্বাশুড়ির ঘরে।খাটের উপর পুতুলের মতো। আশেপাশের মহিলা মহল এসে এসে বউ দেখেছে,সূচির মুখে মিষ্টি গুজে দিয়েছে।কেউ কেউ সূচিকে দেখে মন্তব্যও করেছে। সূচির সামনেই নাক-মুখ কুঁচকে একে-অন্যকে ফিসফিসিয়ে বলেছেঃ” কী বউ আনলো.রোমেলা? এই পোলার লেগা এই বউ?”
সূচির মনটা খারাপ। তখন থেকেই খারাপ।মনে মনে ফয়সালের সাথে নিজেকে তুলনা দেয়।ফয়সালের সৌন্দর্যের কাছে নিজেকে বড্ড ফিকে মনে হয়।এই প্রথম নিজের চেহারা নিয়ে আফসোস করে সূচি।আরেকটু ফর্সা হলে বেশ হতো।ফয়সালের সাথে তখন মানাতো।
বসে বসে চোখ লেগে আসে সূচির।হাঁটুতে মুখ গুজে ঘুমে ঢলে পড়ে। শরীর ভেঙে আসছে।শরীরের আর কী দোষ? দুপুরে খাওয়া হলো না। এখানে আসার পর একের পর এক মিষ্টিই পেটে গেছে। মিষ্টি,তেল-চর্বির খাবার সহ্য হয় না সূচির।তার মন কাঁদে দুটো ভাত-ডালের জন্য।মুখ ফুটে বলতে পারে না কাউকে। আজকে সব সহ্য করতে হবে।
গোলাপ,রজনীগন্ধা দিয়ে খাট সাজানো হয়েছে। ফুলের তীব্র ঘ্রাণ সুড়সুড়ি।দেয় নাকে।দরজায় খট করে শব্দ হয়।বাইরে থেকে দরজা খুলছে কেউ। সূচির ঘুম পালিয়ে গেল।পিঠ সোজা করে সোজা হয়ে বসে।ফয়সাল ঘরে ঢুকছে। গায়ে টি-শার্ট,চুলগুলো ভেজা।গোসল করেছে হয়তো।সূচির চোখ জুড়িয়ে যায়।বাহ! মানুষটাকে দারুন লাগছে।
মুখ ভার করে ঘরে ঢুকে ফয়সাল। ডানহাতে কোঁকড়া চুলগুলো ঠেলে পিছনে ফেলে দেয়।কপাল কুঁচকানো,মুখ বেজার। থমথমে অবস্থা।খাটে বসা সূচির দিকে ফিরে তাকায় না।ওয়ারড্রবের কাছে যেয়ে ফোন চার্জে দেয়।ফোন বন্ধ ছিল এতোক্ষণ। ফোনের গতি করে টেবিলের কাছে এসে পানি খায়।সূচি চোখ মেলে অনুসরণ করে ফয়সালকে।টেবিলের কাছে আসতেই মেরুদণ্ড সোজা করে বসে। হৃৎপিণ্ডের নাচুনী বাইরে থেকে অনুভব করতে পারছে।ঢোক গিলে ফয়সালকে সালাম দেয় সূচি।আসার আগে হুমায়রা শিখিয়ে দিয়েছে এটা।
” আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
সালামের উত্তর দিয়ে বিছানায় চলে আসে ফয়সাল। সূচি কাঁপে।থরথর করে কাঁপে।বিয়ের আগে সূচি অনেক সিনেমা দেখতো।সিনেমায় দেখেছে, নায়ক নায়িকার ঘোমটা তুলে কপালে চুমু দেয়।রাতভর গল্প করে।এখানে নিশ্চয়ই এমন হবে।সারারাত গল্প করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে সূচি।ঘুম আসছে চোখের পাতায় ভর করে।সূচি পাত্তা দেয় না।আজকে ঘুমালে চলবে না।আজ গল্প করতে হবে।আজকেই একে অন্যকে চিনতে হবে।
” উপরের ড্রয়ারে পাতলা কাঁথা আছে।তুমি গায়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যাও।খাটের লেপ-কম্বলে হাত দিয়ো না, প্লিজ। আমি কারো সাথে কাঁথা-কম্বল শেয়ার করতে পারি না।তুমি আমার কম্বল গায়ে দিলে আমি হয়তো ঘুমাতেই পারব না। আমার অনেক ঘুম পেয়েছে।”
আগাগোড়া কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো ফয়সাল।কয়েক সেকেন্ড পর মাথা বের করে আবার বললোঃ” তুমি ফ্রেশ হয়ে লাইটটা বন্ধ করে দিয়ো।আমার মনে ছিলো না।”
সূচি পাথরের মতো বসে রইলো।অচঞ্চল দৃষ্টি ফয়সালের দিকে। লোকটা কি প্রত্যাখ্যান করলো? প্রত্যাখানের ব্যাথা সূচির ভিতর-বাহিরে ঝনঝন করে বাজে।শরীর ভারী লাগছে,মাথা ভারী লাগছে। কার জন্যে এতো সেজেগুজে বসে আছে সূচি? এই লোকটা এতো নিরাসক্ত কেন? সূচির অভিমান হয়,তীব্র অভিমান। চোখের পাতা ভারী মনে হচ্ছে।শীতের রাতে উঠোনের ঝরে নিশির শিশির। সূচির চোখ বেয়েও শিশির ঝরে।টুপটুপ, টুপটুপ।সূচি নড়ে-চড়ে না।ঠায় বসে থাকে নিজের জায়গায়।
চলবে….