শুভ বিবাহ পর্ব-১৩

0
792

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

১৩

আমাদের প্রেম ভালোই চলছে। শুভ যতই ছোঁক ছোঁক করুক, দিন শেষে আমার কাছেই আসে। আমিও জেদ ধরে বসে থাকি। ফোন বন্ধ করে দেই, কথা বন্ধ করে দেই, মুখ দেখা বন্ধ করে দেই। এতে ও অস্থির হয়ে আমার পেছন পেছন ঘোরা শুরু করে। আমিও নাক উঁচিয়ে রাখি। ইদানীং এই টেকনিকেও কাজ হচ্ছে কম। কারণ তার ফোন। ফোনে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। সে ফোন আমার হাতে সহজে দিতে চায় না। শেষ যেবার ওর ফোন চেক করেছিলাম, চারটা নতুন মেয়ের নাম্বার পেয়েছি। রাগ করে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, তখন বলল, ভার্সিটির ছোট বোন। তাহলে এদের সাথে ফোনে কেন কথা বলবে? আবার একজনের সাথে আধাঘন্টার উপরে কথা বলার রেকর্ড আছে। সম্ভবত আমার সাথে রাগ হলেই এসব করে, নতুন কাউকে ধরে আনে। সব ঠিক হয়ে গেলে আবার ছেড়ে দেয়। কিন্তু এসব ছ্যাচড়ামো কতদিন করবে? ঝগড়াঝাটি করে ওর চুল টেনে কিলিয়েও ঠিক করতে পারি নি। এখন যা করে আমার আড়ালে। কি যে করি!

কিছুদিন আগে তো একেবারে যা তা ক্যালেঙ্কারি অবস্থা হয়েছিল। আমার জীবনে এমন দিনও আসবে, কে কল্পনা করতে পেরেছিল?

সেদিন জোর করে শুভকে নিয়ে ইস্টার্ন মল্লিকায় গেলাম কিছু ড্রেস কেনার জন্য। ইদানীং পাকিস্তানি থ্রি-পিস এর উপর আমার নজর পড়েছে। সামনেই এক আত্মীয়ের বিয়ে আছে, সেখানে পরব। শাড়ি একবার ফাল্গুনে পরলেও এখন শাড়ি পরার মুডে নেই আমি। নিজের বিয়েতেও লেহেঙ্গা পরার ইচ্ছা, শাড়ি না। সামলাতে সামলাতে ঘাম ছুটে যায়। সে যাক, শুভকে নিয়ে সেখানে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, ওর পছন্দের কাপড় কেনা। কোন প্রেমিকা চায় না তার প্রেমিকের পছন্দে নিজেকে সাজাতে?

এস্কেলেটর বেয়ে তিন তলায় উঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বিভিন্ন দোকানে ঢু মারলেও কোথাও ড্রেস পছন্দ হচ্ছে না। জোর করে ধরে আনার জন্যই কিনা জানি না, শুভও কোনোটা পছন্দ করছে না। আমি ধৈর্য ধরে এ দোকান থেকে ও দোকানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওমা, কোত্থেকে এক লোক রীতিমতো উড়ে এসে শুভর কলার চেপে ধরল! ওকে রীতিমতো ফ্লোর থেকে কিছুটা উঁচুতে ধরে বলল,
❝তোর সাহস কিভাবে হয় আমার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে কথা বলার?❞

শুভ জবাব দেয়ার বদলে উলটো নিজেকে ছাড়ানোর জন্য জোর করছে। লোকটা ওর চেয়ে কয়েক ইঞ্চি খাটো হবে, কিন্তু গায়ের জোর মনে হচ্ছে ওর তিন গুণ, যেভাবে ওকে ধরেই উঁচু করে ফেলল! ওদিকে আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। শুভ জোর করে কলার ছাড়িয়ে বলল,
❝আপনার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে আমি কেন কথা বলব? কে আপনার গার্লফ্রেন্ড? এই যে, ও আমার গার্লফ্রেন্ড। আপনার গার্লফ্রেন্ড কে আমি চিনি নাকি?❞
লোকটা ফোন বের করে এক মেয়ের ছবি দেখিয়ে বলল,
❝তুই ওকে চিনিস না? চিনিস না ওকে?! আমার সাথে মিথ্যা বলবি না! আমার কাছে তোদের সব চ্যাট হিস্ট্রি আছে!❞
এবার শুভ বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
❝আমি মোটেও ওর সাথে কথা বলতে চাইনি। ওই জোর করে আমার সাথে কথা বলে, নক করে❞
❝বললেই হলো? তোদের চ্যাট দেখে আমি বুঝি না? দেখি নাই? দেখ, আমার সাথে বাড়াবাড়ি করবি না! আমার গার্লফ্রেন্ডকে দ্বিতীয় বার নক করবি না!❞
শুভরও সাহস কম না। সে আঙুল উঁচিয়ে তুড়ি মেরে বলল,
❝এই যে, নিজের গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ন্ত্রণ করা শেখেন। নিজের গার্লফ্রেন্ডকে কন্ট্রোল করতে পারে না, আরেকজনকে ধরতে আসছে! এত লোভী মেয়ে, বয়ফ্রেন্ড থাকতে অন্য দিকে মুখ দেয় কেন?❞
শুভ কয়েকটা গালিও দিল। আমি অবাক হয়ে শুভর দিকে চেয়ে থাকলাম। তখনও ভাবছি, মেয়েটা বেশি খারাপ? নাকি শুভ? ঐ লোক এবার রেগে আমাকে বলল,
❝আপনার বয়ফ্রেন্ড নিজে আমার গার্লফ্রেন্ডকে ডিস্টার্ব করে। রাত বিরাতে কল দেয়! ওরা কত জঘন্য কথা বলে জানেন? সে আবার কোন গলায় মিথ্যা অপবাদ দেয়? আপনারও লজ্জা করা উচিত!❞

আমার মাঝে বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন। আমি শুভর হাত চেপে ধরে বললাম,
❝ও কেন আজেবাজে কথা বলবে আপনার গার্লফ্রেন্ড যদি সুযোগ না দেয়? নিশ্চয়ই আপনার গার্লফ্রেন্ডও কম যায় না! নাহলে কেন ও কথা বলবে? আগে নিজের গার্লফ্রেন্ডকে দেখেন, নিজে লজ্জা পান। এরপর অন্যের লজ্জা নিয়ে ভাববেন! যত্তসব! গার্লফ্রেন্ড এর চরিত্রের ঠিক নেই, আরেকজনের চরিত্র নিয়ে টানাটানি!❞

উঁচু গলা করে শুভর পক্ষপাতিত্ব করতে করতে ওকে টেনে সেখান থেকে নিয়ে আসলাম। শুভও দাম্ভিকতার সাথে বলতে শুরু করল,
❝নিজের খবর নেই, আরেকজনের পেছনে লাগে! আরে বা* আগে নিজের ঘর সামলা! আমাকে বলে লাভ হবে নাকি? আজ আমি, কাল আরেকজনের কাছে যাবে! ওকে ধর! আজব!❞

আমি ওকে কিছু না বলে শপিং মল থেকে বেরিয়ে এসে বললাম,
❝তুই আসলেই ঐ মেয়ের সাথে কথা বলিস না?❞
শুভ কিছুটা দমে গেল। আমার তীব্র দৃষ্টি উপেক্ষা করার শক্তি ওর নেই। আমার পেছনেই যা যা করে, সামনে সামনে তেমন কিছু বলতে পারে না। আমার কথা শুনে ওর কন্ঠ এক স্কেল নিচে নেমে এলো।
❝ইয়ে মানে, কয়েকবার চ্যাট হয়েছে❞
❝কয়েকবার? মাত্র?❞
❝না, অনেকবার আর কি❞
❝ঐ মেয়েই প্রতিবার নক দিত? তুই দিস নাই?❞
❝আরেহ, ফেসবুকে তো এরকম টুকটাক চ্যাট হয়ই। আমিও কয়েকবার আগে নক দিছি। কিন্তু তাতে কি হইছে?❞

শুভ এমনভাবে বলল যেন অচেনা মেয়েদের ফেসবুকে নক করে গল্প করাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার! বরং আমিই বাড়াবাড়ি করছি! নিজের মেজাজকে অনেক কষ্টে নিয়ন্ত্রণে রেখে বললাম,
❝তোর ফোন দে। আমি দেখব, সত্যি সত্যি তুই আজেবাজে চ্যাট করছিস কিনা?❞

শুভ রেগে গেল। আমাকে ফোন না দিয়ে উল্টো চেঁচাতে শুরু করল,
❝আমাকে যদি এতই অবিশ্বাস হয়, তাহলে ঐ ছেলের সামনে এত ভাব নিচ্ছিলি কেন? আমি তো যা বলার বললামই! আবার ফোন দেখিয়ে কি সেটা প্রমাণ করা লাগবে?!❞
আমি শান্ত স্বরে বলি,
❝আগে ফোন দে। সত্যি বললে তো ফোন দিতে তোর সমস্যা থাকার কথা না❞
❝আমাকে তুই অবিশ্বাস করলি? দরকার নাই আমার এমন রিলেশনের!❞

শুভ হনহন করে চলে গেল, ফেলে গেল একা আমাকে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকাতে আটকাতে ভাবলাম, এটাই নিশ্চিত আমার শাস্তি একজন অপরাধীর পক্ষ হয়ে কথা বলার। আমি নিজেও জানি না কেন মলে ওর পক্ষ নিয়ে সাফাই গাইলাম। হয়ত ভালোবাসি বলে… হয়ত আমি সত্য জানার পর মিথ্যা বিশ্বাস করতে চাই বলে… হয়ত ওর অপমান মানতে পারছিলাম না বলে… কে জানে!

ড্রাইভারকে কল করে অপেক্ষা করতে থাকলাম। গাড়িতে উঠে সারারাস্তা মাথা ধরে বসে থাকলাম। মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে, আগামী ক’দিন আর রক্ষা নেই। বাসায় এসে ওষুধ খেয়ে ঘর অন্ধকার করে বিছানায় পড়ে থাকলাম৷ রাতে যখন ঘুম ভাঙলো, তখন এগারোটা আটচল্লিশ বাজে। ফোনের চার্জ শেষ মাথার দিকে এসে ঠেকেছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম শুভর কোনো কল কিংবা মেসেজ নেই। আনমনে আশা করেছিলাম, বরবারের মত সে ক্ষমা চাইবে আর সব ঠিক করে নেবে। ঐ যে বললাম না, আজকাল আমার কোনো টেকনিকেও কাজ করে না?

মাইগ্রেনের ব্যথায় পরদিন ক্লাসে যেতে পারিনি। নীনা, স্নিগ্ধা দুজনেই কল দিয়েছিল। জাহিদও টেক্সট করল। শুভর কোনো খবর নেই, যেন সব অপরাধ আমার। এমনটা ভেবে ভেবে না পারতে সন্ধ্যায় ওকে কল দিলাম। প্রথম বারে না ধরলেও দ্বিতীয়বারে কল রিসিভ করে বলল, রাতে ফ্রি হয়ে কল দিবে, এখন বাইরে আছে। ওর কন্ঠে একেবারে স্বাভাবিক, যেন কিছুই হয়নি। রাতে যখন কল করল, তখন বেশ গম্ভীর শোনালো। সে বারবার একটাই অভিযোগ করে যাচ্ছে, আমি তাকে বিশ্বাস করি না। বিশ্বাসবিহীন সম্পর্ক দিয়ে কি করবে? আমিও বললাম, বিশ্বাস ভাঙার মত কাজ করেছ বলেই দেখতে চাইছি! সে বারবার ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে একই কথা। আমার চোখে বিষাদের সমুদ্র এসে ভর করে, দিশেহারা লাগে। প্রবল পাহাড়ী ঢলের মাঝে উঠে দাঁড়াবার জন্য বলি,

❝আমি যে তোমাকে বিশ্বাস করি, তার জন্য কি করতে বলো আমাকে? কি করলে প্রমাণ হবে যে আমার তোমার প্রতি বিশ্বাস আছে?❞
শুভ চুপ করে থেকে বলল,
❝তোমার বাসায় আসবো। অনেক বার বলার পরও রাজী হওনি তুমি। তোমার আব্বু আম্মু যখন থাকবে না, তখন আসব। পারবে আমাকে বিশ্বাস করতে?❞

আমি কেঁপে উঠলাম। শুভর অন্যায় আবদারে আমার কখনো আপত্তি ছিল না। এমনিতে আমাদের সম্পর্কের দেড় বছর হতে চলল। আজকাল সব সম্পর্কই এদিকে এসে গড়ায়। কিন্তু এখনো আমি রাজী হইনি ওর সাথে একান্তে মিলিত হতে। কারণ ওকে সত্যিই বিশ্বাস করতে পারি না। যদি কাল অন্য মেয়েতে আসক্ত হয়ে পড়ে? আমি শক্ত মেয়ে,তবুও এতটাও না।

শুভর এমন শর্ত শুনে আমি চুপ করে থাকলাম। ভেতরে আমার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। শুভ তাচ্ছিল্য করে ওপাশ থেকে বলল,
❝জানি, পারবা না। তুমি তো বিশ্বাসই করো না আমাকে! আমার উপর ভরসাও নেই!❞
❝এই বৃহস্পতিবার বাসায় আসো, সকাল এগারোটার মাঝে। আমি রাজি❞

শুভ ওপাশে নিশ্চিত খুশি হয়েছে। আমিও রাজি হয়েছি ভালোবাসার সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে। ও আমার ভেতরে কতটা গেঁথে গেছে, তা কেবল আমি জানি। যে কোনোভাবেই হোক, আমাদের সম্পর্ক মিথ্য হতে পারে না, আমি তা হতে দিতে পারি না!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here