#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria
৩৪ ও শেষ পর্ব
ক্লাস শেষ করে বন্ধুদের সাথে হেলতে দুলতে বেরিয়ে এলাম। গেইটের সামনে রাস্তার উল্টো দিকে শুভ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। উনি আজকে বেশ সাজগোজ করেছেন। চোখে একটা নতুন রোদচশমা লাগিয়েছেন। আগে এটা দেখিনি। আমি খুব স্বাভাবিকভাবে তার সামনে এসে বললাম,
❝কখন আসলেন?❞
❝বেশিক্ষণ হয়নি। ক্লাস শেষ তোমার?❞
আমি মাথা নাড়লাম। উনি এদিক ওদিক চেয়ে বললেন,
❝কোথায় বসবা?❞
❝একটা রিকশা নিচ্ছি। চলেন❞
একটা রিকশা ডেকে দুজনে উঠে পড়লাম। এই প্রথম শুভ ভাইয়ার এত কাছে আমি বসে আছি। এর আগে কখনো এত কাছে এত সময় ছিলাম না। সবসময় একটা দূরত্ব রেখে চলেছি। যদিও আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। শুভ ভাইয়া পাশে বসে একটু পর পর চশমার কোণা দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি বসে থেকে সব টের পাচ্ছি, কিন্তু এমন ভাণ করছি যেন কিছু বুঝতে পারছি না। কিছু বুঝতে পারলে লাই পাবে। আমি আমার মত আশেপাশে দেখছি। শুভ ভাইয়া বোধহয় কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু আমি তাকিয়ে না থাকায় বলতে সুবিধা হচ্ছে না। শুভ ভাইয়ার আমাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিতে নিতে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে চলে আসলাম। ঢাকার মতো অলিতে-গলিতে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট না হলেও ইদানীং ভালো ভালো কিছু যায়গা হয়েছে। ছিমছাম গোছানো শহরে মাঝে মাঝে সেসব যায়গায় গিয়ে ভালোই লাগে। আমার যদিও বন্ধু বান্ধব কম, তাই তেমন ঘোরা হয় না। তবে এই রেস্টুরেন্টটা চিনি বলে উনাকে নিয়ে এখানে এলাম।
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মেটাতে গিয়ে দেখি শুভ ভাইয়া আগেই পে করে দিয়েছে। আমি অবাক হয়ে বললাম,
❝আপনি দিলেন কেন? আমিই তো দিচ্ছিলাম!❞
সে হাসি দিয়ে বলল,
❝আরেহ, সমস্যা নাই। চলো তো!❞
❝না! আমি ভাড়া দিব। আপনি আমার হরে এসছেন…❞
❝ঠিক আছে। খাবারের বিল তুমি দিও। চলো❞
শুভ ভাইয়াকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলাম। এসির শীতল হাওয়া মুহূর্তে ছুঁয়ে গেল। আমরা এক পাশের টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। রেস্টুরেন্টা বেশ খোলামেলা। জানালা থেকে বিকেলের রোদ এসে পুরোটা আলোকিত করে তুলেছে। আমার ক্ষুধা লেগেছে বলে আগে খাবার অর্ডার সম্পন্ন করলাম। তারপর শুভ ভাইয়া হাসি মুখে আমার চোখে চোখ রাখলো।
❝আজকে খুব হালকা হালকা লাগছে জানো। অনেক দিন পর একটু ভারমুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে❞
❝ভারমুক্ত কেন?❞
❝এই যে, এত দিন তোমাকে এত বলতাম৷ এত বুঝাতাম যে আমি মিথ্যা কথা বলিনি। শেষ অব্দি তুমি যে বুঝেছ, এতেই আমি অনেক খুশি!❞
আমি চুপচাপ থাকলাম। উনি আবার বলছেন,
❝আমি জানি, তোমার সাথে আমার অনেক পার্থক্য, অনেকটা আলাদা আমরা। কিন্তু কি কারণে জানি না, তোমার প্রতি অনেক আগে থেকে একটা মায়া ছিল। আগে খুব একটা বুঝিনি, গুরুত্বও দেইনি। কিন্তু তোমার সেই এক্সিডেন্টের পর থেকে কেমন যেন হয়ে গেলাম। তোমার প্রতি একটা পাকাপোক্ত সফট কর্ণার যে মনে তৈরি হয়েছে, সেটা তখনই টের পেয়েছি। অন্য কোনো মেয়ের সাথে কথা হয়নি, এমন না। কিন্তু সবসময় তোমাকে নিয়েই ভাবতাম❞
শুভ ভাইয়া তার মতো বকবক করেই যাচ্ছে। সে অকপটে তার অনুভূতি প্রকাশ করছে। আমার লেমোনেড একটু আগে চলে আসায় সেটায় চুমুক দিয়ে কিছুক্ষণ তার কথা শুনলাম। তারপর বললাম,
❝আমার কিছু কথা ছিল❞
শুভ ভাইয়া বেশ আগ্রহ নিয়ে হাসিমুখে তাকালো।
❝হ্যাঁ, হ্যাঁ। শিওর। বলো❞
❝আশা করি কোনো প্রকার ইন্টারাপশন ছাড়া আপনি আমার কথা শুনবেন। আপনি তো এতদিন আপনার কথা বললেন, আমিও শুনলাম। শেষ পর্যন্ত প্রমাণও করেছেন যে আপনি মিথ্যা বলেননি। কিন্তু একটা কথা কি জানেন, এতে আসলে কিছুই বদলে যায় নি!❞
আমার কথাটা শুনে শুভ ভাইয়া কিছুটা থমকে গেলেন।
❝মানে?❞
❝মানেটা সিম্পল। আচ্ছা, একজন নারী পুরুষের মাঝে অন্তরঙ্গতা বলতে কি বুঝেন আপনি? শুধুই সেক্স? ইন্টারকোর্স? আর কিছু না? মানে এই যে ছুঁয়ে দেয়া, চুমু খাওয়া, একে অপরের সাথে একাকী একান্তে সময় কাটানো কি অন্তরঙ্গতা না? আপনি কণাপুর সাথে যথেষ্ট অন্তরঙ্গ ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আজকাল মর্ডান যুগে মানুষ তো শারীরিক সম্পর্ককেও হালকাভাবে দেখতে শুরু করেছে, যেন এসব কিছুই না! অথচ একটা ছেলে আর মেয়ে হাত ধরলেই তাদের মাঝে হরমোনাল চেঞ্জ আসা শুরু করে দেয়! এটুকুও তো অন্তরঙ্গতা। কেবল ফাইনাল স্টেজে যান নি মানেই অন্তরঙ্গতা হয়নি, আপনার কোনো দোষ নেই, বিষয়টি তা না। বরং পুরোটায় যতটা আপনি দায়ী, ততটা কণাপুও দায়ী। দুজনে মিলে এই কাজে ইনভলভ। আমাদের দেশে মেয়েরা সাধারণত এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে যখন ফেঁসে যায়, তখন তারা ছেলেটাকে ব্লেম করে। অথচ ছেলেটাকে ঐ পর্যায়ে নিতে সে নিজেও যথেষ্ট ভূমিকা পালন করে। তারপর যখন অপমানিত হয়, তখন সে প্রতিশোধ নিতে চায়। কণাপু আপনার কাছে নিজের সবটা দিয়েও আপনাকে পায়নি, সেটাই তাকে এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। মিথ্যা বলে আমার ব্রেইন ওয়াশ করে আপনাকে শিক্ষা দিতে চেয়েছে। এটা স্বাভাবিক। আমি এখানে তেমন একটা সমস্যা দেখি না। তার এক মাত্র দোষ, আমার সাথে একটা সুন্দর সম্পর্ক হওয়া সত্ত্বেও মিথ্যা থেকে বের হতে পারেনি। শেষ বারও যখন জিজ্ঞাসা করলাম, সে তখনও মিথ্যা বলেছে। সে আমাকে সত্য বলেই বুঝাতে পারতো। না, তাতে তার ইগোতে লাগছিল বোধহয়। এই গেল কণাপুর কথা।
এবার আপনার প্রসঙ্গে আসি। আপনি অনেক আগে থেকেই অনেক রকম মেয়ের পেছন ঘুরেন। অনেক মেয়েদের সাথেই আপনার কথা হয়। ফ্লার্টিং করা আপনার জন্য ডালভাত। কণাপুর আগেও অনেক মেয়ের সাথে ইনবলভমেন্ট ছিল আমি নিশ্চিত। কণাপুর পরেও হয়েছে। কিন্তু এই সবকিছুর মাঝে আপনি আমার প্রতি নিজের অনুভূতি নিয়ে এত দৃঢ় কেন জানেন?❞
❝তুতুন, আমি তো সবই স্বীকার করেছি! কিন্তু তোমার প্রতি আমার অনুভূতি নিখাঁদ, বিশ্বাস করো!❞
❝আমি কিন্তু বলেছিলাম, নো ইন্টারাপশান৷ যা বলছিলাম। আপনার আমার প্রতি অনুভূতি এত দৃঢ় কারণ অন্য মেয়েদের আপনি পেয়েছেন। সামান্য সময়ের জন্য হলেও মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছেন। আমার মনোযোগ পান নি। একারণে আমার প্রতি আপনার একটা অনুভূতি আছে, এমনটা আপনার মাথায় গেঁথে গেছে❞
❝এটা সত্য না তুতুন। আমি সত্যিই তোমাকে পছন্দ করি, খুব! যতবার বিয়ের কথা ভেবেছি, যতবার তোমার কথা ভেবেছি, মনে হয়েছে আমি তোমাকে পেয়ে সুখী হবো❞
❝কিন্তু আমি তো হবো না শুভ ভাইয়া!❞
❝কেন?! আমি তো বলেছি, কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবো না। আগে যা করেছি, তা আর করবো না। ইনফ্যাক্ট অনেক আগেই এসব ছেড়েছি! তুমি আমার ফোন চেক করতে পারো, আমার বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করতে পারো❞
❝কতদিন আপনাকে আমি চেক দিয়ে রাখবো শুভ ভাইয়া?❞
হাসিমুখে প্রশ্ন করলাম। শুভ ভাইয়া আরও থমকে গেলেন।
❝আপনি জানেন, আজকাল যে এত ডিভোর্স, এত ব্রেকাপ, এত টর্চার, এর একটা বিরাট অংশ সন্দেহের কারণে? নারী পুরুষ একে অপরকে কারণে অকারণে সন্দেহ করে। সন্দেহ তাদের জীবন বিষিয়ে তোলে। হয়ত কোনো এক সময় কারো সাথে সম্পর্ক ছিল, হয়ত অফিসের কোনো কলিগ চিপকানো ব্যবহার করছে! এতে কিন্তু ঐ মানুষের দোষ থাকে না। কিন্তু তার পার্টনার ঠিকই সন্দেহ করে জীবনে অশান্তি টেনে আনে। আমি সব কিছু বাদ দিলাম। কণাপু, আপনার তার সাথে ঘটনা, সব বাদ দিলাম। সব বাদ দিয়েও যদি আপনাকে আমি বিয়ে করি, কি মনে হয়? আপনাকে আমি সম্মান করতে পারবো?❞
শুভ ভাইয়া বিড়বিড় করলেন,
❝তোমার চোখে এত অসম্মানিত হয়ে গেছি?!❞
❝আমি আসলে কখনোই আপনার প্রতি সম্মান বা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিনি। একটা সম্পর্ক টিকে থাকার সবচেয়ে বড় ভিত্তি পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা। দ্বিতীয়টি বিশ্বাস। আপনি আমাকে কখনো পান নি বলে এত উতলা হয়ে গেছেন। পেয়ে গেলে তখন আর আমার গুরুত্ব থাকবে না। আর দশজন মেয়ের মতো হয়ে যাবো আমি❞
❝এসব ঠিক না তুতুন। তুমি বেশি বুঝছো। আমি বদলে গেছি! আর কি করলে আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো? বিশ্বাস করাবো!?❞
শুভ ভাইয়ার কন্ঠে আকুল আকুতি, চোখে অসহায়ত্ব। আমি হেসে ফেললাম।
❝বিশ্বাস করলাম। কিন্তু আমি যে আপনাকে সবসময় সন্দেহ করবো! আপনি কারো সাথে কথা বললেই মনে হবে ফ্লার্ট করছেন। অফিসে, স্কুলে কি করছেন জানতে পারবো না। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে বাইরে ব্যস্ত থাকতে হবে। এই সুযোগে আপনি কি করছেন, তা জানতেও পারবো না! সব মিলিয়ে কখনোই আপনার সাথে সুখী হবো না। আপনিও হবেন না! আপনি কি বুঝতে পারছেন বিষয়টা?❞
এত সুন্দর করে বুঝানোর পরও শুভ ভাইয়া বুঝতে পারলো না। যে বারবার আত্মপক্ষ করতে থাকলো, আমাকে গলানোর চেষ্টা করতে থাকলো। আমিও আমার সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম। শেষ পর্যন্ত তিনি হতাশ হয়ে বললেন,
❝এজন্যই আজ ডেকেছ? আমাকে রিজেক্ট করতে?❞
❝হ্যাঁ। সামনাসামনি না বসলে আপনাকে কনভিন্স করতে পারতাম না। শুভ ভাইয়া, আপনি অন্য কাউকে বিয়ে করেন, ভালো থাকবেন। তার সাথেও অনেস্ট থাকবেন। আমাকেই জরুরী না আপনার। আপনি সেটা যেদিন বুঝবেন, সেদিন সুখী হতে পারবেন❞
❝আমাকে সুখী হওয়ার জ্ঞান দিতে হবে না আর। অনেক জ্ঞানের কথা শুনিয়েছ। এইটুকু পিচ্চি যা খেল দেখালে! আমি ওস্তাদ হয়েও ফেইল মারলাম। ভালো থেকো❞
খাবার না শেষ করে শুভ ভাইয়া উঠে পড়লেন। আমি খুশি মনে পায়ের উপর পা তুলে সোফার নরম গদিতে হেলান দিলাম। বিকাশের শেষ দিকে চলে এসেছে সূর্যটা। এই সময়টা অন্য রকম মোহময়, আমার খুব প্রিয় সময়। খাবার শেষ করে দ্রুত বেরিয়ে হেঁটে বাসার দিকে রওনা দিলাম। আনমনে গুনগুন করে গান গাইছি,
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নে মানা
মনে মনে!
ভাবছেন, শুভ ভাইয়ার এরপর কি হলো? বলছি।
আমি রিজেক্ট করার সাত মাসের মাথায় তার বিয়ের ইনভিটেশান কার্ড পেলাম। আম্মু জিজ্ঞেস করেছিল যাবো কিনা। শুভ ভাইয়ার শুভ বিবাহ আর কনেকে দেখার লোচ সামলাতে না পেরে গিয়েছিলাম। বেশ কচি একটা মেয়েকেই বিয়ে করেছেন। আমার চেয়েও সুন্দরী। মেয়ে নাকি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে উঠেছে কেবল। শুভ ভাইয়ার সাথে বয়সের পার্থক্য কত হবে? সাত বছর? নাকি নয়? যেটাই হোক, তাদের মানিয়েছে। সেখানে গিয়ে অবশ্যই স্টেজে উঠিনি, কেবল খেয়ে এসেছি। তারপর আমার ইন্টার্নি শেষ হলো, ঢাকা চলে আসলাম। আমার মেঝো ভাইয়াও দেশে চলে এলো। সে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। এখন থেকে সে দেশেই থাকবে। ভাবী, ভাইয়া আর বাচ্চাদের নিয়ে আমাদের বাসা আবার ভরে উঠলো। আমি বিয়ে বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দিয়েছি। ভাবছি মেডিসিন বিভাগ নিয়ে পড়বো। আমার মতো ছিঁচকাদুনী মেয়ে গাইনী কিংবা সার্জারীতে গিয়ে সহ্য করতে পারবে না। দেখা যাবে অপারেশন থিয়েটারে কেঁদেকেটে একাকার নিজেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকবো। যদিও জানি যে মেডিসিনেও কষ্ট কম না। অন্তত সার্জারী আর গাইনী বিভাগের চেয়ে কম! আমি সেইফ খেলছি। আমার শ্রদ্ধেয় আম্মু যদিও আমার জন্য পাত্র খুঁজছেন। মাঝে মাঝে উড়ো খবর আমার কাছে উড়ে আসে। তবে তাদের কাউকে আমার পরিবারের কারো মনে ধরে না। আমি তাই সেসব ভাবছি না।
আফটারঅল, কারো কারো জীবনে এই ‘শুভ বিবাহ’ টাই যে সব না!
সমাপ্ত
(অনেক অনেক সময় নিয়ে পুরো গল্প শেষ করেছি। পাঠকরা যে কি করে আমার গল্প পড়ে, বুঝিনা। উৎসাহ তুলনামূলক কম পেয়েছি। এটাও হয়ত না লেখার আরেকটা কারণ। তবুও যারা পড়েছে, মন্তব্য করেছে, অপেক্ষা করেছে, তাদের লাল সালাম! সবসময় এভাবেই এই অভাগী লেখিকাকে সমর্থন করে যাবেন, সেই প্রার্থনা থাকবে। জানাবেন কেমন হলো, ভালো মন্দ অনুভূতি। আর দুয়াতে রাখবেন যেন শীঘ্রই নতুন লেখা নিয়ে হাজির হতে পারি! ভালোবাসা অবিরাম)