শেষ থেকে শুরু পর্ব-২

0
4672

#শেষ_থেকে_শুরু
কলমে :লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:২

গভীর রাতে ফরহাদ লতাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসেছে। গতকাল রাতটা ছিল অবিশপ্ত তবে জীবনের মোড় দারুণভাবে ঘুঁরে গেছে। কথায় বলে ভাগ‍্যবানের বউ মরে যদিও হৈমন্তী মরেছে কি ফরহাদের জানা নেই। মেয়েটা ছিল বড্ড বেশি শান্ত। সব সময় চুপচাপ গুটিয়ে থাকতো। কোথাও হয়তো প্রথম স্বামীর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দোষী ভাবতো। তাছাড়া সমাজের কিছু স্বার্থপর মানুষ আছে তাঁরা কারণে অকারণে মেয়েদের উপরে দোষারোপ করে। তাঁরা মুখিয়ে থাকে কিভাবে সরল মেয়েদের উপরে নির্যাতন করা যায়। দুর্বলের উপরে যুলুম করা ওদের নেশা। হৈমন্তীর প্রথম স্বামী যখন মারা গেলো লোকেরা বলা শুরু করলো ও অপয়া তাই বিয়ের দিন স্বামী মারা গেছে। হৈমন্তীর বাপ ভাইয়ের টাকা পয়সা ছিল তবুও লোকজনের মুখ বন্ধ করতে তাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। ছেলেদের বউ মারা গেলে আরামসে বলা হয় ভাগ‍্যবানের বউ মরে অথচ মেয়েদের বেলায় ভিন্ন। হৈমন্তীর ছোট মনে মানুষের এই কটাক্ষগুলো মেনে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করা কঠিন ছিল। তবুও বড় ভাইয়ের সহায়তায় বিয়ে করে নতুন সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল। তাছাড়া ওর মা মিনারা বেগম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে ছিলেন। হৈমন্তীর জন্য উনার ভালোবাসা ছাপিয়ে সমাজের মানুষের কথাবার্তা বেশি প্রভাবিত করেছে। উনি চাইতেন মেয়ে সংসার করুক আর লোকজনের মুখ বন্ধ হোক। কিন্তু হৈমন্তীতো তো জানতেই পারেনি ফরহাদ আর ওর পরিবার ওকে টোপ হিসেবে ব‍্যবহার করেছে। ফরহাদ আগে থেকেই জানতো এই মেয়েটাকে ভেঙে টুকরো করা খুব কঠিন কাজ হবে না। তাই মায়ের পরামর্শে গেম শুরু করে আর সফল হয়। ফরহাদ লতাকে পেয়ে ভীষণ খুশী হৈমন্তীর জন্য ওর মনের কোথাও কোনো জায়গা নেই। সবখানে শুধু লতা। মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য কতকিছু করতে হয়েছে। অপেক্ষার ফল সত্যি সুমিষ্ট। কথাটা ভেবে ফরহাদ লতার কপলে চুমু দিয়ে ওকে দুহতে জড়িয়ে নিয়ে স্বস্তিতে ট্রেনের জানালায় চোখ রাখলো। লতা চুপচাপ বসে আছে। নিরবতা ভেঙে ফরহাদ বলল,

> তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি লতা। তোমার জন্য আমি নিজের জীবন দিতেও পিছপা হবো না।

লতা ফরহাদের মুখের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

> আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। শুনো না আমাদের বাড়ির জন্য আসবাবপত্র কিনতে হবে এতগুলো টাকা কোথায় পাবে ভেবেছো?

ফরহাদের বেশ মনক্ষুন্ন হলো লতার কথা শুনে। মেয়েটা কখন কি বলতে হয় জানে না। তবুও নিজের সামলে নিয়ে বলল,

> আম্মা সব রেডি করে ফেলেছে তোমাকে ভাবতে হবে না। সরকারি বাসভবনে থাকবো আসবাবপত্র আম্মা লোকজন দিয়ে কিনে ফেলেছে। আব্বার ব‍্যবসা এখন মোটামুটি ভালো চলছে।

লতা ফরহাদের হাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলল,

> ওই মেয়েটার খবর জানো? হঠাৎ এসে ঝামেলা করবে নাতো?

> করবে না। ওর নাম নিয়ে আমাদের সুখের মূহুর্ত নষ্ট করো না তো।

ফরহাদ বিরক্ত হয়ে লতাকে ছেড়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। লতা কিছুক্ষণ ওর দিকে তাঁকিয়ে ব‍্যাগ থেকে আয়না বের করে গাঢ় রঙের লাল লিপস্টিক দিয়ে নিজের উষ্ঠ জোড়া রাঙিয়ে নিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে ভোরের আলো ফুঁটবে। শুনেছে ফরহাদের অফিস থেকে লোকজন আসবে এদের রিসিভ করতে। ওদের সামনে নিজেকে আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে হবে নয়তো ফকিন্নি ভাববে। ছি এসব হবে না। সবাইকে বুঝতে হবে মাধবী লতা কতটা সুন্দর। ফোনের শব্দে লতার ভাবনার অবসান ঘটলো। লতা দ্রুত ফোন রিসিভ করে কানে ধরলো ওপাশে ওর শাশুড়ি আম্মা অধীর আগ্রহে ছেলের খবর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। লতা মিষ্টি হেসে বলল,

> হ‍্যাঁ আম্মা বলুন।

> তোমরা ঠিক আছো? ফরহাদ কি করছে?

> আপনার ছেলে ঘুমিয়ে আছে চিন্তা করবেন না। আম্মা একটা কথা ছিল যদি অভয় দেন তবে বলতে পারি।

> বলো

> কিছু টাকা লাগবে। আসলে নতুন শহর বুঝতেই পারছেন ফরহাদ বেতন পেলে অসুবিধা হবে না।

> ফরহাদ কি তোমাকে টাকার কথা বলেছে?

ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে আওয়া হলো। লতা কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে মিনমিনে কন্ঠে বলল,

> আম্মা ও বলবে কেনো। আমি দেখেছি ওর কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা আছে এতে হবে না। আপনি যদি আর কিছু দিতেন।

> আচ্ছা দেখছি।

শায়লা বানু ফোন কেটে দিলেন। লতার মুখে হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো।মফস্বলের মেয়ে লতা। কতদিনের স্বপ্ন শহরে বসবাস করবে। সেই স্বপ্নটা আজ হাতের নাগালে। জীবন কিভাবে উপভোগ করতে হয় ওর জানা আছে। ফরহাদ সুদর্শন পুরুষ,বাবার অর্থসম্পদ তেমন না থেকলেও মেধাবী ছিল। ফিউচারে ভালো কিছু করবে এটা ওর ভালো করে জানা ছিল। তাছাড়া ছেলেটা ওর প্রেমে অন্ধ কথাটা ভেবে লতা ফোনটা ব‍্যাগে রেখে ফরহাদকে ডেকে দিলো কারণ ট্রেম থেমে গিয়েছে নামতে হবে।

______________

চাঁদরের এক প্রান্ত শক্ত করে ধরে ছোট বন্ধ করে আছে হৈমন্তী। মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে তবুও চাঁদর আকড়ে ধরে আছে ছাড়ছে না। কিছুক্ষণ আগে ডাক্তার এসে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ওর মুখের দিকে দুজোড়া অশ্রুসিক্ত চোখ এক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। মেয়েটার ঠোঁটে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। গতকাল রাতে চলন্ত গাড়ির সামনে থেকে ওকে উদ্ধার করেছে রোহান শেখ। ব‍্যবসার কাজে এসেছিল ফেরার সময় হঠাৎ মেয়েটা ওর গাড়ির সামনে চলে আসে। বিশেষ ক্ষতি হয়নি তবে হাতে পায়ে একটু ক্ষত হয়েছে।রোহান ভাবছে মেয়েটার চোখের সঙ্গে হয়তো সমুদের সংযোগ আছে। চুপচাপ চোখ বন্ধ আছে অথচ অনবরত পানি ঝরছে। গতকাল থেকে চুপচাপ পড়ে আছে কথাবার্তা বলেনি। মেয়েটা ওর পূর্বপরিচিত। বোনের ছোট ননদ। রোহানের সঙ্গে ওর অনেক বছর আগে দেখা হয়েছিল তখন মেয়েটা ছোট ছিল। দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকাই মেয়েটার খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। দুসপ্তাহ আগে দেশে ফিরেছে। মেয়েটাকে পাওয়া মাত্র বোনকে ফোন করেছিল। বোন শোনা মাত্র এখানে ছুটে এসেছে। হৈমন্তী সকলের প্রিয় অথচ তার কপালে সুখ নেই। রোহানের ধ‍্যান ভাঙলো বোনের কথা শুনে।

> ভাবছি ওকে আর গ্রামে রাখবো না। লোকজন নানারকম কথাবার্তা বলবে মেয়েটা এমনিতেই চুপচাপ। ওর শশুর বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিস?

> আপা নিয়েছিলাম। ফরহাদ বিয়ে করেছে। হয়তো এসব নিয়েই ঝামেলা। হৈমন্তী তো কিছুই বলছে না। না বললে কিভাবে কি করবো?

> তোর দুলাভাইকে বলেছিলাম মেয়েটার বিয়ে নিয়ে এতো মাথামাতি না করতে। ওই লোকটার জন‍্যে এই অবস্থা। ফরহাদকে দেখলেই কেমন চোর চোর মনে হয়। তোর দুলাভাই তো মহা খুশী ওই চোরের সঙ্গে বোনের বিয়ে দিয়ে।

চয়নিকার কন্ঠ স্বামীর প্রতি আক্ষেপ ঝড়ে পড়ছে। রোহান জানে এখানে দুলাভাই থাকলে এক ঘর ঝগড়া হয়ে যেতো। বোনকে শান্ত করতে বলল,

> এইটুকু একটা মেয়ের দুবার বিয়ে কিভাবে সম্ভব আপা? দুলাভাই নাহয় ভূল করেছে কিন্তু তুই তো ছিলি মানা করতে পারতি? একদম ঠিক হয়নি।

> মফস্বলে মেয়েদের অল্প বয়সেই বিয়ে হয় রোহান। সমাজে মেয়ের বয়স নিয়ে নানারকম কুট কাচারী হয়। তাছাড়া তোর দুলাভাইয়ের মা আছে না ভদ্রমহিলা তো মেয়ের বিয়ের জন্য নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে এসব করা। যাইহোক ছাড় মেয়েটা সুস্থ হলে ওই বাটপারের সঙ্গে আর রাখবো না।

> এটাই ভালো। দুলাভাইকে বলেছিস আপা?

> বলেছি। এবার আমি কারো কথায় শুনছি না। মেয়েটকে নিয়ে দরকার হয় বাপের বাড়িতে থাকব। আসুক আগে কি অবস্থা করি।

রোহান বোনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। বোনকে ও ভীষন ভালোবাসে। মায়ের পরে এই একটা মানুষ আছে তাকে ও অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে পারে। বোনটা সব দিক থেকেই সুখী কিন্তু তবুও একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। পনেরো বছরের বিবাহিত জীবন অথচ সন্তানের মুখ দেখেনি। যদিও এটা নিয়ে কখনও দুলাভাই আফসোস করে না। গ্রামে গেলে অশান্তি হবে তাই চয়নিকাকে নিয়ে শহরে থাকে। গ্রামের বাড়িতে আগে হৈমন্তী বাবা মায়ের সঙ্গে ছিল। তিন ভাইয়ের দুই বোন। হৈমন্তী সকলের ছোট। বড় বোনটার গ্রামে বিয়ে হয়েছে জামাই পুলিশে চাকরি করে । ভাইয়েরা ভিবিন্ন পেশার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাই তাঁরা ভিন্ন ভিন্ন শহরে বসতি গড়েছে। হৈমন্তীর মেঝো ভাই আর্মি অফিসার সে বউ বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে। বছরে একবার তিনি গ্রামে পা রাখেন। ছোট ভাই অবিবাহিত, আমেরিকা আছে। বড়ভাই ব‍্যবসা করে। হৈমন্তীর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরে বিয়ে হয়েছিল।

বারো ঘন্টা বেঘোরে ঘুমানোর পরে হৈমন্তী জেগে উঠলো। শরীর কাঁপছে কেমন শূণ্য শূণ্য লাগছে।চোখ খুঁলে অচেনা পরিবেশে নিজেকে দেখে খুব ঘাবড়ে গেছে। একটু একটু করে সবটা মনে পড়তেই চিৎকার করে কেঁদে ফেলল। হঠাৎ ওর চিৎকার শুনে পাশ থেকে কেউ একজন ওকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলাই বলল,

> কি হয়েছে, এই তো আমি আছি ভয় পেয়েনো।

হৈমন্তী পরিচিত মানুষের কন্ঠ শুনে তাঁকিয়ে বড় ভাবিকে পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারলো না। আরও শব্দ করে কেঁদে ফেলল। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। চয়নিকা ওর চোখমুখ মুছিয়ে শান্ত কন্ঠ বলল,

> কি হয়েছে বলবে? না বললে বুঝবো কিভাবে? তোমার ভাইয়া বাইরে আছেন, চিন্তা করছে। ডাকবো তাকে?

হৈমন্তীর ভাবিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভয়ে ভয়ে বলল,

> ভাবি বিশ্বাস করো আমি খারাপ কিছু করিনি। এই বাচ্চা ফরহাদের কিন্তু ও কেনো মানতে চাইছে না জানিনা। সবাই আমাকে দোষারোপ করছে। আমি বাঁচতে চায়না। একটু বিষ দিবে আমাকে,

> আজেবাজে কথা বন্ধ করে কি হয়েছে সবটা বলো আমি সামলে নিবো। বিশ্বাস করোতো আমাকে?

হৈমন্তী মাথা নাড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে দুদিনে সব ঘটনা ভাবির কাছে বলে ফেলল। চয়নিকা এবার বুঁঝতে পারলো হৈমন্তীর সঙ্গে কি কি হয়েছে। মগের মুল্লুক নাকি।ফরহাদ বললেই তো আর হবে না। দেশের আইনকানুন আছে। তাছাড়া বাচ্চা কার এটা জানা এখনকার যুগে এতোটা কঠিন কাজ না। টেস্ট করলেই সব বেরিয়ে আসবে। লুচ্চা ব‍্যাডা বউ রেখে পরকীয়া করে এখন স্ত্রী সন্তানের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে। ওরে তো ফাঁসি হওয়া উচিৎ। চয়নিকা আজকের মধ্যেই রোহানকে দিয়ে পুলিশ পাঠাবে ফরহাদের বাড়িতে। কিন্তু হৈমন্তীর শেষ আকুতি। ফরহাদ বা ওর পরিবারের সামনে ও আর যেতে চাইনা। যদি ওকে আবারও ফরহাদের বাড়িতে পাঠানো হয় বা ওর ভাইয়েরা যায় সেখানে তবে ও সুইসাইড করবে বলে জানিয়ে দিলো। চয়নিকা পড়লো ভারি বিপদে। হৈমন্তীর ভাইয়েরা যদি জানে বোনের এই অবস্থা তাহলে তো সবগুলোর মাথায় খুন চেপে যাবে। কিভাবে সামলাবে? একটা বুদ্ধি তো করতে হবে?

চলবে

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। আমি লেখালেখিতে যথেষ্ট কাচা। ভুল করলে ভদ্রভাবে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন ইনশাআল্লাহ শুধরে নিতে চেষ্টা করবো। আজেবাজে কমেন্ট করলে মন খারাপ হয়, লিখতে মন বসে না। গতকাল আল্লাহ শব্দের বানান ভুল ছিল এটা গ্রুপে পোস্ট করার পরে দেখেছি। তাছাড়া লেখার সময় সঠিক লিখেছিলাম জানিনা কিভাবে হলো। তবুও দুঃখিত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here