#শেষ বিকেলের আদর❤️
#রিত্তিকা ইসলাম
সারপ্রাইজিং পর্ব
🌼
গভীর রাত।মৃদু মন্দ বাতাসে ঠান্ডার আমেজ।শরির কাঁপানো সেই বাতাসে মিশেছে গোলাপের মোহময় ঘ্রান।অন্ধকার রুমটিতে বিভিন্ন সাইজের রঙিন মোমবাতি।মিটিমিটি সোনালী আলোতে ঘরটাকে আরো কিছুটা নেশাময় করে তোলার ক্ষুদ্র চেষ্টা।বিছানার চাদর থেকে শুরু করে ঘরের মেঝে সব কিছুই আজ গোলাপের পাপড়িতে ঢাকা।উত্তেজনা আর লজ্জায় ঘেমে নেয়ে একাকার হচ্ছে রোশনি।আজ রাতটা হয়ত তার জিবনের সবথেকে স্পেশাল রাত হতে চলেছে।অধিরকে নিজের অনুভূতির কথাগুলো কিভাবে জানাবে সেটা ভাবতেই শরির ঘেমে উঠছে।রোশনি ছোট্ট শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত রাখা যাচ্ছে না।উত্তেজনা,লজ্জা আর অস্বস্তিতে শরির কাটা হয়ে উঠছে ক্রমেই।খোলা জানালা দিয়ে রুমে বাতাস ঢুকতেই মোমবাতির জলন্ত শিখা মৃদু কেঁপে উঠল।রোশনি দেরি না করে ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল জানালার দিকে।ভারি পর্দাটা টেনে দিয়ে আবারো ফিরে এল।রুম ডেকোরেটের পুরো প্রক্রিয়াটাই তার নিজের।অধিরকে আজ সে চমকে দিতে চাই।অধির যখন বিষ্ময় নিয়ে তাকাবে তখন মুগ্ধ চোখে অধিরের সেই তৃপ্তিময় মুখটাকে সে নয়ন ভরে দেখতে চাই।অধিরকে আরো একটু চমকে দিতে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করতে চাই।অধির হয়ত চমকাবে।থমকাবে। বিষ্ময়ে দু দন্ড হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থেকে কি কৌতুহলি হয়ে বাহুডোরে টেনে নিবে? নাকি আরো কিছুটা ঘনিষ্ঠ হতে চাইবে? রোশনির লজ্জার পরিধি বোধ হয় বাড়ল।অধিরকে নিয়ে গভির ভাবে ভেবে অযথায় লজ্জা পাচ্ছে সে।তবুও ভাবতে ভাল লাগছে।অধিরকে খুব কাছে অনুভব করে লজ্জায় ঝরে যেতে ভাল লাগছে।রোশনির ভাবনা কাটল মেসেজিং এর টং আওয়াজে।রোশনির উত্তেজনা বাড়ল।অস্বস্তি ভর করলো নারী দেহের প্রতিটা খাঁজে।রোশনি এগিয়ে এসে বালিশের উপর থেকে ফোনটা তুলে নিতেই অধিরের পাঠানো ছোট্ট ম্যাসেজটা স্পষ্ট হল।দু লাইনের এই ছোট্ট ম্যাসেজটাতেই লজ্জায় কাটা হয়ে উঠল শরির।নিজেকে কিছুতেই শান্ত রাখা যাচ্ছে না।নিজেকে আজ সদ্য কিশোরীতে পা দেওয়া কোনো এক দুরন্ত কিশোরি বলেই বোধ হচ্ছে। প্রথম প্রেমপত্র হাতে একটা কিশোরি যতোটা লজ্জা,কৌতুহলি এবং অশান্ত হয় ঠিক ততোটাই অশান্ত আজ তার মন এবং শরির।রোশনি দ্বিতীয় বারের মত লেখাটা পড়ল,
“চলে এসো সুইটহার্ট।অপেক্ষা করছি।”
দু লাইনের এই বাক্য টুকুই যথেষ্ট ছিল রোশনির হৃদস্পন্দন বাড়ানোর জন্যে।রোশনি যখন নিজেকে শান্ত করতে ব্যস্ত তখন আবারো ম্যাসেজ এল।অধিরের পাঠানো ছোট্ট ম্যাসেজ।
“অপেক্ষা করছি সুইটহার্ট ”
রোশনি লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করল।আয়নায় আরো একবার নিজেকে দেখে নিয়ে পা বাড়াল ছাঁদের দিকে।সিঁড়ি অবধি পৌছাতেই অবাক হয়ে গেল রোশনি।পুরো সিঁড়ি গোলাপের কালো পাঁপড়িতে ঢাকা।সেই সাথে প্রতিটা সিঁড়িতে ছোট ছোট প্রদিপ রাখা।রোশনি বিষ্ময় নিয়ে একের পর এক সিঁড়ি পাড় করল।দরজার কাছা কাছি আসতেই মনে হল স্বপ্নপুরিতে পা দিল সে। পুরো ছাদ ডেকোরেট করা।রঙ বেরঙের ছোট ছোট লাইটস এর আলোই সব কিছু কেমন নেশাতুর মনে হচ্ছে।ছাঁদের এক পাশটায় সাদা পর্দায় ঘেরা বিছানা।পাতলা পর্দা ভেদ করে ভেতর থেকে অন্ভুদ সুন্দর কিছু আলো বেরিয়ে আসছে।ছাদে লাগানো বিভিন্ন রকমের ফুলের ঘ্রান বাতাসকে ভারি করে তুলেছে।ছাদের মাঝ বরাবর উল্টো ঘুরে দাড়িয়ে আছে অধির।শরিরে সাদা রঙের পাতলা শার্ট।হাতা গুলো কনুই অবধি গুটানো।রোশনির উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাড়ালো অধির।পেছনে ফিরতেই বিষ্ময় হতভম্ব হয়ে গেল চোখ।সাদা শাড়ি আর ঘন কালো কাজলে সামনে দাড়ানো রমনীকে স্বর্গীয় কোনো দেবী মনে হতে লাগল।অধিরের নেশাতুর চোখের চাহনি সহ্য করতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিল রোশনি।অধিরের দৃষ্টি অস্থির।নারি দেহের নেশাময় গঠনের প্রতিটা ভাজে দৃষ্টি যেতেই কেঁপে উঠল অধির।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে রোশনির কাছাকাছি দাড়াতেই অস্বস্তিতে কাদা হয়ে গেল রোশনি।অধির বেশ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইল প্রেয়সীর চোখে মুখে।এক হাত রোশনির কোমরে রেখে অন্য হাতে চুলের খোপা খুলে দিতেই লম্বা চুল গুলো ছড়িয়ে পড়ল পিঠ জুড়ে।সামনের ছোট চুলগুলোকে গুজে নিতে গিয়ে নজর পড়ল থুতনির গাঢ় তিলটাতে।।অধিরের দৃষ্টি গভির হল । তিলটাতে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-আমি বোধ হয় মারা যাচ্ছি সুইটহার্ট। এভাবে খুন করার কি খুব বেশি প্রয়োজন ছিল?
রোশনি চোখ তুলে তাকালো না।অধিরের নেশাময় জ্বালা দেখল না।অধির রোশনির কপালে কপাল ঠেকালো।অধিরের গরম নিশ্বাস চোখে মুখে আচড়ে পড়তেই দুহাতে শাড়ি খামচে ধরল রোশনি।অধির হঠাৎই বলে উঠল,
-ভালবাসি!!!
রোশনির কম্পন বাড়ল।চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল শীতল পানির ধারা।এই ছোট্ট একটা কথাতেই কত শত প্রশান্তি!!কত শত টান!!!অধির রোশনিকে ছেড়ে রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাড়াল।রোশনিকে টেনে নিজের কাছে এনে গালে স্লাইড করতে করতে বলল,
-হ্যাপি সিক্সথ মানথ অ্যানিভার্সারি সুইটহার্ট।
রোশনি চোখ নামিয়ে নিলো।অধিরের কথাগুলো আজ অন্যরকম লাগছে রোশনির।খুব স্বাভাবিক কথাগুলোও শরিরে শিহরন তুলছে।রোশনির লজ্জা রাঙা মুখের দিকে কিছুক্ষন এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎই হাটু গেড়ে বসে পড়ল অধির।রোশনি বোকা বোকা চোখে তাকাতেই রোশনির বাম পা টা তুলে নিলো হাটুর উপরে।পকেট থেকে কালো পাথরের পায়েলটা বের করতেই বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল রোশনি।পায়েলটা তো সে অনেক আগে হারিয়ে ফেলেছিল।তবে কি সেটা অধির পেয়েছিল? এতো যত্ন নিয়ে এতো গুলো দিন নিজের কাছে রেখেছিল? রোশনির কান্না পাচ্ছে।এতো সুখ কেন তার কপালে? এতো কেন ভালোবাসে এই ছেলেটা? অধির খুব যত্ন নিয়ে রোশনির আলতা রাঙা পায়ে পায়েলটা পড়ালো।কোনো মেয়ের পা ও যে কোনো পুরুষকে এতোটা আকৃষ্ট করতে পারে সেটা সে আজ বুঝলো।অধির নিষ্পলক কিছুক্ষন চেয়ে থেকে উঠে দাড়ালো।আগের মতোই রেলিং এ ঠেস দিয়ে রোশনিকে নিজের দিকে টেনে নিল।রোশনির চোখে মুখে মুগ্ধতা।অধির রোশনির দিকে মুখ এগিয়ে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
-তোমার সৌন্দর্য নিয়ে তোমার কোনো ধারনা আছে সুইটহার্ট? আমি তো দিন দিন খুন হচ্ছি।কারো পায়েও এতোটা আকৃষ্টতা কি করে থাকতে পারে সুইটহার্ট?
রোশনির নিশ্বাস আটকে আসছে।এই লোকটা আজ তাকে মেরে ফেলার সব রকম আয়োজন করে বসেছে।রোশনির এমন অস্বস্তি আর লজ্জায় বেশ মজা পাচ্ছে অধির।অধির এবার দুষ্টুমি করে বলে উঠল,
-যদিও তোমার পেটের তিলগুলোই যথেষ্ট….
কথাটা শেষ করার আগেই মুখ চেপে ধরল রোশনি।অস্বস্তি নিয়ে বলল,
-আপনি আজ ভিষন বেসামাল কথা বার্তা বলছেন অধির।আমি লজ্জা পাচ্ছি।
অধির রোশনির হাতের তালুতে চুমু দিতেই দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো রোশনি।অধিরকে একটু রাগ দেখাতে গিয়েও পারল না।কিছুতেই চেহারায় রাগ আনা যাচ্ছে না।ঘুরে ফিরে লজ্জারায় এসে ভর করছে চোখে মুখে।রোশনিকে এমন করতে দেখে হেসে ফেলল অধির।ঠোটের কোনে হাসির রেখা বজায় রেখে বলল,
-আচ্ছা থাক,,, রাগ -লজ্জা কোনো টাই আপাততো পেতে হবে না।রাত এখনো বাকি আছে।লজ্জাটা না হয় পরেই পেও।
অধিরের দুষ্টুমি মাখা কথাতে অধিরের বাহুতে দু চারটে কিল ঘুসি বসাল রোশনি।অধির মুচকি হেসে সহ্য করল।রোশনি আরো কয়েকটা কিল বসিয়ে ক্ষান্ত হল।অধির ঠোট টিপে হাসল কিছুক্ষন। কয়েক সেকেন্ড পর রোশনির দিকে কিছু পেপার এগিয়ে দিতেই ভ্রু কুচকে তাকাল রোশনি।অধির মুচকি হেসে বলল,
-পড়ে দেখো।
রোশনি তাই করল।পেপারের লেখা গুলো পড়তেই টলমলে চোখে তাকাল।ধরে আসা গলায় বলল,
-কাস্টাডি পেপার!!!!
-হ্যা।আজ থেকে আয়াশের কাস্টাডি তোমার। এখন কেউ আর তোমার থেকে ওকে আলাদা করতে পারবে না।
রোশনির চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল।পরমুহূর্তেই প্রশ্ন করে বসল,
-আপনি কিভাবে….?
রোশনির কথার মাঝেই মুখ খুলল অধির।বলল,
-তুমি বিষয়ক সব কিছুই আমার জানা সুইটহার্ট। তুমি অনেক দিন যাবত আয়াশের কাস্টাডি পাওয়ার জন্য কোর্টে দৌড়া দৌড়ি করছিলে।আমি কিছুদিন আগেই আয়াশের কাস্টাডিটা তোমার নামে করে নিয়েছি।ডোন্ট ওয়ারি সুইটহার্ট,,,,, এখন থেকে আয়াশকে তোমার থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না।
-থ্যাংক ইউ অধির। থ্যাংক ইউ সো মাচ।আপনি জানেন না আজ আমি কতোটা খুশি হয়েছি।এক বছর ধরে আদালতে ছোটাছুটি করেছি আয়াশের কাস্টাডি পাওয়ার জন্যে।কিন্তু ওরা ডেইট এর পরে ডেইট দিয়েছে শুধু।আমি তো আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম।আজ আপনি না থাকলে কাস্টাডিটা হয়ত চাচিই পেতেন।থ্যাংস আ লট অধির।
রোশনির তৃপ্তিময় মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল অধির,
-আপনার মুখের এক চিলতে হাসির জন্যে এই অধম বান্দা সব কিছু করতে তৈরি মিসেস বিভা মির্জা চৌধুরি।
রোশনির ভ্রু জোড়া কুচকে এল।অধিরের কথাটা না বুঝতে পেরে বলল,
-বিভা মির্জা…!!!
অধির এক পা এগিয়ে এসে রোশনির মুখোমুখি দাড়ালো।পেপারটা টেবিলের উপর রেখে রোশনির হাত দুটো মুঠোই নিয়ে হাতের উল্টো পিঠে ঠোট ছোয়ালো।রোশনির ভ্রু জোড়া তখনো কুচকে আছে।অধির কি বলল একটু আগে? বিভা মির্জা কেন বলল?তার নাম তো রোশনি।কয়েক সেকেন্ডেই মাথা ভর্তি প্রশ্ন জমা হতে লাগল একের পর এক।অধির রোশনির জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
-তোমারও সারনেইম আছে সুইটহার্ট। তুমি পরিচয়হীন অনাথ মেয়ে নও।তুমি বিভা মির্জা,,,, ডটার অফ ওয়াহিদ মির্জা।
রোশনি আহত চোখে তাকালো।সে কি ঠিক শুনলো? নাকি সবটা মনগড়া কোনো সুন্দর স্বপ্ন? যা ঘুম ভাঙলেই বিলীন হবে!!এমন ভয়াবহ স্বপ্ন সে দেখতে চাই না।এই তো বেশ আছে সে।রোশনির এমন শান্ত দৃষ্টিতে অধির বোধ হয় কিছুটা বিচলিত হল।অধির রোশনির কাধে হাত রেখে চিন্তিত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ল,
-ঠিক আছো সুইটহার্ট?
রোশনির সরল উত্তর,
-আমি বোধহয় স্বপ্ন দেখছি অধির।দেখুন না স্বপ্নে আমার নামটাও পরিবর্তন হয়ে গেছে।
আপনি প্লিজ এটা বন্ধ করুন অধির।এমন ভয়াবহ স্বপ্ন আমি সহ্য করতে পারছি না।প্লিজ বন্ধ করুন।
-এটা স্বপ্ন নয় সুইটহার্ট। ইট’স রিয়েল।দেখো সবকিছু বাস্তব।তুমি শুধু রোশনি নও সুইটহার্ট ।তুমি বিভা মির্জাও।
রোশনি এবার শব্দ করে কেঁদে উঠল।অধির দুহাতে বুকে টেনে নিলো রোশনিকে।মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করল।রোশনি অধিরের শার্ট খামচে ধরে কাঁদতে ব্যস্ত।সত্যিই কি তবে তার পরিচয় আছে? বাবা মা নামক দুটো আশ্রয় আছে? বিভা..!! নামটা যদি তারই হয় তবে তার কেন মনে নেই নামটা? অধির তাকে মিথ্যে শান্তনা নিশ্চয় দিচ্ছে না!!!ওয়াহিদ মির্জা!!!আমার বাবা!!!!মাথার ভেতর ঘুরতে লাগল একের পর এক ছেঁড়া প্রশ্ন।রোশনির কান্নার গতি বাড়ল।অধির ছোট্ট শ্বাস টেনে নিয়ে বলল,
-শান্ত হয়ে যাও সুইটহার্ট। এখনো অনেক সারপ্রাইজ বাকি।কান্না থামাও।আমার কষ্ট হচ্ছে।
রোশনি মুখ তুলে তাকালো।অধিরের দিকে অশ্রসিক্ত চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
-ওনারা কোথায়? আমি আমার বাবা মাকে দেখতে চাই অধির।নিয়ে চলুন না প্লিজ…
অধির দুহাত রোশনির গালে রেখে কপালে ঠোট ছোঁয়ালো।চোখের নিচে জমে থাকা নোনা পানিটুকু মুছে দিয়ে নরম গলায় বলল,
-ওনারা কেউ বেচে নেই সুইটহার্ট।
রোশনি হতাশ চোখে তাকালো।তবে কি সে এখনো অনাথ??একা??যেখানে বাবা মা নামক দুটো জান্নাতই আর নেই সেখানে এই পরিচয় পাওয়াটা কি খুব বেশি প্রয়োজনীয় ছিল?অধির আগের মতোই নরম গলায় বলল,
-তবে কেউ একজন এখনো আছে সুইটহার্ট। জানতে চাও সে কে?
-কে?
-তোমার বোন আভা মির্জা।তোমার আলো দি।
রোশনি হঠাৎই ভিষন অস্থির হয়ে পড়ল।ব্যস্ত গলায় বলল,
-আলো দি!!!!এই নামটা আমার খুব পরিচিত অধির। খুব পরিচিত।আমি স্বপ্নে কাউকে দেখেছি।সেখানে ছোট্ট একটা মেয়ে কাউকে আলো দি বলে ডাকত।কারো মুখই স্পষ্ট দেখতে পেতাম না।বলুন না অধির কোথায় আমার আলো দি?নিয়ে চলুন না আমায় তার কাছে।
-শান্ত হও সুইটহার্ট।নিয়ে যাবো তো তার কাছে।এখন তো রাত সকালে নিয়ে যাই?
রোশনি যেন হঠাৎই বাচ্চাদের মত জিদ করে বসল,
-না না,,,,সকালে নয় এখনই।সকাল হতে অনেক দেরি।সকাল হতে হতে যদি হারিয়ে ফেলি!!!না না,,,,আমি এখনি যেতে চাই।এখনি।
-আর হারাবে না সুইটহার্ট। আমি আছি তো।
-আপনি বুঝতে পারছেন না অধির। ভাগ্য আবার কেড়ে নেবে আমার থেকে।আমার সুখ তার সহ্য হয় না।প্লিজ নিয়ে চলুন।
-আচ্ছা আচ্ছা শান্ত হয়ে যাও।এখন ওখানে যাওয়া যাবে না।তুমি না হয় ওর সাথে ভিডিও কলে কথা বলে নাও।আই প্রমিস কাল সকালে ওকে আমি নিজে তোমার কাছে নিয়ে আসবো।
রোশনি এবার একটু শান্ত হল।অধির ফোন বের করে একটা নাম্বারে ভিডিও কল করতেই অধিরের বুকের সাথে মিশে দাড়ালো রোশনি।শরির কাঁপছে তার।মনে হচ্ছে এই বুঝি জ্ঞান হারাবে।অধির এক হাতে রোশনিকে জড়িয়ে নিয়ে শান্ত হতে বলল।প্রথম বারেই রিসিভ হল কল।ফোনের স্ক্রীনে জ্বলজ্বল করে উঠল পরিচিত এক মুখ।রোশনির মুখ থেকে অজান্তেই বেড়িয়ে এল,
-দিয়া আপু!!!!
রোশনি বিষ্ময় নিয়ে অধিরের দিকে তাকালো।অধির চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করতেই ফুপিয়ে উঠল রোশনি।দিয়ার চোখও ভিজে এল খুশিতে।কিছুক্ষন কেউই কিছু বলতে পারল না।শুধু চেয়ে থাকল একে অপরের দিকে।নিরবতা কাটিয়ে অধিরই মুখ খুলল।বিরক্ত গলায় বললো,
-আরে বাপ!!!আর কতোক্ষন তোদের এই কান্না সহ্য করতে হবে? এবার তো অফ যা দুইটা।তুই তো দেখি আমার স্পেশাল রাতটার বারোটা বাজানোর তালে আছিস।
অধিরের কথায় চোখে পানি নিয়েও হেসে ফেলল দিয়া।মিষ্টি শাষনের সুর তুলে বলল,
-চুপ কর বেয়াদব। আমার বোনটাকে প্রান ভরে দেখতে দে আগে।কত বড় পরে খুজে পেয়েছি।আার সেই ছোট্ট বোনটা কত বড় হয়ে গেছে!!!আমার তিলুমনি!!!
রোশনি কাঁপাকাপা গলায় বলে উঠল,
-তুমি আমার আলো দি?
দিয়া কাঁদতে কাঁদতেই হাসল।বলল,
-হ্যা সোনা। আমিই তোমার আলো দি।তোমার হতাভাগী বোন।
এরপর শুরু হল একেরপর এক কথার মেলা।প্রায় বিশ মিনিটের মত কথা বলে ফোন কেটেছে অধির।নয়ত তাদের এই ফোনালাপ হয়ত সারা রাত চলত।রেলিং এ হেলান দিয়ে বসে আছে অধির।বুক জুড়ে প্রেয়সীর দখলদারি। রোশনি চোখ বুজে শুনে চলেছে অধিরের একনাগাড়ে চলতে থাকা হৃদস্পন্দনের শব্দ।রোশনি মুখ উঠিয়ে তাকাল।বলল,
-আপনি কিভাবে এসব জানলেন অধির?
অধির ছোট্ট শ্বাস টেনে রোশনির আঙুলের ভাজে হাত রাখল।শান্ত গলায় বলল,
-যেদিন তোমাকে নিয়ে আমি চৌধুরি ম্যানশন থেকে বেরিয়ে আসি সেদিনই দিয়ার বিহেভিয়ার সন্দেহজনক লেগেছিল আমার।তোমার সাথে ওর পরিচয় মাত্র কয়েকদিনের।অথচ তোমার অপমানে ওর এতো কান্না দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম।এরপর মায়ের সিন্দুকে গয়না রাখতেও দূর্ভাগ্যবশত আমি দেখে নিয়েছিলাম।কিন্তু তখনও চুপ করে ছিলাম।এরপর এই বাড়িতে আসার প্রথম রাতে তুমি ঘুমের মাঝে আলো দি বলে কিছু বলছিলে।যেটা আমি এর আগেও তোমায় দুদিন বলতে শুনেছি।আমার মাথায় তোমার স্বপ্ন আর দিয়ার ব্যাপারটা ঘুরছিল বারবার।অদ্ভুদভাবে দুটোর মধ্যে কোথাও একটা মিল পাচ্ছিলাম আমি।এরপর একদিন দিয়ার সাথে কথা বললাম।আমার সন্দেহ সঠিক হল।দিয়ার থেকে জানতে পারলাম তোমার স্বপ্নে দেখা আলো দি আসলে সে।দিয়ার ভাষ্যমতে তোমার জন্মের সময় তোমার মা মারা যান।এরপর থেকে তুমি,দিয়া এবং তোমার বাবা ওয়াহিদ মির্জা ছোট একটা বাড়িতে থাকতে শুরু করো।খুব বেশি টাকা পয়সা না থাকলেও তোমরা বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছিলে।তোমার বয়স যখন চার বছরের কাছাকাছি তখন এক রাতে তোমাদের বাড়িতে কিছু বখাটে ছেলের আগমন ঘটে।ছেলে গুলো নেশায় বুদ ছিল।দিয়ার বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ।ছেলেগুলোর নজর পড়ল দিয়ার উপর।মানে আভার উপর।ছেলেগুলো দিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম অত্যাচার করে তোমারই সামনে।দিয়ার থেকে জানতে পারি তুমি দিয়াকে আভা বলে ডাকতে পারতে না। তাই তোমার বাবা তোমার আর দিয়ার আরো একটা করে নাম রাখেন।আলো এবং রোশনি।দিয়ার উপর যখন ওরা নির্মম অত্যাচার করছে তখন তুমি আলো দি আলো দি বলে চেঁচাচ্ছিলে।যেটা তোমার মনে না থাকলেও তোমার স্মৃতিতে গেঁথে গিয়েছে।সেজন্য এখনো মাঝে মধ্যে তুমি সেদিনের ঘটনা স্বপ্নের মাধ্যমে দেখতে পাও।
রোশনি ফুঁপিয়ে উঠতেই থামল অধির।রোশনিকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে নিতেই হিচকি তুলতে তুলতে প্রশ্ন ছুঁড়লো রোশনি,
-আমি স্বপ্নে এমনটাই দেখতাম অধির।কিন্তু কখনো ভাবিনি স্বপ্নের সেই ছোট্ট মেয়েটা আমি আর ওই অসহায় মেয়েটা দিয়া আপু।আমার আলো দি।আমার তো এখনো কিছুই মনে নেই।এরপর কি হয়েছিল অধির? বলুন না…..
অধির পানির গ্লাস এগিয়ে দিল রোশনির দিকে।রোশনিকে পানি খাইয়ে দিতেই হিচকি বন্ধ হল।রোশনিকে বুকে টেনে নিয়ে আবারো বলতে শুরু করল,
-জানোয়ার গুলোর নজর দিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকল না।তাদের নজর গিয়ে পড়ল চার বছরের ছোট্ট বিভার উপর তুমি বুঝতে পারছো কতোটা বিকৃত মানসিকতার ছিল ওরা?কতটা নিকৃষ্ট হলে একটা বাচ্চা মেয়ের উপর ওভাবে নজর দেওয়া যায়?
কথাটা বলতে বলতেই চোয়াল শক্ত হয়ে এল অধিরের।কুত্তার বাচ্চাগুলোকে নিজে হাতে খুন করতে পারলে হয়ত শান্তি পাওয়া যেত।রোশনি ভয়ে অধিরের শার্ট খামচে ধরল।ভয়ে ওর শরির কাপছে।অধির বুঝতে পেরে রোশনিকে আরো একটু শক্ত করে ধরল।বলল,
-ভয় পেও না সুইটহার্ট। ওগুলো শুধুই অতীত।এখন আমি তোমার সাথে আছি।আমি থাকতে তোমার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস কারো হবে না।ভয় পেও না।
রোশনি শান্ত হল।মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল,
-তারপর কি হয়েছিল?
-ওদের উদ্দেশ্য অাঁচ করতে পেরে দিয়া তোমাকে পালিয়ে যেতে বলে।তুমি ছিলে দিয়ার অত্যান্ত বাধ্য বোন।বোন যা বলবে সেটা বিনা বাক্যে মেনে নেওয়ায় ছিল ছোট্ট বিভার এক মাত্র কাজ।দিয়ার কথামত তুমি পালিয়ে গেলে।
-তারপর…?
অধির দির্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলতে শুরু করল,
-এরপর দিয়াকে ধর্ষন করে পালিয়ে যায় জানোয়ার গুলো।তোমার বাবা ছিলেন হার্টের পেশেন্ট।প্রতিদিন রাতে তিনি ঘুমের ট্যাবলেট নিতেন। সেদিন রাতেও তিনি ঘুমের ঔষুধ খেয়ে ঘুমান ফলে দিয়ার চিৎকার ওনার কান অবধি পৌছায় না।সকালে যখন মেয়ের বিধ্বস্ত দেহটাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলেন সহ্য করতে পারলেন না।হার্ট এ্যাটাক করে সাথে সাথেই মারা গেলেন।স্থানীও রা দিয়াকে হসপিটালে ভর্তি করালেন।দিয়ার তখনো জ্ঞান ছিলো না।সৌভাগ্যবশত বাবা সেদিন দাদির কিছু রিপোর্টস আনতে সেই হসপিটালে যান।অচেতন দিয়াকে দেখেন।ডক্টরের সাথে কথা বলে আইনি নিয়ম কানুন মেনে অ্যাডাপ্ট করেন দিয়াকে।বাবা অবশ্য পরে সেই ছেলেগুলোর শাস্তির ব্যবস্থাও করেন।কিন্তু তোমাকে খুজে পাওয়া যায় না।এদিকে আমি ছিলাম আমার মায়ের এক মাত্র সন্তান।শারিরিক কিছু জটিলতার কারনে ডক্টর বলেছিলেন মা আর দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দিতে পারবেন না।দিয়াকে পেয়ে বাড়ির সবাই ভিষন খুশি হয়েছিল।মম আর আমি তো সব থেকে বেশি খুশি হয়েছিলাম।দিয়া তখন ট্রমার মধ্যে ছিল।মমও তাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর করতেন।আস্তে আস্তে দিয়া ট্রমা থেকে বের হল।দিয়ার সাথে আমার বন্ডিংটাও ধিরে ধিরে গভির হল।বোন ছাড়া তখন আমি কিছুই বুঝি না।দিয়ার প্রতি আমার এই অতি ভালবাসাটাই পছন্দ হল না মমের।আস্তে আস্তে দিয়ার প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন মম।এর মাঝেই অদ্ভুদভাবে মম একদিন কনসিভ করলেন।দিয়ার প্রতি ক্রোধটা আরো বাড়ল মমের।এরপর আমার থেকে দূরে সরাতে দিয়াকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হল।প্রথম দিকে ফোনে কথা হলেও আস্তে আস্তে সেটা কমে এল।আমিও বড় হতে লাগলাম।নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।দিয়া মাঝে মাঝে দেশে আসলেও এক সপ্তাহের বেশি থাকতো না।সেটা হয়ত মমের কারনেই।
-আলো দি আমায় চিনলো কি করে?
-তোমার শরিরে অদ্ভুদ কিছু তিল আছে।যেগুলো ছোট থেকেই তোমার শরিরে ছিল।দিয়ার বিয়ের দিন সেই তিল গুলো দেখেই নিশ্চিত হয়েছিল দিয়া।তাছাড়া তোমার নাম এবং তোমার চেহারার মধ্যে কোথাও একটা ছোট্ট বিভার সাথে মিল পেয়েছিল দিয়া।
-আমাকে চিনতে পেরেও কেন কথাটা লুকিয়ে গেল আলো দি? আমি কি বোন হিসেবে খুব খারাপ?
কথাটা বলতেই গলা ধরে এল রোশনির।অধির চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,
-কে বলেছে তুমি খারাপ বোন? তুমি হলে পৃথিবীর সব থেকে ভাল বোন।ইনফ্যাক্ট সব থেকে ভাল মেয়ে,,,সব থেকে ভাল বউ।
অধির ছোট্ট শ্বাস টেনে আবারো বলতে শুরু করল,
-দিয়ার প্রতি আমার এই অধিক ভালবাসাটাই মমের পছন্দ ছিল না।মমের মনে হত তার থেকে বেশি আমি দিয়াকে ভালবাসি।এই একটা কারনেই হয়ত দিয়ার প্রতি এতো ক্ষোভ মমের।দিয়াকে সহ্য করতে না পারার কারন বোধহয় এটাই।দিয়া ভেবেছিল সবাই যদি জেনে যায় তুমি তার বোন তাহলে মম হয়ত তোমাকে আরোই মেনে নেবে না।তোমার ভালোর কথা চিন্তা করেই দিয়া পুরো বিষয়টা লুকিয়ে গেছে।তোমার কি এরপরেও দিয়াকে দোষি মনে হয়?
রোশনি অধিরের বুকে মুখ ঘষল।অধিরের শরিরের ঘ্রানটা নিজের মাঝে শুষে নিয়ে বলল,
-উঁহু….
অধির নিঃশব্দে হাসল।রোশনিকে দুহাতে বুকের সাথে পিষ্টে দেওয়ার চেষ্টা করতেই মুখ তুলে তাকাল রোশনি।অধিরের খোচা খোচা দাড়ি গুলোতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
-থ্যাংক ইউ অধির।আমাকে এতো সুন্দর সুন্দর সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে।আজ আমিও আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।
-সত্যিই!!!কেমন সারপ্রাইজ সুইটহার্ট?আচ্ছা ওয়েট,,, আমি গেইজ করি।
অধির কিছুক্ষন ভেবে বলে উঠল,
-তুমি কি আমার সাথে সারা জিবন থাকতে চাইছো?
-ইট’স আ গুড গেইজ বাট রং আন্সার।যাই হোক কাছাকাছি ছিল।
অধির এক ভ্রু উচু করে বলে উঠল,
-তার মানে তুমি সত্যি সত্যিই আমার সাথে সারা জিবন কাটানোর প্ল্যান করেছো!!!ও মাই গড,,,,আই কান্ট বিলিভ দিস!!!! ভালো হয়েছে তুমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো।নয়ত জোর করে হলেও তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হত। এতো সহজে ছেড়ে দিবো নাকি!!!এখন তাড়াতাড়ি বলে দাও তো কি সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছো?
রোশনি অধিরের বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
-উঁহু… এখনি বলা যাবে না। অপেক্ষা করতে হবে।পারবেন না অপেক্ষা করতে? নাকি ক্লান্ত হয়ে যাবেন?
অধির উঠে দাড়ালো।রোশনির নাক টেনে দিয়ে বলল,
-অপেক্ষা..!! ক্লান্তিহীন অপেক্ষা!!!তোমার অপেক্ষায় বৃদ্ধ হবো,,, কখনো ক্লান্ত হবো না সুইটহার্ট। আচ্ছা তুমি ততোক্ষন তোমার সারপ্রাইজ তৈরি করো আমি একটু নিচ থেকে আসছি।
-কোথায় যাচ্ছেন?
-কোথাও না সুইটহার্ট। ব্যস এখানেই আছি।ওভেনে কিছু খাবার দিয়েছিলাম।ওগুলোই নিতে যাচ্ছি।এসে কিন্তু আমার সারপ্রাইজ চাই।
অধির চলে যেতেই দম ফেলল রোশনি।অধিরকে কিভাবে তার মনের অনুভূতির কথা জানাবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না সে।সরাসরি বলে দিবে সে তাকে ভালবেসে ফেলেছে? নাকি একটু গুছিয়ে বলবে? যেমনটা সিনেমা বা গল্পে সচরাচর দেখা যায়।রোশনি ছাদের এপাশ ওপাশ পায়চারী করছে।বুঝে উঠতে পারছে না কিভাবে অধিরের সামনে তার অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করবে।রোশনির ভাবনার মাঝেই ফোন বাজল।জয় ফোন করেছে।রোশনির মনে হঠাৎই বিষন্নতা ভর করলো।এতো দিন বাদে এতো রাতে জয় কেন ফোন দিচ্ছে?রোশনির ভাবনার মাঝেই ফোন কেটে গিয়ে দ্বিতীয় বারের মত বেজে উঠল।রোশনি কাপা কাপা হাতে রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে বিষন্ন গলা শোনা গেলা,
-হ্যাপি সিক্সথ মানথ আ্যানিভার্সারি রোশনি।ম্যানি ম্যানি রিটার্নস অফ দা ডে।
-থ্যাংক ইউ জয়।এতো দিন বাদে ফোন দিলে যে?কেমন আছো বলো?
-এই তো আছি মোটামুটি।তুমি হয়ত ভুলে যাচ্ছো রোশনি,,,,,সময় পাল্টেছে।সময়ের সাথে সাথে তোমাকে সময়ে অসময়ে ফোন দেওয়ার অধিকারটাও পাল্টেছে। অথবা বলতে পারো সেই অধিকারটা হারিয়ে ফেলেছি।এখন তোমার কাছে ফোন দিতে গেলেও দশবার ভাবতে হয়।
-তোমার কাছে আমি এখনো অপরাধি তাই না জয়? ভুলটা বোধ হয় আমারই ছিল।কেন নতুন করে সবটা শুরু করছো না তুমি?
-সেটা সম্ভব নয় রোশনি।দ্বিতীয় বার কাউকে ভালবাসার সাহস আমার নেই।আমি এখনো তোমায় ভালবাসি।ভবিষ্যতেও ভালবাসবো।আমি তোমার না হওয়া এক অগোছালো প্রমিক হয়েই থাকতে চাই।বুক ভরা অভিমান আর মুখ ভরা নিরবতা নিয়েই বাকিটা জিবন কাটাতে চাই।এতেই আমি সুখী।
-তুমি ভিষন ভাল জয়।তোমার ভাগে এতোটা কষ্ট হয়ত উচিত ছিল না।পৃথিবীর প্রতিটা মেয়েই হয়ত তোমার মত ছেলেকে জিবন সঙ্গি হিসেবে পেতে চাই।সেদিক থেকে আমার কপাল বোধহয় খারাপ ছিলো।সেজন্যই তোমাকে পেয়েও হারালাম।তবে অধির…..
বাকিটা বলার আগেই পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেল রোশনি।পিছন ফিরে তাকাতেই অধিরের শক্ত চোখ মুখ দেখে ভয়ে কেপে উঠল ।ছেলেটা হঠাৎ কেন রেগে গেল,,? বুঝে উঠতে পারছে না রোশনি।এদিকে রোশনিকে কথা বলতে না দেখে ফোনের ওপাশ থেকে একনাগাড়ে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছে জয়।অধির রোশনির হাতের ফোনের দিকে তাকালো।রোশনিও এতোক্ষনে বুঝতে পারলো অধিরের রেগে যাওয়ার কারন।রোশনি কিছু বলবে তার আগেই ওর হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে সজোরে মেঝেতে ছুঁড়ে মারল অধির।মুহূর্তেই ভেঙে খামচুর হয়ে গেল ফোনটা।রোশনি চমকে উঠে একপা পিছিয়ে গেল।অধিরের চোখ মুখ লাল টকটকে হতেই ভয়ে শিউরে উঠল রোশনি।রোশনিকে ভয় পেতে দেখেও থামলো না অধির।দু কদম এগিয়ে গিয়ে রোশনির বাহু চেপে ধরে চোয়াল শক্ত করে বলে উঠল,
-এখনো তুই জয়ের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করিস নাই? আমি চলে যেতেই শুরু হয়ে গেছে প্রেমলিলা? তোর জন্যে কি কি করি নাই আমি? তোর জন্যে আমি আমার বাড়ি ছেড়েছি।পরিবার ছেড়েছি।তোর খুশির জন্য তোর পরিবারকে পাগলের মত খুজে বেরিয়েছি।তোর মুখে হাসি ফোটানোর জন্যে আলাদত পর্যন্ত গিয়েছি আমি।এতো কিছুর পরেও কি পেলাম আমি? কি দিয়েছিস আমাকে? আমার চোখের আড়ালে পুরোনো প্রেমিকের সাথে ফোনালাপ করা হচ্ছে?বল কেন ঠকিয়েছিস আমাকে? কেন..?
অধিরের চিৎকারে কেপে উঠল রোশনি।চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নোনা পানি ধারা।রোশনির জানা নেই অধির ঠিক কতটুকু শুনেছে তার কথা।সে তো অধিরকে ঠকানোর মত কিছু বলে নি।রোশনি বুঝতে পারছে অধির তাকে ভুল বুঝেছে।ওর ভুল ভাঙাতে হবে।রোশনি পানি ভর্তি চোখ নিয়ে ছলছল চোখে তাকালো।হালকা আর্তনাদ করে বলে উঠল,
-অধির আমার লাগছে।আপনি একটু শান্ত হোন।আমি সবটা বুঝিয়ে বলছি।আমি আপনাকে ঠকায় নি।আপনি পুরো কথাটা না শুনেই আমাকে ভুল বুঝছেন।
অধির আরো শক্ত করে চেপে ধরল রোশনির বাহু।রোশনো ঠোট চেপে সহ্য করে নিল।অধির আগের থেকেও বেশি ক্রুদ্ধ হয়ে বলল,
-আমি ভুল বুঝছি না।তুই আমাকে এতো দিন ভুল বুঝিয়েছিস।আমি মনে করেছিলাম তুই আমাকে ভালবাসতে শুরু করেছিস।আমাকে মেনে নিয়েছিস।কিন্তু না।আমি ভুল ছিলাম।সবটা তোর ছলনা ছিল।সবটা।তুই আমার ভালবাসার সাথে ছলনা করেছিস।তোকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।কখনো না।
অধির রোশনিকে ধাক্কা দিয়ে হনহন করে ছাঁদ থেকে নেমে গেল।অধির এতোটাই রেগে আছে যে একটাবার ফিরেও তাকালো না।ফিরে তাকালে হয়ত দেখতে পেত রোশনিকে ধাক্কা দেওয়ার ফলে রেলিং এর সাথে বারি খেয়ে রোশনির কপাল কেটে গেছে।রোশনি ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে কপাল চেপে ধরল।অধিরকে তার আটকাতে হবে।ওর ভুল ভাঙাতে হবে।সামান্য কিছু ভুল বুঝাবুঝির জন্যে তাদের সম্পর্কে কোনো আঁচ সে আসতে দেবে না।রোশনি কপালে হাত রেখে উঠে দাড়ালো।উঠে দাড়াতেই মাথাটা কেমন ঘুরে গেল রোশনির। দূর্বল পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে আসতেই টাল সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।
অন্যদিকে বাড়ি থেকে অনেকটাই দুরে চলে এসেছে অধির।স্টেয়ারিং এ সজোরে বারি মেরে গাড়ি থামিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল।কয়েক মুহূর্ত কেটে যেতেই কিছুটা শান্ত হল অধির।চোখ বুজে সীটে মাথা এলিয়ে দিতেই রোশনির বলা একটা কথা হঠাৎই ভেসে উঠল মষ্তিষ্কে।”আপনি পুরো কথা না শুনেই ভুল বুঝছেন অধির।আমি আপনাকে ঠকায় নি”।অধিরের কপাল কুচকে গেল।তবে কি সত্যিই সে বুঝতে ভুল করেছে?পুরো কথাতো সে শোনে নি।অর্ধেক কথা শুনে এভাবে রিয়্যাক্ট করা কি তার উচিত হয় নি? এমন নানা প্রশ্নে মাথা ভারি হয়ে এল অধিরের।হঠাৎ করেই মনে পড়ল আসার সময় রোশনিকে সে ধাক্কা দিয়েছিল।রোশনির কঁকিয়ে ওঠার আওয়াজও সে শুনেছিল।রাগের কারনে পেছনে ফিরে তাকানো হয় নি।অধিরের চিন্তায় শরির ঘেমে যাচ্ছে।কোথাও রোশনির আঘাত লাগে নি তো?অধির আর দেরি না করে গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত ড্রাইভ করতে শুরু করল।আকাশে তখন কালো মেঘের গর্জন।অধির বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে এক প্রকার দৌড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল।সিড়ি অবধি যেতেই থমকে গেল পা।হাত পা অবশ হয়ে আসছে তার।সিড়ি ঘরের দরজার ওপাশে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে রোশনি।শাড়ির আচল আগুনে পুড়ছে।বাতাসে উড়ে এসে দরজার কাছে রাখা প্রদিপের উপর আচল পড়তেই আগুন ধরে যায় আচলে।অধির দ্রুত পা ফেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করল।অতিরিক্ত উত্তেজনায় সেটাও ঠিকমত নেভাতে পারল না অধির।ভয়ে ওর কলিজা কাপছে।হাত পায়ে কোনো শক্তি পাচ্ছে না।অজানা ভয়ে মাথাটা দপদপ করছে।অধির আর দেরি না করে একটানে রোশনির শাড়ি খুলে নিয়ে ছাদের মাঝ বরাবর ছুড়ে মারল।হাটু গেড়ে বসে রোশনির নিথর দেহটা বুকে চেপে হাউমাউ করে কেদে উঠল অধির।বুদ্ধি হবার পর এই প্রথম অধির কাঁদছে।প্রেয়সীকে হারানোর ভয়ে ডুঁকরে উঠছে মন।অধির রোশনির গালে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল একের পর এক।সাথে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে নোনা পানির ধারা।
-সুইহার্ট তাকাও না? দেখো আমি তোমার কাছেই আছি।তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পারো না।শুনেছো তুমি? আমি ভুল করেছি সুইটহার্ট।আমি তোমাকে ভুল বুঝেছি।তুমি আমাকে শাস্তি দাও।অাঘাত করো আমায়।তবুও চুপ করে থেকো না।তাকাও না সুইটহার্ট। প্লিজ একটা বার তাকাও।আমি তোমাকে এভাবে সহ্য করতে পারছি না।
অধির রোশনির গালে হাত রেখে ঝাকাতেই চোখ পিটপিট করে তাকাল রোশনি।দূর্বল গলায় বলল,
-আমি আপনাকে ঠকায় নি অধির।
অধির কাদতে কাদতেই রোশনির চোখ মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিল।বুকের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
-আই এম সরি সুইটহার্ট। আমি তোমাকে আঘাত করে ফেলেছি।ক্ষমা করে দাও আমাকে।আমি আর কখনো এমন করবো না।প্লিজ আমার কাছেই থাকো।আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না সুইটহার্ট।মরে যাবো।একদম মরে যাবো।আমাকে ক্ষমা করে দাও।
অধির বাম হাতে চোখ মুছে রোশনিকে কোলে তুলে নিলো।সিড়ি ভেঙে নিচে নামল।পা দিয়ে বেড রুমের দরজায় ধাক্কা দিতেই অবাক হয়ে গেল অধির।সেই সাথে নিজের অপরাধ বোধটাও বাড়ল তরতর করে।মেয়েটা তাকে সারপ্রাইজ দিতে এতো কিছু করেছে অথচ সে কি করলো? মেয়েটাকে আঘাত করে বসল!!কষ্ট দিলো!!অধির রুমে ঢুকে রোশনিকে বিছানায় শুইয়ে দিল।মুখের উপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে রুমাল দিয়ে কপালের রক্ত পরিষ্কার করে দিল।সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ বেধে দিয়ে উঠে দাড়াতে নিলেই দূর্বল হাতে অধিরের হাত চেপে ধরে রোশনি।অধির অপরাধি চোখে তাকায়।রোশনি অধিরের হাত ধরে হালকা টানতেই রোশনির বুকে মাথা রেখে ফুপিয়ে ওঠে অধির।রোশনি অবাক হয়।এই প্রথম সে অধিরকে কাঁদতে দেখছে।একটা মানুষেরই কত রুপ?এতো তো কিছুক্ষণ আগেই কতোটা রাগ ছিল চোখে। এখন সেই চোখেই তাকে হারানোর ভয়।
-আমাকে মাফ করে দাও সুইটহার্ট। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।আমার জন্যে আজ তোমার প্রানও চলে যেতে পারতো।সব কিছু আমার জন্যে হয়েছে।আমি তোমার যোগ্য না।একদমই যোগ্য না।
অধিরকে বলতে না দিয়ে দূর্বল গলায় বলে উঠল রোশনি,
-হুশশশ,,,,,।আর কোনো কথা নয়।আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই।আমি আজ আপনার হতে চাই অধির।সম্পূর্নরুপে আপনার।
অধির মুখ তুলে তাকাতেই অধিরের ঠোটে ঠোট ছোয়াল রোশনি।শুষে নিতে থাকলো একেকটা দির্ঘশ্বাস।অধিরও আকড়ে ধরল পিয়তমার কোমল ঠোট।সব ভুলে হারিয়ে গেল নতুন কোনো দুনিয়ায়। বাইরে তখন তুমুল বর্ষন। অাকাশ বাতাস কাপিয়ে বৃষ্টির তাণ্ডব। বৃষ্টির পানিতে সব মান -অভিমান,ক্ষোভ-অপরাধ ধুয়ে মুছে কাল হয়ত তারা নতুন সূর্যের উদয় দেখবে।নতুন করে শুরু হবে পরবর্তি পথচলা।নাকি কাছের মানুষের চক্রান্তের শিকার হয়ে নষ্ট হবে তাদের আগামির পথচলা!!!
চলবে……