শেষ রাত পর্ব-১৩

0
1613

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৩
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

‘আমি, তুমি আর তুলতুলকে নিয়ে আমাদেরও সুখের সংসার হবে অনুপাখি। খুব শীগ্রই হবে।’

আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ পেছন ফিরে দেখলাম সাদাফের প্রাণোচ্ছল হাসি। এই প্রথম ঘৃণা করলাম আমি সাদাফকে। জীবনে প্রথম কাউকে ঘৃণা করলাম। সেটাও আবার আমার ভালোবাসার মানুষকেই। ঘৃণার দৃষ্টিতে সাদাফের দিকে চেয়ে শক্ত গলায় বললাম-

‘তুমি আজও সব কিছুতে হেয়ালি করছো সাদাফ। তোমার অবহেলা পেয়েও আমি সব সময়ের মতো ভালোবাসা নিয়ে তোমার ফিরে আসার অপেক্ষা করতে পারিনি। শেষ দিনের কথাটা খুব হাস্যকর ভাবেই সত্যি হয়ে গেল সাদাফ। তুমি ফিরে এসে আমাকে আর পাওনি। আমি এখন অন্যকারো অর্ধাঙ্গিনী। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। এটা তোমাকে মানতেই হবে আজ না-হয় কাল। সত্যিটা তোমাকে মেনে নিতেই হবে। তেতো হলেও মানতে হবে। কষ্টের হলেও মানতেই হবে সাদাফ।’

সাদাফ তার হাসি থামিয়ে বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলো আমার দিকে। কয়েক পা এগিয়ে এসে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে-

‘তুমি আমাকে শায়েস্তা করার জন্য এমনটা করছো তাই না অনন্যা!’

আমি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসলাম। তুলতুলের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে সহজ গলায় বললাম-

‘তোমার আমার কখনও সুখের সংসার হবে না। তুলতুলের আব্বু কখনই তা হতে দিবে না। আর তুলতুলের আম্মু কখনই তুলতুলকে ছাড়বে না।’

কথাটা বলেই আমি চলে আসলাম মনি মা’র কাছে। তুলতুলকে মনি মা’র কোলে দিয়ে আড়ালে এসেই কল করলাম সানিয়াকে। দু-তিন বার রিং বাজতেই কল রিসিভ হলো। সানিকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই আমি গম্ভীরমুখে বললাম-

‘শোন সানি! সাদাফ হয়তো তোর কাছে ফোন করবে৷ আমার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করলে তুই সরাসরি বলে দিবি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। ও যেন এই সত্যিটা মেনে নেয় ব্যস।’

ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সানিয়া বিরক্তি নিয়ে বলল-

‘সাদাফ ভাই কি এখনও বিশ্বাস করছে না তোর বিয়ের কথা?’

‘তোর কি মনে হয় সাদাফ এতসহজেই সব বিশ্বাস করবে?’

আমার পালটা প্রশ্নে সানিয়া হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে। নিম্ন স্বরে বলল-

‘আচ্ছা আমি বলে দিবো। আর হ্যাঁ তোর বউ সাজের কিছু ছবি আছে আমার কাছে ওগুলো কি দেখাবো?’

‘তোর যা ভালো মনে হয়।’

আমি ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে কথাটা বলেই ফোন রেখে দিলাম। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে পা বাড়ালাম তুলতুলের উদ্দেশ্যে। মেয়েটা আবারও কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে কি-না কে জানে!

অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর আর যন্ত্রণাদায়ক হয়তো কিছু নেই। আমার প্রথম অপেক্ষা করা শুরু হয়েছে সাদাফের জন্য। আমাদের সম্পর্কের ছ’মাস চলছিলো তখন। হঠাৎ করেই একদিন সাদাফ বলল সে তার বন্ধুদের সঙ্গে তিনদিনের জন্য কক্সবাজার যাবে। আমি রাজি হয়েছিলাম। তবে খুব আকষ্মিকভাবেই খেয়াল করলাম কক্সবাজার যাওয়ার পর সাদাফ আমার সাথে পুরোপুরিভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভয় পেয়েছিলাম খুব। কোনো দূর্ঘটনা হয়েছে কি-না ভেবেই আঁতকে উঠেছিলাম বার বার। ভয়ে ভয়ে কাটিয়েছিলাম তিন দিন। নির্দিষ্ট সময়েই সাদাফ ফিরেছিল। সে ছিল স্বাভাবিক। যেন কিছুই হয়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করাটাও স্বাভাবিক। আমাকে ফোন দিয়ে নিজের খোঁজ খবর না জানানোও বেশ স্বাভাবিক। এর কারণ জানতে চাইলেই সহজ জবাব দেয়- ‘ঘুরতে গিয়েছিলাম তাই শুধু প্রকৃতিকেই অনুভব করতে চেয়েছি। এ কারণেই ফোন বন্ধ করে রেখেছিলাম।’ আমি রাগ করেছিলাম তারপর আবারও সব স্বাভাবিক। এর পর থেকে দু এক মাস পর পর তার ট্যুর দেওয়াই ছিল নিয়ম। যোগাযোগও বরাবরের মতোই ছিল বিছিন্ন। আস্তে আস্তে তার ট্যুর দেওয়ার সময় দীর্ঘ হতে লাগে। তিন দিন থেকে পাঁচ দিন। পাঁচ দিন থেকে সপ্তাহ খানেক। এভাবেই আমার অপেক্ষার প্রহর গুনা শুরু হয়। আজও অপেক্ষা করছি। তবে সাদাফ নয় ভিন্ন মানুষের জন্য। ধ্রুবর জন্য। সকাল সকাল বেরিয়েছে আব্বুর সাথে অফিসে কাজে। আব্বু সন্ধ্যা হতেই ফিরে এসেছে তবে ধ্রুবর এখনও ফিরেনি।

কলিং বেলের শব্দেই আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটালো। সোফা থেকে উঠে দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখলাম। বারোটা বেজে পনের মিনিট। আমি ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজা খুলতেই ধ্রুব খানিকটা উৎকন্ঠিত হয়ে বলল-

‘সরি অনেক দেরি হয়ে গেল। আসলে অফিসে…’

ধ্রুবকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে আমি শান্ত গলায় বললাম-

‘সমস্যা নেই। আমি আপনার কাছে কোনো কৈফিয়ত চাইবো না। আমি যথাসম্ভব আপনার শর্তগুলো মেনে চলার চেষ্টা করবো।’

আমার কথা শুনে ধ্রুব অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলো। হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছেন তবে পারছে না। ধ্রুব হতাশ হয়ে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে থমথমে পায়ে রুমে চলে যায়। ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে খাওয়ার মাঝে হঠাৎ করে বলল-

‘সেদিন আমি ওভাবে কথা গুলো বলতে চাইনি। আমার কথায় আপনি কিছু মনে করে থাকলে আমি সরি।’

আমি গ্লাসে পানি ঢেলে ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বললাম-

‘আমি কিছু মনে করিনি। আপনি আপনার মতো থাকবেন এটাই আমাদের মাঝে শর্ত ছিল। তাই আপনাকে কোনো কিছু নিয়ে আমাকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন নেই।’

ধ্রুব নিশ্চুপ। খাবার শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল-

‘সকালে দেরি করে ঘুম থেকে উঠবো। তাই কাল ড্রাইভার আপনাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে।’

আমি মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বলতেই ধ্রুব ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে রুমে যায়।

ক্লাসের মাঝেই রাফিন ভাই আমাকে ক্লাস থেকে ডেকে আনে। মাঠের এক পাশে সাদাফকে আঙুলের ইশারায় দেখিয়ে দিয়েই তিনি নিঃশব্দে চলে যান। আমি গম্ভীর পায়ে সাদাফের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম-

‘তুমি আবারও এখনে কেন এসেছো সাদাফ!’

আমার প্রশ্নে সাদাফের কোনো ভাবান্তর হলো না। শূণ্য দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে রইলো আমার চোখের দিকে। তার চাহনিতে কোনো পরিবর্তন হলো না। শূন্য দৃষ্টিতেই তাকিয়ে থেকে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল-

‘আমি খোঁজ নিয়েছে। সবাই বলছে তোমার বিয়ে হয়ে গেছে৷ তোমার বউ সাজের ছবি দেখিয়েছে। আমি অন্য কারও কথা কিংবা কোনো ছবি কোনো কিছুই বিশ্বাস করি না। আমি শুধু তোমার মুখে সত্যিটা শুনতে চাই অনন্যা।’

‘তুমি যা শুনেছো সবটাই সত্যি। আমি তোমাকে আগেও অনেক বার বলেছি আমার বিয়ে হয়ে গেছে। কেন বিশ্বাস করছো না আমার কথা?’

আমার সহজ প্রতিত্তোরে সাদাফ খানিকটা হাসার চেষ্টা করলো। আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে জোড়ালো কন্ঠে বলল-

‘তুমি মজা করছো তাই না অনুপাখি!’

আমি খুব সাবধানে সাদাফের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। দু পা পিছিয়ে এসে তপ্ত শ্বাস ফেললাম। সাদাফের দিকে তাকাতেই হতভম্ব হলাম আমি। তার চোখদুটো ছলছল করছে। মুখটাও কেমন মলিন হয়ে আছে। হয়তো দোটানায় পরে গেছে। আমার বিয়ের কথা বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে তবে তার মন হয়তো বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না এই কথা।

‘আমি মজা করছি না সাদাফ। আমার বিয়ে হয়ে গেছে। আর আমি এখন অন্য একজনের ওয়াইফ এটা তোমার বিশ্বাস করতেই হবে। তুমি চলে যাওয়ার বিশদিন পরেই আমার বিয়ে হয়। আমি তোমার সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও ব্যর্থ হয়েছি।’

আমি তাচ্ছিল্যের সুরে কথা গুলো বলেই হাল্কা হাসলাম। সাদাফের চোয়ালে শক্ত হলো। মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে এলো তার মুখের ভঙ্গিমা। গম্ভীর থেকেই গম্ভীরতর হলো তার চাহনি। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত গলায় বলল-

‘বিয়ে হয়ে গেছে তোমার? অন্য কারও ওয়াইফ তুমি! এতটা সহজে বলে দিলে এসব! যাকে তাকেই বিয়ে করে নিবে। বিয়েটা কি তোমার কাছে ছেলেখেলা মনে হচ্ছে অনন্যা?’

‘ছেলেখেলা তো আমাদের সম্পর্কটা ছিল তোমার কাছে। দিনের পর দিন অবহেলা করেছো। ছন্নছাড়া ভাব নিয়ে আমার সাথে থেকেছো কয়েকটা বছর। আমার অনুভূতি, আমার অভিমান, অভিযোগ, রাগ কোনো কিছুরই গুরুত্ব তোমার কাছে ছিল না। ছেড়ে দিয়েছো আমাকে আমার মতো একা। একটা বার খোঁজ নিয়ে দেখো নি আমি কীভাবে তোমার জন্য অপেক্ষা করেছি। কীভাবে অভিমান গুলোকে নিজের মনে চাপা দিয়ে থেকেছি এতটা দিন।’

সাদাফ কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। পকেট থেকে ফোন বের করে আমার বউ সাজের ছবি আমার দিকে তুলে ধরে। ভীষণ শান্ত গলায় বলে,

‘তুমি বউ সেজেছো অন্য কারো জন্য? এই লাল শাড়ি সাজগোজ সব কিছু অন্য কারও জন্য? এতটাই অভিমান ছিল যে একেবারে অন্যকারো সাথে নিজের জীবন জড়িয়ে নিলে? এতটাই রাগ ছিল আমার উপর যে এত বড় একটা শাস্তি দিলে আমাকে!! আমার জন্য কি আর একটু অপেক্ষা করা যেতো না অনন্যা???’

সাদাফ লাস্টের কথাটা হুংকার দিয়ে বলেই ফোনটাকে মাটিতে আছাড় মা’রে। চোখের পলকেই চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ফোন। রক্তিম হয়ে এলো সাদাফের চোখ দুটো। আজ প্রথম সাদাফের এমন রূপ দেখছি। তার হাসিখুশি মুখের পেছনে এতটা রাগ লুকিয়ে আছে আগে কখনই তা প্রকাশ পায়নি। আমি অপ্রস্তুত হয়ে খানিকটা দূরে সরে গেলাম। ভয় জড়ানো দৃষ্টিতে তাকালাম সাদাফের রাগান্বিত চেহারার দিকে। আশেপাশের দু একজন স্টুডেন্ট কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। সাদাফ চোখ বন্ধ করে কিড়মিড়িয়ে বলল-

‘আমার সামনে থেকে যাও অনন্যা। আমি চাই না রাগের মাথায় আমি তোমাকে আঘাত করি। আমি চাই না এই মুহুর্তে তুমি আমার সামনে থাকো। অনন্যা ক্লাসে যাও বলছি।’

সাদাফের ধমকে আমি কেঁপে উঠলাম। ভয়ে এলোমেলোভাবে পা ফেলে ফিরে আসলাম ক্লাসে। সাদাফেএ এমন রূপ দেখে আমার পুরো শরীর অসাড় হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। কিভাবে সামলাবো আমি সব কিছু? হতভম্ব হয়েই হাঁটতে লাগলাম। ক্লাসে এসে আবারও সানিয়ার পাশে মূর্তির মতো বসে রইলাম। সানিয়া নানানরকম প্রশ্ন করেছে তবে তার উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। গলার স্বর আটকে গেছে। এভাবেই নিস্তব্ধ হয়ে কাটয়ে দিলাম এক ঘন্টা। ক্লাস শেষ খানিকটা ভয় নিয়ে বের হলাম। সাদাফ এখনও মাঠে আছে কি-না ভেবেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পরলো মস্তিষ্ক। সাদাফের এমন ভয়ংকর রাগ দেখার পর যেন আত্মা শুকিয়ে গেছে আমার। ভার্সিটির মাঠে সাদাফকে না দেখে মনে মনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম। তবে এই স্বস্তি বোধ বেশিক্ষন টিকলো না। বড়সড় এক ধাক্কা খেলাম ভার্সিটির গেইট থেকে বের হয়েই। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলাম সামনের দিকে। চোখদুটোকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। পর পর কয়েকবার চোখের পলক ফেলে আবার দৃষ্টি স্থির করলাম সেদিকে। নাহ এটা কল্পনা না। আমি সত্যি দেখছি। ধ্রুব সাদাফের সাথে কোলাকুলি করছে। ভীষণ হাসি হাসি তাদের দুজনের মুখ। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম আমি। কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। সাদাফের সাথে ধ্রুবর কি সম্পর্ক? ধ্রুব কি সাদাফকে চেনে? আর ধ্রুব হাসিমুখেই বা কেন কোলাকুলি করছে সাদাফের সঙ্গে?

চলবে..

[বাকিটা আপনারা ভাবতে থাকুন। রিচেক করা হয়নি তাই ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here