শেষ রাত পর্ব-১৫

0
1558

#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৫
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত

ঘুম ভেঙেই নিজেকে ধ্রুবর বাহুডোরে দেখে ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম। রাতে করা নিজের বোকামির কথা ভেবেই লজ্জা পেলাম খুব। খানিকটা অবাক হলাম ধ্রুবর ব্যবহার আর তার কথা গুলো মনে করে। সবার সামনে আমাকে তুমি সম্মোধন করলেও যখন আমরা একা থাকি তখন কখনই তিনি আমাকে তুমি সম্মোধন করেননি। কিন্তু কাল রাতে কি অদ্ভুত ভাবেই না কথা বললেন। কিন্তু কেন? আর আমিই বা কেন ওনার বুকে নিজের ঠাঁই খুঁজে নিতে চাইলাম। কেন ওনার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে চাইলাম আমি? প্রশ্ন গুলো দিশেহারা হয়ে আমার মস্তিষ্কের পুরোটা জায়গা জুড়ে ঘুরতে লাগল। তবে কোনো উত্তর এলো না মস্তিষ্ক থেকে। আমি নেড়েচেড়ে উঠলাম। ধ্রুবর বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু হলো তার বিপরীতে। ধ্রুব আরও শক্ত করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন-

‘উফফ তুলতুলের আম্মু! সাপের মতো এভাবে মোচড়ামুচড়ি করছেন কেন? আমার জানামতে আমি তো কোনো নাগিন মেয়ে বিয়ে করি নি।’

ওনার কথায় ক্ষীণ রাগ নিয়ে মাথা তুলে তাকাতে চাইলাম কিন্তু সম্ভব হলো না। আমি হাল ছেড়ে স্বাভাবিক হয়ে শুয়ে রইলাম। দারুণ অস্বস্তি নিয়ে মিনমিনিয়ে বললাম-

‘আমাকে ছাড়ুন। আমি উঠবো।’

ধ্রুব আমাকে ছাড়লেন না বরং আমাকে লজ্জায় ফেলার মতো কিছু ভয়ংকর কথাবার্তা বলা শুরু করলেন,

‘কাল রাতে তো আমার পারসোনাল বুকের ভেতর একদম ডুকে যেতে চাচ্ছিলেন। তখন তো আমি বাধা দেইনি। তাহলে এখন কেন এতো লজ্জা পাচ্ছেন?’

আমি লজ্জা আর অস্বস্তিতে চুপ করে করে থাকলাম। ধ্রুবর প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো কোনো কথা খুঁজে পেলাম না বা খুঁজতে চাইলাম না। ধ্রুব হয়তো বুঝলেন আমার মনের অনুভূতি। তিনি খুব সাবধানেই তার বাহুডোর থেকে আমাকে মুক্ত করলেন। খাঁচায় বন্দী থাকা পাখির মতোই আমি মুক্তি পেতেই ঝটপট করে উঠে বসলাম। ভীষণ অপ্রস্তুত হয়েই নিজেকে ঠিক করতে ব্যস্ত হলাম। আমার এলোমেলো চুলগুলো হাত খোপা করতেই ধ্রুব আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন। অত্যন্ত সহজ গলায় বললেন-

‘আমার পারসোনাল বুকটা আপনার সাথে শেয়ার করলাম। আমার এতো বছরের যত্ন করে রাখা একান্ত ব্যক্তিগত বুকটাতে আপনার জায়গায় দিলাম। তাই বলে যে আপনি কেঁদেকেটে আমার বুক ভাসাবেন আর সারা রাত বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আমার শরীর ঝিম ধরিয়ে ফেলবেন তা তো হবে না। বুকে যেমন জায়গায় দিয়েছি তেমনি আপনারও উচিত সেই বুকটাকে সযত্নে আগলে রাখা, খেয়াল রাখা আর নিয়মিত এর ভাড়া পরিশোধ করা।’

ধ্রুবর এমন উদ্ভট কথাবার্তায় আমি বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম-

‘ভাড়া কিভাবে দিবো! আর আপনার অতি পারসোনাল বুকের খেয়াল আমি রাখবো কিভাবে?’

‘এখন এত কিছু জানতে হবে না। সময় হলে আমি নিজেই বলে দিবো। আপাতত আপনার নোনাজলে ভেসে যাওয়া আমার টি-শার্টটা ধুয়ে দিলেই হবে।’

ধ্রুব ভ্রুক্ষেপহীন গলায় কথা গুলো বলেই নিজের টি-শার্ট খুলতে লাগলেন। আমি বিস্ফোরিত চোখে ওনার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। আমতা আমতা করে বললাম-

‘আপনি.. আপনি…!’

আমার কথা জড়িয়ে গেল। ওনাকে বলার জন্য কথা গুছিয়ে নিতে পারলান না। ধ্রুব তার নির্লিপ্ত কন্ঠে বললেন-

‘কি? আপনি আপনি করছেন কেন?’

আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললাম-

‘আপনি নির্লজ্জ। আপনার লজ্জা করে একটা মেয়ের সামনে এভাবে হুটহাট টি-শার্ট খুলে ফেলতে!’

ধ্রুব অবাক করা কন্ঠে বললেন-

‘আমি তো এখানে আমার বিবাহিত বউ ছাড়া অন্য কোনো মেয়ে দেখছি না তুলতুলের আম্মু। তাহলে লজ্জার কি হলো এখানে? যাই হোক এই নিন টি-শার্ট সময় করে ধুয়ে রাখবেন।’

ধ্রুব তার টি-শার্ট দিয়ে আমার সাড়া মুখ ডেকে দিয়েই ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমি হতবিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। লোকটার ভাবগতিক কিছুই বুঝতে পারছি না৷ দিন দিন যেন তার লুকিয়ে রাখা নানান ধরনের রূপ এক এক করে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মুখ থেকে ওনার টি-শার্ট সরিয়ে হাতে নিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ফেললাম।

‘কিরে তুই কখন এলি?’

সানি তুলতুলের সঙ্গে খেলতে খেলতে এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে বলল-

‘বেশিক্ষন না মিনিট দশেক হবে।’

আমি সানির পাশে বসে ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললাম-

‘সকাল সকাল এই বাসায় কি ব্যাপার!’

‘কোনো ব্যাপার না। সকাল সকাল তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে গেছে তাই ভাবলাম তুলতুলের সঙ্গে দেখা করে তোকে নিয়েই এখন থেকে কলেজে যাবো।’

খানিকক্ষণ বাদেই ধ্রুব এসে কুশল বিনিময় করলেন সানির সাথে। কথার এক পর্যায়ে সানি বেশ উৎসুক হয়ে বলল-

‘দুলাভাই আপনি আজ গাড়ি নিয়ে অফিসে চলে যান। অনু আর আমি আজ রিকশা করে যাবো ভার্সিটিতে। অনেক দিন একসাথে যাওয়া হয়না।’

‘এক সাথে যাবে তাহলে আমার গাড়ি দিয়ে যাও। ধুলোবালির মধ্যে রিকশা দিয়ে যাওয়ার কি দরকার!’

ধ্রুবর কথায় সানি হাসতে হাসতে বলল-

‘আমি আর অনু আগে রিকশা দিয়েই যেতাম তাই ওর ডাস্ট অ্যালার্জি নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না।’

ধ্রুব কপাল কুচকে কিছুক্ষন চুপচাপ বসে রইলেন। ছোট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে উদাসীন গলায় বললেন-

‘আমার বউটাকে দেখে রেখো শালি সাহেবা। আমার কিন্তু একটা মাত্রই বউ।’

ধ্রুবর কথায় সানি শব্দ করে হেসে ফেলল। রান্নাঘর থেকে মনি মা-ও হাসলেন। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ধ্রুবর দিকে নিক্ষেপ করলাম। তবে এতে তার কোনো হেলদোল হলো না। উনি ওনার মতোই স্বাভাবিক।

বহুদিন পর সানির সাথে রিকশায় কলেজে এলাম। পুরনো স্মৃতি গুলো মনে করে খুব হাসলাম। মেয়েটা আমাকে হাসাতে পারে যে কোনো পরিস্থিতিতে। আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়েকে মুহূর্তেই হাসাতে হাসাতে পেট ব্যথায় করিয়ে ফেলে। ভার্সিটির মাঠে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় সানির কথা হঠাৎ করেই থেমে যায়। আমার হাতে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলল-

‘দোস্ত সাদাফ ভাই দাঁড়িয়ে আছে।’

আমি সানির দৃষ্টি অনুসরণ করে মাঠের অন্য প্রান্তে তাকাই। সাদাফকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও এড়িয়ে গেলাম। সানিকে বললাম-

‘বাদ দে ক্লাসে চল।’

আমরা ক্লাসে চলে আসলাম। পর পর তিনটা ক্লাস শেষ হলো অথচ সাদাফ এখনও আমার ক্লাস রুমের জানালা বরাবর মাঠের সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এক মুহুর্তের জন্যেও সেখান থেকে যায়নি। আমার পাশ থেকে সানি চিন্তিত গলায় বলল-

‘অনু সাদাফ ভাই তো দেখছি পাগল হয়ে গেছে।’

আমি চুপ করে রইলাম। সানির কথার প্রতিত্তোরে কিছু বললাম না। সানি আমার কাধের উপর হাত রেখে ভারি গলায় বলল-

‘শোন অনু। তুই সাদাফ ভাইয়ের সঙ্গে ভালো করে কথা বল। রাগ না করে ভালো করে বুঝিয়ে বল ওনাকে। তাহলেই হয়তো উনি বুঝবেন। এভাবে আর কত দিন এড়িয়ে যাবি? ওনাকে দেখে মনে হচ্ছে না উনি এত সহজে তোকে নিয়ে হার মানবে।’

আমি চুপ থেকে মনে মনে ভাবলাম সানির বলা কথা গুলো। সানিকে চোখের ইশারায় সম্মতি জানিয়ে ব্যাগ নিয়ে ক্লাস থেকে বেরিয়ে এলাম। সাদাফের কাছে এসে নির্লিপ্ত কন্ঠে বললাম-

‘তুমি এখনও যাওনি কেন সাদাফ? এখানে তো তোমার কোনো দরকার থাকার কথা না।’

‘এখনও আমার তোমাকে পাওয়া বাকি আনুপাখি।’

সাদাফের সহজ সরল জবাবে আমি হতাশ হলাম। ছোট্ট করে তপ্ত শ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বললাম-

‘আমাদের কোথাও বসে কথা বলা উচিত।’

আমার কথা শুনেই সাদাফের চোখদুটো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো। তার বিষন্ন মুখে এক চিলতে হাসি দেখা দিল। আনন্দিত হয়ে বলল-

‘সত্যিই বলছো অনু পাখি? আমার সাথে যাবে তুমি?’

আমি কোনো জবাব না দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ভার্সিটি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে একটা রেস্টুরেন্টে এসে বসলাম দুজনে। রেস্টুরেন্টের এক কোণের টেবিল দখল করে চুপচাপ বসে রইলাম। আমার সামনের চেয়ারেই সাদাফ কথা বলার জন্য হাসফাস করতে লাগলো। একটা পর্যায়ে চুপ থাকতে না পেরে উত্তেজিত হয়েই বলল-

‘আমি তো ভাবতেই পারিনি ধ্রুব তোমার হাসবেন্ড। তুমি সবার কথা রাখতে বিয়ে করেছো তাই না অনুপাখি? আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো। আগের মতোই ভালোবাসো। তুমি কখনই আমাকে ছেড়ে নিজের ইচ্ছাতে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না। কাল রাতে কত করে কল দিলাম। কিন্তু তুমি ধরলে না কেন? আমাকে ব্লক করলে কেন? ধ্রুব সাথে ছিল না-কি?’

সাদাফ একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে। কথা বলতে বলতে হাঁপিয়ে যাচ্ছে তবুও থামছে না। অবশেষে আমি মুখ খুললাম। ভীষণ শান্ত গলায় বললাম-

‘আমাদের উপন্যাসের বইয়ের সূচনা হয়েছিল ভালোবসার রঙিন কালির আঁচড়ে। মাঝের ধূসর পাতায় লেখা ছিল কিছু অভিমান, অপেক্ষা আর হেয়ালিপনার কথা। অপেক্ষা, অভিমান আর কষ্ট আমার ছিল। একান্তই আমার। আর খামখেয়ালিপনা ছিল তোমার। তোমার অবহেলা আর হেয়ালিতে আমাদের উপন্যাসের শেষের পাতা গুলো ফাঁকাই রয়ে গেল। বিষাদে মোড়ানো একটা সমাপ্তি টানতে হলো উপন্যাসের। ভালোবাসার রঙিন কালি দিয়ে আবারও সেই সমাপ্ত উপন্যাসের শেষটা লেখা সম্ভব না। প্রকাশিত উপন্যাস আবারও নতুন করে লেখা হয়না সাদাফ। উপন্যাসের সমাপ্তিটা বিষাদময় হলেও সেটাই আমাদের মেনে নিতে হবে আজীবনের জন্য।’

আমি থামলাম। নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে রইলাম সাদাফের দিকে চেয়ে। সাদাফ মাথা চেপে ধরে মিনিট খানেক সময় নিঃশব্দে বসে থাকলো। দৃষ্টি তুলে তাকায় আমার দিকে। গম্ভীর গলায় বলে,

‘তুমি চাইলেই ধ্রুবকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে আসতে পারো। তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না। আমাকে ভালোবাসো। তাহলে ধ্রুবর সাথে কেন সংসার করবে? ভালোবাসাহীন সম্পর্ক কতদিনই বা নিজের অনিচ্ছায় টিকিয়ে রাখবে অনন্যা? ধ্রুবকে বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই রাজি হবে তোমাকে ডিভোর্স দিতে। ধ্রুব আমার কথা বুঝবে আমি জানি।’

চলবে….

[দুঃখিত দেরি করে দেওয়ার জন্য। সময়ের সল্পতায় গল্প রিচেক করা হয়নি ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। সবাইকে ধন্যবাদ আর ভালোবাসা।❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here