শেষ_প্রহর পর্বঃ০২

0
1647

#শেষ_প্রহর
পর্বঃ ০২
জাহান আরা

সুলতানা চন্দ্রকে নিয়ে নিচে নেমে আসে।সুলতানা আর চন্দ্রর পিছন পিছন আসছে অনিতা।উপস্থিত সবাই তিনজনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেনো একজন অন্যজনের কার্বন কপি।কি অদ্ভুত মিল তিনজনের চেহারায়।

সুলতানার মা সুরাইয়া বেগম,চন্দ্রর মা শায়লা আর সুলতানার শাশুড়ী নাসিমা বেগম বসে বসে কথা বলছেন।শায়লা বেগমের দম আটকে আসছে,এভাবে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে কখনোই ভাবেন নি তিনি,আর এতো বিরাট বড়লোকের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে হবে এটা তার কল্পনাতীত ছিলো।কার ভাগ্য কোথায় লিখা আছে কেউ জানে না।

নিচে এসেই সুলতানা জিজ্ঞেস করে,”নিষাদ এখনো আসে নি,এখনো রেডি হওয়া হয় নি ওর?”

নিষাদের নাম শুনে চন্দ্রর আত্মারাম বের হবার জোগাড়। শেষমেশ নিষাদের সাথে আপা ওর বিয়ে ঠিক করেছে,যে কি-না ভালোবাসে সুস্মিতা নামের একটা মেয়েকে।

আপা কিভাবে এই কাজ করলো আমার সাথে?
কিছুতেই ভেবে পায় না চন্দ্র।

বাহিরে থেকে একজন পুলিশ অফিসার নিষাদকে নিয়ে ভিতরে আসে।
ভাবী যে বাড়িতে পুলিশ গার্ডের ব্যবস্থা করেছে নিষাদের ভাবনা তে ও ছিলো না।

নিষাদ কে দেখে সুলতানা মুচকি হাসে।

নিশান এগিয়ে গিয়ে নিষাদ কে বলছে,”বলেছিলাম না তোর ভাবীর সব কাজ গুছানো,সি ইজ ভেরি স্মার্ট,আই লাইক হার”
নিষাদ হাল ছেড়ে দিয়ে বসে পড়লো।

চন্দ্রর পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না এখনো, কেনো নিষাদের সাথেই তার বিয়ে!

অনিতার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে চন্দ্র,একটু পরে তার কুরবানি হয়ে যাবে,স্বেচ্ছায় তাকে মেনে নিতে হবে সব।

কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে লাগলো। চন্দ্রকে কবুল বলতে বলা হচ্ছে,চন্দ্র ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখতে পারছে না সে।চোখের সামনে সব আবছা লাগছে,তার মাথায় ঢুকছে না কিছু।
কবুল বলার মুহূর্ত কেনো এতো কঠিন!
চন্দ্রর জানা নেই।

নিষাদ মনে মনে দোয়া করছে যাতে চন্দ্র কবুল না বলে,চন্দ্রর দিক থেকে যাতে ভেঙে যায় বিয়েটা।
কোনো মতে যেনো চন্দ্র কবুল না বলে।

সুলতানার ধাক্কায় হুশ এলো চন্দ্রর,অস্ফুটস্বরে কবুল বললো।

নিষাদের পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো সাথে সাথে।অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবুল বলতে হলো তার।এক মুহূর্তে তারা সামাজিক নিয়মে একে অন্যের হয়ে গেলো অথচ মন থেকে তাদের যোজন যোজন দূরত্ব।প্রতিদিনই বিয়ে হয়,কিন্তু মনের সাথে মনের বিয়ে ক’জনার হয়??
তবুও বেঁচে থাকে মানুষ অদেখা এক সমাজকে ভয় করে।

নিষাদ কবুল বলার সাথে সাথে সুলতানা কান্নায় ভেঙে পড়ে। নিশান হাজার চেষ্টা করছে কিন্তু সুলতানা কে থামাতে পারছে না।সুলতানার কান্নার কারন কেউ জানে না,সুলতানার মা আর চন্দ্রর মা ও কি ভেবে যেনো চোখ মুছছেন।
বিয়ে হওয়ায় কান্নার কথা ছিলো চন্দ্রের,সেখানে সুলতানার এমন কান্না দেখে তার ও কান্না থেমে গেছে,নিষাদ এতোক্ষণ সুলতানার উপর যে রাগ নিয়ে ছিলো মুহূর্তে সেটা উধাও হয়ে গেলো।

কি এমন কষ্ট হচ্ছে সুলতানার?

নিশান সুলতানা কে মানানোর জন্য সব করছে কিন্তু সুলতানা থামছে না।

“সুলতানা,আমাকে বলো কি হয়েছে তোমার,কেনো এতো কাঁদছো???
আচ্ছা,এটা বলো কি করলে তোমার কান্না বন্ধ হবে??”

“তুমি আগামীকালের টিকিট কাটো,আমি তোমার সাথে আগামীকাল-ই ইউএসএ চলে যাবো,এটাই আমার শেষ কথা। ”

সুলতানার এরকম কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে,হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ কেউ বুঝতে পারছে না।
সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছে নিষাদ,ভাবীকে ছেড়ে তার থাকার অভ্যাস নেই,ভাবী তার বোনের মতো।তার কখন কি দরকার সেটা সে নিজেও জানতো না,ভাবী সব ঠিকঠাক করে দিতো।
সুলতানা রুমে চলে গেলো,মেহমানরা যারা থাকার তারা তাদের রুমে চলে গেলো।

নিষাদ আর চন্দ্রকে ওদের রুমে এনে দিয়ে গেছে নিষাদের বন্ধু রা।যাবার সময় বলে গেছে,ভয় পাস না,আমরা আশেপাশে আছি,কোনো টিপস দরকার হলে কল দিস আমাদের,প্রয়োজনীয় সব কিছু তোর টেবিলে রাখা আছে”

বলেই হাসা শুরু করলো সবাই,লজ্জায় চন্দ্রর ইচ্ছে করছে মাটির সাথে মিশে যেতে।
নিষাদ চোখ বড় করতেই সবাই চলে গেলো নিচের দিকে।

এতোক্ষণ সবার সামনে থাকায় নিষাদ সুস্মিতা কে কল দিতে পারে নি। নিষাদের প্ল্যান এখনো আছে পালিয়ে যাওয়ার। আগামীকাল পালিয়ে যাবে,তারপর চন্দ্রকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিবে।

নিষাদের সব প্ল্যান ভেঙে দিবে সুস্মিতা তা নিষাদ ভাবতে ও পারে নি।
চন্দ্র রুমে এসে শাড়ি খুলে সুতি একটা শাড়ি পরে নিলো।নিষাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে,সুস্মিতার টেক্সট পড়ছে।

“নিষাদ,আমার এখন ক্যারিয়ারের শুরু,আমি এই মুহূর্তে তোমার সাথে পালিয়ে গিয়ে নিজের ক্যারিয়ার এখানে শেষ করে দিতে পারবো না,আমাকে মাফ করে দিও,আমি অনেক বড় মডেল হতে চাই,ভালোবাসা,প্রেম জীবনে অনেক আসবে মডেল হতে পারলে,তোমার মতো হাজার হাজার নিষাদ এসে পায়ে লুটিয়ে পড়বে,কিন্তু এখন ক্যারিয়ার শেষ করে দিলে জীবনে কিছুই পাবো না।আমাকে আর কল দিও না,বিয়ে করে নিও তাতেই ভালো”

সুস্মিতার এই মেসেজে নিষাদের পুরো দুনিয়া এলোমেলো হয়ে গেলো। নিষাদ চোখে অন্ধকার দেখছে হঠাৎ করেই। কিছুতেই ভাবতে পারছে না সুস্মিতা এরকম করতে পারে। এভাবে তার বিশ্বাস ভেঙে দিবে তা তার ভাবনাতে কখনো ছিলো না।
নিজেকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হচ্ছে নিষাদের,জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়া মানুষের মতো লাগছে।এতো কষ্ট কেনো জীবনে?
বুকটা ভীষণ ভারী হয়ে আসছে,নিশ্বাস ফেলতে পারছে না নিষাদ,চোখে ও দেখছে না।কোনোরকমে নিজেকে টেনে এনে সোফায় উপুড় হয়ে শুতে গেলো,সোফায় শুতেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে তার।

নিষাদ এসে চন্দ্রর গায়ের উপর পড়তেই চন্দ্র চিৎকার করে উঠে।চন্দ্রর চিৎকার শুনে নিষাদ চন্দ্রর মুখ চেপে ধরে হাত দিয়ে।

নিষাদের বন্ধুরা সবাই রুমের বাহিরে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো,চন্দ্রর চিৎকার শুনে সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিলো।
একজন বাহির থেকে বলে উঠলো,”বন্ধু ফার্স্ট টাইম,একটু সাবধানে করতে হবে সব কিছু”

চন্দ্র লজ্জায় লাল হয়ে গেলো,নিষাদ কথা বলার শক্তি ও পাচ্ছে না।ক্লান্তিতে,অবসাদে তার শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। তারপর ই নিষাদ জ্ঞান হারালো।

বাহির থেকে নিষাদের বন্ধুরা ডেকে বলছে,”বন্ধু কাজের সাথে সাথে আমাদের সাথে একটু কথাবার্তা চালিয়ে যা”
বলেই বাহিরে আবার হাসির রোল পড়ে গেলো।

নিচ থেকে সবাই শুনছে হাসাহাসি উপরে হাসাহাসি হচ্ছে,৩ তলা পুরো টা নিষাদ আর ওর বন্ধুদের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন নিষাদের বাবা,নিষাদের বাবার মনটা ভালো হয়ে গেলো,বন্ধুরা হাসাহাসি করছে তারমানে নিষাদ ও খুশী আছে।

চন্দ্র নিষাদের এরকম ব্যবহার নিতে পারছে না। চাপা গলায় বললো,”আমার উপর থেকে উঠুন,আমি ব্যথা পাচ্ছি”

বাহির থেকে নিষাদের বন্ধুরা আবার ডেকে বললো,”ভাবী ফার্স্ট টাইম এরকম হবেই,ঠিক হয়ে যাবে,একটু সামলে নিন,হুট করে বিয়ে হয়ে যাওয়ায় নিষাদকে আমরা ট্রেনিং দিতে পারি নি”

চন্দ্র করুণ চোখে নিষাদের দিকে চাইলো,নিষাদের বন্ধুদের জন্য কোনো কথা-ই বলা যাচ্ছে না।
ওদিকে নিষাদ ও নড়াচড়া করছে না,গায়ের উপর সেই যে পড়েছে,চন্দ্র নিষাদ কে সরাতে পারছে না কিছুতেই।

বাহির থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,”ভাবী কথাবার্তা যা বলার ইশারা,ইঙ্গিতে বলে নিন আজকের রাত,ওরা আপনাদের রুমে মাইক্রোফোন লাগিয়েছে সব শোনার জন্য”

অন্যরা সবাই কথা বলা লোকটার উপর রেগে গেলো বলে দেয়াতে,বাহিরে রাগারাগি,হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে।

চন্দ্র ভেবে পাচ্ছে না এখন তার কি করা উচিৎ?

কথা বললে বাহির থেকে ওরা সব শুনতেছে,কথা না বললে আবার নিষাদকে সরাতে পারবে না,রাত দুটো বেজে গেছে,ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে চন্দ্রর।

শাড়ি বদলে সোফায় এসে শুয়েছিলো চন্দ্র,নিষাদের বিছানায় শোবে না বলে,নিষাদ ও যে সোফায় এসেই পড়বে সেটা কে জানতো!

একসময় চন্দ্রও ঘুমিয়ে পড়লো।

সুরাইয়া বেগম আর শায়লা বেগম এক রুমে শুয়েছে,কেউ কারো সাথে কথা বলছে না।কোনো এক অজানা কারণে দুজনেই কেঁদে যাচ্ছে।
শায়লা বেগম কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।তার বুক ছিঁড়ে যেনো কেউ তার কলিজা নিয়ে গেছে।
জীবনে তো কতো কিছুই হারালেন তিনি,তবু কেনো এখনো হারানোর ব্যথা তাকে কাবু করে ফেলছে তা-ই ভেবে পাচ্ছেন না।

সুরাইয়া বেগম রুমের এপাশ ওপাশ করছেন।তার চোখের পানি বাঁধ মানছে না।কেনো মেয়ে চলে যাবে তাকে ছেড়ে,মেয়ের এতো অভিমান কেনো?
জেনেও তিনি অবুঝের মতো কাঁদছেন।মেয়েকে ছেড়ে থাকা তার জন্য অনেক কষ্টের তা তো মেয়ে জানে তবু কেনো এতো অভিমান। তিনি তার আদর ভালোবাসা দিয়ে কি মেয়ের অভিমান দূর করতে পারেন নি আজও!!!

সুলতানা নিশান কে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। নিশান সুলতানার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।মেয়েটাকে তার কাছে আজও ছোট বাচ্চার মতো লাগে।
সবার সামনে কি রাগী একটা মানুষ,যা বলে তাই করে,ভাঙবে তবু মচকাবে না,সেই মেয়েটাই একা হলে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়।
কি নিষ্পাপ একটা মুখ,শান্ত দিঘির মতো চোখ,যেনো একটু বাতাস এলেই চোখের জল চলে আসবে!

এই মেয়েটার জীবনে ও কতো কষ্ট আছে,তা নিশান জানে শুধু। অথচ অন্য কেউ দেখলে বুঝবেই না সেটা।নিজের প্রাণের বিনিময়ে যদি পারতেন তার বৌ টাকে খুশী করতে।

সুলতানা নিরবতা ভেঙে কথা বললো,”আমার বাবুটার যদি আমার মতো কপাল হয় নিশান?”

“ছিঃ কি বলছো এসব,কিছু হবে না পাগলী।”

“আমার মন কু ডাকছে নিশান,আমি জানি আমার বাবুর কপাল আমার মতো হবে,জানো তবু আজকে আমি স্বস্তি পাচ্ছি,চন্দ্র আছে বলে”

“এখন কথা বাদ দিয়ে ঘুমাও লক্ষ্মী মেয়ের মতো,আমি জড়িয়ে ধরে রাখছি”

সুলতানা কথা না বাড়িয়ে নিশান কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে পড়ে। তার শরীর খুব ক্লান্ত ছিলো।
নিশান টের পায় ঘুমের মাঝেই সুলতানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

আশ্চর্য হয় নিশান,সুলতানার কষ্টে তার বুকের ভিতর তোলপাড় করে,যদিও আশ্চর্য হওয়ার কথা না,এটা সুলতানার পুরোনো অভ্যাস,তবুও এতোদিনেও নিশান এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত হতে পারে নি,প্রতিবার সুলতানার কান্নার সাথে তার ও বুক কেঁপে উঠে। ইচ্ছে করে তখন সুলতানা কে বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখতে তার।

ঘুম ভাঙে সকালে নিষাদের,রুমে লাইট অন করা,চোখ মেলতেই দেখতে পায় সে চন্দ্রর বুকের উপর শুয়ে আছে। চন্দ্রর শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে,বুকের উপর থেকে নিচে শাড়ি পড়ে আছে।

চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here