#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
আগামী কাল প্রোডাক্ট লঞ্চ, অফিসের সবাই এখন চরম ব্যস্ত। গত একটা মাস ধরে অফিসের প্রত্যেকেই ওভারটাইম করছে, কুহেলির তো একদম দম ফেলারও সময় নেই। তবে সেদিনের পর থেকে কিন্তু ভুলেও আর না খেয়ে থাকে না, সময়মত খাওয়া টা ঠিক রেখেই সব কাজ করেছে। সব একদম ঠিকঠাক চলছে, এমনকি সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির মেসেজও, একদিনও বাদ যায় নি, তবে কুহেলির সেদিকে নজর দেওয়ার সময় নেই। আজকে নিশীথ আগরওয়াল আসবেন, তারও একটা প্রস্তুতি আছে, এখন আবার প্রোডাক্ট লঞ্চের ভেনুটাও চেক করতে যেতে হবে। অফিসের কাজগুলো শেষ করে তবে ভেনু চেক করে একেবারে বাড়ি ফিরবে ঠিক করেছে, নাহলে একবার যাওয়া আবার ফেরা, শুধু শুধু সময় নস্ট। পাঁচটার সময় নিশীথ আগরওয়ালের আসার কথা, তার আগেই সবটা শেষ করে ফেলতে হবে। কুহেলি পাঁচটার আগেই সব কাজ গুছিয়ে নিল, আর ঠিক পাঁচটার সময় নিশীথ আগরওয়াল পৌঁছলেন। আজকে আর মিটিং রুমের প্রয়োজন নেই, আলেখের কেবিনে বসেই মিটিংটা হওয়ার কথা। নিশীথ আগরওয়াল আসার একটু পরেই কুহেলির ডাক পড়ল, কুহেলি ওর ল্যাপটপ টা নিয়ে আলেখের কেবিনে এসে নক করল।
মে আই কাম ইন স্যার?
আলেখ দরজার দিকে তাকিয়ে কুহেলিকে দেখে হেসে বলল,
কাম ইন মিস বাসু।
ভিতরে ঢুকতেই কুহেলির নিশীথের দিকে চোখ গেল, সেই প্রথম দিনের মতই দেখাচ্ছে আজকে, শুধু মুখে প্রথম দিনের মত বিরক্তির বদলে একটা অদ্ভুত হাসি লেগে আছে। কুহেলি হেসে একটা চেয়ার টেনে বসে ল্যাপটপ টা অন করে নিশীথ আর আলেখ দুজনকেই সবটা দেখাতে লাগল। পুরোটা দেখানো হয়ে গেলে নিশীথ হেসে বলল,
ইটস জাস্ট পারফেক্ট, আমি জানতাম আপনি সবটা পারফেক্টলি হ্যান্ডেল করবেন।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
এবার আলেখ বলল,
মিস্টার আগরওয়াল, সব কিছু একদম রেডি হয়ে গেছে, আই অ্যাম শিওর কালকের দিনটা গ্র্যান্ড হতে চলেছে।
ইয়েস, আর আমরা যেভাবে প্ল্যান করেছি, এই প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হতে বাধ্য। ওহ, মিস্টার শর্মা আপনি আমাকে ভেনুর যে পিকচার গুলো পাঠিয়েছিলেন সেগুলো দেখে যতটা বুঝতে পারলাম, বেশ ভালই। কিন্তু আমি নিজে একবার দেখতে চাই, আই হোপ ভেনু রেডি হয়ে গেছে।
আলেখ বলল,
হ্যা, ভেনু রেডি হয়ে গেছে মিস বাসু আজ ফাইনাল চেকিং করতে যাবেন।
ওহ গ্রেট, তাহলে তো আমি আপনার সাথেই যেতে পারি মিস বাসু।
কুহেলি একবার আলেখের দিকে তাকাল, আলেখও একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,
হ্যা, সে তো যেতেই পারেন, মিস বাসু আপনি কখন যাচ্ছেন?
আমি তো এই মিটিং টার পরেই বেরোব ভেবেছি, আসলে অফিসের সব কাজ কমপ্লিট করে একেবারে বেরিয়ে যাব ভাবছিলাম।
আলেখের অভিব্যক্তি যেন সামান্য কিছু পরিবর্তিত হল তবে তা এতই সূক্ষ্ম যে কারোর দৃষ্টি গোচর হওয়ার অসম্ভব, এবং সেটাও ক্ষণিকের জন্য। আলেখ মুখে সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা এনে বলল,
দ্যাটজ গুড, তাহলে আপনি মিস্টার আগরওয়াল কে নিয়ে ভেনুটা চেক করে আসুন, আর কোনরকম প্রবলেম হলে আমাকে জানাবেন।
ওকে স্যার।
নিশীথ এবার উঠে দাড়িয়ে বলল,
দেন, লেট না করে বেরিয়ে পড়া উচিৎ।
কুহেলিও উঠে দাড়িয়ে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল,
ওকে স্যার, আপনি একটু ওয়েট করুন আমি ব্যাগটা নিয়ে আসছি।
নিশীথ টেবিলে রাখা ওর ফোনটা তুলে নিয়ে বলল,
ফাইন, আমি তাহলে নিচে ওয়েট করছি।
তারপর আলেখের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
ওকে মিস্টার শর্মা, সি ইউ টুমরো।
আলেখও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছিল, নিশীথের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে আলেখ হেসে জবাব দিল,
শিওর মিস্টার আগরওয়াল। কালকের দিনটা আমাদের দুটো কোম্পানির জন্যই খুব স্পেশ্যাল। আই হোপ সব ঠিক হবে।
নিশীথ ওর সেই অদ্ভুত হাসিটা ঠোঁটের কোণে এনে বলল,
অফকোর্স, সবকিছু ঠিক হতেই হবে।
বলে নিশীথ আগরওয়াল কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন, সঙ্গে তার সেক্রেটারি উমেশও। কুহেলিও আলেখকে বলে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিল কিন্তু আলেখের ডাকে থেমে যেতে হল।
মিস বাসু ওয়েট।
ইয়েস স্যার।
কুহেলির মনে হল আলেখ কিছু একটা ভাবছে, তাই নিজেই জিজ্ঞেস করল,
ইজ এনিথিং রং স্যার?
নো নো, নাথিং ইজ রং। মিস বাসু আপনার এখানকার সব কাজ হয়ে গেছে? মানে সবটা ফাইনাল চেক করা, সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে গেছে?
ইয়েস স্যার, আমি সব চেক করে নিয়েছি, এভরিথিং ইজ রেডি।
ওহ, গুড।
বলে আলেখ আবার যেন কোনও একটা ভাবনায় ডুবে গেল, কুহেলির খুব অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। একটু আগেও তো সব ঠিক ছিল তাহলে এখন হঠাৎ এত চিন্তার কারণ কি! রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে কুহেলি একটু গলা পরিষ্কার করে বলল,
উম.. উহুম.. স্যার বলছিলাম যদি আর কিছু বলার না থাকে তাহলে আমি কি যেতে পারি? আসলে মিস্টার আগরওয়াল ওয়েট করছেন।
আলেখ যেন হঠাৎ ভাবনার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল।
হ্যা..! ওহ, হ্যা.. আপনি যান। আর কোনরকম প্রবলেম হলে আমাকে বলবেন।
ওকে স্যার।
কুহেলি কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলে আলেখ কিছুক্ষণ বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকল, ঠোঁটে লেগে থাকা সবসময়ের সেই হাসিটা এখন আর নেই, মাথায় ঘুরছে সম্পূর্ণ অন্য চিন্তা। এদিকে কুহেলি ওর ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে নিচে নামতেই দেখল সামনে নিশীথ আগরওয়ালের গাড়ি দাড়িয়ে আছে আর মিস্টার আগরওয়াল গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছেন। কুহেলিকে দেখে ইশারায় একটু ওয়েট করতে বলে ফোনের কনভারসেশনে মন দিলেন, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না মিনিট দুয়েকের মধ্যেই কথা শেষ করে নিশীথ গাড়িতে উঠে কুহেলিকেও উঠতে বললেন। নিশীথ আগরওয়ালের গাড়ি ড্রাইভারই চালায়, আর তার পাশের সিটে উমেশ বসেছে, সুতরাং কুহেলির কাছে ব্যাক সিটে নিশীথের সঙ্গে বসা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই। কুহেলির কেমন যেন একটু অস্বস্তি লাগছে কিন্তু উপায় নেই তাই উঠতেই হল। ব্যাঙ্কয়েট হল টা মোটামুটি একটু দূরেই, শহরের একটা প্রান্তে হওয়া সত্বেও এই হলটাকেই আলেখ ভেনু হিসেবে পছন্দ করেছে, কারণ একটাই, জায়গাটা একটু অড হলেও হলটা বাকি সব দিক থেকেই সেরা। কুহেলি আগেও গিয়ে দেখেছে, হলের প্রত্যেকটা অ্যারেঞ্জমেন্ট একদম উচ্চ পর্যায়ের। অনেকক্ষণ কেউ কোনও কথা বলছে না, একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে গাড়িতে। নিশীথ প্রথম এই নিস্তব্ধতা ভেঙে কথা বলল,
মিস বাসু, আপনি তো কলকাতা থেকে বিলং করেন তাই না?
ইয়েস।
আমি দু তিনবার কলকাতায় গিয়েছিলাম, বিজনেসের জন্যই। নাইস সিটি। আপনাদের দুর্গাপূজা টা দেখার খুব ইচ্ছে আমার, কিন্তু এখনও পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। শুভ্র, মানে আমার সেই ফ্রেন্ড যার কথা আপনাকে বলেছিলাম, ও বলত কলকাতার দুর্গাপূজা যে দেখেনি তার লাইফটাই বৃথা।
দুর্গাপূজার কথায় কুহেলির মনটা যেন একলাফে পিছিয়ে গেল পুরনো দিনগুলোতে, কি মজাটাই না হত পুজোর দিনগুলোয়। সেই মহালয়া থেকে শুরু হয়ে যেত পুজোর আমেজ। শপিং, অঞ্জলি, ভোগের খিচুড়ি, রাত জেগে প্যান্ডেল হপিং, আর শেষে ভাসানে মনখুলে নাচ। এখন তো আর সেসব হয়ে ওঠে না, সেই যেদিন থেকে পড়ার জন্য ব্যাঙ্গালোরে এসেছে তবে থেকেই পুজোর আনন্দ টা যেন অর্ধেক হয়ে গেছে। এখানে দুর্গাপুজোর আলাদা ছুটি নেই, একবার তো যেতেই পারেনি বাড়িতে, আর যেবার যায় তাও হাতে গোনা কয়েকদিনের জন্য। সপ্তমী কিংবা অষ্টমীতে গিয়ে পৌছায় আবার দশমীর দিন ব্যাক, কতদিন ভাসান দেখে নি কুহেলি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, আসলে দুর্গাপূজার নামেই সকল বাঙালির মনেই একটা আলাদা অনুভুতি কাজ করে, সেটা একমাত্র খাটি বাঙালিরাই বুঝবে। পুরনো দিনের স্মৃতিতে এতটাই ডুবে গিয়েছিল কুহেলি যে নিশীথ দুবার ডাকলেও সে আওয়াজ তার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। নিশীথের তৃতীয় বারের ডাকটা কুহেলিকে একটানে অতীত থেকে বর্তমানে এনে ফেলল।
মিস বাসু।
ইয়েস স্যার, কিছু বলছিলেন?
বলছিলাম তো অনেক কিছু, কিন্তু আপনি মনে হয় তার কিছুই শোনেননি।
কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, হয়তো কাজের কথা বলছিলেন কুহেলি মনোযোগ দেয়নি।
অ্যাম সরি স্যার, আসলে আপনি দুর্গাপূজার কথা বললেন তো, পুরনো কথা মনে পড়ে গিয়েছিল।
তার জন্য সরি বলার কি দরকার? আপনাকে তো পুজোর কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
কি জিজ্ঞেস করছিলেন, আসলে আমি খেয়াল করিনি।
আমি বলছিলাম, আপনি তো ছোট থেকেই কলকাতায় বড় হয়েছেন, ওখানকার সবই জানেন। পুজোর ঠিক কোনদিন টায় গেলে আমি দুর্গাপূজার বেস্ট টা দেখতে পাব? আসলে বুঝতেই পারছেন, চারদিন স্পেন্ড করা তো পসিবল নয়, তাই ভাবছি এইবার পুজোয় একদিনের জন্য যাব।
ওহ, এত খুব ভালো কথা, পুজোর চারটে দিনই সমান, তবে আপনি যেহেতু একদিনের জন্য যাবেন বলছেন তাহলে আমি অষ্টমীর দিন যেতে বলব। মায়ের অঞ্জলি দেওয়া থেকে শুরু করে সব দেখতে পাবেন, তবে আপনার তো মনে হয় কলকাতায় চেনা কেউ নেই, আপনার সেই ফ্রেন্ডের সাথেও তো বললেন আর যোগাযোগ নেই, একজন চেনা কেউ থাকলে সুবিধা হয় নাহলে একদম অচেনাদের একটু অসুবিধা হয়।
কলকাতার কথা, দুর্গাপূজার কথা বলতে বলতে কুহেলির মুখটা খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, নিশীথ সেদিকে তাকিয়ে ওর সেই অদ্ভুত হাসিটা হেসে বলল,
পুজোর তো এখনও একটু দেরি আছে, ততদিনে তেমন চেনা কাউকে তো পেয়ে যেতেও পারি।
কথাটার মানে ঠিক পরিষ্কার হল না কুহেলির কাছে, আর এই নিশীথ আগরওয়ালের হাসিটা ওর খুব রহস্যময় মনে হয়, যেন কত না বলা কথা লুকিয়ে রয়েছে ওই হাসিতে। কুহেলি এইকথার আর কোনও উত্তর দিল না, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল আকাশটা কালো হয়ে এসেছে, যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি নামবে। কিছুদিন হল এখানে বর্ষা শুরু হয়েছে, কুহেলি প্রমাদ গুনল, তাড়াহুড়োয় ছাতা আনতে ভুলে গেছে। তারমধ্যে সেইরকম বৃষ্টি শুরু হলে ক্যাবও পাওয়া যাবে না, মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল যাতে ও বাড়ি পৌঁছানোর পর বৃষ্টিটা শুরু হয়। মিনিট চল্লিশের দূরত্ব রাস্তা ফাঁকা থাকায় আধাঘণ্টাতেই পেরিয়ে গেল, গাড়ি থেকে নেমে কুহেলি নিশীথ কে নিয়ে এগিয়ে গেল হলের দিকে। ডেকোরেশন কমপ্লিট, শুধু হলের বাইরের ডেকোরেশন কালকে হবে কারণ বর্ষা কালে যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে, তাতে ডেকোরেশন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই ডেট টা স্থির করা নিয়েও সমস্যা হচ্ছিল প্রথমে, সবাই বলেছিল বর্ষা কাল টা পেরিয়ে গেলে ডেট স্থির করতে, কারন ঝড় বৃষ্টির কারণে যেকোনো সময় প্রবলেম হতে পারে, কিন্তু আলেখ কিছুতেই রাজি হয়নি। কুহেলিরও মনে হয়েছিল এইসময়টায় ডেট টা না ফেললেই ঠিক হত কিন্তু আলেখ নিজের সিদ্ধান্তে একেবারে অনড়, কারনটা যদিও কেউ জানে না। কুহেলি একে একে সিটিং অ্যারেঞ্জমেন্ট, স্টেজ ডেকোরেশন, বুফে এরিয়া, সিকিওরিটি সিস্টেম সব চেক করে নিল, সঙ্গে নিশীথ কেও সবটা দেখিয়ে দিল। নিশীথের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে সবকিছু তার বেশ ভালই পছন্দ হয়েছে, সেটা আন্দাজ করতে পেরে কুহেলি একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। নাহলে এই নিশীথ আগরওয়ালের কোনও ভরসা নেই, কিছু অপছন্দ হলেই এক্ষুনি হয়তো পরিবর্তন করতে বলতেন আর তাতে কুহেলির শিরে সংক্রান্তি হত। সবটা দেখা হয়ে গেলে কুহেলি যখন বাইরে বেরোল তখন মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে, হলের ভিতরটায় বাইরের আওয়াজ খুব একটা শোনা যায় না, তাই টের পায়নি। এমনিতে বৃষ্টি কুহেলির খুব প্রিয় কিন্তু এই মুহূর্তে ভিষন বিরক্ত লাগছে। বর্ষাকালের বৃষ্টি, একবার শুরু হলে সহজে থামে না, আর যে হারে বজ্র বিদ্যুৎ সহ শুরু হয়েছে তাতে করে ক্যাবের আশাও ত্যাগ করতে হবে মনে হচ্ছে। এখান থেকে কুহেলির আপ্যার্টমেন্ট টাও বেশ দূরে, তবে এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি এই যা রক্ষে, কিন্তু এই বৃষ্টি কখন থামবে তার তো কোনও ঠিক নেই। কুহেলিকে ওরকম মুখ ব্যাজার করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নিশীথ বলল,
ইউ অলসো ডোন্ট লাইক রেইন, আমারও একদম ভালোলাগে না, শুধু শুধু কাজে বাধা হয়ে দাড়ায়। এই এখন যেমন দেখুন, বাড়ি ফিরে আমার কতগুলো ইম্পর্ট্যান্ট কনফারেন্স কল অ্যাটেন্ড করতে হবে, বাট এখন যতক্ষণ না অন্তত এই মেঘ ডাকা আর বিদ্যুৎ চমকানো টা কমছে ততক্ষণ এখানেই ওয়েট করতে হবে।
নিশীথের গলায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, কথাগুলো একটাও অসঙ্গত নয় কিন্তু তাইবলে বৃষ্টি ভালোবাসে না! কুহেলির তো ছোট থেকেই বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে, কতবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরেও পড়েছে, বৃষ্টি পড়লে ভেজা মাটির যে সোদা গন্ধটা বেরোয় ওটা তো কুহেলির ভিষন ভালোলাগে। এখনের কথা যদিও আলাদা, এখন বাড়ি ফেরাটা নিয়ে চিন্তা হচ্ছে। কতক্ষন এভাবে দাড়িয়ে থাকা যায়! তারমধ্যে যেভাবে মেঘ ডাকছে তাতে মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে বাজ পড়বে। হলের ম্যানেজার মিস্টার কৃষ্ণা ওদের ভিতরে গিয়ে বসার জন্য বললেন, কুহেলিরও মনে হচ্ছিল এইভাবে বাইরে দাড়িয়ে থাকার থেকে ভেতরে গিয়ে বসাটাই বেটার কিন্তু নিশীথ না বললে তার কিছু বলাটা ঠিক ভালো দেখায় না, তাই চুপ করে দাড়িয়ে রইল। নিশীথ কিন্তু একবাক্যে রাজি হয়ে গেল, মিস্টার কৃষ্ণা ওদের অফিসে নিয়ে বসালেন, বেশ বড় একটা সোফা রাখা রুমটায়, মিস্টার কৃষ্ণা ওদের সেখানেই বসতে বললেন। কুহেলির মোটেও নিশীথের সাথে একসাথে বসার ইচ্ছে নেই, কেন যেন খুব অস্বস্তি হয়। কিন্তু এখন অন্য কোথাও বসলে ব্যাপারটা খারাপ দেখায়, তাই সোফার একসাইড ঘেঁষে বসল, নিশীথ ওর থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখেই বসল। ওদের বসিয়ে মিস্টার কৃষ্ণা কোথাও একটা চলে গেলেন, উমেশও সেই কখন থেকে কাকে যেন একটা ফোনে কনট্যাক্ট করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছিল না, এতক্ষণে মনে হয় লাইনটা কানেক্ট হয়েছে, নিশীথের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে উমেশও বাইরে বেরিয়ে গেল। এই চুপচাপ বসে থাকাটা কুহেলির সব থেকে অপছন্দের কাজ, ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল চার্জ প্রায় শেষের দিকে সুতরাং ওটা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা যাবে না। অগত্যা চুপচাপ বসেই থাকল, বাইরে এখনও মেঘ ডাকছে, থেকে থেকেই বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। এই রুমটা বিল্ডিঙের পিছন দিকটায়, স্বচ্ছ কাচের জানালা ভেদ করে বাইরের সবকিছুই দেখা যাচ্ছে, আওয়াজও শোনা যাচ্ছে কিছুটা। কুহেলি সেইদিকেই তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ নিশীথ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, অন্তত কুহেলির তো অদ্ভুতই মনে হল,
আপনি মেঘের আওয়াজে ভয় পান না?
হ্যা..? মানে?
মানে ম্যাক্সিমাম মেয়েরাই তো এই মেঘের আওয়াজে ভয় পায়, তাই ভাবলাম আপনিও…
কুহেলি এবার নিশীথ কে কথাটা শেষ করতে দিল না,
আমি ভয় পাই না। ইনফ্যাক্ট আমি তো এটাই বুঝি না, মেঘের আওয়াজে এত ভয় পাওয়ার আছে টা কি?
নিশীথ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিস্টার কৃষ্ণা আর তার সঙ্গে একটি লোক হাতে একটা ট্রে তে দুকাপ কফি নিয়ে ঢুকলেন। বৃষ্টির ওয়েদারে গরম ধোয়া ওঠা কফির কাপ দেখলে যে কারোরই মন ভালো হয়ে যায়, কুহেলিও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা কাপ নিয়ে একটা তৃপ্তির চুমুক দিল কফিতে, মিস্টার কৃষ্ণা কফি দিয়ে আবার ফিরে গেলেন, নিশীথও চুপচাপ বসে কফি খাচ্ছিল। কুহেলি কফিটা শেষ করে রিস্ট ওয়াচে টাইম দেখল, আটটা বাজে। অলরেডি একঘন্টা হয়ে গেছে ওরা বৃষ্টিতে আটকে রয়েছে, ওদিকে বৃষ্টি কমার কোনও লক্ষণই নেই। এইভাবে আরো একটা ঘণ্টা কেটে গেল, নটা বাজে এখন যদি ক্যাব বুক না করে তাহলে এরপরে মোটেই পাবে না, এখনই তাই এই দুর্যোগে এই অড জায়গায় ক্যাব আসবে কিনা তার ঠিক নেই। কুহেলি ওর ফোনটা বের করে ক্যাব চেক করতে লাগল, নিশীথ সেটা লক্ষ্য করে বলল,
কি করছেন?
ক্যাব বুক করছি, এরপর আর পাওয়া যাবে না।
কেন?
কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
কেন মানে? আমি বাড়ি ফিরব কীকরে?
যেভাবে এসেছেন সেভাবে।
কুহেলি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
না না, তার দরকার নেই। আর এমনিতেও আমার বাড়ি আর আপনার বাড়ি সেম ডিরেকশনে নয়।
মিস বাসু, আপনি এখানে আমার সঙ্গে এসেছেন তাই আপনাকে সেফলি বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্ব টাও আমার। এখন আমি যদি আপনাকে একা ছেড়ে দিই, আর ধরুন কিছু একটা হয়ে গেল তখন মিস্টার শর্মা তো আমাকেই ব্লেম করবেন। ওনার এম্প্লয়ীকে নিয়ে আমি অফিসের কাজেই বেরিয়েছি, সো, রেসপনসিবিলিটি টাও তো আমারই, তাই না।
এতগুলো কথার পর কুহেলি আর কিছু বলার মত খুঁজে পেল না। পৌনে দশটা নাগাদ বৃষ্টিটা একটু কমলে ওরা বেরিয়ে পড়ল, কুহেলির আপ্যার্টমেন্টে পৌঁছাতেই সাড়ে দশটা ছাড়িয়ে গেল। নিশীথ বাড়ি অবধি পৌঁছে দেওয়াতে কুহেলির অবশ্য সুবিধাই হল, নাহলে কতক্ষণে যে বাড়ি পৌঁছাত তার ঠিক নেই। ফ্রেশ হয়ে কালকের ইভেন্টের জন্য একটা ড্রেস সিলেক্ট করে রেখে খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ল। কালকে খুব সকালে ওঠার প্রয়োজন নেই, কাল অফিসে যাওয়ার ব্যাপার নেই, সোজা ভেনুতে পৌঁছাতে হবে। ইভেন্ট টা বিকেলে রাখা হয়েছে, ডট পাঁচটায় শুরু হবে, কুহেলিদের যদিও দুপুরেই চলে যেতে হবে, তাও একটু দেরীতে উঠলে সমস্যা হবে না। অ্যালার্ম টা সেইমত সেট করে ফোনটা রাখতে যাবে এমন সময় একটা মেসেজ এল, সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি।
“বেস্ট অফ লাক ফর টুমরো।“
কুহেলি অভ্যাস মত মেসেজটা পড়ে ডিলিট করে দিল, আজকাল আর অবাক হয় না, রোজকার অভ্যাসে দাড়িয়ে গেছে। ফোনটা রেখে কোলবালিশটা জড়িয়ে চোখ দুটো বন্ধ করল, ঘুম আসতে একটুও দেরী হল না। পরদিন ঠিক সময়মত অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল, অভ্যাসমত আগে স্নান সেরে নিয়ে বাইরে এসে দেখল, গীতার প্রায় সব কাজই সারা হয়ে গেছে। কুহেলিকে দেখে গীতা ওর ব্রেকফাস্ট এনে দিল, গীতার সঙ্গে গল্প করতে করতে ব্রেকফাস্ট সারা হয়ে গেল, ওদিকে গীতারও কাজ শেষ। গীতা চলে যাওয়ার পর কুহেলি একবার বাড়িতে ফোন করে কথা বলে নিল, আজকের দিনটা ওর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবীর আশির্বাদ নেওয়াটাও খুব গুরত্বপূর্ণ। কথা শেষ করে টুকটাক কিছু কাজ গুছিয়ে সাড়ে বারোটা নাগাদ লাঞ্চ সেরে রেডি হতে বসল। আজকের ইভেন্ট টা সম্পূর্ণ বিজনেস ইভেন্ট তাই পোষাকটাও ফর্ম্যাল হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এমনিতে কুহেলি ফরম্যাল প্যান্ট আর শার্ট পরে আজ একটা ব্ল্যাক কালারের ফর্ম্যাল স্কার্ট আর রেড কালারের ফুল স্লিভ শার্ট পরল। চুলটা উচুকরে পনি করে ছেড়ে দিল, কানে দুটো ছোট্ট টপ পরল, আর হাতে শুধু একটা ওয়াচ। মেকাপ টা আজকে একটু সুন্দর করেই করল, একটা গাঢ় লাইনার পেন্সিল দিয়ে চোখ দুটো একে নিল, কালো রঙের ছোয়ায় গভীর চোখ দুটো যেন আরো গভীর হয়ে উঠল, ঠোঁটে শার্টের ম্যাচিং চেরী রেড লিপস্টিক লাগিয়ে যখন সুগন্ধীর ছোয়া দিয়ে আয়নার সামনে দাড়াল তখন সত্যিই ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো অসম্ভব মনে হল। এরকম খাটি ফর্ম্যাল সাজে কাউকে এতোটা আকর্ষণীয় দেখাতে পারে সেটা বোধহয় কুহেলিকে না দেখলে বোঝা যেত না। গেস্টরা সবাই সাড়ে চারটের থেকে আসা শুরু করবেন তাই কুহেলিদের তিনটের মধ্যে পৌঁছনোর কথা। ক্যাবটা যখন কুহেলিকে হলের সামনে নামাল তখনও তিনটে বাজতে দশ মিনিট বাকি। বাইরেটাও অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে, ভিতরে ঢুকে দেখল অনেকেই এসে পড়েছে, মিস্টার শেট্টি, বিদিশা সবাই কাজে ব্যস্ত, রুহিকে কোথাও দেখতে পেল না। কুহেলি এগিয়ে গিয়ে নিজের কাজে হাত লাগাল, যদিও কাজের বিশেষ কিছুই নেই, তাও লাস্ট মোমেন্ট চেকিং। চারটে নাগাদ আলেখ এল আর তার একটু পরেই নিশীথ, দুজনকেই আজকে অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে। বিদিশা তো একবার কুহেলির কানে কানে বলে গেল,
আই স্যোয়ার, বলিউড কিং রেহান খান্নাকেও আজ এই দুজনের কাছে চায় কম পানি মনে হবে, বেচারার লাইম লাইট আজ গেল।
বর্তমান বলিউডের নম্বর ওয়ান হিরো রেহান খান্না আজ এই ইভেন্টে প্রোডাক্ট লঞ্চ করতে আসছেন, ওনার হাত দিয়েই নিউ প্রোডাক্ট লঞ্চ হবে। এছাড়াও আরও অনেক নামী দামী ব্যক্তিত্বরা আসবেন আজকে, বিজনেসম্যান, পলিটিশিয়ান কেউ বাদ নেই। আজকে সবাই ব্যস্ত, টাইম মত গেস্ট রা আসতে শুরু করলেন, আর ঠিক পাঁচটায় শুরু হল মেইন ইভেন্ট। একে একে প্রোডাক্ট লঞ্চ, মিডিয়া, প্রেস কনফারেন্স শেষ হলে কুহেলি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল, এতদিনের পরিশ্রম খুব সুন্দর ভাবে সার্থক হল। এখন সবার পার্টির আমেজ, সবার হাতেই ড্রিঙ্কসের গ্লাস, এই একটা জিনিষ একদম ভালোলাগে না কুহেলির, পার্টি মানেই কি ড্রিঙ্কস করতেই হবে! রুহিও মনের সুখে ড্রিঙ্ক করছে, কুহেলি একটা সফট ড্রিঙ্কসের গ্লাস নিয়ে ছাদে উঠে এল, এই পরিবেশটাই ওর ভালোলাগে না, সবার এমন একটা ভাব যেন অ্যালকোহল না অমৃত খাচ্ছে। এখন ওর আর কোনও কাজ নেই চলে গেলেই হয় কিন্তু সেটাও দৃষ্টি কটু দেখায় তাই একটু সময় ছাদে থেকে একেবারে নেমে ডিনার করে বেরিয়ে যাবে। আজকেও দুপুরে বৃষ্টি হয়েছে, এখনও আকাশে মেঘ আছে তবে হালকা, মেঘের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যেই চাঁদ টা দেখা যাচ্ছে। কুহেলি একভাবে সেদিকে তাকিয়ে ছিল, বেশ ভালোলাগছিল দেখতে, হঠাৎ একটা যান্ত্রিক টুং টাঙ্গ শব্দে হুশ ফিরল। হাতে থাকা মুঠোফোনটায় মেসেজ এসেছে, সেই অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি, এখন তো আর কোনও কৌতুহলও হয় না কুহেলির, নিতান্তই অভ্যাস বশে মেসেজটা ওপেন করতেই চমকে উঠল।
“ইউ ক্যান কল মি নাও।“
মেসেজটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে আরেকটু হলেই হাতের গ্লাসটা পড়ে যাচ্ছিল, কুহেলি কোনরকমে গ্লাসটা ছাদের কার্নিশে রেখে তিনটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে সেভ করা নম্বরটা ডায়াল করল। মাত্র দুবার রিং হওয়ার পরেই ওপাশ থেকে কলটা রিসিভ হল, কিন্তু ওপার থেকে কোনও কথা ভেসে আসার আগেই কুহেলি বলে উঠল,
হু আর ইউ?
ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এল,
আগে তো হ্যালো বা হাই কিছু একটা বলতে হয়, তা না করে আগেই প্রশ্ন!
গলাটা কুহেলির কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকল,
আপনার সঙ্গে হাই হ্যালো করার মত সম্পর্ক আমার নিশ্চয়ই নেই, তাই সোজাসুজি আমার প্রশ্নের উত্তর টা পেলে খুশি হব।
কুহেলির কণ্ঠে একটা বিরক্তি মিশ্রিত রাগ ফুটে উঠল। কিন্তু ফোনের অপর প্রান্ত কিন্তু একদম শান্ত,
নিজের পরিচয় টা দেব বলেই তো আজ ফোনটা করতে বললাম, তবে আপনি আমার পরিচয় জানার জন্য এত উৎসুক দেখে খুব খুশি হলাম।
বাজে কথা না বলে উত্তর টা দিন।
বাবা, বড্ড বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন দেখছি। আচ্ছা বলুন তো আমার পরিচয় টা ফোনে শুনবেন না সামনা সামনি শুনবেন?
মানে?
মানে, যদি আপনি চান তাহলে আমরা মিট করতে পারি… এক্ষুনি।
কুহেলি অবাক হয়ে বলল,
আমি কোথায় আছি সেটা জানা আপনার পক্ষে অসম্ভব নয় সেটা এতদিনে আমি বুঝেছি কিন্তু আপনি এখানে আসবেন কীকরে? এখানে আজকে অফিস স্টাফ আর গেস্ট ছাড়া কেউ আসতেই পারবে না।
ধরে নিন আমিও তাদেরই একজন।
কুহেলি এবার আরও অবাক হল,
মানে!!
একবার পিছন ঘুরে দেখুন মানেটা নিজেই বুঝতে পারবেন।
কুহেলি প্রথমে বুঝতেই পারল না, লোকটা কি বলতে চাইছে!
পিছনে ঘুরব মানে!!
আপনি বড্ড বেশি মানে মানে করছেন, একবার পিছন ঘুরেই দেখুন না।
কুহেলি ফোনটা কানে রেখেই পিছন ঘুরল, আর যাকে দেখল, তার জায়গায় ভুত দেখলেও বোধহয় এতটা অবাক হত না। ওর সামনে কানে ফোন লাগিয়ে হাসিমুখে দাড়িয়ে আছে নিশীথ আগরওয়াল!!! কুহেলি যেন পলক ফেলতেও ভুলে গেল, এটা কীকরে সম্ভব!! দ্য নিশীথ আগরওয়াল এতদিন ওকে এই মেসেজ গুলো করছিল, কিন্তু কেন? নিশীথ ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ওর দিকে, ফোনটা ততক্ষণে নিজের পকেটে রেখে দিয়েছে কিন্তু কুহেলির হাতটা ফোন সমেত তখনও কানের কাছেই ধরা রয়েছে। নিশীথ এগিয়ে এসে একদম কুহেলির সামনে দাড়িয়ে বলল,
মিস বাসু, এখনও কি আমার পরিচয় টা দেওয়ার দরকার আছে?
কুহেলি চমকে ওর হাতটা কান থেকে নামিয়ে নিল, কিন্তু এখনও ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। আবারও নিশীথই কথা বলল,
মিস বাসু আই নো আপনি খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেছেন, বাট ইটস ট্রু, এতদিন ওই মেসেজ গুলো আমিই আপনাকে পাঠাতাম।
কুহেলি এবার কথা বলল, অবাক ভাবটা এখনও যায়নি।
কিন্তু কেন?
বিকজ আই লাইক ইউ।
এইরকম একটা কথা শোনার জন্য কুহেলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না, আর এত সরাসরি তো মোটেই নয়। কিন্তু কুহেলির অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল, নিশীথ খুব সহজ ভাবে কুহেলির চোখে চোখ রেখে বলল,
অ্যাকচুয়ালি আই ডোন্ট লাইক ইউ, আই লাভ ইউ।
কুহেলি এইসবের জন্য একদম প্রস্তুত ছিল না, আর নিশীথ আগরওয়ালের কাছ থেকে তো একেবারেই না। এত সহজ ভাবে সরাসরি কেউ এভাবে নিজের মনের কথা বলতে পারে সেটা কুহেলির জানা ছিল না। কুহেলি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল, উত্তর দেওয়া তো অনেক পরের ব্যাপার এই মুহূর্তে ঠিক কিভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিত সেটাই ওর মাথায় এল না। নিশীথ ব্যাপারটা বুঝল, কুহেলিকে কিছুটা সময় দিল, একটু পরে কুহেলি একটু ধাতস্থ হয়ে বলল,
আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?
নিশীথ ঠিক আগের মতোই শান্ত ভাবে বলল,
জানি, আর আমি সবদিক ভেবে নিজে শিওর হয়ে তবেই বলছি। আমি কোনো কাজ না ভেবে করি না, এটুকু নিশ্চয়ই এতদিনে বুঝতে পেরেছেন, আমি সত্যিই আপনাকে ভালোবাসি মিস বাসু।
কুহেলির চোখের অবাক ভাবটা কেটে গিয়ে একটা বিরক্তির ভাব ফুটে উঠছে,
ভালোবাসার আপনি কতটা বোঝেন?
কুহেলির কণ্ঠে এক অদ্ভুত কাঠিন্য টের পেল নিশীথ, যতদিন কুহেলিকে দেখেছে কোনদিনও এইরূপটা দেখেনি। কিন্তু নিশীথ আগরওয়ালও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নয়, ঠিক আগের মতোই শান্ত স্বরে উত্তর দিল,
যতটা বোঝা উচিত ঠিক ততটাই বুঝি।
কুহেলির ভালোবাসার অভিজ্ঞতার কথা আমরা সবাই জানি, জীবনের প্রথম প্রেম অপূর্ণ থেকে গেলে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয় সেটা বোধহয় কোনোদিনই পুরোপুরি সারে না। আর কুহেলির জীবনে এমনিতেই প্রেম ভালোবাসার কোনও জায়গা ছিলনা, তবুও প্রেম এসেছিল নিভৃতে কিন্তু তার অপূর্ণতার আঘাতে কুহেলির এই প্রেম ভালোবাসা নামক বস্তুটির ওপরে একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে, শব্দ দুটোর প্রতি একটা তীব্র অবিশ্বাস যেন আপনা থেকেই জন্ম নিয়েছে। নিশীথের উত্তর শুনে কুহেলির কণ্ঠে বিরক্তির সঙ্গে রাগও ঝরে পড়ল,
হেয়ালি আমি ভালোবাসি না, সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর পেলেই খুশি হব। আর আপনি বলছেন আপনি আমাকে ভালোবাসেন, কতদিন ধরে চেনেন আমায়? কতটা জানেন আমার ব্যাপারে? এইভাবে না জেনে না বুঝেই ভালোবেসে ফেললেন?
কুহেলির রাগ মিশ্রিত বিরক্তি নিশীথের নজর এড়াল না, কিন্তু তাতেও তার মধ্যে কোনও পরিবর্তন এল না। সেই হাসিটা ঠোঁটের কোণায় এনে খুব সহজ ভাবে বলল,
লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট বলে একটা কথা আছে জানেন তো? আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিছুটা সেরকমই। তবে আমি আপনার বিউটির জন্য আপনার প্রেমে পড়িনি, আপনার থেকেও অনেক বেশি সুন্দরী নারীর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, আমি আপনার প্রেমে পড়েছি, দ্য রিয়েল ইউ, প্রথম দিন আপনার কনফিডেন্স আমায় ভিতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিয়েছিল, তারপর আপনাকে যত চিনেছি ততই আরও বেশি করে ভালোবেসেছি।
এই কথা শুনে অন্য যে কেউ হলে নরম হয়ে যেত কিন্তু কুহেলি যেন আরও রেগে গেল,
এইভাবে দিনের পর দিন নিজের পরিচয় গোপন রেখে একটা মেয়েকে মেসেজ করাকে আপনি ভালোবাসা বলেন?
মিস বাসু, আমি একটাও এমন মেসেজ আপনাকে পাঠাইনি যেটা আমার পাঠানো উচিৎ নয়, আর আমি শুরু থেকেই প্ল্যান করেছিলাম আজকের দিনটাতেই আপনাকে নিজের মনের কথাটা বলব, কিন্তু ততদিন আপনার সাথে একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকাটাও আমার ভালোলাগছিল না। আর আমার পরিচয় দিয়ে নিশ্চয়ই রোজ আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম না, তাই এই রাস্তা টা বেছে নিয়েছিলাম। সামান্য একটা মেসেজের মাধ্যমে হলেও একটা যোগাযোগ রোজই হত আমাদের মধ্যে, আর সেটাই যথেষ্ট ছিল আমার জন্য।
কুহেলির খুব অসহ্য লাগছে এইসব শুনতে, ওর কাছে এইসব কথার কোনও মূল্য নেই। একটা অগ্নিদৃষ্টি নিশীথের দিকে ছুড়ে দিয়ে কিছু না বলেই সেখান থেকে চলে আসছিল কুহেলি, কিন্তু নিশীথের কথায় থেমে যেতে বাধ্য হল।
আই নো এবাউট হিম।
কুহেলি পিছন ফিরে নিশীথের দিকে তাকিয়ে বলল,
কি জানেন আপনি?
যতটা জানা সম্ভব।
কুহেলির দৃষ্টি স্থির, সত্যিই তো, যে এতকিছু জানে তারপক্ষে এটা জানা এমন কোনও বড় কথা নয়। নিশীথ আবার বলল,
আমি জানি, আপনি দেবার্ঘ্যকে ভালোবাসতেন, হয়তো এখনো বাসেন। এটাও জানি আপনাদের ব্রেকআপ হয়ে গেছে, যদিও কারনটা আমার জানা নেই, আর জানতেও চাই না। পাস্ট নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই, আপনার পাস্টে যেই থাকুক তাতে আপনার কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আপনার প্রেসেন্টে আপনার ফিউচারে আমি থাকতে চাই। মিস বাসু, আমি আপনাকে এখনই কোনো উত্তর দিতে বলছি না, টেক ইওর টাইম, আই ক্যান ওয়েট। তবে একটা কথা বলব, অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখতে নেই, তাতে লাইফ কমপ্লিকেটেড হয়ে যায়।
কুহেলির মুখ দিয়ে একটাও কথা সরল না, চুপচাপ একটা পুতুলের মত দাড়িয়ে রইল। নিশীথ আবার বলল,
মিস বাসু, একটা ব্যাপারে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, আমি কোনদিনও আপনাকে জোর করব না, তবে এরমানে কিন্তু এটাও নয় যে আমি হাল ছেড়ে দেব।
বলে নিশীথ আগাওরয়াল নিচে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল, কিছুদূর গিয়ে ফিরে দাড়িয়ে বলল,
এখানে বেশিক্ষণ একা থাকবেন না, ওয়েদার টা ভালো না, ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
নিশীথ আগরওয়াল নীচে চলে গেলে কুহেলি আবারও একবার আকাশের দিকে তাকাল, চাঁদটাকে আর দেখা যাচ্ছে না। কালো মেঘ গুলোর আড়ালে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, কুহেলির মনে হল ওর মনটাও কেউ কালো চাদরে মুড়ে দিয়েছে, সেখানে কোনও আলো নেই, কেমন দমবন্ধ করা পরিবেশ। নিশীথের বলা কথাগুলো যেন সেই অন্ধকারকে আরও বেশি গাঢ় করে তুলছে, এর কারণ যদিও সে জানেনা, জানতেও চায় না। এইমুহুর্তে শুধু একটু একা থাকতে চায়, একদম একা।
ক্রমশ_____________
© স্বত্ব সংরক্ষিত
নিশীথ আগরওয়াল নির্দ্বিধায় নিজের মনের কথা জানিয়ে দিয়েছে কুহেলিকে। কিন্তু কুহেলি…. সে কি মেনে নিতে পারবে? মনের যে দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে নিয়েছে সেটা কি নিশীথের জন্য খুলবে? নাকি অন্যকিছু অপেক্ষা করছে কুহেলির জন্য? কি মনে হয় আপনাদের আমাকে জানাবেন কিন্তু। আমি কিন্তু আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় থাকি। খুব ভালোলাগে আপনাদের প্রতিক্রিয়া পেলে। আর হ্যা, আর একটা প্রশ্ন আপনাদের কাছে, এই লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট কি সত্যিই হয়? এই প্রশ্নটার উত্তর হিসেবে আপনাদের মতামত পেলে খুব খুশি হব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।