সংগোপনে’ পর্ব-৫৯অন্তিম_পর্ব

0
5560

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫৯
#অন্তিম_পর্ব
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

সকাল থেকে আজ ওঙ্কার ভিলায় সাজো সাজো রব পড়ে গেছে, বাড়ি ভর্তি লোকজন। শৈলজা দেবী, চৈতালী দেবী, চিরন্তন, দেবাঞ্জলি, চৈতী দেবী, দিঠি, দিঠির বাবা অনিমেষ বাবু কে নেই? শুধু কুহেলির দাদু স্বরূপ বাবু আসেননি, কারণ উনি এতোটা জার্নি সইতে পারেন না। আর এদিকে আলেখের বুয়া মেহের জী আর ওনার পুরো পরিবার মানে, হরমন জী আর বিহানও রয়েছেন। আলেখের চাচা চাচীও বাদ নেই, মনিন্দর জী, হর্ষিতা জী আর রাজীব, তারাও উপস্থিত, এককথায় গম গম করছে বাড়িটা। সবাই মিলে মেতে রয়েছে দারুন আনন্দে, আর হবে নাই বা কেন! আজ দিনটাই যে বড্ড বিশেষ একটা দিন। আনন্দের মাঝেই কিন্তু সবাই চরম ব্যস্ত, বাড়ির সাজ সজ্জার দায়িত্ত্ব তো রাজীব আর বিহান দেখছে, গোটা ওঙ্কার ভিলা যেন একদম নতুন করে সেজে উঠছে। চিরন্তন আর বাকি পুরুষ সদস্যরাও এদিক ওদিক ঘুরে সব কিছু সামলাচ্ছেন, আর মেহের জী আর হর্ষিতা জী তো সেই যে সকাল সকাল রান্নাঘরে ঢুকেছেন আর বেরোনোর নাম নেননি।সবার কথাই তো হল কিন্তু এখনও কুহেলির কথাই তো হল না, কুহেলি তো যেন সব থেকে বেশি ব্যস্ত। সেই ভোর বেলায় উঠেছে, তারপর থেকে একবার এদিকে দৌড়াচ্ছে তো আবার ওদিকে দৌড়াচ্ছে। এত ব্যস্ততার মাঝে কিন্তু একজনের কোনও কাজ নেই, তিনি শুধু বসে বসে সব দেখছেন। আসলে কাজ ঠিক নেই যে তা নয়, তার যা কাজ ছিল সেটা গতকালই সারা হয়ে গেছে আর এখন বাকি যা কাজ সেগুলো তো বিহান, রাজীব আর বাকিরা মিলেই সামলে নিচ্ছে। সুতরাং এই এত ব্যস্ত মানুষ জনের মধ্যে একমাত্র আলেখের আজ কোনও কাজ নেই, আসলে একটু ভুল বলা হল, একটা দায়িত্ব তার আছে আর সেই কারণেই বাকিরা সবাই মিলে আজকে তাকে অন্য সব কাজের থেকে ছুটি দিয়েছে। তাই আলেখ তো এখন নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে নিজের ঘরে কারণ আপাতত তার দায়িত্বে সাময়িক বিরতি ঘটেছে। বেচারা বেশ বোর হচ্ছে, কিন্তু কি আর করার, তাই চুপচাপ নিজের ল্যাপটপ টা নিয়েই বসে রয়েছে। যতই হোক কাজ পাগল মানুষ বলে কথা, বোর হলেও সেই কাজের কথাই মনে পড়ে। চুপচাপ বসে আলেখ কিছু অফিসিয়াল কাজ দেখে নিচ্ছিল এমন সময় কুহেলি হন্ত দন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল। ঢুকেই সোজা একবার বিছানার দিকে তাকিয়ে তারপর আলেখের কাছে এসে বলল,

আবার কাজ নিয়ে বসে পড়েছ?

আলেখ একটু দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল,

কি করব বলো, আমাকে তো কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। এমনকি নিজের বউটাকে দেখেও তো মনে হচ্ছে না যে তার আমার কথা আদৌ মনে আছে।

কুহেলি আলেখের কাধে একটা আলতো চাটি মেরে বলল,

সবসময় খালি অজে বাজে কথা।

কুহেলি একটু হেসে ওয়ার্ডরোবের কাছে চলে গেল, কিছু একটা খুঁজছে মনে হচ্ছে। আলেখ এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে কুহেলির দিকে, রোজ দেখেও যেন মন ভরে না। প্রতি দিন যেন নতুন করে আবার কুহেলির প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। সবার সঙ্গে এমনটা হয় কিনা জানা নেই কিন্তু আলেখের যেন মনে হয় কুহেলির একটা নতুন রূপ সে রোজ আবিষ্কার করে। আজ এই মুহূর্তে যেমন আবার কুহেলির একটা নতুন রূপের প্রেমে পড়েছে আলেখ। আজ কুহেলি শাড়ি পরেছে, যদিও বিশেষ অনুষ্ঠান ছাড়া সে শাড়ি পরে না কিন্তু আজ পরেছে। হ্যা, আজও একটা বিশেষ দিন, কিন্তু সেই পর্ব তো সন্ধ্যেবেলায়, এখনও তো প্রস্তুতিই চলছে। তবুও আজ কুহেলি একটা হালকা সুতির শাড়ি পরেছে, একদম সাধারণ। বাঙালি গৃহবধূরা দৈনন্দিন দিনচর্যায় যেমন টা পরে থাকেন ঠিক তেমন। চুলগুলো আলগোছে হাতখোপা করে রাখা, কিছু চুল তাও অবাধ্যের মত সেই বাঁধন ছেড়ে কুহেলির মুখের ওপর এসে পড়েছে। শাড়ির আঁচল টা ঘুরিয়ে এনে কোমরে গুজে রেখেছে, এক্কেবারে পাকা গিন্নি যেন। কপালে, খোলা পিঠে এত দৌড়াদৌড়ির ফলস্বরূপ জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এককথায় বলতে গেলে নিতান্ত সাধারণ ঘরোয়া বাঙালি গৃহবধূর রূপ ফুটে উঠেছে আজ কুহেলির অঙ্গে। আর বাকি সকলের কাছে নিতান্ত সাধারণ হলেও আলেখের কাছে এই রূপটাই যেন অনন্য সুন্দর, সাধারণের মাঝেও অসাধারণ। আলেখ ল্যাপটপ টা সরিয়ে রেখে উঠে কুহেলির কাছে এসে পিছন থেকেই ওর ফর্সা মেদহীন পেটে নিজের হাত দুটো রেখে টেনে নিল নিজের বুকের কাছে। আলেখের স্পর্শ গুলো প্রতিবারই কুহেলির সর্বাঙ্গে যেন একটা অদ্ভুত শিহরণের সঞ্চার করে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না, নিজের উন্মুক্ত পেটে আলেখের বলিষ্ঠ হাতের ছোয়ায় যেন আবার নতুন করে শিহরিত হল কুহেলি। আলেখ খুব উপভোগ করে কুহেলির এই শিহরণ টা, ওর প্রত্যেকটা ছোয়ায় যখন কুহেলি তিরতির করে কেপে ওঠে সেই কম্পন যেন আলেখের উত্তেজনা দ্বিগুণ করে তোলে। আলেখ আলতো করে কুহেলির কাধে ঠোঁট জোড়া স্পর্শ করতেই কুহেলি আবারও কেপে উঠল। একটু কম্পিত স্বরেই বলল,

কি.. কি করছ? ছাড়ো আমাকে।

ছাড়া তো অনেক পরের কথা, আলেখ ওর হাতের বাঁধনটা আরও দৃঢ় করে কুহেলির কানের কাছে মুখ এনে মৃদু স্বরে বলল,

এখনও এত লজ্জা পাও কেন বলোতো? অবশ্য তোমার এই লজ্জা মাখা মুখটাই আমার সব থেকে বেশি ভালোলাগে।

কুহেলি চোখ দুটো বন্ধ করে নিল, আলেখের তপ্ত নিশ্বাস ছুয়ে যাচ্ছে ওর কান, গলা। আলেখ কুহেলির কানের লতিতে হালকা একটু ঠোঁটের ছোয়া দিতেই কুহেলির নিশ্বাস যেন ঘন হয়ে এলো। সে নিজেও বুঝতে পারে না, এখনও আলেখের প্রতিটা ছোয়ায় তার শরীরটা এরকম অবশ হয়ে পড়ে কেন। কুহেলি নিজেকে সামলানোর একটা ব্যর্থ চেষ্টা করে বলে উঠল,

আলেখ প্লিজ, ছাড়ো না।

আলেখ কুহেলির গলায় মুখ ডুবিয়ে আলতো ঠোঁটের পরশ ছুঁইয়ে দিতে দিতে নেশা ধরা কণ্ঠে বলল,

উহু, ছাড়ব না। সকাল থেকে একবারও কাছে পাইনি তোমাকে, এত সহজে ছাড়ছি না।

কুহেলি একটু কাতর স্বরেই বলে উঠল,

আলেখ, কেন এরকম করছ? ছাড়ো না, প্লিজ। কত কাজ বাকি পড়ে আছে বলো তো।

কুহেলি নিজেকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেই চলেছে আর আলেখও তার কাজ করে চলেছে। কুহেলির প্রচেষ্টা বন্ধ করার জন্য আলেখ এবার কুহেলিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে চেপে ধরল নিজের সঙ্গে। বেচারি কুহেলির হাত দুটো এখন এমন ভাবে আলেখের বুকের ওপর অবস্থান করছে যে বেচারি চাইলেও তাদের এক চুলও নড়াতে পারছে না। শুধু কি হাত! বেচারি নিজেই তো আর একটুও নড়তে চড়তে পারছে না। এদিকে আলেখের ঈষৎ সবুজ চোখের তারায় খেলছে দুষ্টুমির আভাস। আলেখ এক হাতে কুহেলির কোমরটা শক্ত করে পেঁচিয়ে অন্যহাতে মুখের ওপর এসে পড়া চুলগুলো কানের পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল,

তোমার এই পালাই পালাই স্বভাব টা কবে যাবে বলো তো?

আলেখ কুহেলির এতটাই কাছে রয়েছে যে কুহেলি যেন ওর প্রতিটা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে, উষ্ণ বাতাসের ছোয়ায় যেন মাতাল হয়ে উঠছে মনটা। কিন্তু তবুও কুহেলি নিজেকে বহুকষ্টে সংযত করে অনুনয়ের সুরে বলল,

আলেখ, দরজা টা খোলা রয়েছে, কেউ এসে পড়বে।

আসুক না, ক্ষতি কি? উই আর লিগ্যালি ম্যারেড ডার্লিং। রীতিমত ছাড়পত্র আছে, তোমার সাথে প্রেম করার।

কুহেলি বেশ বুঝতে পারছে তার এখন ছাড়া পাওয়ার কোনও আশা নেই। আলেখের ঠোঁট ইতিমধ্যেই স্পর্শ করেছে কুহেলির ললাট, স্পর্শ গুলো ধীরে ধীরে নামছে। চোখের পল্লব ছুয়ে রক্তিম আভা ছড়ানো গালে নিজেদের পরশ বুলিয়ে এখন তারা এগিয়ে চলেছে ঈষৎ কম্পমান পেলব ওষ্ঠদ্বয়ের দিকে। দূরত্ব যখন প্রায় মিলিয়ে এসেছে ঠিক তখনই একটা কচি গলার কান্নার শব্দে যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে জেগে উঠল দুজনে। কুহেলি বিছানার দিকে তাকিয়ে আলেখের কাছ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে করতে বলল,

এই ছাড়ো, অনু কাদছে।

আলেখও আর বাধা দিল না, কুহেলি এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল তার এক বছরের ছেলে অনু ওরফে আহান কে। কুহেলি তার ছেলেকে কোলে নিয়ে আবার একটু ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। আলেখ ওর পাশে বসে বাচ্চাদের মত মুখ ফুলিয়ে বলল,

তোমার ছেলে আমার রোম্যান্সের শত্রু বুঝলে তো। যখনই একটু তোমাকে কাছে পাই বিচ্ছু টা ঠিক তখনই জেগে যায়।

কুহেলি হেসে বলল,

বা রে, ওকি জেনে বুঝে করে নাকি? আর আমার ছেলে মানে টা কি?

তোমারই তো ছেলে, তুমিই তো চেয়েছিলে একটা সুন্দর ছেলে হবে তোমার। দেখো, তোমার ইচ্ছে টাও পূরণ হয়েছে আর আমাকে জ্বালাতনও করছে।

হুম, তুমি তো আর ওর মায়ের কথা শোনো না, তাই আমার ছেলেই ঠিক আমার পক্ষ নেয়, বুঝলে তো।

আলেখ উঠে গিয়ে খাটের অন্য পাশে বসে বলল,

থাকো তুমি তোমার ছেলে নিয়ে, আমার জন্য আমার প্রিন্সেস আছে, আমার সুইটহার্ট, আমার অলি। আমার প্রিন্সেস আমাকে তোমার থেকেও বেশি বোঝে বুঝলে তো। ওকে দেখেছ কখনও, আমাদের ডিস্টার্ব করতে।

আলেখ ওদের ছোট্ট মেয়ে অলি ওরফে আহেলির মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে বোলাতে কথা গুলো বলল। এদিকে অনু মানে আহান আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, কুহেলি ওকে সন্তর্পণে শুইয়ে দিয়ে বলল,

হুম, কারণ অলি আমার মত হয়েছে আর অনু তোমার মত।

কথাটা বলে কুহেলি আর এক মুহূর্তও দাড়াল না ঘরে, এমনকি কি যে খুঁজতে এসেছিল সেটাও আর না খুঁজেই হাসতে হাসতে ছুটে পালিয়ে গেল। আলেখ বেচারা জোরে ডাকতেও পারল না, তার প্রিন্স আর প্রিন্সেস ঘুমাচ্ছে যে। সকাল থেকে এই দুই মূর্তিমানের দায়িত্ত্ব নিয়ে বসে আছেন মিস্টার আলেখ শর্মা। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে আলেখ আর কুহেলির ঘর আলো করে এই দুই রাজপুত্র আর রাজকন্যার আগমন। একসাথেই আগমন হলেও তবে দুটো মিনিটের হেরফের আছে দুজনের আগমনের সময়ে, আহান পুরো দুমিনিটের বড় আহেলির থেকে। আজ আহান আর আহেলির এক বছর পূর্ণ হল সেই উপলক্ষেই বিরাট এক পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। যেদিন আলেখ আর কুহেলি জানতে পেরেছিল তাদের ঘরে একটা নয় দুটো খুশি একসঙ্গে পা রাখতে চলেছে সেদিন যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল দুজনেই। প্রায়ই তাদের মধ্যে জল্পনা কল্পনা চলত, দুটো প্রিন্স আসবে নাকি দুটো প্রিন্সেস আসবে নাকি একজন প্রিন্স আর একজন প্রিন্সেস আসবে। মুখে যে যাই বলুক না কেন, দুজনেই মন থেকে এটাই চেয়েছিল যেন একটা রাজপুত্র আর একটা রাজকন্যা আসে তাদের ঘরে। ঈশ্বর তাদের এই ইচ্ছে টা আর অপূর্ণ রাখেননি, আর খুব অদ্ভুত ভাবে অলির মুখটা দেখে মনে হয় যেন একদম আলেখের মুখটা বসানো আর অনুর মুখে কুহেলির ছাপ স্পষ্ট। কচি কচি দুটো প্রাণ কে কোলে নিয়ে আলেখের মনে হয়েছিল যেন তার সব পাওয়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধন যেন ঈশ্বর তার হাতে তুলে দিয়েছেন, সে এক অনন্য সুন্দর অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আলেখ সেদিন তাদের ছোট্ট প্রাণ দুটোকে কোলে নিয়ে কুহেলিকে বলেছিল,

দেখেছ তো কুহু, আমাদের দুজনের চাওয়াই পূর্ণ হল, তোমার ছেলে আর আমার মেয়ে।

কুহেলি দুর্বল শরীরেও পরম প্রাপ্তির সুখানুভূতির আবেশ নিয়ে বলেছিল,

আমরা, আজ থেকে সবটাই আমরা, সবটাই আমাদের।

দেখতে দেখতে কোথা থেকে যে দুপুর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে গেল কেউ যেন টেরই পেল না। ইতিমধ্যেই আরও একজন এসে উপস্থিত হয়েছেন, রাত্রি। সে যদিও আগেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু কর্ম ব্যস্ততা এতটাই যে আর হয়ে ওঠেনি। তবে সে যে আসবে এতে কোনও ভুল ছিল না, তার অনু আর অলির জন্মদিনে সে না এসে কি পারে! এসেই সে তার ক্ষুদে দুটোকে নিয়ে বসে পড়েছে, আজকাল তো আলেখ কুহেলির দর যেন সবার কাছেই কমে গেছে। সবাই এখন অনু আর অলিকে নিয়েই ব্যস্ত, এমনকি রাত্রিও তার ব্যতিক্রম নয়। সে তো নিজের দ্বিধা টাও কাটিয়ে উঠেছে, রাত্রির তো বিরাট একটা চিন্তা ছিল এই ক্ষুদে দুটো তাকে কি বলে ডাকবে। হ্যা, সেই সমস্যার সমাধান সে নিজেই করে নিয়েছে, সে ঠিক করেছে অনু আর অলি তাকে রি বলে ডাকবে। শুধু রি, এটা যে কেন আর কিভাবে তার মাথায় এসেছে সে একমাত্র সেই জানে। যাইহোক, এখন রাত্রি নিজে তার অনু আর অলিকে সাজাতে ব্যস্ত। এখন থেকেই খুব অদ্ভুত ভাবে পুঁচকে দুটো রাত্রি কে খুব ভালো করে চেনে আর ওর কাছে খুব ভালো থাকে। তবে শুধু রাত্রিই নয়, আরও একজন কিন্তু এসেছে, নিশীথ। দুপুরের আগেই সে নিজের সব কাজ গুছিয়ে এসে পড়েছে, অলিখিত ভাবে যেন সেও এখন এই পরিবারেই একজন সদস্য, ঠিক রাত্রির মত। আহান আর আহেলিকে নিশীথ খুব ভালোবাসে, সে নিজেও এই পরিবার টার সঙ্গে যেন খুব গভীর ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। কুহেলি আর আলেখ তৈরি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ, আলেখের পরনে আজ একটা গাঢ় নীল রঙের শার্ট আর তার সঙ্গে সাদা রঙের স্যুট। কুহেলি আজ একটা সুন্দর লাল রঙের শাড়ি পরেছে, ব্লাউজটা কালো হওয়ায় যেন আরও সুন্দর লাগছে, তার সঙ্গে মানানসই সাজ তো আছেই। আর আজকের আরেকটা বিশেষ ব্যপার আছে, আজ আহান আর আহেলির ড্রেস দুটোও আলেখ কুহেলির সঙ্গে একদম ম্যাচিং। আলেখের সঙ্গে অলি আর কুহেলির সঙ্গে অনুর পোশাক একদম ম্যাচিং। এইসব কিছুই রাত্রির মস্তিষ্ক প্রসূত, সেই নিজে এই সব কিছু করেছে। সন্ধ্যে সাতটায় পার্টি শুরু হবে, এখনও কিছুটা সময় বাকি আছে কিন্তু নিমন্ত্রিত অভ্যাগতরা ইতিমধ্যেই আসতে শুরু করেছেন। তবে আলেখ আর কুহেলি এখনও পার্টিতে উপস্থিত হয়নি, অতিথি দের রাজীব বিহান আর চিরন্তন মিলে আপায়্যন করছে, আর নিশীথ তো আছেই। আলেখ আর কুহেলি আসবে তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আগে সম্পূর্ণ করার আছে, সেই উদ্দেশ্যেই তারা এখন অনু আর অলিকে নিয়ে এসে দাড়িয়েছে একটা বন্ধ দরজার সামনে। আলেখ আর কুহেলি একবার নিজেদের মধ্যে দৃষ্টি বিনিময় করল, সেই দৃষ্টিতে কোনও দুঃখ বা হতাশা নেই আছে একটা অন্যরকম একটা অনুভূতির প্রকাশ। আলেখ আলতো হাতে বন্ধ দরজা টা খুলে দিল, ছোট্ট অনু আর অলিকে কোলে নিয়ে আলেখ আর কুহেলি প্রবেশ করল ঘরটায়। সুন্দর করে সাজানো একটা ঘর, সারা ঘরের দেওয়াল জুড়ে নানারকম কার্টুন চরিত্রের ছবি, আসবাব পত্র থেকে শুরু করে বিছানা পত্র সবই ঠিক তেমন করেই সাজানো যেমনটা কোনও ক্ষুদে সদস্যর ঘর হওয়া উচিৎ। হ্যা, এটাই সেই ঘর যেটা নভতেজ বাবু নিজে হাতে সাজাতে চেয়েছিলেন, তার জুনিয়র শর্মার জন্য। নাহ, এই ইচ্ছে টা তার অপূর্ণ থাকেনি, এই ঘরটা তিনি নিজের ইচ্ছে মতই সাজিয়েছিলেন তার জুনিয়র শর্মার জন্য, তবে…. তাদের দেখে যেতে পারেননি। নাহ, কোনও যাদু বলে বদলে যায়নি নিয়তিটা, বিধিলিপি মেনেই ফুরিয়েছিল তার আয়ু। তবে এতটুকু তিনিও জানতে পেরেছিলেন যে একজন নয় দুজন জুনিয়র শর্মা আসতে চলেছে। লন্ডন থেকে ফেরার পর ঠিক চারটে মাস ছিলেন তিনি তার আলেখ আর কুহেলির কাছে। তারপরেই ফুরিয়েছিল তার মেয়াদ, তিনি অবশেষে পাড়ি জমিয়েছিলেন তার নিন্নির কাছে। আলেখ দুঃখ পেয়েছিল, একটা অব্যক্ত বেদনায় ছিন্ন ভিন্ন হয়ে হয়ে গিয়েছিল তার অন্তর টা। মায়ের পর বাবাকেও হারানোর যন্ত্রণা টা ঠিক কতটা, সেটা যারা অনুভব করে তারাই একমাত্র বুঝতে পারে। আর কুহেলি, সে তো দ্বিতীয়বার হারিয়েছিল তার বাবাকে, শূন্য স্থান টা আবারও শূন্যই থেকে গিয়েছিল। কিন্তু হাজার কষ্টের মাঝেও তারা ভেঙে পড়েনি, কষ্ট গুলোকেই যেন নিজেদের শক্তি করে গড়ে তুলেছিল। কারণ, তাদের জীবন টা তখন শুধুই তাদের ছিল না, দুটো আসন্ন প্রাণ তাদের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আর তার থেকেও বড় একটা কারণ ছিল। কারণ টা আর কেউ নন স্বয়ং নভতেজ বাবু, হ্যা নভতেজ বাবু। তিনি যতদিন ছিলেন এক মুহূর্তের জন্যও না নিজে মন খারাপ করেছিলেন আর না ওদের করতে দিয়েছিলেন। শরীরের ক্রমাগত অবনতি দেখেও আলেখ আর কুহেলি এক মুহূর্তের জন্যও মন খারাপ করেনি। ভিতরে ভিতরে যন্ত্রণা হলেও বাইরে ফুটে উঠতে দেয়নি কখনও। নভতেজ বাবু বলতেন,
‘এক মুহূর্তও আমি দুঃখে কাটাতে চাই না, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি শুধু হাসতে চাই।’
সেই কথা তিনি রেখেছিলেন, আলেখ আর কুহেলিও সঙ্গ দিয়েছিল তাকে। আর আজও সেই নভতেজ বাবুর একটা কথা মনে করেই আলেখ বা কুহেলি কারোর মুখেই দুঃখের লেশ মাত্রও নেই। নভতেজ বাবু এককথায় ফরমান জারি করেছিলেন বলা চলে, তাকে মনে করে কখনও চোখের জল ফেলা চলবে না। তিনি সবার হাসির মধ্যেই বেঁচে থাকতে চান কারোর চোখের জল হয়ে নয়। নভতেজ বাবুকে শেষ বিদায় দেওয়ার পর সত্যিই আলেখ আর কুহেলি একবারের জন্যও চোখের জল ফেলে নভতেজ বাবুর ইচ্ছের অপমান করেনি। আলেখ আর কুহেলি আহান আর আহেলিকে নিয়ে একটা ছবির সামনে এসে দাড়াল। সুদৃশ্য একটা বিরাট ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবি। এটা সেই ছবিটা, যেটা কুহেলি স্টাডি রুমে দেখেছিল। নভতেজ বাবু আর নন্দিনী দেবীর সুখতম মুহূর্তের একটা সুমধুর স্মৃতি। কুহেলি নিজে হাতে ছবিটা এই ঘরে সাজিয়েছে, তাদের অনু আর অলির সঙ্গে সব সময় যাতে নভতেজ বাবু আর নন্দিনী দেবীর স্নেহাশীষ জুড়ে থাকে। আলেখের মধ্যে একটা খুব অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে, সে আর তার মায়ের স্মৃতি থেকে দূরে থাকে না। তার মায়ের স্মৃতি গুলো আর তাকে দুর্বল করে তোলে না কষ্ট দেয় না, বরং একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করে যেন। নভতেজ বাবু যেন নিজের সঙ্গে আলেখের মন থেকে সেইসব পুরনো দুঃখ কষ্ট গুলোও কোনও এক অলীক উপায়ে নিয়ে গেছেন চিরতরে। আলেখ হাসি মুখে ছবিটার দিকে তাকিয়ে বলল,

ড্যাড, দেখো তোমাদের আহান আর আহেলির আজ এক বছর হয়ে গেল। মম, তুমি দেখেছ তো? জানি তোমরা এখন যেখানেই আছ একসাথেই আছ আর খুব সুখে আছ। আমরাও ভালো আছি ড্যাড… মম। তোমাদের মতই আমরাও খুব সুখে আছি।

কুহেলি আলেখের একটা হাত শক্ত করে ধরে ছবিটার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলে উঠল,

হ্যা ড্যাড, আমরা খুব সুখী। তোমাদের আশীর্বাদ আমাদের সাথে সবসময় আছে আমি জানি। তাও বলছি, ড্যাড.. মম, তোমাদের আশীর্বাদ যেন এভাবেই আমাদের সাথে থাকে। তোমাদের ছোট্ট আহান আর আহেলির ওপর নিজেদের আশীর্বাদের ছায়াটা এভাবেই রেখো।

কিছুক্ষণ ওই ঘরেই কাটিয়ে আলেখ আর কুহেলি আহান আর আহেলি কে নিয়ে নেমে এলো নীচে। ছোট্ট রাজপুত্র আর রাজকন্যা কে পেয়ে সবাই যেন আনন্দে মেতে উঠল, আজ তো এই ক্ষুদে দুটোরই দিন। আলেখ আর কুহেলি দুটো ক্ষুদে ক্ষুদে হাতের ওপর নিজেদের হাত দিয়ে একসাথে কেক কাটল। চারপাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল আনন্দ উচ্ছ্বাসের কলোরোল। ওঙ্কার ভিলায় যেন আজ নতুন করে সুখের সঞ্চার হয়েছে, প্রতিটা মানুষের মনে যেন শুধুই সুখের বাস, ঠিক যেমন নভতেজ বাবু চেয়েছিলেন। ওরা সবাই এইভাবেই হাসি খুশিতে মেতে উঠুক, শুধু আজকের জন্য নয় সারাটা জীবনের জন্য। উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠুক ওদের এই সুখী পরিবারের সুমধুর চিত্র টা। আলেখ আর কুহেলি হয়তো কখনও ভাবতেও পারেনি ওরা কখনও এক হবে, ভালোবাসবে একে অপরকে, পূর্ণ হবে ওদের সংসার। কিন্তু জীবন যে কার জন্য কি রচনা করে চলে সবার অলক্ষ্যে কেউ জানে না। নিয়তির হাতে সংগোপনে আঁকা হতে থাকে আমাদের জীবনের জলছবি। সেই জলছবির রেখা চিত্র ফুটিয়ে তুলতে নিমিত্ত হয় কোনও বিশেষ একজন। আলেখ আর কুহেলির জীবনে সেই বিশেষ ব্যক্তি টি ছিলেন নভতেজ বাবু। ওনার জন্যই তো নিয়তির সংগোপনে রচিত ওদের জীবন কাহিনী বাস্তবায়িত হল। তবে আরও একটা প্রসঙ্গ উত্থাপন যে এখনও বাকি.. নিশীথ আর রাত্রি। ওদের ভবিষ্যত্ জীবন নিয়েও তো এখনও চলছে প্রশ্নের আনাগোনা। তবে সব সম্পর্কের কি আর সুমধুর পরিণতি হয়? নিশীথ আজও একইভাবে ভালোবাসে কুহেলিকে, নিঃস্বার্থ নিষ্কাম সেই প্রেম কে সন্মান করেই রাত্রিও মনের গভীরেই ভালোবেসে চলেছে নিশীথ কে। ভালোবাসা নাই বা পেল পূর্ণতা তাতে কি! বন্ধুত্ব তো আছে। সময়ের সাথে আরও গভীর হয়েছে সেই বন্ধুত্ত্ব, নিশীথ আর রাত্রি এখন শুধু মুখে বলার জন্য নয় সত্যিই অন্তরঙ্গ বন্ধু। অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে তাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে সেটা জানা নেই, তবে এই মুহূর্তে বন্ধুত্বের রংটাই না হয় উজ্জ্বল হয়ে উঠুক। বাকিটা তো আছে সময়ের হাতে, সময় হলেই জানা যাবে নিয়তি তাদের জন্য কোন কাহিনী রচনা করে রেখেছে সংগোপনে।

সমাপ্ত

একটু সময় নিয়ে বাকি কথা টুকুও পড়বেন।

এতদিন এই দীর্ঘ যাত্রায় আপনাদের ভালোবাসা কে পাথেয় করেই এগিয়েছিলাম। আমার প্রথম রচনা “মন জানে” এর মতই “সংগোপনে” কেও সিক্ত করেছেন নিজেদের ভালোবাসায়। আলেখ কুহেলি নিশীথ রাত্রি কখন যেন আমার থেকে আমাদের হয়ে উঠেছিল বুঝতেই পারিনি। ধন্যবাদ দেব না, ফিরিয়ে দেব অফুরান ভালোবাসা। অনেকটা ভালোবাসা রইল আপনাদের সবার জন্য এভাবে আমার পাশে থাকার জন্য। আমি দুর্বল হলেও কঠিন সময়ে আপনারা আমাকে দুর্বল হতে দেননি। এভাবেই আগামীতেও পাশে থাকবেন তো? কেমন লাগল এই কাহিনী অবশ্যই জানাবেন কিন্তু, আজ তবে আসি ফিরে আসব খুব তাড়াতাড়ি নতুন একটা গল্প নিয়ে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here