সংগোপনে’ পর্ব-৫৭

0
2311

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৫৭
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

নিশীথ নিজেই ড্রাইভ করছে গাড়িটা, নিজে খুব একটা ড্রাইভিং না করলেও আজকের কথা টা আলাদা। নিশীথের পাশের প্যাসেঞ্জার সিটে রয়েছে আলেখ আর পিছনে রাত্রি আর কুহেলি। নিশীথ সঠিক আন্দাজ করেছিল, মারণ ব্যাধি বলতে আজও সবার মনে আগেই ক্যান্সারের নামটাই আসে। তাই একটা চেষ্টা করেছিল মাত্র, আর তার চেষ্টা যে বিফলে যায়নি সেটা সকালের ফোনকলের মাধ্যমেই পরিষ্কার হয়ে গেছে। নিশীথ ড্রাইভ করতে করতেই বলল,

রিল্যাক্স আলেখ, বেশি টেনশন করবেন না। আমি বলেছিলাম তো, আমরা খুব তাড়াতাড়ি ওনার ইনফরমেশন পেয়ে যাব। এখন যখন আমরা জানতে পেরেছি উনি কোথায় আছেন তখন তো আর কোনও চিন্তা নেই।

আলেখের চিন্তাটা তাও কমল না, আসলে ঠিক চিন্তা নয় একটা অদ্ভুত মিশ্র অনুভুতি, যেখানে আছে ভয়, আশঙ্কা, উত্তেজনা। কুহেলি আর রাত্রি দুজনেই চুপচাপ বসে ছিল, কুহেলি হঠাৎ নিশীথের এইভাবে আলেখকে নাম ধরে সম্বোধন করায় কিছুটা অবাক হল কিন্তু এখন সেদিকে মন দেওয়ার মত পরিস্থিতি নয়। রাত্রি একটা জুসের ক্যান কুহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

কুহেলি এই জুস টা খেয়ে নাও, তোমার কিন্তু এখন খালি পেটে একদম থাকা উচিৎ নয়। তোমার তো এখন কোনরকম স্ট্রেসও নেওয়া উচিৎ নয় কিন্তু সিচুয়েশন টাই তো অন্যরকম। বাট না খেয়ে থেকো না, খেয়ে নাও এটা, নিজের জন্য নাহলেও……

রাত্রি কথাটা শেষ করল না। তখন নিশীথ ব্যস্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই বলেছিল ওদের তৎক্ষণাৎ বেরোতে হবে। নভতেজ বাবুর খোজ পাওয়া গেছে শুনে কারোর আর অন্য কোনও দিকে কোনও খেয়ালই ছিল না। সবাই যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়েছিল কিন্তু রাত্রি ঠিক কুহেলির জন্য একটা জুসের ক্যান সঙ্গে নিয়ে নিয়েছিল। নিশীথের বাড়িতে কোথায় কি আছে না আছে সেটা রাত্রি জানত না, তাই অন্য কিছু নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এটাও তো তাই একজন পরিচারক কে ডেকেই দিতে বলেছিল। কুহেলি বা আলেখ, ওদের বর্তমান মানসিক পরিস্থিতি যা তাতে এখন অন্য কোনও কথা ভাবার পর্যায়ে ওরা নেই কিন্তু তাই বলে তো আর ছোট্ট প্রাণ টাকে কষ্ট দেওয়া যায় না। সেই দায়িত্ব টা তাই রাত্রি আজ নিজের কাধেই তুলে নিয়েছে। সত্যি, জীবনে চলার পথে এইরকম কিছু বন্ধুর সঙ্গ যেন আমাদের জীবন টাকে পরিপূর্ণ করে তোলে। নিশীথ জানত না এই সুখবর টা, রাত্রি যদিও এখন তেমন কিছুই বলেনি কিন্তু নিশীথের বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না। লুকিং গ্লাসের মধ্য দিয়ে একবার তাকাল কুহেলির দিকে, কুহেলি যে ওর জীবনে আরও একটা পরম প্রাপ্তির দিকে এগোচ্ছে এটা জেনে মনে মনে খুব খুশি হল নিশীথ। কিন্তু সেই খুশির সঙ্গে কিছুটা বিষন্নতা যেন আপনা থেকেই মিশে গেল। এত সুন্দর একটা সময়েই এই দুঃসময় টা ঘনিয়ে এলো! একটা দীর্ঘশ্বাস যেন ওর অজান্তেই বেরিয়ে এলো। নিশীথের মনে হল, এই অপূর্ণতা গুলো জীবনে না থাকলে কি এমন ক্ষতি হত? কুহেলি সত্যিই যেন ভুলে গিয়েছিল সে এখন একা নয়, নিজের ওপরেই খুব রাগ হল। কিভাবে ভুলে যেতে পারে সে তার শরীরে বাড়তে থাকা ছোট্ট কুড়ি টাকে? কিন্তু এখানে ওর তো কোনও দোষ নেই, পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে কতক্ষন আর নিজেকে সামলে রাখা যায়! রাত্রি জুস টা কুহেলির হাতে দিয়ে ওর কাঁধে একটা হাত রাখল। কুহেলি একবার রাত্রির দিকে তাকিয়ে জুস টা খেয়ে নিল। জুস টা শেষ করে একবার আলেখের দিকে তাকাল। আলেখ নিজেও যেন কিছুটা অনুতপ্ত, নিজের দুঃখ গুলোর সামনে নিজের ছোট্ট প্রিন্সেস টাকেই ভুলে গিয়েছিল সে! আলেখ লুকিং গ্লাসের মধ্য দিয়ে তাকিয়ে ছিল কুহেলির দিকে। কুহেলি আলেখের চোখের ভাষা পড়তে জানে, আর তার থেকেও বড় কথা সে আলেখের মন পড়তে জানে। এই মুহূর্তে আলেখের মনের অবস্থাটাও যে তারই মত, সেটা আর আলাদা করে বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ছোট্ট লুকিং গ্লাসটায় ফুটে ওঠা কুহেলির গভীর চোখ দুটোর প্রতিবিম্ব যেন আলেখের অশান্ত মনটা কে কিছুটা শান্ত করল। নীরব চোখের ভাষাতেই যেন অনেক না বলা কথারা স্পর্শ করল দুটো হৃদয়। ঠিক কতক্ষন পরে যে গাড়িটা তার গন্তব্যে পৌঁছলো সেটা হয়তো ওদের মধ্যে কেউই জানে না। চারজনে গাড়ি থেকে নামার পরে নিশীথ বলল,

এখানেই আছেন মিস্টার শর্মা।

আলেখ সামনে তাকিয়ে দেখল বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে একটা বহুতল, আই আর সি রয়্যাল হসপিটাল। আলেখের হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে, এখানেই কোনও একটা ঘরে রয়েছেন নভতেজ বাবু। কুহেলির মনের অবস্থাও প্রায় একই, বাবার অভাব টা ছোটবেলা থেকেই ছিল ঠিকই কিন্তু তাকে হারানোর কষ্ট টা পেতে হয়নি তাকে। কাউকে হারানোর যন্ত্রণা টা ঠিক কেমন হয় সেটা বুঝে ওঠার আগেই পিতা নামক ছায়া টা হঠাৎ যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ তো আর সে অবুঝ নয়, নিজেকে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সে কিন্তু ভিতর টা যেন ভেঙে যাচ্ছে। রাত্রি একহাত দিয়ে শক্ত করে কুহেলির একটা হাত চেপে ধরলো, কুহেলিকে সে এক মুহুর্তও একা ছাড়তে চায় না। নিশীথ কাউকে একটা ফোন করেই এগোতে লাগল আর তার সঙ্গে বাকিরাও। রিসেপশনের সামনে যেতেই একজন স্থানীয় যুবক নিশীথের দিকে এগিয়ে এলো, নিশীথ তাকে দেখে বলল,

ব্লেক, ডক্টর ব্রাউন এসেছেন? খোজ নিয়েছ তুমি?

ইয়েস স্যার, আমি খোজ নিয়েছি, উনি এখনও আসেননি তবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন।

গুড, আর পেশেন্টের রুম নম্বর?

ইয়েস স্যার, ওয়ান ওয়ান নাইন, ফোর্থ ফ্লোর।

হুম, কোন ডক্টরের আন্ডারে আছেন উনি?

মেইনলি উনি ডক্টর উইলিয়ামসের পেশেন্ট তবে বর্তমানে একটা স্পেশ্যাল মেডিকেল বোর্ড ওনার ট্রিটমেন্টের দায়িত্বে আছে।

হুম, ওকে ব্লেক গুড জব। ইউ ক্যান গো নাও, তোমারও অনেকটা পরিশ্রম হল।

ইটস ওকে স্যার নো প্রবলেম। বলছিলাম স্যার আজকের মিটিং টা কি….

ক্যানসেল করে দাও, ওনাদের বলবে আমরা ঠিক সময়মত কনট্যাক্ট করে নেব।

ওকে স্যার।

ব্লেক চলে যাওয়ার পর নিশীথ বলল,

আলেখ, আমি কালকে ডক্টর ব্রাউনের সাথেই কথা বলেছিলাম। উনি বি এম আই এর ডিপার্টমেন্টাল হেড, উনিই আমাকে সকালে ফোন করেছিলেন যে মিস্টার শর্মা এখানে রয়েছেন।

আলেখের কানে কতটা প্রবেশ করল বলা যায় না, কারণ ওর এখন অন্য কোনও কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। কতক্ষণে নভতেজ বাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই ভাবছে, কুহেলির মনেও একই উৎকণ্ঠা। আসলে পরিস্থিতি টাই এইরকম, অন্য কোনও কিছুর কথা বোধহয় মনে আসাটাই অস্বাভাবিক। রাত্রিও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন, কিন্তু তার মধ্যেই নিশীথের ব্যবহার দেখে যেন অজান্তেই মুগ্ধ হয়ে গেল। মনের মধ্যে থাকা নিশীথের প্রতি ওর ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর সন্মান সবটাই যেন আরও বৃদ্ধি পেল। ওরা অপেক্ষা করছে ডক্টর ব্রাউনের জন্য, কারণ এখন ভিজিটিং আওয়ার নয় আর ভিজিটিং আওয়ার ব্যতীত কাউকে রোগীর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয় না। এই নিয়ম টা পৃথিবীর সব জায়গাতেই একই, বাড়ির লোক হোক আর যেই হোক নিয়মটা বদলায় না। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিয়মের উলঙ্ঘন হয়েই থাকে কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা একটু মুশকিল। কারণ এতদিন যাবৎ নভতেজ বাবু এখানে রয়েছেন কিন্তু কেউ ওনার বাড়ির লোক বা পরিচিত কাউকেই দেখেনি। আলেখ বা কুহেলি কারোরই যেন আর ধৈর্য্যের বাঁধ অটল থাকতে চাইছে না। তবে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, ডক্টর ব্রাউন মিনিট পনেরোর মধ্যেই চলে এলেন। ডক্টর উইলিয়ামস অর্থাৎ যিনি নভতেজ বাবুর মূল চিকিৎসক তিনি এখন উপস্থিত না থাকলেও কোনও অসুবিধা হল না কারণ ডক্টর ব্রাউন অন্য হসপিটালের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ওনার মত বিশিষ্ট চিকিৎসকের একটা আলাদা প্রতিপত্তি তো থাকবেই। ডক্টর ব্রাউনের সুবাদে ওদের আর ভিজিটিং আওয়ার পর্যন্ত প্রতীক্ষা করতে হল না। নিয়ম উলঙ্ঘন করাটা অনুচিৎ হলেও বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে দাড়িয়ে সেটা আর অনুচিৎ বলে মনে হয় না। তীব্র উৎকণ্ঠার সঙ্গে ওরা ডক্টর ব্রাউনের সঙ্গে এগিয়ে চলল ডক্টর লুইসের কেবিনের দিকে। ডক্টর লুইস ডক্টর উইলিয়ামসের জুনিয়ার, আর যে মেডিকেল বোর্ড টা এখন নভতেজ বাবুর চিকিৎসার দায়িত্বে রয়েছে তার একজন সদস্যও। ডক্টর লুইসের কেবিন সেকেন্ড ফ্লোরে, ওনার কেবিনের সামনে গিয়ে ডক্টর ব্রাউন একবার নক করেই দরজাটা খুলে বললেন,

গুড মর্নিং ডক্টর লুইস, আসতে পারি?

ডক্টর লুইস একটা কেস ফাইল স্টাডি করছিলেন নিজের কেবিনের দরজায় এত সকাল সকাল ডক্টর ব্রাউন কে দেখে একটু অবাক হলেন। তবে এটুকু বুঝতে কোনও অসুবিধা হল না যে ডক্টর ব্রাউন নিজে এসেছেন মানে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ প্রয়োজন হবে। ডক্টর লুইস হাসি মুখে উঠে দাড়িয়ে বললেন,

গুড মর্নিং স্যার, প্লিজ কাম ইন, বসুন।

ডক্টর ব্রাউনের সঙ্গে ওরাও প্রবেশ করল কেবিনে, ডক্টর ব্রাউন কোনও ভনিতা না করেই কথা শুরু করলেন।

লিসেন ডক্টর লুইস আমি একটা বিশেষ প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছি, সেটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝতে পেরেছ।

ইয়েস স্যার।

আমি উইলিয়ামস কে ফোন করেছিলাম বাট হি সেইড দ্যাট হি ইজ আউট অফ্ টাউন রাইট নাও।

ইয়েস স্যার, উনি একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে গেছেন ম্যানচেস্টারে।

ইয়া, আই নো দ্যাট। লিসেন আমি যে কারণে তোমার কাছে এসেছি, তোমাদের একজন ইন্ডিয়ান পেশেন্ট… নিশীথ ওনার নাম টা যেন….

শেষের কথাটা নিশীথের উদ্দেশ্যে ছিল সেটা বলাই বাহুল্য কিন্তু নিশীথ উত্তর দেওয়ার আগে আলেখ উত্তর দিল।

নভতেজ… মিস্টার নভতেজ শর্মা।

ইয়েস, মিস্টার শর্মা। ওনার ফ্যামিলি ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। আমি উইলিয়ামস কে ব্যাপারটা বলেছি, সে বলল তোমার কাছে আসতে।

নো প্রবলেম স্যার বাট আমরা যতদূর জানি ওনার ফ্যামিলিকে তো উনি কিছু জানান নি। ইনফ্যাক্ট আমি নিজেও কয়েকবার ওনাকে বলেছিলাম ওনার ফ্যামিলি কে কনট্যাক্ট করার জন্য বাট এভরি টাইম উনি এড়িয়ে গেছেন।

তারপরেও আমরা জানতে পেরেছি ডক্টর আর সেই জন্যেই ছুটে এসেছি।

কথাটা আলেখ বলেছে, ডক্টর লুইস একটা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে আলেখের দিকে তাকালে কুহেলি বলল,

হি ইজ আলেখ শর্মা অ্যান্ড আই অ্যাম হিজ ওয়াইফ মিসেস কুহেলি আলেখ শর্মা, মিস্টার নভতেজ শর্মা ইজ আওয়ার ফাদার। প্লিজ ডক্টর, আমরা ওনার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

ওকে, নো প্রবলেম, স্যার যখন নিজে পারমিশন দিয়েছেন তখন আমার কোনও আপত্তি নেই।

ডক্টর ব্রাউন এবার একটু কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন,

বাই দ্য ওয়ে, ওনার কি হয়েছে?

গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার।

শব্দ দুটো যেন আলেখের মর্মে গিয়ে আঘাত হানল, আবারও সেই ক্যান্সার, ছিনিয়ে নিতে চাইছে ওর প্রিয় মানুষটা কে।

ওহ, আই সি, ওকে দেন তুমি ওনাদের কে একটু পেশেন্টের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করো।

শিওর স্যার, আসুন আমার সঙ্গে।

ডক্টর লুইস নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেন, ডক্টর ব্রাউনও উঠে দাড়িয়ে বললেন,

ডক্টর লুইস প্লিজ টেক কেয়ার অফ দেম।

শিওর স্যার।

ওকে নিশীথ, আই হ্যাভ ডান মাই জব। নাও আই হ্যাভ টু গো।

থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ডক্টর।

ডোন্ট কল মি ডক্টর, আই ডোন্ট লাইক দ্যাট।

ওকে সরি আঙ্কেল।

গুড বয়, ওকে আই অ্যাম রানিং লেট। নবীনের কথা পরে শুনব তোমার কাছে।

ডক্টর ব্রাউন চলে গেলেন। ডক্টর লুইস ওদের নিয়ে এগোতে লাগলেন নভতেজ বাবুর রুমের দিকে, রুম নম্বর ওয়ান ওয়ান নাইন। ফোর্থ ফ্লোরের একদম শেষ প্রান্তে আলাদা একটা রুম, রুমের সামনে এসে ডক্টর লুইস বললেন,

আসুন।

আলেখের পা দুটো যেন আর চলছে না, পাথরের মত ভারী হয়ে এসেছে, নড়বার শক্তি টুকুও যেন নেই। কুহেলির পরিস্থিতিও প্রায় একই, কিন্তু তাও নিজেকে সংযত করে এগিয়ে এসে আলেখের একটা হাত ধরল। যেন নিঃশব্দে সবার অলক্ষ্যে বলতে চাইল,
ভয় পেও না, পাশে আছি।
বন্ধ দরজার ওপারে রয়েছেন নভতেজ বাবু, ওদের মাঝখানে শুধুমাত্র একটা দরজার ব্যবধান। কিন্তু এই সামান্য ব্যবধান টুকুও যেন সহস্র যোজন মনে হচ্ছে আলেখের কাছে। ডক্টর লুইস ওদের দাড়িয়ে থাকতে দেখে ওদের মনস্থিতি হয়তো কিছুটা আঁচ করতে পারলেন। সারাটা দিন তো তাদের রুগী আর তাদের পরিবারকে নিয়েই কেটে যায়, এইরকম পরিস্থিতি তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। ডক্টর লুইস এগিয়ে এসে আলেখের কাধে একটা হাত রেখে বললেন,

বি স্ট্রং, প্লিজ কাম ইন।

ডক্টর লুইস দরজা টা খুলে প্রবেশ করলেন রুমে, আলেখ আর কুহেলিও কম্পিত পায়ে প্রবেশ করল। রাত্রিও এগোচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ বাধা প্রাপ্ত হয়ে থেমে দাড়াল, পিছন ফিরে দেখল নিশীথ ওর হাতটা ধরে রয়েছে।

এখন যাবেন না।

রাত্রি আর দ্বিতীয় কোনও কথা না বলে পিছিয়ে এল। নিশীথ কেন বাধা দিয়েছে প্রথমে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছে। নভতেজ বাবুর সঙ্গে এই সময়টা আলেখ আর কুহেলির প্রয়োজন, কত কথারা হয়তো জমে রয়েছে। নিশীথ আর রাত্রি বাইরেই রয়ে গেল, আর আলেখ আর কুহেলি ডক্টর লুইসের সঙ্গে প্রবেশ করল রুম নম্বর ওয়ান ওয়ান নাইনে। বিরাট সুসজ্জিত একটা ঘর, মেডিক্যল সরঞ্জাম গুলো না থাকলে হয়তো বিশ্বাস করাই কঠিন হত যে এটা একটা হসপিটালের রুম। ঘরের মাঝখানে একটা মাঝারি মাপের বেড, আর সেই বেডে শুয়ে আছেন নভতেজ বাবু। আলেখের পা জোড়া যেন আবার প্রস্তরে রূপান্তরিত হয়েছে, অন্তরে যেন বেদনা গুলো ঝড় তুলেছে। কুহেলি নিজেকে এই পরিস্থিতির জন্য কিছুটা প্রস্তুত করলেও এতোটা হয়তো আশা করেনি। বিছানায় যে মানুষটা শুয়ে রয়েছেন তাকে চেনা যেন বড্ড দুষ্কর মনে হচ্ছে, এ কি চেহারা হয়েছে তার! কোথায় সেই সৌম্য কান্তি চেহারা? অস্থিসার দেহটার দিকে যেন আর তাকাতে পারল না কুহেলি, ভেঙে পড়ল কান্নায়। আর আলেখ… তার যেন সব অনুভূতি গুলো আরও একবার হারিয়ে গেছে কোনও অজানায়। কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা গেলো না তার মধ্যে, যেন কোনও নির্জীব জড় পদার্থ। ডক্টর লুইস এগিয়ে গিয়ে হাসি মুখে ডাকলেন,

গুড মর্নিং মিস্টার শর্মা, হাউ আর ইউ ফিলিং টুডে?

নভতেজ বাবু চোখ দুটো বন্ধ করে শুয়েছিলেন, ডক্টর লুইসের আওয়াজে চোখ মেলে একটা শীর্ণ হাসি ঠোঁটের কোণে এনে বললেন,

ফাইন ডক্টর, গুড মর্নিং।

উনি আলেখ বা কুহেলি কাউকেই লক্ষ্য করেননি, আসলে ওরা যে এখানে আসতে পারে সেটাই তো ওনার ধারণার বাইরে। ডক্টর লুইস বললেন,

আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে।

নভতেজ বাবু একটু ম্লান হেসে বললেন,

আমার জন্য আর কি সারপ্রাইজ?

নিজেই দেখুন।

ডক্টর লুইস একটু সরে গিয়ে আলেখ আর কুহেলির দিকে ইশারা করলেন। নভতেজ বাবু কোনও রকম উত্তেজনা বা আকর্ষণ ছাড়াই তাকালেন কিন্তু ওদের দেখে যেমন আশ্চর্য্য হলেন তেমনই ভীত হলেন। যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার থেকে এড়ানোর জন্য তিনি সবটা অলক্ষ্যেই রেখে দিয়েছিলেন সেই পরিস্থিতিই তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। প্রতি নিয়ত এই একটা ঘরে আবদ্ধ থেকে ওদের কথাই ভাবতেন তিনি, একটা বার একটু চোখের দেখা দেখতে চাওয়ার ইচ্ছে দমন করেছেন বহুবার। আজ ওদের সামনে দেখে খুশি তিনি হয়েছেন, এতদিন পর নিজের সন্তানদের কাছে পেলে কে না খুশি হয় কিন্তু সেই খুশির থেকেও বেদনার ভার টা অনেক বেশি। কুহেলির চোখের জল আর আলেখের ভাবলেশহীন মূর্তি তিনি যেন সইতে পারছেন না। এই দুঃসহ পরিস্থিতি টাই তো তিনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ডক্টর লুইস একটু এগিয়ে গিয়ে নভতেজ বাবুকে বললেন,

সব কিছু থেকে পালানো যায় না, এক দিন না একদিন থামতেই হয়। আপনি কথা বলুন, আমি আসছি।

যাওয়ার সময় আলেখের কাধে একটা হাত রেখে গেলেন আর তার সঙ্গে ঘরে উপস্থিত নার্সটি কেও তার সঙ্গে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। নভতেজ বাবু ওনার চোখের কোণে জমে থাকা বাষ্প গুলোকে অশ্রুবিন্দু তে রূপান্তরিত হওয়ার আগেই সামলে নিয়ে সেই স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গীতে বললেন,

শেষ পর্যন্ত চলেই এলি? ভাবলাম একটু লুকোচুরি খেলব, সেটাও করতে দিলি না?

আলেখ কোনও কথা বলল না, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে নভতেজ বাবুর জীর্ণ রুগ্ন দেহটার দিকে। নভতেজ বাবু আলেখের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেলেন, কোনও অভিব্যক্তি নেই কেন সেখানে? যে ভয় টা তিনি পেয়েছিলেন, সেটাই হতে চলেছে। আলেখ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে ভিতরে, তাই তো বাইরের আবরণ টা এমন কঠিন হয়ে উঠেছে। বহুকষ্টে নিজের কষ্ট গুলো চেপে রেখে খুব স্বাভাবিক ভাবে যেন কিছু হয়নি এমন সুরে আবারও বললেন,

কবে এলি তোরা?

আলেখ তবু নিরুত্তর, আর কুহেলির চোখে চলেছে নিঃশব্দ অশ্রুবর্ষন। নভতেজ বাবু এবার কুহেলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

এতদিন পর দেখা হল, এভাবে চোখের জল ফেলছ কেন বলতো? তোমার হাসি মুখটাই আমার বেশি ভালোলাগে বেটা।

কুহেলি আর পারল না, ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল শায়িত নভতেজ বাবুকে। চোখের জল গুলো কেমন যেন বেহায়া হয়ে উঠেছে, হাজার বারন সত্বেও বয়েই চলেছে বাঁধভাঙা নদীর মত। নভতেজ বাবুর চোখের কোনা দুটোও ভিজে এলো, তার দুর্বল শীর্ণ একটা হাত কুহেলির মাথায় রেখে বললেন,

কাদছ কেন? চোখের জল গুলো বড্ড দামী, এত সহজে খরচ করো না।

কুহেলি ওনার বুক থেকে মাথা তুলে বলল,

কেন করলে তুমি এটা আমাদের সঙ্গে? কেন?

কি উত্তর দেবেন তিনি এই প্রশ্নের? কেন করেছেন সেটা তো তিনি জানেন, কিন্তু যে কারণে করেছিলেন সেটা আর পূর্ণ হলো কোথায়? সেই তো নিজের ছেলে মেয়ে দুটোকে চোখের সামনে কষ্ট পেতে দেখছেন। কুহেলির চোখের জল টুকু মুছে দিয়ে বললেন,

তুমি কারনটা হয়তো জানো তাই না?

কুহেলি নীরবে ঘাড় নাড়লো, নভতেজ বাবু অল্প হেসে বললেন,

ডায়েরিটা পড়ে ফেলেছ বুঝি?

এবারও কুহেলি শুধুই ঘাড় নেড়ে সায় দিল। নভতেজ বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

খুব কি ভুল করেছিলাম বলো তো?

এবার আর কুহেলির উত্তর দিতে হল না, কারণ উত্তরটা ভেসে এলো আলেখের কাছ থেকে।

নাহ, একদম ভুল করনি তুমি ড্যাড, তুমি একদম ঠিক কাজ করেছ।

নভতেজ বাবু তাকিয়ে দেখলেন আলেখের অনুভূতি হীন চোখ দুটোয় ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে একরাশ বেদনা ক্লিষ্ট অভিমান। কিছু বললেন না তিনি, শুধু একটা আলগা হাসির রেশ নিয়ে চেয়ে রইলেন আলেখের দিকে। আলেখ কঠিন স্বরে বলতে শুরু করল,

তুমি কি ভুল করতে পার? ভুল তো আমরা করেছি, আমি করেছি। আমার তো সবটাই ভুল, তাই তো তোমরা সবাই আমাকে একা করে দিয়ে যেতে চাও।

কুহেলি উঠে দাড়াল, আলেখের একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,

এভাবে বলো না আলেখ, প্লিজ, একবার ড্যা…..

কুহেলির কথা শেষ হল না, আলেখ তার আগেই বলল,

কেন কুহেলি? আমি ভুল কি বলছি? সবাই নিজের মত করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, আমি কিসে কষ্ট পাব আমি কোনটায় আনন্দ পাব সেটাও সবাই নিজের মত করেই ঠিক করে নেয়। কেন? আমি কি….

আলেখের অভিমানী কথাগুলোর মাঝে হঠাৎ নভতেজ বাবু স্মিত হেসে বলে উঠলেন,

এতোটা রাগ করেছিস? একবার ড্যাড বলে ডাকলিও না?

আলেখের এতক্ষণের সংযম, এত কষ্টে ধরে রাখা বাঁধ যেন এই ছোট্ট কথা দুটোয় নিমেষে ভেঙে পড়ল। নোনা জল গুলো আর কোনও নিষেধ মানল না, মুক্ত বারিধারার মত ঝরে পড়তে লাগল। নভতেজ বাবু কষ্ট করে একটু উঠে বসলেন, আলেখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

রাগ অভিমান গুলো না হয় পরে করিস, আগে একটু কাছে আসবি না?

আলেখ দ্রুত পদে এগিয়ে গিয়ে নভতেজ বাবুর বুকে মাথা রেখে দু হাতে জড়িয়ে ছোট্ট ছেলের মত কান্নায় ভেঙে পড়ল। নভতেজ বাবুও উষ্ণ জলকণা গুলো কে রুদ্ধ করার আর কোনও চেষ্টা করলেন না। এতদিন পর তার আলেখকে কাছে পেয়ে তার নিজের মন টাও যেন শত কষ্টের মাঝে কিছুটা শান্তি অনুভব করল। আলেখের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন পরম স্নেহে, সেই স্নেহের স্পর্শ যেন আলেখের মনটা কে শান্ত করার পরিবর্তে আরও তীব্র এক ভয়ের মুখে ঠেলে দিল, হারিয়ে ফেলার ভয়।

ক্রমশ_____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজও কিছু বলব না, মনটা সত্যিই ভারী হয়ে আসছে। আপনাদের মতই আমিও আগামীর অপেক্ষায় রইলাম। তবে আপনারা আবার আজকের পর্বটা কেমন লাগল সেটা না জানিয়েই চলে যাবেন না যেন। আপনাদের মতামত গুলো দেখলেই তো মনটা একটু ভালো লাগে। আজ তবে আসি দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here