সংগোপনে’ পর্ব-১২

0
1602

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১২
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলি ঠিক কতক্ষন ঐভাবে ছাদে দাড়িয়েছিল সেটা নিজেও জানে না। গত একমাসে নিজের মনটাকে শক্ত করে কাজের মধ্যে ডুবে ছিল, একটু একটু করে দেবার্ঘ্যকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ঠিক আগের মতই প্রেম ভালোবাসাকে দূরে সরিয়ে নিজের কাজকে সবার আগে রেখে সেই ছোটবেলার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে আবার এগিয়েছিল। কিন্তু আজ হঠাৎ নিশীথ যেন আবার সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেল, সেদিন দেবার্ঘ্যও আকুল স্বরে বলেছিল,
‘আমি তোমাকে ভালোবাসি কুহু’
কুহেলিও সাড়া দিতে চেয়েছিল সেই ডাকে কিন্তু পারেনি, বুকে পাথর রেখে আবার বন্ধ করে নিয়েছিল মনের দরজা। আজ আবার সেই বন্ধ দরজায় কড়া নাড়ছে নিশীথ, কিন্তু কুহেলি সেই আওয়াজ শুনতে চায় না। ওর জীবনের খাতায় এই প্রেম শব্দটার জন্য কোনও জায়গা নেই, আর কোনদিনও হবেও না। এতদিন পরে দেবার্ঘ্যর কথা মনে করে চোখের কোন দুটো যেন হালকা ভিজে উঠেছিল, ওর সঙ্গে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্ত গুলো একে একে মনে পড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ মেঘ ডাকার আওয়াজে ভাবনার জালটা ছিন্ন হয়ে গেল, যেন প্রকৃতি ওকে সতর্ক করে দিতে চাইল। কুহেলি চমকে উঠে নিজের মনেই বলে উঠল,

এসব কি ভাবছিলাম আমি? আর কেন? আবার দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম আমি! না, আমি আর দুর্বল হব না, কিছুতেই না, কোনমতেই না। শুধু শুধু পিছন ফিরে তাকিয়ে সময় নস্ট করা আমার সাজে না, আর নিশীথ আগরওয়াল হোক বা অন্য কেউ, কারোর জন্যই আমার মনে কোনদিনও আলাদা অনুভূতির সৃষ্টি হবে না, কোনদিনও না।

হঠাৎ একটা বৃষ্টির ফোঁটা কুহেলির হাতের উপর পড়ল, আবার বৃষ্টি শুরু হচ্ছে, কুহেলি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল। নিচে এখন অতিথিদের সংখ্যা অনেক কম, কুহেলি একবার রিস্ট ওয়াচে টাইম দেখল, ইতিমধ্যে সাড়ে দশটা। এবার বাড়ি ফিরতে হবে, এখন না বেরোলে অনেক দেরি হয়ে যাবে, কিন্তু এভাবে না বলে তো আর যাওয়া না। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল আলেখ একটা টেবিলে বসে নিশীথ আর আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলছে। এখন ওখানে গিয়ে কথা বলাটা উচিৎ হবে না কিন্তু দেরীও হয়ে যাচ্ছে, তাও অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। একটা দিকে সরে এসে দাড়াল কুহেলি, কীকরে আলেখের সাথে কথা বলা যায় সেটাই ভাবছিল এমন সময় কোথা থেকে রুহি এসে ওর সামনে দাড়াল। মুখ থেকে অ্যালকোহলের স্মেল আসছে, নেশাও যে হয়েছে সেটা ওর কথা শুনেই বুঝতে পারল কুহেলি।

দি, তুমি এখানে কি করছ? আরে চল ডিনার করবে চল। আমি দুবার ডিনার করেছি জানো তো, চল চল।

বলে কুহেলির হাত ধরে টানতে লাগল, এই জিনিসটাই ওর একেবারে অপছন্দের। কিন্তু রুহিকে এই মুহূর্তে কিছু বলা যে বেকার সেটা খুব ভালো করেই জানে, ডিনারের কথা শুনে মনে পড়ল এখনও ডিনারটা করা হয়নি। আলেখ এখনও কথা বলছে, এই সুযোগে বরং ডিনারটা সেরে নিলে হয়, আজকাল আর কারণে অকারণে খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম করে না কুহেলি। রুহি আরও কি কি সব যেন বলছে, কিন্তু সেদিকে মন দিল না, জানে লাভ নেই। ঝটপট ডিনারটা সেরে নিল, রুহিও ওর সাথে ডিনার করল, কুহেলি ওকে দেখে মনে মনে ভাবল,

কি জানি, সত্যিই আগে দুবার ডিনার করেছে কিনা! এইভাবে বাড়ি ফিরবে কীকরে?

বিদিশা আর রুহির বাড়ি একই দিকে, ওকে বিদিশার সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। খাওয়া শেষ করে বিদিশার খোজ করতে লাগল কুহেলি, একটা দিকে ফোনে কারো একটা সঙ্গে কথা বলছিল। কুহেলি রুহিকে নিয়ে সোজা বিদিশার কাছে গিয়ে উপস্থিত হল, তখন কুহেলি বিদিশাকেও ড্রিঙ্ক করতে দেখেছে কিন্তু তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। আসলে বিদিশা ওর সীমা জানে, অভিজ্ঞতা বলে একটা কথা আছে তো। কুহেলিকে দেখে বিদিশা বলল,

কুহেলি তুমি কোথায় ছিলে? আমি তো ভাবলাম তুমি বেরিয়ে গেছ।

একটু অন্যদিকে ছিলাম, আর এভাবে কীকরে বেরোব, আচ্ছা যেটা বলতে এলাম তুমি বাড়ি ফিরবে কীকরে?

ক্যাব বুক করেছি, কেন?

কুহেলি রুহিকে দেখিয়ে বলল,

ওর হাল দেখ, এইভাবে একা যেতে পারবে নাকি! তুমি তো ঐদিকেই যাবে যদি ওকে একটু পৌঁছে দাও।

বিদিশা রুহির দিকে তাকিয়ে বলল,

কি অবস্থা, এরা কেন যে এত খায়?

রুহি তখনও নিজের মনে বক বক করেই চলেছে। কুহেলি বিরক্ত হয়ে বলল,

খাওয়ার দরকার টাই বা কি?

বিদিশা হেসে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

সবাই তো আর তোমার মত হয়না। তুমি চিন্তা করোনা, আমি ক্যাব ড্রাইভারের সাথেই কথা বলছিলাম, এক্ষুনি এসে যাবে, আমি রুহিকে পৌঁছে দেব।

কুহেলিও হেসে ধন্যবাদ জানিয়ে ওখান থেকে সরে এল, আলেখের টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখল বাকিরা কেউ নেই শুধু আলেখ আর নিশীথ কথা বলছে। যদিও এখন নিশীথের মুখোমুখি হওয়ার একেবারেই ইচ্ছে নেই কুহেলির, কিন্তু আর দেরি করা যায় না, ইতিমধ্যে এগারোটা পেরিয়ে গেছে। কুহেলি ওদের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই দেখল ওরা দুজনও উঠে দাঁড়িয়েছে, একটু কাছাকাছি পৌঁছাতেই শুনতে পেল আলেখ বলছে,

আজকের ইভেন্ট টা সাকসেসফুলি হয়ে গেল, এবার এই নিউ প্রোডাক্ট মার্কেটে কেমন রেসপন্স পায় সেটাই দেখার।

ডোন্ট ওয়ারি মিস্টার শর্মা, আপনি দেখবেন আমাদের এই নিউ প্রোডাক্ট কয়েকদিনের মধ্যেই সব জায়গায় ট্রেন্ডিংয়ে থাকবে।

লেটস হোপ ফর দ্য বেস্ট।

নিশীথ হেসে আলেখের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

ওকে মিস্টার শর্মা, আই হ্যাভ টু গো নাও। গুড নাইট।

আলেখও করমর্দন করে গুডনাইট উইশ করল। কুহেলি ততক্ষণে ওদের কাছে পৌঁছে গেছে, নিশীথ কুহেলিকে দেখে হেসে বলল,

মিস বাসু, গুড নাইট সি ইউ সুন।

কুহেলি অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে গুডনাইট উইশ করল। নিশীথ ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে সেখান থেকে চলে গেল। আলেখ কুহেলিকে বলল,

মিস বাসু আপনি কোথায় ছিলেন? প্রেস কনফারেন্স এর পর আপনাকে আর দেখতে পাইনি।

এখানেই ছিলাম স্যার, একটু অন্যদিকটায়।

ওহ। আপনি ডিনার করেছেন?

ইয়েস স্যার। স্যার বলছিলাম, অনেকটা লেট হয়ে গেছে, এবার কি আমি বাড়ি ফিরতে পারি? আসলে অল্প অল্প বৃষ্টিও শুরু হয়েছে, এখন যদি না বেরোই তাহলে প্রবলেম হবে। এরপর বৃষ্টি বেড়ে গেলে আরো সমস্যা হবে, তাই বলছিলাম যদি…

কুহেলি কথা শেষ করার আগেই আলেখ নিজের রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকিয়ে বলল,

ইয়েস, সত্যিই অনেকটা লেট হয়ে গেছে। আপনার তো আরো আগেই চলে যাওয়া উচিৎ ছিল, এত লেট করলেন কেন?

না, মানে আপনি বিজি ছিলেন, আর আপনাকে না বলে কীকরে যেতাম।

বাট এখন কীকরে যাবেন? ক্যাব বুক করেছেন?

না স্যার, এখন করব।

দরকার নেই, আমিও এখনই বেরোব। আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি।

কুহেলি কোনরকম তর্কের মধ্যে গেল না, জানে শুধু শুধু কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। আলেখ একবার যখন বলেছে তখন সেটাই হবে, তাই চুপচাপ রাজি হয়ে গেল। আলেখ ওকে একটু অপেক্ষা করতে বলে কোথায় যেন গেল, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, আলেখ পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ফিরে এল।

চলুন মিস বাসু, বৃষ্টি এখনও সেভাবে শুরু হয়নি।

কুহেলি আলেখের সঙ্গে হল থেকে বেরিয়ে এল, পার্কিং এরিয়ায় এখন শুধু আলেখের কালো এক্স ইউ ভি টাই দাড়িয়ে রয়েছে। দুজনে গাড়িতে উঠে বসলে, গাড়ির চাকা গড়াল কুহেলির আপ্যারটমেন্টের উদ্দেশ্যে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, একটা ঠান্ডা হাওয়া কুহেলির চোখ মুখ ছুয়ে যাচ্ছে, অল্প অল্প বৃষ্টির ছিটে ওর মুখে এসে পড়ছে। কুহেলির বেশ ভাল লাগছিল, আলতো বৃষ্টির কণা গুলো যেন ওর অশান্ত মনটাকে একটু একটু করে শান্ত করে দিচ্ছিল। চোখ দুটো বন্ধ করে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে উড়ে আসা বৃষ্টির কণাগুলো অনুভব করছিল, হঠাৎ সেগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চোখ খুলে দেখল আলেখ জানালার কাচ বন্ধ করে দিয়েছে। পাশ থেকে আলেখ বলে উঠল,

বৃষ্টির জল গায়ে লাগলে জ্বর আসতে পারে।

কুহেলি কিছু বলল না, আলেখ চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগল। কিছুক্ষণ চলার পরেই বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল, সঙ্গে কান ফাটানো মেঘের ডাক আর বিদ্যুতের ঝলসানি। ধীরে ধীরে বৃষ্টির গতি প্রচন্ড বেড়ে উঠল, সামনের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, সব বৃষ্টিতে আবছা মনে হচ্ছে, ওয়াইপার দুটো সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও কিছু করতে পারছেনা। এই অবস্থায় ড্রাইভ করা খুবই বিপদজ্জনক, আলেখ রাস্তার ধারে একটা বড় গাছের নিচে গাড়িটাকে দাড় করাল। কুহেলি রিস্ট ওয়াচে সময় দেখল, এগারোটা চল্লিশ। কুহেলির এবার সত্যিই বিরক্ত লাগল, এত প্রিয় বৃষ্টির ওপরেও রাগ হতে লাগল, এরকম অসময়ে হওয়ার কি দরকার! এখন কতক্ষন এভাবে মাঝরাস্তায় গাড়ির মধ্যে বসে থাকতে হবে ঠিক নেই। আলেখ বলল,

যতক্ষণ না বৃষ্টিটা একটু কমছে আমাদের এখানেই ওয়েট করতে হবে।

কুহেলি শুধু ছোট্ট করে হুম বলল। বৃষ্টি আপনমনে বেড়েই চলল, তার সাথে পাল্লা দিয়ে মেঘের গর্জন, মাঝে মাঝেই বিদ্যুতের আলোয় চোখ ঝলসে উঠছে। কুহেলি এতক্ষণ বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার হঠাৎ আলেখের দিকে চোখ পড়তেই দেখল আলেখ দুহাতে শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল টা ধরে রয়েছে, ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লাগল, এমন সময় হঠাৎ আবার ভিষন জোরে মেঘ ডাকল, আর মুহুর্তের মধ্যে আলেখের চোখ মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে গেল, হাত দুটো আরও শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল টাকে আঁকড়ে ধরল। কুহেলি অবাক হয়ে ভাবল,

স্যার কি মেঘের শব্দে ভয় পান! উনি কি.. ধুর কিসব ভাবছি আমি! কিন্তু দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। কিন্তু ছেলেরা কি মেঘের ডাকে ভয় পায়? ওয়েট! এগুলো কি অদ্ভুত কথা! ভয়ের সঙ্গে জেন্ডারের কি সম্পর্ক? ভয় তো যে কেউ পেতে পারে, ছেলেরা মেঘের আওয়াজে ভয় পেতে পারে না এমন কোনো রুল আছে নাকি!!

নিজের মনেই একের পর এক বিশ্লেষণ করছিল কুহেলি, আচমকা আবার মেঘ ডাকল। পাশে তাকিয়ে দেখল আলেখ চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়েছে, হাত দুটো এখনো শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল টা ধরে রেখেছে। কুহেলি কি মনে করে আস্তে করে আলেখকে ডাকল,

স্যার।

আলেখ চমকে উঠে কুহেলির দিকে তাকাল, ওর মনে হয় ভয়ের চোটে মনেই ছিল না কুহেলির কথা। আলেখের চোখে মুখে বিব্রতের ছাপ স্পষ্ট, এইভাবে যদি কারো দুর্বলতা অন্যের সামনে চলে আসে তাহলে সবাই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কুহেলি সেটা বুঝতে পেরে ওই প্রসঙ্গেই গেল না, পরিস্থিতি টা একটু হালকা করার জন্য বলল,

স্যার, বলছিলাম আপনার কাছে জল হবে? আসলে গলাটা খুব শুকিয়ে গেছে।

আলেখ সত্যিই একটু স্বাভাবিক হল, একটু হেসে একটা জলের বোতল কুহেলির দিকে এগিয়ে দিল। কুহেলি এতটুকুও তেষ্টা না থাকা সত্ত্বেও খানিকটা জল খেল, খেতেই হত। বোতলটা ফেরত দিতে গিয়ে লক্ষ্য করল আলেখ এখনও বেশ ভয় পাচ্ছে, যতবার মেঘ ডাকছে ততবারই ওর অভিব্যক্তি পাল্টে যাচ্ছে, কিন্তু এবার যেন একটু সতর্ক ভাব, কুহেলির উপস্থিতির কথা মনে করেই বোধহয় এই সতর্কতা। কুহেলির বড্ড অদ্ভুত লাগছে পরিস্থিতি টা, এইভাবে চুপচাপ বসে থাকলে ব্যাপারটা আরও বিব্রতকর হয়ে যাবে। কুহেলি একটু সাহস করেই কথা বলতে শুরু করল,

ইভেন্ট টা সত্যি অন্যসময়ে করলেই হত, এই সময়টায় প্রায় রোজই এরকম ঝড় বৃষ্টি হয়, তাও ভালো ইভেন্ট টা শেষ হওয়ার পর বৃষ্টিটা শুরু হল।

কথাটা শুনে আলেখের চোখ মুখে কেমন যেন একটা বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠল। কুহেলির সেটা চোখ এড়াল না, আলেখ একটু চুপ করে থেকে বলল,

ইউ আর রাইট, দেখতে গেলে এই টাইম টা একদমই ঠিক নয়, সবাই তাই বলবে। কিন্তু আমার জন্য আজকের থেকে বেটার কোনও দিন হতে পারে না।

কুহেলি বুঝতে পারল, প্রসঙ্গ পাল্টাতে গিয়ে ও নিজের অজান্তেই এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলে ফেলেছে যেটা হয়তো ওর বলা উচিৎ হয়নি। আলেখের চোখে একটা প্রচ্ছন্ন কষ্ট দেখতে পেল কুহেলি, একভাবে স্টিয়ারিং হুইল টার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে সেইদিকে তাকিয়েই আলেখ বলল,

আজকে আমার মায়ের জন্মদিন।

এটা শুনে কুহেলি চমকে উঠল, আলেখ শুরু থেকেই এই তারিখটা স্থির করে রেখেছিল, অনেকেই এটা বদলাতে বলেছিল কিন্তু আলেখ রাজি হয়নি। কুহেলি আন্দাজ করেছিল এটা নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ দিন হবে, কিন্তু আলেখ নিজের মায়ের জন্মদিন টাকে বেছে নেবে সেটা আন্দাজ করেনি। কুহেলি জানে মায়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে আলেখ দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই এই মুহুর্তে কিছু না বলে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করল। বাইরে বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত এখনও অব্যাহত রয়েছে, মেঘের গর্জন তো মাঝে মধ্যেই কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু আলেখের এখন সেদিকে মন নেই। আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আলেখ বলতে শুরু করল, যেন একটু হালকা হতে চাইছে,

জানেন মিস বাসু, আজকে পার্টি তে এমন একজনও ছিলেন না যিনি আমার ড্যাডের কথা জিজ্ঞেস করেন নি। সবার মনেই একই কৌতূহল, ওঙ্কার গ্রুপসের এতবড় একটা ইভেন্টে মিস্টার নভতেজ শর্মা কেন উপস্থিত নেই।

সত্যি বলতে এই প্রশ্নটা কুহেলির মনেও যে আসেনি তা নয়। আলেখ বলে চলল,

ড্যাড কেন আসেনি জানেন? কারণ ড্যাড এখন মমের বার্থডে সেলিব্রেট করছে, পাঞ্জাবে আমার ননীহালে। যদিও নানাজী বা নানিজী কেউই আর নেই, আসলে একমাত্র মেয়ের অকাল মৃত্যুর শোকটা টা সহ্য করতে পারেননি। নানাজী মমের ডেথের একমাসের মধ্যে মারা যান, নানিজি হয়তো তার স্বামীর কথা ভেবে শোক টা সামলে উঠতে পারতেন কিন্তু….. দু দুটো আঘাত পরপর মেনে নিতে পারেননি।

কুহেলি চুপচাপ শুনছিল, এখানে তার বলার মত কিছু নেই। আলেখের মায়ের কথাটা জানত, কিন্তু এত কিছু জানত না। কতটা কষ্ট লুকিয়ে আছে মানুষটার বুকে, আলেখ একভাবে বলে চলেছে।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখেছি এভরি ইয়ার মমের বার্থ ডে তে আমরা পাঞ্জাব যেতাম। কোনোদিন এর অন্যথা হয়নি, ইভেন মম চলে যাওয়ার পরেও এটা বদলায় নি। ড্যাড প্রত্যেক বছর এই দিনটায় পাঞ্জাবে গিয়ে মমের বার্থ ডে সেলিব্রেট করে, কিন্তু আমি যাই না। যেতে পারিনি, ওখানে গেলেই আমার সব থেকে প্রিয় মানুষ গুলোর কথা আরও বেশি করে মনে পড়ে।

আলেখের দুই চোখে এখন বাইরের মতই বৃষ্টি নেমেছে। কুহেলি চুপচাপ বসে শুনতে শুনতে যেন হারিয়ে গিয়েছিল ওর শৈশবে, যখন প্রতি নিয়ত নিজের বাবার অভাবটা তীব্র হয়ে উঠত। ভিজে উঠেছে চোখের কোল দুটো, হঠাৎ চারপাশটা বড্ড শান্ত মনে হওয়ায় তাকিয়ে দেখল বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে। পাশে বসা আলেখের চোখে তখনও বর্ষণ অব্যাহত, কব্জিতে বাধা হাতঘড়িতে সময়ের কাটা তখন সাড়ে বারোটা পেরিয়ে গেছে। কুহেলি কিছু না বলে বসে রইল, এই সময়টা আলেখের প্রয়োজন। কিন্তু বাইরের এই হঠাৎ নিস্তব্ধতা বোধহয় আলেখেরও নজর এড়ায়নি, চমকে একবার বাইরে তাকিয়ে কুহেলির দিকে তাকাল। চট করে চোখের জলটা মুছে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,

সরি মিস বাসু, অযথা অনেক কিছু বলে ফেললাম, আসলে…..

কুহেলি আলেখকে মাঝপথেই থামিয়ে দিল, ও জানে অন্যের সামনে নিজের দুর্বল দিকটা প্রকাশ পেলে সবারই একটা অস্বস্তি হয়, আলেখও তার ব্যতিক্রম নয়।

ইটস ওকে স্যার, মাঝে মধ্যে মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট গুলোকে প্রকাশ করতে হয়, নাহলে একটা সময় মনটা গুমোট হয়ে যায়।

আলেখ একভাবে কুহেলির দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল, সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যেটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আবার একবার বিদ্যুৎ চমকাল, হয়তো আবার বৃষ্টির বেগ বাড়বে, আলেখ চমকে কুহেলির দিক থেকে চোখ সরিয়ে ড্রাইভিং এ মন দিল। বাকি রাস্তা টা আর কেউ কোনও কথা বলল না, আলেখ প্রায় ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করতে লাগল। এত রাতে রাস্তা ফাঁকা, তাই স্পিড তুলতে কোনও বাধা নেই, কুহেলি বুঝতে পারছে আলেখ ফিরে বৃষ্টি নামার আগে পৌঁছাতে চাইছে, কিন্তু সেটা বাইরের আকাশে জমা মেঘের বারি বর্ষণ না আলেখের মনের আকাশে জমা মেঘের অশ্রুবর্ষণ, সেটা জানা নেই। আলেখের গাড়িটা যখন কুহেলিকে ওর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তখনও বৃষ্টি নিজের গতি বাড়ায়নি। আলেখ আজ কোনরকমে গুডনাইট উইশ করে চলে গেছে, এক মুহূর্তও বেশি দাঁড়ায়নি, কারনটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। কুহেলি নিজের ফ্ল্যাটে এসে আগে ওয়াশরুমে ঢুকল, যত রাতই হোক বাইরে থেকে আসার পরে স্নান না করলে ওর ঘুম আসেনা। স্নান সেরে নাইট ড্রেস পরে গা টা বিছানায় এলিয়ে দিল, একদিনে কতকিছু হয়ে গেল, নিশীথ আগরওয়ালের কথাটা মনে হতেই একটা বিরক্তি এসে গ্রাস করল কুহেলিকে। মনে মনে ঠিক করেই নিল এখন থেকে যতটা সম্ভব নিশীথ আগরওয়ালকে এড়িয়ে চলবে, অযথা নিজের জীবনে কোনরকম জটিলতা চায় না। মন থেকে নিশীথের কথা গুলো ঝেড়ে ফেলে দিল, চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ঘুম এল না, তার বদলে থেকে থেকে শুধু আলেখের মুখটা ভেসে উঠছে, সবসময় হাসি মুখে থাকা আলেখের এই রূপটা কুহেলি আগে কখনও দেখেনি। নিজের অজান্তেই যেন আলেখের কষ্টটা অনুভব করতে পারছে, চোখের কোনায় কখন যে দুফোঁটা জল চলে এসেছে বুঝতে পারেনি। এভাবেই কখন যে ঘুম এসে নিজের পরশ কাঠি ছুঁইয়ে দিয়ে গেছে সেটাও বুঝতে পারেনি। পরেরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল গীতার ডাকে, আজ রবিবার তাই অ্যালার্ম দেওয়া ছিল না, ঘুম ভেঙে দেখল ইতিমধ্যে নটা বাজে, সেটা হওয়াই যদিও স্বাভাবিক। কালকে ঘুমাতে ঘুমাতে দুটো ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গীতা ওকে ব্রেকফাস্টের জন্য ডেকে আবার নিজের কাজে চলে গেল, কুহেলিও উঠে স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে নিল। গীতার তাড়া থাকে, এখান থেকে আরও দুটো বাড়িতে যায় তাই সাড়ে নটার মধ্যে সব কাজ সেরে বেরিয়ে যায়, আজকেও ঠিক সময়মত বেরিয়ে গেল। কুহেলিও নিয়ম মাফিক কাজ গুলো সেরে বাড়িতে ভিডিও কল করল, আজকে স্ক্রীনে শুধু চৈতালী দেবীকে দেখে একটু অবাক হল, আবার চিন্তাও হল।

মা, ঠাম্মু কোথায়? ঠাম্মুর শরীর ঠিক আছে তো?

চৈতালী দেবী একটু হেসে বললেন,

সব ঠিক আছে, তুই চিন্তা করিস না তো, মা ঘুমাচ্ছে।

এই অসময়ে ঘুমাচ্ছে!!

হ্যা, মানে… আসলে..

চৈতালী দেবীকে ইতস্তত করতে দেখে কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

মা, সত্যি করে বলতো, ঠাম্মু কেমন আছে?

চৈতালী দেবী জানেন কুহেলির সামনে মিথ্যে কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

মায়ের ঘুমটা খুব কমে গেছে, বুকেও মাঝে মধ্যে ব্যথা হয়, তাই নতুন ওষুধ দিতে হচ্ছে। এই অসময়ের ঘুম তারই সাইড এফেক্ট বলতে পারিস।

কুহেলির মুখটা কালো হয়ে গেল, চৈতালী দেবী সব বুঝলেন, তাই মুখে একটা হাসি এনে বললেন,

আরে এতে এত চিন্তা করার কিছু নেই রে, ডক্টর সিংহরায় বলেছেন বয়স হলে এরকম মাঝে মধ্যে হয়।

সত্যি বলছ?

হ্যা রে বাবা, আর আমিও তো ডাক্তার নাকি! তবে কুহু, মা তোকে দেখতে চাইছে কদিন ধরেই। আর তুইও তো বলেছিলি তোর এই প্রজেক্টটা শেষ হলেই কদিন এসে ঘুরে যাবি।

হ্যা মা, যাব। তবে এখনও আমি স্যারকে কিছু বলিনি, কালকে অফিসে গিয়ে কথা বলব। এখন ছুটি পেতে অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না, ছুটি পেলেই চলে যাব। আমারও তোমাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, কতদিন একটু ঠিকমত তোমাদের সাথে সময় কাটানো হয় না।

কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল, কথা শেষ হলে ল্যাপটপ টা রেখে খেতে বসল। খাওয়া সেরে কুহেলি ফোনটা খুলে বসল, এইকদিনে এত ব্যস্ত ছিল যে ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ কোনোটাই সেভাবে চেক করার টাইম পায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে দেখল একগাদা মেসেজের ভিড়, এত মেসেজ পড়তে ইচ্ছে করল না। একটা নাম দেখে সেই মেসেজটা না দেখে পারল না, স্মৃতি, ওর ছোটবেলার বন্ধু। মেসেজটা ওপেন করতেই মুখে একটা হাসি খেলে গেল,

“কুহু, আমি ব্যাঙ্গালোরে এসেছি কালকে। তোকে ফোন করব ভাবছিলাম, কিন্তু তুই কখন যে বিজি থাকিস আর কখন ফ্রী থাকিস তার তো ঠিক নেই, তাই মেসেজ করলাম, যদি দেখা করবি মনে করিস তাহলে কল করিস।“

মেসেজটা পড়েই সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিকে কল করল, স্মৃতি ফোন রিসিভ করেই কলকল করে উঠল,

কুহু, ফাইনালি তাহলে তোর টাইম হল, কখন থেকে ওয়েট করছি তোর কলের।

আরে ছাড় ওসব তুই হঠাৎ ব্যাঙ্গালোরে?

এই তো, মাসি বাড়ি এসেছি, কিন্তু কালকেই চলে যাব।

আরে আজকের দিনটা তো আছিস, আমরা আজকেই মিট করব।

কোথায় মিট করবি বল, আমি তো এখানের তেমন কিছু চিনি না।

আরে চেনার কি দরকার! ক্যাব বুক করবি চলে আসবি। আমি তোকে অ্যাড্রেস মেসেজ করে দিচ্ছি। লেট করবি না কিন্তু।

আমি মোটেও লেট করি না।

থাক, জানা আছে আমার।

আচ্ছা ছাড়, তুই অ্যাড্রেস টা দে।

হুম, পাঠাচ্ছি।

ফোনটা রেখে কুহেলি সেই আইসক্রিম পার্লারের অ্যাড্রেস টা স্মৃতিকে মেসেজ করে দিল। ছোট্ট বেলার বন্ধুদের মধ্যে সবথেকে কাছের ছিল এই স্মৃতি, ওর সঙ্গে দেখা করার আনন্দে কুহেলি বাকি সব কথা ভুলে গেল। সময়মত তৈরি হয়ে পৌঁছে গেল পার্লারে, কিন্তু স্মৃতি সেই পুরনো রেকর্ড কায়েম রেখে আজকেও লেটে এল। কুহেলি ভেবেছিল স্মৃতিকে লেট করার জন্য একটা জব্বর বকুনি দেবে কিন্তু স্মৃতি সেই সুযোগই দিল না। এসেই এমন ভাবে কুহেলিকে জাপটে ধরল, যে পার্লারের বাকি রাও একবার ফিরে তাকাল। কুহেলিকে শেষে একপ্রকার জোর করেই নিজেকে ছাড়াতে হল, তারপর দুই বন্ধু মুখোমুখি বসল। স্মৃতিই কথা শুরু করল,

কুহু, কতদিন পর দেখা হল বলত।

উহু, দিন নয় বছর।

হুম, সত্যিই, দেখতে দেখতে কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল। বল কেমন আছিস?

আমি ভালই আছি, তুই কেমন আছিস বল, অনেকদিন তো মুম্বাই বাসী হয়েছিস। তোর বুটিক কেমন চলছে?

আরে দারুন। কোনোদিন টাইম করে মুম্বাই গেলে যাস, দেখিস এই স্মৃতি চৌধুরীর বুটিক মুম্বাইয়ের বুকে টপে দাড়িয়ে আছে।

অফকোর্স যাব। বাট সেটা পরের কথা, এখন আগে জমিয়ে আইসক্রিম খাই।

দুই বন্ধু মিলে এত দিনের জমানো গল্প একে অপরের সঙ্গে ভাগ করতে করতেই সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হয়ে গেল। স্মৃতি ফিরে গেলে কুহেলিও নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে এল, আজ এত দিন পর স্মৃতির সাথে কথা বলে সময় কাটিয়ে খুব ভালোলাগছে, মনটা একদম তরতাজা লাগছে। স্মৃতির সঙ্গে একেবারে ডিনারটা সেরে এসেছে তাই আগে ফ্রেশ হয়ে সব খাবার গুলো ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখল,। তারপর ফোনে অ্যালার্ম সেট করে শুতে যাবে এমন সময় ফোনে একটা মেসেজ ঢুকল, নিশীথ আগরওয়াল।

“গুড নাইট, মিস বাসু।“

কুহেলি তিনটে প্রশ্নবোধক চিহ্ন সরিয়ে নম্বরটা নিশীথের নামে সেভ করে নিল, একবার ভাবল ব্ল্যাক লিস্টে দিয়ে দেয় কিন্তু পর মুহুর্তেই সেই চিন্তা বাদ দিল, এটা করা কোনও সমাধান নয়। একটা বিরক্তি সূচক শব্দ করে মেসেজটা ডিলিট করে দিল, ঠিক করল আগের মতই উপেক্ষা করবে। আজকে বেশ ভালো মুড আছে এই মেসেজের জন্য সেটা শুধু শুধু নষ্ট করবে না। ফোনটা পাশে রেখে শোয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন যথারীতি সময়মত উঠে রেডি হয়ে অফিসে পৌঁছে গেল, বেশ হালকা মেজাজ সবার। কুহেলি ওর সিটে বসে কাজ শুরু করল, কিছুক্ষণ পর রুহি এল, মুখটা কেমন যেন কালো হয়ে আছে। কুহেলি দেখে বলল,

কি ব্যাপার? মুখটা অমন করে রেখেছ কেন?

রুহি মুখটা নীচু করে বলল,

সেদিন নেশার ঘোরে না জানি কি কি করেছি, আমার কিচ্ছু মনে নেই। সবাই কি ভাববে বলত দি?

এতই যখন চিন্তা তাহলে খেলে কেন?

আরে সবাই খাচ্ছিল, আমারও একটু ইচ্ছে হল তাই খেলাম। বাট নাক কান মুলছি, ওই দিকে আর ভুলেও পা বাড়াব না।

কুহেলি হেসে বলল,

কথা টা মনে থাকলেই হল, এবার কাজে মন দাও, রিল্যাক্স, তেমন কিছু করনি।

কুহেলির কথা শুনে রুহি খুশি হয়ে নিজের কাজে মন দিল। দেখতে দেখতে গোটা দিনটা পেরিয়ে গেল, পাঁচটা বাজলে আস্তে আস্তে অফিস ফাঁকা হয়ে এল, কুহেলিরও তেমন কাজের চাপ নেই তাই ব্যাগ গুছিয়ে বেরোতে গিয়ে মনে পড়ল ছুটির কথাটা বলা দরকার। আলেখের কেবিনে আলো জ্বলছে দেখে এগিয়ে গিয়ে নক করল,

মে আই কাম ইন স্যার?

ইয়েস।

কুহেলি কেবিনে ঢুকে দেখল আলেখ খুব মন দিয়ে কিছু একটা করছে, যেভাবে ওকে দেখতে সবাই অভ্যস্ত ঠিক তেমন। ওকে দেখেই কুহেলির ইভেন্টের দিনের কথা মনে পড়ে গেল। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ যেন, আলেখ কুহেলি কে দেখে হেসে বলল,

মিস বাসু, ডু ইউ নিড এনিথিং?

কুহেলিও হেসে বলল,

ইয়েস স্যার।

প্লিজ হ্যাভ এ সিট।

কুহেলি একটা চেয়ার টেনে বসল।

বলুন মিস বাসু।

স্যার আমার কয়েকদিনের ছুটির প্রয়োজন।

কেন?

আসলে লাস্ট টাইম আমি ঠাম্মু মানে আমার গ্র্যান্ড মাদার কে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে এই প্রজেক্টটা শেষ হলে কটা দিন ওনার সাথে কাটিয়ে আসব, তাই… আর এখন তো তেমন প্রেসারও নেই।

কতদিনের জন্য যেতে চান?

বেশি না, দিন চারেক হলেই যথেষ্ট।

হুম, ওকে ইউ ক্যান গো। তবে নেক্সট মন ডে জয়েন করতে হবে, সো আপনি ডিসাইড করুন কবে যাবেন।

কুহেলি হিসাব করে দেখল বুধবার গেলেই হবে, তাই বুধবার টাই বলল।

ওকে, তাহলে বুধবার থেকে শনিবার এই চারদিনের জন্য একটা লিভ অ্যাপ্লিকেশন অঙ্কিত কে দিয়ে দেবেন।

কুহেলি একটা চওড়া হাসি ফুটিয়ে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

ইউ আর ওয়েলকাম।

কুহেলি আলেখের অনুমতি নিয়ে কেবিন থেকে চলে আসছিল কিন্তু আলেখ আবার ডাকল।

মিস বাসু।

কুহেলি পিছন ফিরে বলল,

ইয়েস স্যার।

আলেখ একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হেসে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ।

কুহেলি অবাক হয়ে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ!! কিন্তু কিসের জন্য?

এমনি। ইউ ক্যান গো নাও।

কুহেলি কিছুটা অবাক হয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল। আলেখ হঠাৎ ওকে থ্যাঙ্কস কেন বলল সেটা বুঝতে পারল না, কিন্তু সেটা নিয়ে এখন মাথা ঘামাল না, অনেকদিন পর ছুটি কাটাতে বাড়ি যাচ্ছে। মনটা আনন্দে ভরে আছে, সোজা বাড়ি ফিরেই আগে লিভ অ্যাপ্লিকেশন টা টাইপ করে অঙ্কিত কে মেল করে দিল। মাঝখানের একটা দিন কোথা থেকে পেরিয়ে গেল টের পেল না, অফিস থেকে ফিরে আগে প্যাকিং করল, যদিও বিশেষ কিছুই নেওয়ার নেই। এবার আগে থেকে গীতাকে বলে রেখেছে, বেচারি আগের বার শুধু শুধু চিন্তা করেছে। সব কাজ সেরে ঘুমোতে যাবে এমন সময় মেসেজ, কে করেছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কুহেলি ওর কথা মতই উপেক্ষা করে চলেছে, ঠিক আগের মতোই মেসেজটা পড়েই ডিলিট করে দেয়। আজকেও সেটাই করল, কালকে সকালের ফ্লাইট, তাই ভোরে উঠতে হবে। আর তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল, তবে বাড়ি যাওয়ার আনন্দে ঘুম আসবে কিনা সে বিষয়ে ঘোর সন্দেহ।

ক্রমশ____________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজ আর কিছুই বলব না, যা বলার আপনারাই বলুন। আমি শুধু আপনাদের কমেন্টের অপেক্ষায় থাকব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here