সংগোপনে’ পর্ব-১৩

0
1795

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৩
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

কুহেলি এবার ওর ছুটির কথা বাড়িতে জানায়নি, কালকেও চৈতালী দেবীর সঙ্গে কথা বলেছে কিন্তু একবারও ছুটির কথা উল্লেখ করেনি। সোজা গিয়ে সারপ্রাইজ দেবে ঠিক করেছে, একদম সঠিক সময়ে ফ্লাইট টা ল্যান্ড করল দমদম এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে ক্যাব নিয়ে বাড়ি পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না, কারণ এখনো বেলা হয়নি, তাই রাস্তায় ট্রাফিকও কম। ইচ্ছে করেই বাড়ির একটু আগেই নেমে পড়ল, হেঁটে এগোনোর সময় মনে একটা আলাদা অনুভুতি হতে লাগল। সাদা রঙের দোতলা বাড়িটা চোখে পড়তেই মনটা আনন্দে নেচে উঠল যেন, আর তর সইছে না, ওকে হঠাৎ এখানে দেখে সবার প্রতিক্রিয়া কেমন হয় সেটা ভেবেই নিজেকে ভিষন উত্তেজিত মনে হচ্ছে। মাত্র সাড়ে আটটা বাজে, ইচ্ছে করেই এত সকালে এসেছে নাহলে চৈতালী দেবী নার্সিংহোম চলে যেতেন। মুখে একটা হাসি নিয়ে কলিংবেল টা প্রেস করে দাড়িয়ে রইল, ভিতর থেকে মান্তুদির আওয়াজ এল, কে কে করতে করতে এগিয়ে আসছে। কুহেলি ইচ্ছে করেই সাড়া দিল না, আর তাতে যে মান্তুদি বিরক্ত হল সেটাও একটা বিরক্তিপূর্ন শব্দে বোঝা গেল, মান্তুদি দরজা খুলেই একটা বিরক্তি সূচক কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সামনে দাড়ানো কুহেলিকে দেখে প্রথমে কিছুক্ষণ হা করে থেকে তারপর হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল,

পিসি, ও পিসি দেখো কে এসেছে। কই গো, পিসি? এসো শিগগিরি, পিসি, ও পিসি।

মান্তু চৈতালী দেবীকে পিসি বলে ডাকে, ওর চেঁচামেচি শুনে চৈতালী দেবী হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলেন। কুহেলি তো হেসেই যাচ্ছে, চৈতালী দেবী কি হয়েছে বলতে বলতে এসে কুহেলিকে দেখে তিনিও অবাক হয়ে গেলেন। তারপর হঠাৎ এসে কুহেলিকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

তুই! হঠাৎ? আয় ভিতরে আয়।

চৈতালী দেবী কুহেলিকে ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে বললেন,

কালকে কথা হল কই কিছু বললি না তো!

বলে দিলে তোমাদের এই মিষ্টি রিয়্যাকশন গুলো দেখতে পেতাম?

হুম, সত্যিই সকাল সকাল মনটা ভালো করে দিলি।

মা, ঠাম্মু কোথায়?

এইসময় তোর ঠাম্মু আর কোথায় থাকবে? ঠাকুর ঘরে আছে। তবে তুই এই বাইরের কাপড়ে আবার ঢুকে পড়িস না যেন।

আরে জানি, তাহলে ঠাম্মুর পুজো হতে হতে আমি বরং ফ্রেশ হয়ে আসি।

তাই যা, এই মান্তু তাড়াতাড়ি জলখাবারের ব্যবস্থা কর।

কুহেলি দোতলায় নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল, এতক্ষণে শৈলজা দেবীর পুজো প্রায় হয়ে এসেছে মনে করে কুহেলি নিচে এসে চুপিচুপি ঠাকুর ঘরে ঢুকল। শৈলজা দেবী একমনে পুজো করছিলেন, কুহেলি ওনাকে বিরক্ত না করে চুপচাপ পিছনে বসে রইল। আরো কিছুক্ষন পর শৈলজা দেবীর পুজো সম্পন্ন হলে কুহেলি যেই ওনাকে পিছন থেকে আচমকা জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনই শৈলজা দেবী পিছন না ফিরেই বলে উঠলেন,

তাহলে সময় হল অবশেষে?

কুহেলি অবাক হয়ে গেল,

তুমি কীকরে টের পেলে? আমি তো একটুও শব্দ করিনি।

শৈলজা দেবী এবার আস্তে আস্তে উঠে ওর দিকে ঘুরলেন, কুহেলিও উঠে দাড়াল। শৈলজা দেবী কুহেলির হাতে প্রসাদ দিয়ে বললেন,

তোর উপস্থিতি বুঝতে আমার চোখের প্রয়োজন হয় না রে।

কুহেলি সঙ্গে সঙ্গে ওনাকে জড়িয়ে ধরল, একটা অদ্ভুত শান্তি অনুভব করল। ছোট থেকেই এই মানুষটা ওর সবথেকে কাছের, এই মানুষটার জন্য ও সব করতে পারে। অনেকদিন পর আজকে আবার ওরা তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছে, চৈতালী দেবী একেবারে নার্সিংহোমে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসেছেন। মান্তু এরমধ্যেই লুচি তরকারি করে ফেলেছে, এইভাবে একসাথে বসে খাওয়া, তাও আবার প্রিয় লুচি তরকারি। কুহেলি মহানন্দে খেতে শুরু করল, চৈতালী দেবী খেতে খেতে বললেন,

তুই আগে বললে আজকে আমি একটু ম্যানেজ করে নিতে পারতাম।

কুহেলি একটুকরো লুচি মুখে দিয়ে বলল,

কেন? ম্যানেজ করার কি আছে, আমি তো আছি কদিন। তুমি কাজ সেরে ফিরলে জমিয়ে বসে আড্ডা দেব।

ধন্যি মেয়ে তুই, এত কাজ পাগল হলি কীকরে? কোথায় তুই বলবি ডে অফ নিতে সেখানে আমি নিজে বলছি আর তুই আমাকে কাজে পাঠাচ্ছিস!

কাজ টা আগে মা।

চৈতালী দেবী একটু হেসে আবার খাওয়ায় মন দিলেন, তার সেদিনের ছোট্ট কুহু এত বড় হয়ে গেছে ভাবলেও অবাক লাগে। খাওয়া শেষ করে চৈতালী দেবী বেরিয়ে গেলেন, কুহেলি ওর ঠাম্মু কে নিয়ে গল্পের ঝুলি খুলে বসল। একদম সেই ছোট বেলার মত, যেন হঠাৎ করেই ফিরে গেল সেই দিনগুলোতে, গল্প যেন আর ফুরোতে চায় না। কিন্তু গল্পের আসরে একটু বিরতি দিতে হল, শৈলজা দেবীর খাওয়া দাওয়া এখন একদম ঘড়ির কাঁটা মেপে। কুহেলির তেমন খিদে ছিল না কিন্তু তাও শৈলজা দেবীর সঙ্গেই খেয়ে নিল, রোজ তো একাই খেতে হয় এই কটা দিন সুযোগ পেয়েছে, হাতছাড়া করার কোনও মানেই হয় না। খাওয়া হয়ে গেলে শৈলজা দেবী ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লেন, এখন চাইলেও উনি জেগে থাকতে পারবেন না, ওষুধের প্রভাবেই ঘুম এসে যাবে। কুহেলিও আর ওনাকে বিরক্ত না করে নিজের ঘরে চলে এল, কত স্মৃতি ছড়িয়ে আছে ঘরটায়। খাটের পাশের জানালাটা খোলা রয়েছে, কুহেলি উঠে গিয়ে কোলবালিশ টা জড়িয়ে জানালার পাশে বসল। আগেও এইখানটায় চুপচাপ বসে সময় কাটাতে বেশ ভাললাগত, দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস ওর নেই তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এখন শুলেও ঘুম আসবে না। তার থেকে এই জানালায় বসে পুরনো স্মৃতিচারণ করাটাই অপেক্ষাকৃত শ্রেয়। জানালার পাশেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, লাল লাল ফুলগুলো খুব ভালোলাগে কুহেলির, গাছটা যখন ফুলে ভরে থাকে তখন যেন রঙের ছটায় চোখ ঝলসে যায়, এখনও গাছটায় ফুল রয়েছে, একটা পাখি মুখে খড় কুটো নিয়ে মনে হয় বাসা বানানোর চেষ্টা করছে, সেইদিকে তাকিয়েই দিব্যি কেটে গেল দুপুরটা। কুহেলি ঠিক করেই রেখেছিল বিকেলে শৈলজা দেবীকে নিয়ে শপিংয়ে যাবে, সেইমত উঠে ওনার ঘরে গেল। শৈলজা দেবী ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন, কুহেলিকে দেখে বললেন,

তুই ঘুমাস নি?

না, আমার দুপুরে ঘুম আসে না। ওসব ছাড়ো, তুমি ঝটপট রেডি হও।

শৈলজা দেবী অবাক হয়ে বললেন,

রেডি! কেন?

আহ্, বড় বেশি কথা বল তুমি, তাড়াতাড়ি রেডি হও।

কিন্তু কেন?

বেরোব।

কোথায়?

সে দেখতেই পাবে।

আমি এখন বেরোতে পারব না, তুই যা। আমার সন্ধ্যে বাতি দিতে হবে।

একদিন তুমি সন্ধ্যে বাতি না দিলে কিছু হবে না, মান্তু দি দিয়ে দেবে।

কুহু, অমন করে হয় নাকি!

হওয়ালেই হয়, এখন উঠে রেডি হও তো।

বলে একপ্রকার ঠেলেঠুলে শৈলজা দেবীকে বিছানা থেকে তুলে দিয়ে নিজে রেডি হতে চলে গেল। শৈলজা দেবীও আর উপায় না দেখে রেডি হয়ে নিলেন, তিনি বেশ ভালো করেই জানেন তার এই নাতনি টির মাথায় একবার কিছু ঢুকলে সেটা না করে নিস্তার নেই। কুহেলি দশ মিনিটের মধ্যে একটা ক্যাজুয়াল জিন্স টপ পরে চলে এল, শৈলজা দেবী সদ্য শাড়িটা পরেছেন। কুহেলি তাড়া দিতে শুরু করল, ওর পাগলামি দেখে শৈলজা দেবী হেসেই অস্থির।

ওরে বাপু দাড়া, বয়স হয়েছে তো, অত তাড়াতাড়ি পারি না। আর এসেই একেবারে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছিস কেন! কালকেই চলে যাবি নাকি?

আরে না, রবিবার যাব। কিন্তু এখন দেরী করলে চলবে না, চল।

খানিক পরে কুহেলির বুক করা ক্যাবে দুজনে মিলে রওনা হল শপিং মলের উদ্দেশ্যে। ক্যবটা শপিং মলের সামনে এসে থামলে শৈলজা দেবী বললেন,

একি এখানে আমি কি করব?

কি করবে মানে! শপিং করবে।

ধুর, তোদের এই মল টলে আমার পোষায় না।

কিন্তু কোনও আপত্তিই ধোপে টিকল না, কুহেলি শৈলজা দেবীকে নিয়ে মলে ঢুকল। এদিক ওদিক ঘুরে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনল, শেষে ফুড কোর্ট থেকে আইসক্রিম খেয়ে তবে বাড়ি ফিরল। একগাদা শপিং করেছে, মলের কোনও দোকান মনে হয় বাদ রাখেনি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই শৈলজা দেবী ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ওনাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করতে দিয়ে কুহেলি নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল, সময়মত চৈতালী দেবী নারসিংহোম থেকে ফিরলেন। এসে এত কান্ড দেখে অবাক, এই মেয়ে আজকে এসেই আবার শপিং ও করে এল! তিনজনে মিলে বসে সব দেখতে লাগলেন, কুহেলি বেশিরভাগ জিনিসই কিনেছে ওর মা আর ঠাম্মুর জন্য। এইভাবেই কোথা থেকে যে সময় পেরিয়ে গেল কেউ টের পেল না, শুধু আজকের দিন নয়, এইভাবে হৈ হৈ করতে করতে আরও দুটো দিন কেটে গেল। চৈতালী দেবী এইকদিন যতটা পেরেছেন তাড়াতাড়ি ফিরেছেন, একদিন নিজে হাতে রান্না করেও খাইয়েছেন। শৈলজা দেবীও রান্না করতে চেয়েছিলেন কিন্তু কুহেলি রাজি হয়নি বরং একদিন ওনার নির্দেশ অনুসরণ করে নিজে রান্না করেছে। সব মিলিয়ে সত্যিই এবারের ছুটিটা ঠিক ছুটির মত করেই কাটাচ্ছে। যদিও এরমধ্যে নিশীথ আগরওয়ালের মেসেজ অব্যাহত রয়েছে, তবে কুহেলিও সেদিকে কোনও গুরুত্ব দেয়নি, নিয়ম মত পড়েছে আর ডিলিট করে দিয়েছে। আজ শনিবার, কালকে কুহেলি চলে যাবে তাই চৈতালী দেবী আজকে ডে অফ নিয়েছেন, সন্ধ্যেবেলায় বসে তিনজনে চা আর পকোড়া সহযোগে তুমুল আড্ডা চালাচ্ছে, বাইরে বৃষ্টিও হচ্ছে, ওয়েদার টাও এক্কেবারে পারফেক্ট। এভাবে গল্প করতে করতে হঠাৎ শৈলজা দেবী বললেন,

কুহু, এবার বিয়েটা কর।

এইরকম একটা কথার জন্য কুহেলি মোটেই তৈরি ছিল না, একটা পকোড়া সদ্য মুখে দিয়েছিল, এই কথায় বিষম লেগে একাকার কান্ড। চৈতালী দেবী জল খাইয়ে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে নিজেকে একটু ধাতস্থ করল কুহেলি। তারপর হেসে বলল,

ঠাম্মু তুমি দারুন ইয়ার্কি করতে পার, কিন্তু তাই বলে খাওয়ার সময়! আর একটু হলেই তো দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

চৈতালী দেবী জানেন কুহেলির প্ল্যানে বিয়ের কোনও জায়গা আপাতত নেই, কিন্তু উনি শৈলজা দেবীর কথাটাও বোঝেন। একবার শৈলজা দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখলেন ওনার মুখটা গম্ভীর হয়ে গেছে, শৈলজা দেবী শান্ত স্বরে বললেন,

আমি মজা করছি না কুহু, এবার সত্যিই বিয়েটা কর। আমার বয়স হয়েছে আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি, তুই…..

কুহেলি ওনার কথার মাঝখানে চিৎকার করে উঠল,

ঠাম্মু, তোমাকে কতদিন বলেছি এভাবে এইসব উল্টোপাল্টা কথা বলবে না, তোমার কিচ্ছু হবে না।

তুই বললেই তো আর সত্যিটা বদলে যাবে না মা, জন্ম নিলে মরতে তো হবেই। আজ হোক কাল হোক সবাইকে মরতে হবে, আর আমার তো সত্যিই বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো থাকে না। তুই তো আমার সব, তাই তোর একটা সুখী সংসার দেখে যেতে চাই, এইটুকু করবি না তুই আমার জন্য?

বলতে বলতে শৈলজা দেবীর চোখের কোনা দুটো ভিজে উঠল, কুহেলিরও চোখ ফেটে জল আসছে, খুব কষ্ট হচ্ছে, এক ছুটে ওখান থেকে নিজের ঘরে চলে এল। চৈতালী দেবী সবটাই বুঝলেন, শৈলজা দেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

মা, তুমি কেদ না, শরীর খারাপ করবে। আমার থেকে ভালো তুমি কুহু কে চেন, একটু সময় দাও, আমি কথা বলব ওর সাথে। আমাদের কুহু এতোটা অবুঝ নয়, তুমি দেখ ও ঠিক বুঝবে, শুধু একটু সময় লাগবে।

শৈলজা দেবী চোখের জল মুছে বললেন,

সময়েরই তো অভাব চৈতালী, কি জানি, আমার হাতে আর কতটা সময় বাকি আছে!

মা, কেন এমন করে বলছ? তুমি ঘরে যাও, একটু বিশ্রাম কর। আমি কুহুর সাথে কথা বলব।

শৈলজা দেবীকে ঘরে পাঠিয়ে চৈতালী দেবী নিজের ঘরে এসে বসলেন, দেওয়ালে টাঙানো অরিন্দম বাবুর ছবিটার দিকে কিছুক্ষন একভাবে তাকিয়ে রইলেন। দুচোখ বেয়ে নেমে আসতে লাগল উষ্ণ জলের ধারা, ছোট থাকতেই মাকে হারিয়েছিলেন তারপর বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় অরিন্দম বাবু চলে যাওয়ার পর শৈলজা দেবী আর কুহু কে আকড়ে ধরেছিলেন। শৈলজা দেবী তার কাছে মায়ের থেকেও অনেক বেশি, ওনাকে হারানোর ভয়টা তাই কুহেলির থেকে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু ওনার এই ভয় টা কারো কাছে প্রকাশ করতে পারেন না, কুহেলি তো ওনার কাছে মনের কথা বলে হালকা হতে পারে কিন্তু ওনার মনের কথা শোনার মত যে কেউ নেই। চোখের জল টা মুছে দোতলায় কুহেলির ঘরে উঠে এলেন, কুহেলি সেই থেকে নিজের খাটের পাশের জানালার ধারে বসে কেদেই যাচ্ছে। ওর সবথেকে কাছের মানুষটাকে হারিয়ে ফেলার কথা চিন্তাও করতে পারে না, আজ শৈলজা দেবীর কথা শুনে কেমন একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে মনে। না, ওসব চিন্তা ও মনেও আনতে চায় না, কিন্তু ঘুরে ফিরে ওই কথাগুলোই কানে বাজছে। চৈতালী দেবী ধীরে ধীরে এসে কুহেলির পাশে বসলেন, কাধে একটা হাত রাখতেই কুহেলি চমকে ওনার দিকে ফিরল। চৈতালী দেবী কখন ওর পাশে এসে বসেছেন ও টের পায়নি, চৈতালী দেবীকে দেখেই ওনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল, চোখের জলগুলো এখনও ঝরেই চলেছে। চৈতালী দেবী পরম স্নেহে কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

জানি, তুই মা কে কতটা ভালবাসিস, আর মা যে তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা তুই আমার থেকেও ভালো জানিস। কুহু আমি জানি তুই খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে, সব বুঝিস, তোকে আলাদা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। সত্যিটা আমরা জানি শুধু মানতে চাই না, মায়ের বলা একটা কথাও কিন্তু অযৌক্তিক নয়, আমাদের সবাইকেই এক দিন না একদিন যেতে হবে। যতই নিষ্ঠুর শোনাক না কেন এটাই সত্যি, আর…..

চৈতালী দেবী বলতে বলতে থেমে গেলেন। তার গলাটা ভারী হয়ে এসেছে, কুহেলি উঠে বসে চৈতালী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

মা, চুপ করে গেলে কেন? আমি জানি এমন কিছু আছে যেটা তুমি আমাকে বলনি।

চৈতালী দেবী কুহেলির একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন,

ডক্টর সিংহরায় বলেছেন মায়ের হার্ট অনেকটাই দুর্বল, সামান্য তম আঘাতও মায়ের জন্য ক্ষতিকর, তাছাড়া বিপি টাও হাই। একবার অলরেডি হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে তাই কোনরকম উত্তেজনা মায়ের জন্য ঠিক নয়।

কুহেলি অনেক চেষ্টা করছে চোখের জলগুলো কে আটকানোর কিন্তু বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। কথাগুলো যেন সব গলার কাছে এসে আটকে গেছে, অনেক কষ্টে বলল,

ঠাম্মু জানে?

না, তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। কুহু, মায়ের কথা টা একবার ভেবে দেখিস, তোর বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে তুইই ওই মানুষটার সব। তোকে সুখী দেখতে চাওয়াটা হয়তো খুব অন্যায় নয়, আমি জানি তুই এখনই এই বিয়ে নিয়ে কিছু ভাবতে চাস না, কিন্তু মায়ের দিকটাও একবার ভাব।

কুহেলি আকুল স্বরে বলল,

মা, আমি তো এখনও সুখী আছি, যে লাইফটার স্বপ্ন দেখেছিলাম সেটা পূরণের পথে এগোচ্ছি। তোমাদের নিয়ে একটা পারফেক্ট লাইফ।

কুহু, তোর চিন্তা আর মায়ের চিন্তা আলাদা, মা তোকে নিজের নাতনি নয় মেয়ে হিসেবেই দেখে, আর সব মায়েরাই চায় তার মেয়ের একটা সুন্দর সাজানো সুখী সংসার হোক।

কিন্তু মা….

আমি তোকে জোর করব না, তুই বড় হয়েছিস, ভাল মন্দের বিচার করার জ্ঞান হয়েছে। তুই যেটা ঠিক মনে করবি সেটাই করবি, শুধু এইটুকুই বলব, যাই করিস না কেন তার আগে একবার তোর ঠাম্মুর কথাটা মনে রাখিস, মানুষটার পুরো জীবন টা জুড়ে কিন্তু তুই ছাড়া আর কেউ নেই, তোর একটা সিদ্ধান্তের উপরে অনেক কিছু নির্ভর করে। আমি বলছি না এখনই বিয়ে করতে হবে বা, আমরা যাকে পছন্দ করব তাকেই বিয়ে করতে হবে। এ বিষয়ে তোর সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে, কিন্তু এবার সত্যি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় হয়েছে কুহু, এরপর তুই যা ভালো বুঝিস।

কুহেলি মাথাটা নীচু করে কিছুক্ষণ বসে রইল, হঠাৎ এমন একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ভাবতে পারেনি, নিজেকে একটু গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। মাথাটা তুলে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল কুহেলি, বৃষ্টিটা এখন আর হচ্ছে না, কিন্তু পরিবেশটা কেমন গুমোট হয়ে রয়েছে হয়তো আবার বৃষ্টি নামবে। কুহেলি বাইরের দিকে তাকিয়েই বলল,

আমাকে একটু ভাবার সময় দাও মা, কথা দিচ্ছি, ঠাম্মুর মনে আঘাত লাগে এমন কিছু করব না।

চৈতালী দেবী কিছু না বলে কুহেলির মাথায় একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। কুহেলি বাইরের দিকেই চেয়ে রইল, ওর ঠাম্মু ওর কাছে সব, ওনার মুখে একটু হাসি দেখার জন্য ও সব করতে পারে। ছোট থেকে নিজের সবটা উজাড় করে দিয়েছেন কুহেলিকে, বিনিময়ে কখনো কিছু আশা করেননি, আজ প্রথমবার তিনি তার কুহুর কাছে কিছু চেয়েছেন, সেটাও ওরই সুখের জন্য। কুহেলির মনে একটা দ্বন্দ্ব চলতে লাগল, যেন ওর মধ্যে দুটো ভিন্ন সত্তা জেগে উঠল।

আমি তো ঠাম্মুর জন্য সব করতে পারি, তাহলে এত ভাবার কি আছে? হ্যা বলে দিতে এত কেন ভাবতে হচ্ছে?
ভাবতে তো হবেই, বিয়েটা কোনও ছেলেখেলা নয়, বললেই করে নেওয়া যায় না।
কেন? একদিন তো বিয়ে করতেই হবে, তাহলে এখন করলে অসুবিধা টা কোথায়? তাছাড়া এখন মানে তো আর কালকেই নয়।
বিয়ে করতেই হবে এমন কোনও কথা নেই, আর আমি বিয়ে করতে চাই না।
কেন? দেবার্ঘ্যর জন্য? অন্য কাউকে দেবার্ঘ্যর জায়গায় বসাতে কষ্ট হবে?
জানি না, হয়তো।
কিন্তু আমি তো ওকে ভুলে যেতে চাই।
ভুলতে চাইলেই কি ভোলা যায়?
কেন? এতদিন তো কোনও যোগাযোগ ছাড়া আছি, ভবিষ্যতেও পারব।
সেটা হয়তো পারব, কিন্তু অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এখানে ভালোবাসার কথা আসছে কেন?
বিয়ে করে একজনকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নেব অথচ তাকে ভালবাসতে পারব না, এটা তো তার সাথে অন্যায় হবে।
তাহলে?
জানিনা।
আমি জানি, কুহেলি বসু স্বার্থপর হয়ে গেছে। নিজের কথাটা ভাবছে, নিজের প্রথম ভালোবাসার কথা ভাবছে, কিন্তু ভুলে যাচ্ছে সেই মানুষটার কথা যার জীবন জুড়ে শুধুই তার কুহু। ছিঃ এত স্বার্থপর?
না, আমি স্বার্থপর নই। আমি ঠাম্মুর জন্য সব করতে পারি, সব।
তাহলে হ্যা বলে দিতে বাধা কোথায়?
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি..
পারবে না, নিজের মনকে পিছনে ফেলে হ্যা বলতে পারবে না, আমি জানি। এটা সেই কুহেলি নয় যে তার ঠাম্মুর জন্য সব করতে পারে, এই কুহেলি স্বার্থপর।
নাআআআ, আমি স্বার্থপর নই।

শেষের কথাটা কুহেলি জোরেই বলে উঠল, ওর সিদ্ধান্ত নেওয়া শেষ। পৃথিবীর কোনো কিছুই ওর ঠাম্মুর খুশির থেকে বড় নয়। চোখের জল মুছে একছুটে নিচে নেমে শৈলজা দেবীর ঘরে ঢুকল, চৈতালী দেবীও সেখানেই বসে ছিলেন। শৈলজা দেবীর চোখের কোণে এখনও জল চিক চিক করছে, সেটা লক্ষ্য করেই কুহেলি দৌড়ে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরল।

আমি খুব বাজে, তাই না ঠাম্মু? আজ আমার জন্য তোমার চোখে জল এল।

শৈলজা দেবী হাসতে হাসতে কুহেলির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

ধুর বোকা মেয়ে, তুই তো আমার মুখের হাসি, তোর জন্য কাদব কেন রে?

কুহেলি সোজা হয়ে বসে বলল,

সরি ঠাম্মু, তোমার দিকটা কখনও ভেবে দেখিনি, নিজের ইচ্ছামত জীবন টা সাজাতে চেয়েছিলাম। আমি… আমি বিয়ে করব ঠাম্মু।

কুহেলির কথা শুনে শৈলজা দেবীর মুখে একটা চওড়া হাসি খেলে গেল, আর ওই হাসিটা দেখে কুহেলির মনে হল, পৃথিবীর সব পাওয়া হয়ে গেছে আর কিছু চাই না ওর। চৈতালী দেবী একটু হেসে বললেন,

দেখেছ তো মা, আমি বলেছিলাম না, আমাদের কুহু অবুঝ নয়।

কুহেলি একবার চৈতালী দেবীর দিকে তাকাল, একটা অদ্ভুত শান্তি দেখতে পাচ্ছে ওই চোখ দুটোয়, যেটা ওর মনটাকেও শান্ত করে দিচ্ছে। শৈলজা দেবী বললেন,

তাহলে এবার তো পাত্র দেখা শুরু করতে হয়, কি বল চৈতালী, নাকি আগে থেকে আমার নাতজামাই ঠিক করা আছে?

শৈলজা দেবীর গলায় মজার সুর, কুহেলিও এবার হাসল। শৈলজা দেবী এবার কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

সত্যি, তোর যদি কাউকে পছন্দ হয়ে থাকে বলতে পারিস, আমি আপত্তি করব না, আমি জানি আমার কুহু যাকে পছন্দ করবে সে নিশ্চয়ই লাখে একজন হবে।

কুহেলির মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল, পছন্দ তো করেছিল, আর হয়তো লাখে একজনই ছিল, কিন্তু…. যেটা ভেবে লাভ নেই সেটা ভেবে সময় নষ্ট করার মানে হয় না। কুহেলি অল্প একটু হাসি ঠোঁটের কোনায় এনে বলল,

ঠাম্মু তেমন কেউ নেই, তবে এত তাড়াহুড়ো করোনা। আমাকে একটু সময় দাও, চিন্তা করোনা, একবার যখন বলেছি তখন কথার খেলাপ করব না।

চৈতালী দেবী বললেন,

ঠিকই তো বলছে কুহু, মা আমারও মনে হয় আমাদের ওকে একটু সময় দেওয়া উচিত। বিয়ের মত একটা ব্যাপার, সব দিক ভেবে চিন্তে এগোনোই ভাল, আর ও যখন একবার বলেছে বিয়ে করবে তখন আর চিন্তার কি আছে।

শৈলজা দেবীও হেসে কুহেলির থুতনি টা নাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

বেশ, তাই হবে। তুই যে রাজি হয়েছিস এতেই আমি খুশি, তুই সময় নে, তবে এই সময় নেওয়ার বাহানায় এই বুড়ি টাকে ফাঁকি দিস না যেন।

শৈলজা দেবীর গলায় আবার মজার সুর। কুহেলি ওনার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

তোমাকে ফাঁকি দিতে পারে এমন কেউ আছে নাকি!

ওদের কথার মধ্যেই মান্তু এসে খেতে ডেকে গেল। কালকেই কুহেলি চলে যাবে, তাই আজ জমিয়ে রান্না হয়েছে। সব চৈতালী দেবী নিজে রান্না করেছেন, রাতের খাওয়াটা তিনজনে একসাথেই সারল। কুহেলি নিজে হাতে শৈলজা দেবীকে ওষুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে গেল। আলো টা নিভিয়ে শুয়ে পড়ল, অনেক চিন্তা মাথায় ভিড় করে আসছে, শৈলজা দেবীর খুশির জন্য বিয়ে করার সিদ্ধান্ত টা নিয়ে তো নিয়েছে কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সহজ! একটা মানুষ যে ওকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে, যার সঙ্গে সারাটা জীবন একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার করবে, তারও তো কিছু চাওয়া থাকবে। খুবই ন্যয্য সেই চাওয়া, স্বামী স্ত্রী যদি একে অপরের পরিপূরক না হয়ে উঠতে পারে তাহলে সম্পর্কটা পরিপূর্ণ হবে কীকরে? কুহেলি বুঝতে পারছে না সে আদৌ এই দায়িত্ব গুলো পালন করতে পারবে কিনা। যে মানুষটা তার জীবনে আসবে তাকে তার প্রাপ্য অধিকার টুকু দিতে পারবে কিনা সে জানে না। ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুকে দেবার্ঘ্যর প্রোফাইলটা ওপেন করল কুহেলি, অনেক বলার পর নিজের একটা ছবি ডিপি তে দিয়েছিল দেবার্ঘ্য। কুহেলিই পছন্দ করে দিয়েছিল, গালে টোল ফেলা হাসি আর ঘুম জড়ানো চোখ দুটো দেখে আজও বুকের বা পাশটায় কেমন একটা দমবন্ধ করা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। ছবিটার উপরে আলতো করে হাত বোলালো কুহেলি, খুব ইচ্ছে করছে একবার ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু না, ফোন বা মেসেজ কোনোটাই করল না। কুহেলি অলীক স্বপ্নের দুনিয়ায় বাস করার মেয়ে নয়, বাস্তব কে মেনে নিতে জানে, তা সে যতই নিষ্ঠুর হোক। ফোনটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিয়ে সাইড টেবিলে রাখা ওদের ফ্যামিলি ফটোটা নিয়ে বুকে জড়িয়ে চোখটা বন্ধ করে নিল। বন্ধ চোখের বাধা উপেক্ষা করে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল নরম বালিশটার উপরে। তবে রাত পেরিয়ে গেলে যেমন সেই অন্ধকারটাও মুছে যায়, তেমনি কুহেলিও নিজের মনের সব চিন্তা, দুঃখ, কষ্টকে একপাশে সরিয়ে খুশিমনে নতুন দিনের শুরু করল। আজকের ছুটির শেষ দিনটা আনন্দের মধ্যে দিয়েই কাটাতে চায়। রবিবার দিনটা এমনিতেই বাঙালিদের কাছে ভালোমন্দ ভোজনের দিন, তার মধ্যে আজ বিকেলের ফ্লাইটে কুহেলি ফিরে যাচ্ছে। আর কবে আসতে পারবে ঠিক নেই, তাই একদম জমিয়ে রান্না হচ্ছে, তিন প্রজন্ম একসাথে রান্নাঘরে, শৈলজা দেবীকে অবশ্য কেউ রান্নায় হাত দিতে দেয়নি উনি শুধু বসে একটু গল্প করছেন, আর মাঝে মাঝে এটা সেটা বলে দিচ্ছেন। হৈ হুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে সময় যেন ঝড়ের বেগে পেরিয়ে গেল, দেখতে দেখতে কুহেলির যাওয়ার সময় হয়ে এল। কুহেলি রেডি হয়ে লাগেজ নিয়ে নিচে এলে শৈলজা দেবী বললেন,

সাবধানে যাবি, আর আমার কথাটা মনে রাখিস কিন্তু। নাতজামাইয়ের মুখ দেখার জন্য আর তর সইছে না আমার।

ঠাম্মু, এখনও তো ঠিকই হল না কিছু, না আমি কাউকে দেখেছি আর না তুমি কাউকে দেখেছ, তাহলে এত নাতজামাই নাতজামাই করছ কেন? কেউ তো জানিই না সে কে?

আরে বাবা কেউ না কেউ তো হবে, তাকে দেখার জন্যই আর তর সইছে না, বুঝলি?

শৈলজা দেবীর মুখের সরল হাসিটুকু কুহেলির মনে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। এখন আর দেরী করা যাবে না, সময় হয়ে এসেছে, শৈলজা দেবীকে প্রণাম করে কুহেলি আর চৈতালী দেবী বেরিয়ে পড়লেন। চৈতালী দেবী নিজে ড্রাইভ করে কুহেলিকে পৌঁছে দিলেন এয়ারপোর্টে, ফ্লাইট একটু লেট তাই দুজনে ওয়েটিং এরিয়ায় বসল। চৈতালী দেবী বললেন,

কুহু, আমি জানি এভাবে হঠাৎ বিয়ের ডিসিশন টা নিতে তোর খুব কষ্ট হয়েছে। আমি আবারও বলছি তোর অমতে কিছুই হবে না, তোর যাকে পছন্দ হবে তার সাথেই তোর বিয়ে হবে। আমাদের তরফ থেকে কোনরকম প্রেসার তোর ওপর থাকবে না, তাই তুই যদি মনে করিস নিজে কাউকে পছন্দ করবি সেটাও করতে পারিস, আর যদি মনে করিস তাহলে আমাদেরও বলতে পারিস, তেমন কাউকে পছন্দ হলে নাহয় তোকে বলব, লাস্ট ডিসিশন তুই নিবি।

মা, আমি এখনই এত তাড়াহুড়ো করে কিছু বলতে চাই না। একটু সময় দাও, আমি ঠিক তোমাদের জানাব, বাকি পছন্দ অপছন্দের কথা নাহয় পরে হবে।

চৈতালী দেবী হেসে কুহেলির গালে হাত ছোয়ালেন, এর মধ্যে ফ্লাইটের অ্যানাউন্সমেন্ট হয়ে গেল, কুহেলি চৈতালী দেবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফ্লাইট বোর্ড করল। মাঝাকাশে উড়োজাহাজের গর্ভে বসে কুহেলির মনে হল হঠাৎ করে জীবন টা কেমন যেন জটিল হয়ে গেছে। কালকে রাতের পর থেকে ফোনে হাত দেওয়ার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনোটাই হয়নি, ফ্লাইট মোড অন করার সময় দুটো মেসেজ নজরে এসেছিল, কিন্তু নামটা দেখে আর পড়ার ইচ্ছে হয়নি। এখন কি মনে হতে মেসেজ দুটো ওপেন করল, একটা কালকে রাতে পাঠানো “গুডনাইট” আর অন্যটা এই ঘন্টাখানেক আগে পাঠানো “হ্যাভ এ সেফ জার্নি।“ অভ্যাসমত মেসেজ দুটো ডিলিট করে দিল। এটাও কেমন যেন রোজনামচার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে। ইয়ারফোন টা লাগিয়ে মিউজিক প্লেয়ার টা অন করে সিটে মাথা হেলিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করল কুহেলি, এখনও দেড় ঘণ্টার পথ বাকি। কুহেলির ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে আটটা পেরিয়ে গেল, গীতাকে বলাই ছিল তাই রাতের খাবার রান্না করে রেখে গেছে, অতএব ডিনারের চিন্তা নেই। ফ্ল্যাটে ঢুকেই আগে কুহেলি বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিল, তারপর স্নান সেরে একেবারে একটা হালকা নাইটসুট পরে নিল। মাত্র নটা বাজে এখনই খেতে ইচ্ছে করল না, সোফায় বসে টিভি টা অন করল, চ্যানেল সার্ফ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেল, এতগুলো চ্যানেলের মধ্যে একটাতেও তেমন দেখার মত কিছু নেই। শেষে বিরক্ত হয়ে টিভিটা বন্ধ করে উঠতে যাচ্ছে এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল, স্ক্রীনে ভেসে ওঠা নামটা দেখে কুহেলি বেশ অবাক হল, সঙ্গে একটা বিরক্তিও ভর করল। একবার ভাবল বাজুক, রিসিভ করবে না কিন্তু তারপর ভাবল সেটা অভদ্রতা হয়ে যায়, শেষমেশ ফোনটা রিসিভ করেই ফেলল,

হাই মিস বাসু, আই হোপ আপনাকে ডিস্টার্ব করিনি।

কুহেলি নিজের বিরক্তিটা বুঝতে না দিয়ে বলল,

নো স্যার, ইটস ওকে।

মিস বাসু, আই থিঙ্ক অফিসের বাইরে আপনি আমাকে নিশীথ বলে ডাকতেই পারেন, আসলে এই স্যার সম্বোধনটা শুনতে খুব একটা ভালোলাগে না।

কুহেলির বিরক্তিটা ক্রমেই বাড়ছে, তবুও সেটাকে যতটা সম্ভব সংযত করে কুহেলি বলল,

সরি স্যার, আই ডোন্ট থিঙ্ক সো। আর আমি যতদূর জানি, বাকিরাও আপনাকে স্যার বলেই অ্যাড্রেস করে।

ইয়েস, ইউ আর রাইট। বাট ইউ আর ডিফরেন্ট ফ্রম দেম।

সেটা আপনার ধারণা, আমার কাছে উই অল আর সেম।

মিস বাসু আমি….

নিশীথ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুহেলি মাঝপথেই বলে উঠল,

স্যার আমার মনে হয় আপনার তেমন কিছু বলার নেই, আর আমার মতে ওয়ার্ক রিলেটেড আলোচনা অফিস আওয়ারেই হওয়া উচিত। তাই ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড এখন ফোনটা রাখছি, আমার ডিনারের সময় হয়ে গেছে।

মিস বাসু, আমি যে এখন ওয়ার্ক রিলেটেড আলোচনা করার জন্য ফোন করিনি সেটা বোধহয় আপনি বুঝতে পেরেছেন।

সরি স্যার, আমার মনে হয় কাজের বাইরে কোনও কথা বলার মত সম্পর্ক আমাদের নয়।

নিশীথ খুব ধীরে বলল,

সেটাই তো গড়তে চাইছি।

হোয়াট?

বলছি কথা না বললে সম্পর্ক টা তৈরি হবে কীকরে? একে অপরকে চেনার জন্য কথা বলাটা ভিষন জরুরি।

কুহেলির এবার অসম্ভব রাগ হতে লাগল, এবার আর নিজের বিরক্তি বা রাগ কোনটাকেই লুকানোর চেষ্টা করল না,

আর আমি যদি বলি আমি আপনাকে চিনতে চাই না, আপনার সঙ্গে কোনরকম সম্পর্ক গড়ে তুলতে আমি বিন্দুমাত্র আগ্রহী নই, তাহলে?

নিশীথ খুব শান্ত ভাবে বলল,

আগ্রহ আজ নেই, কালকে হতেও তো পারে। এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় না, আর আমি লক্ষ্যে না পৌঁছে হাল ছাড়তে ভালোবাসি না।

কুহেলির আর কথা বলতে ভালোলাগছে না। নিশীথ আগরওয়াল যে এত সহজে হার মানার পাত্র নয় সেটা কুহেলি জানে। চোখ দুটো বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

স্যার, অ্যাম রিয়েলি ভেরি টায়ার্ড, আমি রাখছি, গুড নাইট।

নিশীথ কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে লাইনটা ডিসকানেক্ট করে দিল। হঠাৎ করে জীবনে একসাথে এত জটিলতা আসবে এটা কুহেলি কোনদিনও ভাবেনি। সশব্দে ফোনটা সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বিরক্তির কিছুটা বহিঃপ্রকাশ করে কুহেলি খাবার গরম করতে চলে গেল। ডিনারটা সেরে চুপচাপ শুয়ে পড়ল, আর কিছু ভাবতে ভালোলাগছে না। পরেরদিন সকালে ঠিক নিয়ম মত উঠে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ল, কাজই ওর সব সমস্যার একমাত্র সমাধান, একবার কাজে ডুবে যেতে পারলে আর অন্যকিছুর কথা মনেও আসবে না। অফিসে ঢুকে দেখল এখনও তেমন কেউ আসেনি, যদিও এখনও টাইম হয়নি। নিজের ডেস্কে বসে এইকদিনের পেন্ডিং কাজ গুলো দেখে নিচ্ছিল। অবশ্য এখন চাপ তেমন একটা নেই, তাই কাজও খুব বেশি নেই, সময় হতেই একে একে সবাই আসতে শুরু করল, রুহি এসে একদফা বকবক করে নিল। ডট আটটায় আলেখ অফিসে ঢুকল, সবার সঙ্গে কুহেলিও উঠে দাড়িয়ে গুডমর্নিং উইশ করল কিন্তু অদ্ভুত ভাবে আলেখ কারো দিকে না তাকিয়ে কোনও কথা না বলে সোজা নিজের কেবিনে চলে গেল। ব্যাপারটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে অফিসের সবাই কেমন হতভম্বের মত দাড়িয়ে রইল, আলেখ প্রতিদিন সবার উইশের উত্তর দেয়, মুখে না বললেও অন্তত একটা হাসি তার ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকে কিন্তু আজ সেই হাসিটুকুও ছিল না। সবাই খুব অবাক হয়েছে কিন্তু তারজন্য কাজ ফেলে দাড়িয়ে থাকা যায় না, সবাই যার যার কাজে মন দিল। কিন্তু অফিসে একটা চাপা আলোচনা চলতে লাগল এটা নিয়ে, কুহেলিরও যে একটা কৌতূহল হচ্ছে না তা নয় কিন্তু এভাবে গসিপ করা ওর পছন্দ নয়। যাই হোক, সবাই যে যার কাজের মধ্যে ছিল হঠাৎ অফিসে নিশীথ আগরওয়ালের আগমনে আবার একটা চাপা গুঞ্জন উঠল, নিশীথ আগরওয়াল কখনও উইদাউট নোটিশে এভাবে আসেননি, তাও আবার একা, এমনকি ওনার সেক্রেটারি উমেশও নেই সঙ্গে। কুহেলির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিশীথ একটা হাসি ছুড়ে দিয়ে গেল, যেটা ওর মোটেই ভালোলাগল না। কিছুক্ষণ পরেই আলেখের কেবিনে ওর ডাক পড়ল, অনুমতি নিয়ে ভিতরে ঢুকলে আলেখ ওকে বসতে বলে সোজা কাজের কথায় গেল।

মিস বাসু, এই এক সপ্তাহেই আমাদের প্রোডাক্ট মার্কেটে নম্বর ওয়ান পজিশনে পৌঁছে গেছে, তাই মিস্টার আগরওয়াল একটা নতুন ডিল করার কথা ভাবছেন।

কুহেলি একবার নিশীথের দিকে তাকাল, সেই হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে রেখেছে। কুহেলি এবার চোখ ফিরিয়ে আলেখের দিকে তাকাল, হাসিটা ঠোঁটে লেগে আছে বটে কিন্তু সেটা যে মেকি তা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। একটা নতুন ডিল হতে চলেছে, এটা নিঃসন্দেহে খুব ভালো খবর কিন্তু আলেখের মুখে খুশির লেশমাত্রও নেই, এটা একদমই স্বাভাবিক নয়। এবার নিশীথ কথা বলল,

এই প্রজেক্টটা এতোটা সাকসেস ফুল হওয়ায় আমার মনে হয়েছে আমাদের একসাথে আরো কাজ করা উচিৎ। এই নতুন প্রজেক্টটা আমার মাথায় অনেক আগেই এসেছিল কিন্তু নানা কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি বাট এবার আমি এটা করতে চাই।

ওরা তিনজনে বসে বেশকিছুক্ষণ ধরে নতুন প্রোজেক্ট নিয়ে আলোচনা করল, কুহেলিরও মনে হল প্রজেক্টটা বেশ ভালো। আলোচনা শেষ হলে নিশীথ বলল,

সো, হোয়াট ডু ইউ থিঙ্ক মিস্টার শর্মা?

এটা নিঃসন্দেহে খুবই ভালো একটা প্রজেক্ট। আই থিঙ্ক আমাদের এটা নিয়ে একটা প্রপার মিটিং করা উচিত।

ওকে, তাহলে আপনি মিটিংয়ের ডেট ফিক্স করুন, আমি আজকে তাহলে আসি, আর সরি এভাবে না বলে চলে আসার জন্য, আসলে আইডিয়া টা হঠাৎ করেই আজকে সকালে মাথায় এল, আর আমি আজকে বিকেলের ফ্লাইটে ইউ এস যাচ্ছি, দুদিন পরে ফিরব। লেট করতে চাইছিলাম না, তাই না বলেই চলে এলাম, হোপ ইউ ডোন্ট মাইন্ড।

আলেখ বলল,

একদমই নয়, আমি তাহলে মিটিংয়ের ডেট টা ফিক্স করে আপনাকে কালকের মধ্যেই জানিয়ে দেব।

গ্রেট, তাহলে এখন আমি আসছি।

বলে নিশীথ উঠে দাড়াল, কুহেলি আর আলেখও উঠে দাড়াল। আলেখ বলল,

হ্যাভ এ সেফ জার্নি।

নিশীথ থ্যাঙ্কস বলে হঠাৎ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

মিস বাসু ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনি কি আমাকে আমার গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসতে পারবেন?

কুহেলি এটা শুনেই আগে আলেখের দিকে তাকাল, এমনিতেই সকাল থেকেই আজ আলেখের ব্যবহার কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে কুহেলির। এখন যেন আবার মনে হল আলেখের মুখটা মুহুর্তের জন্য গম্ভীর হয়ে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

মিস বাসু, আপনি মিস্টার আগরওয়ালকে এগিয়ে দিয়ে আসুন।

এরপর আর আপত্তি করার কোনও জায়গা থাকে না। নিশীথ আলেখের সঙ্গে হ্যান্ডসেক করে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল, কুহেলিও ওর সঙ্গেই বেরিয়ে এল। লিফটে উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বাটন প্রেস করে চুপচাপ একপাশে দাড়িয়ে রইল, নিশীথের দিকে না তাকিয়েও বেশ বুঝতে পারছে নিশীথ একভাবে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তি কর, কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। হঠাৎ নিশীথ বলে উঠল,

মিস বাসু, আপনার আমার সঙ্গে কথা বলতে কি কোনও প্রবলেম হয়?

কুহেলি আচমকা এই প্রশ্নে চমকে উঠে বলল,

সরি?

না, আমার মনে হয় আপনি আমার সাথে ঠিক কথা বলতে চান না।

কথাটা ঠিকই কিন্তু সেটা তো আর বলা যায় না, তাই একটু ইতস্তত করে বলল,

না… মানে.. আসলে…

কুহেলির কথা শেষ হওয়ার আগে নিশীথ হঠাৎ কুহেলির দিকে এগোতে লাগল, এটা দেখে কুহেলি একটু ঘাবড়ে গেল। এমনিতেই ও একটা পাশে সরে দাঁড়িয়েছিল তাই আর সরার জায়গা নেই, নিশীথ কিন্তু ওর খুব কাছে এল না, কিছুটা এসে দাড়িয়ে গেল। একটু তাকিয়ে থেকে বলল,

মিস বাসু, আপনি মনে হয় আমার কথাগুলো সিরিয়াসলি নেননি। হয়তো ভাবছেন, এটা আমার হঠাৎ জাগা একটা শখ, বাট ট্রাস্ট মি মিস বাসু, আই রিয়েলি লাভ ইউ। একটা সুযোগ কি আমাকে দেওয়া যায় না?

কুহেলির এবার আর বিরক্তি এল না, বরং কেমন একটা খারাপলাগা কাজ করতে লাগল, নিশীথের কথায় একটা আকুল অনুনয়ের সুর শুনতে পেল। কুহেলি একটু নরম স্বরে বলল,

স্যার আপনি কেন বুঝতে চাইছেন না, আপনি যেটা চাইছেন আমি সেটা আপনাকে দিতে পারব না।

কিন্তু কেন? আমি তো…

নিশীথ কথাটা শেষ করতে পারল না, লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে পৌঁছে গেছে। কুহেলি লিফট থেকে বেরিয়ে এল, নিশীথও বেরিয়ে এসে কুহেলির পাশে দাঁড়াল।

মিস বাসু আমি কথা অসম্পূর্ণ রাখতে ভালোবাসি না, আপনার খুব অসুবিধা না থাকলে কিছুটা সময় দিতে পারবেন আমাকে?

কুহেলিও ব্যাপার টা মিটিয়ে নিতে চাইছিল, কিন্তু এখন অফিস আওয়ারে এইভাবে… ওর মনের ভাবটা বুঝতে পেরে নিশীথ বলল,

ডোন্ট ওয়ারি, মিস্টার শর্মা কিছু বলবেন না আপনাকে, উনি তো জানেন আপনি আমার সঙ্গে আছেন।

কুহেলি আর আপত্তি করল না, এই বিল্ডিংএর গ্রাউন্ড ফ্লোরেই একটা ছোট্ট কফি শপ আছে, সেখানেই বসল দুজনে। নিশীথ বলতে শুরু করল,

মিস বাসু, আপনি কেন আমাকে একটা সুযোগ দিতে চাইছেন না?

কুহেলি একটু চুপ করে থেকে বলল,

কারণ আমি আপনার ভালোবাসার বদলে আপনাকে কিছুই দিতে পারব না।

আপনাকে কে বলেছে আমি ভালোবাসার বদলে আপনার কাছ থেকে কিছু চাই? আমি শুধু আপনার সঙ্গ চাই, সারা জীবনের জন্য।

কুহেলি অবাক হয়ে গেল, কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল নিশীথের দিকে। নিশীথ আবার বলল,

আমি আপনাকে আমাকে ভালবাসতে বলছি না, জানি আপনার পক্ষে তাকে ভুলে যাওয়াটা হয়তো পসিবল নয়। ট্রাস্ট মি মিস বাসু আমি আপনাকে ভুলতে বলছিও না, আমি একবারও বলছি না আপনার মনে তার জায়গাটা আমাকে দিতে কিন্তু অ্যাটলিস্ট আমাকে একটা সুযোগ তো দিতেই পারেন। বন্ধুত্ব দিয়ে আমাদের সম্পর্ক টা তো শুরু করা যেতেই পারে, হয়তো একদিন আমার ভালোবাসায় আপনিও বাধ্য হবেন আমাকে ভালোবাসতে।

নিশীথ কথাগুলো যে মন থেকে বলছে সেটা বুঝতে কুহেলির কোনও অসুবিধা হল না। আর সেটাই ওর কাছে আরও অস্বস্তিকর হয়ে দাড়িয়েছে, নিশীথ ওর কাছে কিছু প্রত্যাশা না করলেও ও জেনে বুঝে এটা কীকরে করবে? একটা মানুষ যে ওকে ভালোবাসতে চাইছে তাকে জেনে বুঝে ও ঠকাতে পারবে না। কুহেলি খুব ধীর অথচ স্থির কণ্ঠে বলল,

স্যার, আমি আপনাকে মিথ্যে আশা দিতে চাই না, আমি কোনদিনও আপনার ভালোবাসার যোগ্য মূল্য দিতে পারব না। সে সামর্থ্য আমার নেই, তাই আমার মনে হয় এই বিষয়টার এখানেই ইতি হওয়া উচিৎ।

নিশীথ কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে একটু হেসে বলল,

মিস বাসু, আমি কখনও ভাবিনি আমাকে কেউ এভাবে রিজেক্ট করবে, বাট দ্যাটস দ্য রিজন, এই জন্যই আপনি বাকিদের থেকে আলাদা। অন্যরা যেটা করার কথা ভাবতেও পারে না আপনি সেটা অনায়াসে করে ফেলেন। আমি আপনাকে কথা দিলাম মিস বাসু, যতদিন না আপনি চাইবেন এই বিষয় নিয়ে আপনার সঙ্গে আমি কোনও রকম কথা বলব না। তবে এটার মানে কিন্তু এই নয় যে আমি আপনাকে ভালোবাসা বন্ধ করে দেব, দ্যাটস নট পসিবল, আপনাকে ভালোবাসা থেকে আপনি আমাকে আটকাতে পারবেন না। আমি লাইফে কখনও আশা ছাড়িনি, আজও ছাড়ব না। একটা রিকোয়েস্ট করব আপনাকে?

বলুন।

ভালোবাসা নাহয় নাই দিলেন, বন্ধুত্ত্ব টা তো দিতে পারেন।

বলে নিশীথ একটা হাত কুহেলির দিকে বাড়িয়ে দিল। কুহেলি কি করবে বুঝতে পারল না, চুপচাপ তাকিয়ে রইল, নিশীথ আবার বলল,

এটুকু তো চাইতেই পারি, আপনার মত একজন কে বন্ধু হিসেবে পেলে নিজেকে খুব লাকি মনে করব। আমার এই ইচ্ছে টা কি পূরণ করা যায় না?

কুহেলি এখনও নিশীথের বাড়িয়ে দেওয়া হাত টার দিকে তাকিয়ে আছে, নিশীথের এই চাওয়া টুকু সে পূরণ না করে পারল না। অল্প একটু হেসে নিশীথের হাতটা ধরল, নিশীথ কুহেলির হাতটা ধরে বলল,

থ্যাঙ্ক ইউ। ডোন্ট ওয়ারি, আপনি না চাওয়া পর্যন্ত আমাদের সম্পর্ক টা বন্ধুত্বেরই থাকবে। দ্যাটস মাই প্রমিস।

তারপর কুহেলির হাতটা ছেড়ে নিজের ঘড়ি দেখে নিশীথ উঠে দাড়াল, কুহেলিও সেইসঙ্গেই উঠে পড়ল। নিশীথ বলল,

এবার আমাকে যেতে হবে।

কুহেলি নিশীথ কে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিল। নিশীথ গাড়িতে উঠে বলল,

সি ইউ সুন মিস বাসু, বাই।

নিশীথের গাড়িটা চলে যাওয়ার পর কুহেলি অফিসে ফিরে এল, নিজের চেয়ার টায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। হঠাৎ করে ওর জীবনে যেন একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই চলেছে, কিন্তু কুহেলি তখনও জানে না আরও একটা ঘটনা অপেক্ষা করে রয়েছে ওর জন্য। কাজের মধ্যে দিয়ে বাকি সময়টা কেটে গেল, পাঁচটা বাজে, বাড়ি ফেরার জন্য নিজের ব্যাগটা গুছিয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছে এমন সময়ে অঙ্কিত এসে জানাল ওকে আলেখ ডাকছে। খবরটা দিয়ে অঙ্কিত অফিস থেকে বেরিয়ে গেল, বাকিরাও মোটামুটি সবাই চলে গেছে, দু এক জন ছাড়া। কুহেলি ওর ব্যাগটা আবার ডেস্কে রেখে আলেখের কেবিনে গিয়ে নক করল। ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেয়ে কুহেলি কেবিনে ঢুকল, আলেখ একভাবে একটা ফাইল দেখছে, মুখটা এখনও কেমন যেন গম্ভীর হয়ে রয়েছে। আলেখ চোখ তুলে কুহেলিকে দেখে বলল,

মিস বাসু, আপনি একটু বসুন। আপনাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাওয়ার আছে, আমি এই ফাইলটা কমপ্লিট করে বেরোব।

কথাগুলো আলেখ কেমন যেন আদেশের সুরে বলল, এর আগে ওর গলায় এই সুরটা কখনও শোনেনি কুহেলি। কিছু বলার বা জিজ্ঞেস করার সাহস হল না, চুপচাপ একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। একটু পরেই আলেখের কাজ শেষ হয়ে গেলে ওরা বেরিয়ে পড়ল, গাড়িতেও কুহেলি চুপ করেই রইল, কারণ আলেখ এখনও তেমনি গম্ভীর হয়েই রয়েছে। মুখের সেই হাসিটা না থাকায় কেমন যেন অচেনা লাগছে এই আলেখকে। কিছুক্ষণ পর গাড়িটা একটা জায়গায় থামল, আলেখ গাড়ি থেকে নামল। কুহেলিও নেমে দেখল এটা সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্ট টা যেখানে আলেখ আগে একদিন ওকে নিয়ে এসেছিল। আজ হঠাৎ এখানে আবার কেন নিয়ে এল সেটা কুহেলি অনেক ভেবেও বুঝতে পারল না। রেস্টুরেন্ট টা আজকেও ফাঁকা তবে পুরোপুরি নয়, দুচারজন আছে আজকে, আলেখ সেই টেবিলটা তেই বসল, কুহেলিও ওর উল্টোদিকের চেয়ারে বসল। আজকে আলেখ অর্ডার করল, কুহেলিকে জিজ্ঞেস করেই করল,

কি খাবেন মিস বাসু?

আলেখের গাম্ভীর্যের সামনে কুহেলি কোনরকম তর্ক করার সাহস পেল না, কোনরকমে বলল,

ভেজ নুডলস।

আলেখ দু প্লেট ভেজ নুডলসের অর্ডার দিয়ে দিল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না, কুহেলি কিছু বলার সাহস পেল না আর আলেখ… সে যেন এখন কোনও এক গভীর চিন্তার সাগরে কিছু একটা খুঁজছে। কুহেলির খুব অদ্ভুত লাগছে, আলেখের এহেন ব্যবহারের কোনও কারণ অনেক ভেবেও খুঁজে পেল না। কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছে না, খুবই অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। এরমধ্যেই একটা ছেলে এসে ওদের অর্ডার সার্ভ করে দিয়ে গেল, আলেখ নিজের প্লেট টা টেনে নিয়ে কুহেলিকেও খাওয়া শুরু করতে বলল। কুহেলি নিজের প্লেট টা টেনে নিয়ে কিছুটা নুডলস চামচে পেচাতে পেচাতে আলেখের দিকে তাকাল। এখনও কিছু একটা ভাবছে, হাতের চামচ টা দিয়ে শুধু নুডলস গুলো নাড়া চাড়া করছে। কুহেলি কিছুই বুঝতে পারছে না, হঠাৎ আলেখের এমন কি হল? আর ওকেই বা এখন এখানে নিয়ে আসার মানে কি? এসব ভাবতে ভাবতেই কুহেলি নুডলস সমেত চামচ টা মুখের কাছে নিতে গিয়েও একটা কথা শুনে থেমে গেল। না, থেমে গেল বলাটা বোধহয় ঠিক হল না, থমকে গেল। কথাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত যে চামচ সমেত কুহেলির হাতটা শুন্যেই থেমে রইল। কথাটা বলেছে আলেখ, অনেকক্ষণ ধরে ভাবনার সাগরে ডুবে থেকে যেন হঠাৎ জেগে উঠে বলল,

মিস বাসু, উইল ইউ ম্যারি মি?

ক্রমশ___________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজকে মহাপর্ব দিয়েছি। দৈর্ঘ্যের দিক দিয়েও আর কাহিনীর দিক থেকেও। কি মনে হচ্ছে আপনাদের? কুহেলি নিজের ঠাম্মুর কথা ভেবে বিয়েতে মত দিলেও আদৌ কি নিজেকে বিয়ের জন্য তৈরি করতে পারবে? আর এই নিশীথ, কুহেলিকে কথা দিয়েছে তার অনিচ্ছায় আর কোনদিনও কুহেলিকে নিজের ভালোবাসা মেনে নিতে বাধ্য করবে না, কিন্তু সত্যিই কি তাই? নিশীথ কি সত্যিই শুধু কুহেলির বন্ধু হয়ে থাকবে? আর সবার শেষে আলেখের এহেন অদ্ভুত আচরণ আর সর্বোপরি ওর হঠাৎ এই প্রস্তাব! কি মনে হয় বলুন তো, কেন করছে আলেখ এগুলো? আর এতে কুহেলির প্রতিক্রিয়াই বা কেমন হবে? কোন দিকে মোড় নিতে চলেছে কুহেলির জীবন? আমাকে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আপনাদের মতামতের অপেক্ষায় থাকব। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন আর ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here