সংগোপনে’ পর্ব-১৮

0
1761

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৮
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

চৈতালী দেবী নার্সিংহোমে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলেন, আজকে একটু আগেই যেতে হবে। সদ্য স্নান সেরে শাড়িটা পড়েছেন এমন সময় কলিংবেল বাজল। এইসময়ে সাধারণত কেউ আসে না, হাতে ঘড়িটা পরতে পরতে মান্তুকে ডেকে কে এসেছে দেখতে বললেন। কিন্তু রান্নাঘর থেকে পাল্টা মান্তুর জবাব এল, তার দুটো হাতই আটকা ফলে চৈতালী দেবী নিজেই গেলেন দরজা খুলতে। দরজা খোলার আগে একবার জিজ্ঞেস করলেন ‘কে’ কিন্তু কোনও সাড়া পেলেন না। এমনিই দেরী হয়ে যাচ্ছে তারমধ্যে এইসব, একটু বিরক্ত হয়েই দরজাটা খুললেন। কিন্তু সামনে কুহেলিকে দেখে বিরক্তিটা বিষ্ময়ে পরিবর্তিত হতে বেশি সময় লাগল না। এখন কুহেলির আগমন ভিষন ভাবে অপ্রত্যাশিত, চৈতালী দেবী কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাড়িয়ে থেকে বললেন,

তুই!! তুই এখন এখানে!! কীকরে?

কুহেলি হেসে জবাব দিল,

বাইরেই দাড় করিয়ে রাখবে নাকি!

চৈতালী দেবী কুহেলিকে নিয়ে ভিতরে এলেন। কুহেলি সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে বলল,

আগে একটু জল দাও, পরে বাকি কথা।

চৈতালী দেবী জল এনে দিলেন, এক চুমুকে পুরো জলটা শেষ করে কুহেলি গ্লাসটা টেবিলে রেখে চৈতালী দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল,

তুমি এত তাড়াতাড়ি বেরোচ্ছ কেন?

কাজ আছে তাই, তুই আমার কথা ছাড়। আগে বল তুই হঠাৎ কি ব্যাপার?

কেন? আসতে পারি না?

আমি তাই বললাম? কিন্তু এইতো দুদিন আগেই ঘুরে গেলি, এত তাড়াতাড়ি আবার এলি। এমন তো কখনও হয়নি তাই বলছি।

দরকার আছে, তাই এলাম।

অফিসের কাজে এসেছিস নাকি?

না।

তাহলে?

আছে, সে পরে শুনবে। এখন আমি ঘরে গেলাম, ফ্রেশ হব আগে। ঠাম্মু তো পুজো করছে নিশ্চয়ই?

হ্যা, আচ্ছা তুই আগে ফ্রেশ হয়ে আয়।

কুহেলি নিজের ঘরে চলে এল, আলমারি খুলে এক সেট জামা বের করে স্নান করে আবার নিচে নেমে এল। শৈলজা দেবীর পুজো শেষ, কুহেলিকে দেখেই ওনার মুখটা একগাল হাসি তে ভরে গেল। ওনার হাসি মুখটা দেখে কুহেলির মনটা জুড়িয়ে গেল। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল, শৈলজা দেবী কুহেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

কি ব্যাপার কুহু? আমাকে ছেড়ে বুঝি আর থাকতে পারলি না?

তোমাকে ছেড়ে কি থাকা যায়?

হুম, বুঝলাম। এবার আসল কথাটি বলে ফেল তো দেখি।

কুহেলি অবাক হয়ে বলল,

কিসের আসল কথা?

সেটা তো তুই জানিস, যতক্ষণ না বলছিস ততক্ষণ আমি কীকরে জানব?

তুমি কীকরে বুঝলে আমার কিছু বলার আছে?

শৈলজা দেবী হেসে বললেন,

মাথার চুলগুলো কি এমনি এমনি সাদা হয়েছে নাকি? সব বুঝি, বিশেষ করে তোর কথা তো বলার আগেই বুঝতে পারি।

চৈতালী দেবী সবার জন্য খাবার বাড়ছিলেন, ওদের কথা শুনে হেসে বললেন,

এখন এগুলো বুঝবি না, সময় হলে ঠিক বুঝতে পারবি। নে, এখন আগে খেয়ে নে। মা তুমিও আগে খেয়ে নাও, ওষুধ খাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। কুহুর কথা পরেও শুনতে পারবে।

তিনজনে বসে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল, খাওয়া শেষে মান্তু সবার জন্য বাটিতে করে পায়েস নিয়ে এল। বিনা কারণে সাধারণত পায়েস করা হয় না, আজ হঠাৎ পায়েস দেখে চৈতালী দেবী বললেন,

কি রে মান্ত, হঠাৎ পায়েস করলি যে?

দুপুরে শুক্তো করব তো, তাই কাজু বাদাম খুঁজছিলাম। তা খুঁজতে গিয়ে দেখি অল্প কটা গোভিন্দভোগ চাল রয়েছে। বেশ কিছুটা দুধও ছিল, তাই ভাবলাম অল্প করে পায়েস করি।

শৈলজা দেবী এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বললেন,

খুব ভালো করেছিস রে, আহা কি ভালো হয়েছে খেতে, কুহু খেয়ে দেখ, চৈতালী তুমিও খাও, দেখ খুব সুন্দর হয়েছে।

বলে আবার আরেক চামচ পায়েস মুখে দিলেন। কুহেলি আর চৈতালী দেবীও খেলেন, সত্যি খুব ভালো হয়েছে পায়েস টা। সবাই মান্তুর প্রশংসা করল। শৈলজা দেবী খেতে খেতে বললেন,

এই মান্তু, তোর জন্য আছে তো? নাকি পাকামি করে সবটাই আমাদের দিয়ে দিয়েছিস?

না গো ঠাকুমা, আছে।

সত্যি বলছিস তো?

হ্যা গো, সত্যি বলছি, বলো তো এনে দেখাই।

মান্তুর ফাজলামি দেখে শৈলজা দেবী একটু মেকি ধমক দিয়ে বললেন,

থাক থাক, বড্ড বেশি কথা শিখেছিস। যা গিয়ে নিজের কাজ কর, আর শোন, শুক্ততে কিন্তু বড়ি দিতে ভুলবি না।

মান্তু ঘাড় নেড়ে হাসতে হাসতে চলে গেল। শৈলজা দেবী বাকি পায়েস টুকু খেতে খেতে বললেন,

সকাল সকাল কতগুলো ভালো ভালো ঘটনা ঘটল, প্রথমে তুই এলি এখন আবার এত সুন্দর পায়েস। আজকের দিনটা মনে হচ্ছে বেশ ভালই কাটবে। কি বলিস কুহু?

কুহেলি হেসে বলল,

একদম।

চৈতালী খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লেন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন,

তোরা বসে গল্প কর, আমি বেরোলাম। এখন না বেরোলে দেরী হয়ে যাবে, আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দুপুরের পর আমার আর ডিউটি নেই আজ, সন্ধ্যের আগেই চলে আসব, তখন বসে কথা বলব।

চৈতালী দেবী চলে গেলেন। কুহেলিও খাওয়া শেষ করে শৈলজা দেবীকে ওষুধ এনে দিল। তারপর দুজনে মিলে বসল গল্প করতে, শৈলজা দেবী বললেন,

এবার বল তো, কি এমন কথা, যার জন্য বাড়ি পর্যন্ত ছুটে এলি।

কুহেলি সামান্য হেসে বলল,

এখন না, মা আসুক তারপর বলব।

বেশ, তাই হবে।

দুজনে মিলে অন্য নানারকম গল্পে মজে গেল। কুহেলির এখন একটুও চিন্তা হচ্ছে না, নিজের প্রিয় মানুষগুলোর কাছে এসে যেন খুব অদ্ভুত ভাবেই নিজের সিদ্ধান্ত টার উপর বিশ্বাস অনেকটা দৃঢ় হয়েছে। গল্প করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেল, শৈলজা দেবীর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কুহেলিও ওনার সাথেই খেয়ে নিল, তারপর ওষুধ খাইয়ে ওনাকে শুইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এল। কুহেলি দুপুরে ঘুমায় না, কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। ল্যাপটপটাও আনেনি, যে কাজ করে সময় কাটাবে, টিভি দেখতে পারত কিন্তু ইচ্ছে করছে না। আর এমনিতেও এই সময়টা টিভি মান্তুর দখলে থাকে, যত রাজ্যের অতি নাটকীয় সিরিয়ালগুলো মন দিয়ে দেখে, ওগুলো কুহেলির একদম সহ্য হয় না। অগত্যা শুয়েই পড়ল, চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের পায়নি। ঘুম ভাঙ্গল কলিংবেলের আওয়াজে, উঠে বসে দেখল পাঁচটা বাজে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে, ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে দেখল চৈতালী দেবী চলে এসেছেন। কুহেলিকে দেখে বললেন,

কিরে, ঘুমাচ্ছিলিস নাকি?

হুম, শুয়ে ছিলাম, কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।

ও। এই দেখ, কি এনেছি।

কি?

চৈতালী দেবী একটা প্যাকেট কুহেলির হাতে দিয়ে বললেন,

নিজেই দেখ।

কুহেলি প্যাকেটটা খুলে দেখল একটা আইসক্রিম টাব, চকলেট ফ্লেভারের একটা ফ্যামিলি প্যাক। কুহেলি আইসক্রিম ভিষন ভালবাসে, বক্সটা দেখে মুখে একটা চওড়া হাসি খেলে গেল।

ওয়াও মা, ইউ আর জাস্ট বেস্ট।

হুম, জানি তো।

দুজনেই হেসে উঠল, চৈতালী দেবী বললেন,

ওটা ফ্রিজে রেখে দে এখন, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি ততক্ষণে মায়েরও সন্ধ্যে দেওয়া হয়ে যাবে। তারপর তিনজনে বসে আইসক্রিম খেতে খেতে গল্প করব। আর তোর কথাটাও তো শোনা বাকি, যেটা বলার জন্য এসেছিস সেটা তো আগে শুনতে হবে।

কুহেলি শুধু হাসল, চৈতালী দেবীও হেসে নিজের ঘরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর শৈলজা দেবীর সন্ধ্যে বাতি দেওয়া হলে ওরা তিনজনে মিলে আইসক্রিম নিয়ে বসল। শৈলজা দেবী হাতে আইসক্রিমের বাটিটা নিয়ে বেশ জমিয়ে বসে বললেন,

হ্যা, এবার বলতো কুহু কি এমন কথা যেটা বলার জন্য তোকে এখানে আসতে হল।

কুহেলি অল্প অল্প করে বেশ উপভোগ করে আইসক্রিম টা খাচ্ছিল। শৈলজা দেবীর কথায় খাওয়া থামিয়ে একে একে দুজনের দিকেই তাকাল। কুহেলি মনে মনে নিজেকে তৈরি করে নিল, সময় উপস্থিত। শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী দুজনেই কুহেলির দিকে তাকিয়ে আছেন। কুহেলি একটু সময় নিয়ে বলল,

আমি ডিসিশন নিয়েছি, এবার বিয়েটা করব।

চৈতালী দেবী বললেন,

সে তো আগেরবারই ঠিক হল, তুই তো নিজেই বললি, বিয়েতে আর আপত্তি করবি না, শুধু একটু সময় চেয়ে নিয়েছিলি। এটা তো আমরা জানি।

কুহেলি একটু আইসক্রিম মুখে দিল, তারপর একটু থেমে বলল,

হুম, সে তো বলেছিলাম কিন্তু…

কুহেলি আবার একটু থামল, চোখ দুটো বন্ধ করে একটা বড় নিঃশ্বাস নিল। তারপর এক নিঃশ্বাসে বলে গেল,

আমি একজন কে পছন্দ করেছি, তাকেই বিয়ে করতে চাই।

কথাটা চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবী দুজনের কাছেই এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে দুজনেই হতভম্ব হয়ে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বললেন না, কুহেলি কথাটা চোখ বন্ধ করেই বলেছিল, কিছুটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনও সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ খুলে দেখল ওরা দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। একটু ধাতস্থ হয়ে চৈতালী দেবী বললেন,

তুই.. তুই সত্যি বলছিস না মজা করছিস?

সত্যি বলছি।

চৈতালী দেবী আরও অবাক হলেন, যে মেয়ে এই দুদিন আগে পর্যন্ত বিয়ের নাম পর্যন্ত শুনতে চাইছিল না, শুধুমাত্র শৈলজা দেবীর কথা ভেবে বিয়েতে নিমরাজি হয়েছিল, সে এত তাড়াতাড়ি নিজের জন্য ছেলেও পছন্দ করে ফেলল! বাড়ির মেয়ে যদি এসে বলে সে কাউকে পছন্দ করেছে সেক্ষেত্রে সাধারণত বাড়ির লোকেরা আগে জিজ্ঞেস করে ছেলে কে, সে কি করে, কোথায় থাকে। কিন্তু চৈতালী দেবী জিজ্ঞেস করলেন,

মানে… কীকরে? এই তো দুদিন আগেও বিয়েতেই রাজি ছিলি না, আর মাত্র এই কদিনে…..

চৈতালী দেবীর কথা শেষ হল না, শৈলজা দেবীও যথেষ্ট অবাক হয়েছিলেন, প্রথমটায় বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, কিন্তু এবার উনি চৈতালী দেবীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,

থামো তো চৈতালী, কীকরে কবে কখন আমার জানার দরকার নেই।

তারপর একগাল হেসে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন,

আমার কুহু বিয়েতে রাজি হয়েছে, নিজে ছেলে পছন্দ করেছে, এটা তো খুশির খবর। আয় মা আমার কাছে আয় দেখি।

বলে দুটো হাত কুহেলির দিকে বাড়িয়ে দিলেন, কুহেলিও হেসে উঠে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরল। শৈলজা দেবী কুহুকে জড়িয়ে ধরে অনেক আদর করলেন। উনি যে এই খবরটা শুনে ভীষন খুশি হয়েছেন সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। কিছুক্ষণ আদর করার পর কুহেলিকে নিজের পাশে বসিয়ে শৈলজা দেবী বললেন,

চৈতালী, সকালে আমি বলেছিলাম না আজকের দিনটা ভালো কাটবে। দেখেছ, কত বড় একটা আনন্দ সংবাদ শুনলাম আমরা। ইশ, পায়েস টা এখন হলে ভালো হত, এত বড় একটা খুশির খবর একটু মিষ্টি মুখ নাহলে চলে নাকি! যাই হোক পায়েস না হোক আইসক্রিম তো আছে, এটাও তো মিষ্টি। এটা দিয়েই মিষ্টি মুখ হবে।

বলে উনি ওনার বাটি থেকে এক চামচ আইসক্রিম নিয়ে কুহেলিকে খাইয়ে দিলেন। কুহেলির ওনাকে এত খুশি দেখে যে কতটা ভালোলাগছে সেটা বলে বোঝাতে পারবে না। চৈতালী দেবী যে খুশি হননি তা নয়, উনি শুধু ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। হাতের বাটিটা নামিয়ে রেখে বললেন,

কুহু তুই সত্যিই কাউকে পছন্দ করেছিস?

হ্যা মা।

চৈতালী দেবী এবার হেসে বললেন,

আমি তো… আমার.. আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। কুহু.. ছেলেটা কে?

এবার আসল কথা, কুহেলি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আলেখের পরিচয় দিল।

চৈতালী দেবী শুনে তো অবাক,

তোর বস!! কি বলছিস তুই? এটা কীকরে হল?

কুহেলি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কারনটা বলল, যে কারনটা ওরা নভতেজ শর্মাকেও বলেছে। চৈতালী দেবী সবটা শুনে কিছুক্ষণ কোনও কথা বললেন না, ওনার মুখে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল। কুহেলির দিকে তাকিয়ে চিন্তা জড়ানো গলায় বললেন,

কুহু, ছেলেটা ভাল তো? না মানে, এত বড় একটা কোম্পানির কর্ণধার হঠাৎ এভাবে যেচে তোকে বিয়ে করতে চাইছে, কোনও অন্য উদ্দেশ্য নেই তো?

কুহেলি ওনার চিন্তা টা বুঝল। ওনাকে আশ্বস্ত করে বলল,

মা, ওরা খুব ভাল মানুষ। তুমি এটা নিয়ে একদম ভেব না, আমি ওনার বাবার সঙ্গেও দেখা করেছি, উনি তো আমাকে একদম নিজের মেয়ের মত কাছে টেনে নিয়েছেন। তোমাদের সঙ্গে আলাপ হলে তোমরাও বুঝতে পারবে।

চৈতালী দেবী কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেন কিন্তু পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারলেন না। ওনার একমাত্র মেয়ে বলে কথা, ওনার জীবনের সবটুকু জুড়ে তার কুহু। চিন্তা তো হবেই, যতক্ষণ না নিজে পরখ করে দেখছেন ততক্ষণ শান্তি পাবেন না। শৈলজা দেবী এত বিজনেস টাইকুন বা বিরাট বড় ব্যক্তিত্ব বা দুই পরিবারের মধ্যে সামাজিক অবস্থানের ব্যবধান এসব কিছু বোঝেন না। আপাতত বুঝতেও চান না, ওনার কুহু অবশেষে বিয়ে করবে এটাই ওর কাছে যথেষ্ট।

আহা চৈতালী এত চিন্তার কি আছে? আরে আমাদের কুহু যাকে পছন্দ করেছে সে ভালো হতে বাধ্য। আর তাছাড়া আমরা তো তাদের সাথে কথা বার্তা বলব নাকি! তখন তো দেখতেই পাব। শুধু শুধু এত চিন্তা করো না তো।

কুহেলি এটা শুনে খুশি হল, কিন্তু এবার যে মূল কথাটা বলতে হবে, কুহেলি এখনও বলেনি আলেখরা পাঞ্জাবি। ব্যাঙ্গালোরে প্রচুর বাঙালি থাকে আর তাছাড়াও বাঙালিদের মধ্যে অল্প হলেও শর্মা পদবী আছে। তাই সেক্ষেত্রেও হয়তো ওরা এখনও বোঝেননি যে পাত্রপক্ষ অবাঙালি। কুহেলি শৈলজা দেবীর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলল,

ঠাম্মু, একটা কথা ছিল।

শৈলজা দেবীর আনন্দ আর ধরছে না, উনি হেসে বললেন,

আবার কি বলবি রে? আর খুশির খবর দিস না কিন্তু, এবার তাহলে বেশি হয়ে যাবে।

কুহেলি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল,

আসলে ওনারা… ওনারা না.. মানে..

কুহেলিকে ইতস্তত করতে দেখে চৈতালী দেবীর একটু সন্দেহ হল, এমনিতেই ওনার কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে সবটা। এতবড় একজন বিজনেস ম্যান, তার জন্য কি মেয়ের অভাব হত? না, উনি নিজের মেয়েকে ছোট করছেন না, কুহেলিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে যেই পাবে সেই ভাগ্যবান হবে। কিন্তু আজকাল মানুষ চেনা বড় দায়, সবাই আগে সামাজিক অবস্থান টাকেই গুরুত্ব দেয়। সেদিক থেকে তো ওদের মধ্যে আকাশ পাতালের পার্থক্য, নিজে কথা না বলা পর্যন্ত মনটা খচ খচ করছে। তারমধ্যে এখন আবার কুহেলি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না দেখে মনটা আরও কেমন করে উঠল।

কুহু, কি হয়েছে? এত ইতস্তত করছিস কেন? যা বলবি বলে ফেল।

কুহেলি একটু থেমে বলল,

আসলে ওনারা.. ওনারা না.. বাঙালি না.. পাঞ্জাবি।

এটা শুনে শৈলজা দেবীর হাসিটা মিলিয়ে গেল, এই ভয়টাই কুহেলি পেয়েছিল। চৈতালী দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখল ওনার অভিব্যক্তির তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। কুহেলি ওদের দুজনের উদ্দেশ্যেই বলল,

তোমরা একবার ওদের সাথে কথা বলে দেখ, তোমাদের কোনও আপত্তি থাকবে বলে আমার মনে হয় না। ওনাদের পরিবারের তরফ থেকে এই ডিফরেন্ট কমিউনিটি নিয়ে কোনো আপত্তি নেই। তোমাদেরকেও বলছি কোনও ডিসিশন নেওয়ার আগে একবার ওনাদের সাথে দেখা করে কথা বলে নাও, প্লিজ।

কুহেলির গলায় অনুনয়ের সুর। এখনও কেউ কোনও কথা বলছে না দেখে কুহেলি আবার বলল,

প্লিজ মা, ঠাম্মু.. একবার, শুধু একবার ওনাদের সাথে আলাপ করো, তারপরেও যদি তোমাদের মনে হয়… তাহলে…

কুহেলি কথাটা শেষ করতে পারল না, গলা দিয়ে আর শব্দ বেরচ্ছে না। মনটা খারাপ হয়ে গেল, মাথাটা নীচু করে চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ একটা অসম্ভব নিস্তব্ধতা বিরাজ করল বসার ঘরটায়। সামান্য একটা সূচ পড়লেও তার শব্দ শোনা যাবে, কিছুক্ষণ পর চৈতালী দেবী এই নিস্তব্ধতা ভেঙে শান্ত স্বরে বললেন,

ছেলে বাঙালি না অবাঙালি তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। ওরা কোন জাতি সেটা জানার থেকেও এটা জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ওরা কেমন মানুষ। আর ঠিক এই কারণেই আমি কিন্তু এখনই কোনও কথা দিতে পারছি না, আগে ওনাদের সাথে আলাপ করে দেখব, তারপর যদি মনে হয় তোর কথাটাই ঠিক, ওনারা সত্যিই ভালো। তাহলে আমার আপত্তি করার আর কোনো কারণ থাকবে না, কিন্তু হ্যা, মা এবাড়ির বড়। ওনার অমতে কিন্তু কিছুই হবে না, সুতরাং মায়ের যদি মত না থাকে তাহলে কিন্তু আমারও মত থাকবে না।

কুহেলির আশা অনুযায়ী চৈতালী দেবীর ওদের অবাঙালি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আপত্তি নেই, শুধু ছেলে বা তার পরিবারকে নিজে পরখ না করা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সেটা নিয়ে কুহেলির কোনও চিন্তা নেই, আলেখ আর ওর বাবার সঙ্গে একবার আলাপ করার পর কেউই ওনাদের পছন্দ না করে পারবে না। কিন্তু সেটা তো তখন হবে যখন শৈলজা দেবী রাজি হবেন, কুহেলি আকুল চোখে শৈলজা দেবীর দিকে তাকাল। উনিও একভাবে কুহেলির দিকেই তাকিয়ে আছেন, ওনার মুখ দেখে কুহেলির ভয় হল। কিছু বলার সাহস হল না, চোখ দুটো আপনা থেকেই নেমে এল। শৈলজা দেবীর যে মত নেই সেটা কুহেলির বুঝতে অসুবিধা হল না। কিন্তু হঠাৎ ওকে অবাক করে দিয়ে শৈলজা দেবী বললেন,

তা আমার হবু নাতজামাইটিকে কবে দেখতে পাব?

কথাটা শুনে কুহেলি এতটাই চমকে উঠল, যে উত্তেজনার বশে সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল। শৈলজা দেবীর দিকে তাকিয়ে দেখল, মুখখানা এখনও তেমনই গম্ভীর। কিন্তু ধীরে ধীরে ঠোঁটের কোনায় একটা হাসি ফুটে উঠছে, শেষে হাসিটা প্রশস্ত হয়ে সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। সেটা দেখে কুহেলির মুখেও হাসি ফিরে এল, অবাক চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বলল,

ঠাম্মু.. তুমি!!!

শৈলজা দেবী হেসে ওর হাতটা ধরে আবার ওনার পাশে বসিয়ে বললেন,

তোর কি মনে হয়েছিল, ছেলে অবাঙালি বলে আমি আপত্তি করব! আরে বাঙালি নাহলে কি সে ভালো হবে না! আর সব বাঙালিই কি ভালো নাকি! ভালো মন্দ তো সবার মধ্যেই আছে। চৈতালী তো ঠিকই বলেছে, ছেলে বাঙালি না অবাঙালি অত দিয়ে কাজ নেই, ছেলে ভাল কিনা সেটাই আসল। আর সেটা তো আমি দেখলেই বুঝতে পারব, যদিও আমার তোর পছন্দের ওপর পুরো ভরসা আছে, তুই পছন্দ করেছিস মানে সে ছেলে লাখে.. না না.. কোটিতে একটা হবে।

কুহেলি আনন্দে শৈলজা দেবীকে জড়িয়ে ধরল, শৈলজা দেবী কুহেলির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

আমার কুহু কাউকে পছন্দ করেছে তাকে আমি কীকরে অপছন্দ করব বলত? তোর পছন্দটাই আমার কাছে শেষ কথা, তোর খুশিতেই আমার খুশি। কিরে কুহু, তোর সত্যিই পছন্দ তো ছেলেটাকে?

কুহেলি মাথা নেড়ে হ্যা বলল। না, এটা কিন্তু মিথ্যে নয়, সেই অর্থে না হলেও মানুষ হিসেবে সে আলেখকে যথেষ্ট পছন্দ করে। তার থেকেও বেশি শ্রদ্ধা করে, ওরকম একটা মানুষ সত্যিই খুব একটা দেখা যায় না। চৈতালী দেবী পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নাহলেও নিজের মেয়ের প্রতি তারও ভরসা আছে, কুহেলি যে অবশেষে সত্যিই বিয়ে করতে রাজি হয়েছে এটা ভেবে ওনার মুখেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠল। শৈলজা দেবী বললেন,

তাহলে এবার বল দেখি কবে আমার নাতজামাইকে দেখব?

চৈতালী দেবীও বললেন,

হ্যা কুহু, এসব বিষয়ে দেরী করাটা ঠিক নয়। ওনাদের সাথে কথা বলে দেখ ওনারা কবে সময় দিতে পারবেন। আর হ্যা, মাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরে যাওয়াটা সম্ভব নয়, তাই ওনারা যদি এখানে আসতে পারেন তাহলে ভাল হয়। যদি একান্তই অসুবিধা থাকে তাহলে…..

কুহেলি বাধা দিয়ে বলল,

তুমি অত চিন্তা করো না। ওনার বাবা আমাকে নিজে বলেছেন আমি তোমাদেরকে সবটা জানালে উনি নিজে এসে তোমাদের সাথে কথা বলবেন।

বেশ, তাহলে তো ভালই হয়। তুই কথা বলে দেখ, ওনারা কবে আসতে পারবেন। আমাকেও তো সেই বুঝে ছুটির ব্যবস্থা করতে হবে, অন্তত একটা দিন আগে আমাকে নার্সিংহোমে ইনফর্ম করতে হবে।

ঠিক আছে মা, আমি আজকেই কথা বলব।

শৈলজা দেবী বললেন,

আরে সে তো পরের কথা, এই কুহু, সামনা সামনি যবে দেখব তবে দেখব কিন্তু এখন একটা ছবি দেখা না। আমার হবু নাতজামাইয়ের মুখটা দেখার ভারী ইচ্ছে হচ্ছে।

কুহেলি একটু চিন্তায় পড়ল, ওর ফোনে আলেখের কোনও ছবি নেই। থাকার কোনও কারণও নেই, কিন্তু শৈলজা দেবী এভাবে দেখতে চাইছেন। হঠাৎ মনে পড়ল, আলেখের ছবি পাওয়া এমন কি দুঃসাধ্য কাজ! এত বড় একজন বিজনেস ম্যান, গুগলে সার্চ করলেই একগাদা ছবি বেরিয়ে পড়বে। তাই করল, গুগলে সার্চ করতেই অনেকগুলো ছবি স্ক্রীনে ফুটে উঠল। তার মধ্যে থেকে একটা ছবি বেছে নিয়ে শৈলজা দেবীকে দেখাল। শৈলজা দেবী ছবিটা ভাল করে দেখে বললেন,

চৈতালী, এ যে রাজপুত্র! দেখ দেখ।

চৈতালী দেবীও দেখলেন। ছবিটা দেখে সত্যিই রাজপুত্র বলেই মনেই হচ্ছে। কিন্তু ওনার বাহ্যিক রূপের প্রতি অত আগ্রহ নেই, রূপ আর কদিন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধানো রূপও ফিকে হয়ে যায়, মানুষের চরিত্র টাই আসল। তবে চেহারায় মানুষের চরিত্র কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়, ছবি দেখে তো বেশ ভালই মনে হচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, এখন বাকিটা তো আলাপ হলেই বোঝা যাবে। শৈলজা দেবী হঠাৎ ফোনটা কুহেলির মুখের পাশে ধরে বললেন,

আমাদের কুহুর সঙ্গে কিন্তু বেশ মানাবে, কি বল চৈতালী?

চৈতালী দেবী হাসলেন, কিন্তু কথাটা শুনে কুহেলি হঠাৎ কেন যেন লজ্জা পেল, কারনটা ওর নিজেরও জানা নেই। কুহেলি ফোনটা নিয়ে ছবিটা সরিয়ে দিল, সেটা দেখে শৈলজা দেবী হেসে বললেন,

ওমা চৈতালী, আমাদের কুহু যে লজ্জা পাচ্ছে গো!

শৈলজা দেবী আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই মান্তু এসে বলল,

কে লজ্জা পাচ্ছে গো?

শৈলজা দেবী বললেন,

কে আবার! আমাদের কুহু, আর লজ্জা পাবে নাই বা কেন বল দেখি! হাজার হোক মেয়ে মানুষ তো, বিয়ের কথায় লজ্জা তো পাবেই।

মান্তু উত্তেজিত হয়ে বলল,

বিয়ে! কার বিয়ে গো?

মুখপুড়ি, এটাও বুঝলি না! কার আবার বিয়ে, কুহুর বিয়ে।

ওমা তাই!!! সত্যি গো ঠাকুমা? কবে? কবে?

দাড়া দাড়া, অত ব্যস্ত হস না। এখনও কিছু ঠিক হয়নি, আগে কথা বার্তা হবে তবে তো।

সে যাই হোক, ছোড়দি, আমার কিন্তু একটা ভালো শাড়ি চাই।

মান্তু বয়সে কুহেলির থেকে বড় হলেও ওকে ছোড়দি বলে। কুহেলি ওর কথার কোনও উত্তর দিল না, কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে ওর। ফোনটা হাতে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

মা, আমি ঘরে যাচ্ছি, কথা বলে তোমাকে জানাব।

বলে কুহেলি সটান দোতলায় নিজের ঘরে চলে এল। নিচে শৈলজা দেবী তখনও হাসছেন, আজ তার ভারী আনন্দের দিন। কুহেলি ঘরে এসে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসল, নিজেকে একটু শান্ত করল। ওদের কথা শুনে হঠাৎ ওরকম কেন মনে হচ্ছিল সেটা বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু সবটা যে ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে এটা ভেবেই খুব ভালোলাগছে। শৈলজা দেবী মেনে নেবেন কিনা সেটা নিয়ে চিন্তায় ছিল, কিন্তু উনি কত সহজে সবটা মেনে নিলেন। এখন আলেখকে জানাতে হবে, ফোনটা হাতে নিয়ে আলেখের নম্বরটা ডায়াল করল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই কলটা রিসিভ হল,

আমি আপনার কলের জন্যই ওয়েট করছিলাম। বলুন মিস বাসু, সব ঠিক আছে তো?

আলেখ যে বেশ চিন্তায় আছে সেটা ওর গলা শুনেই বোঝা গেল। কুহেলি হেসে বলল,

সব ঠিক আছে স্যার। আমি যা ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা তার থেকেও সহজে হয়ে গেছে।

কুহেলি এতক্ষণ যা যা কথা হয়েছে সবটা জানাল। চৈতালী দেবী যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওদের সাথে দেখা করতে চান সেটাও জানাল। আলেখ সবটা শুনে বলল,

দ্যাটস গ্রেট।

আলেখের গলায় এখন উদ্বেগের চিহ্ন মাত্র নেই। বরং একটা নিশ্চিন্ত ভাব ফুটে উঠেছে। আলেখ বলল,

আমি ড্যাডের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে একটু পরেই জানাচ্ছি। আপনি তো জানেনই, ড্যাড কতটা একসাইটেড, হয়তো কালকেই যেতে চাইবে।

হুম।

তবে আমার শিডিউল টাও একটু দেখতে হবে। ওকে, আমি আগে ড্যাডের সঙ্গে কথা বলে আমার শিডিউল চেক করে একটা ডেট ফিক্স করে আপনাকে জানাচ্ছি।

ওকে।

আলেখ ফোনটা রেখে দিল। কুহেলি চুপচাপ বসে আলেখের ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক দশ মিনিটের মাথায় ফোনটা বেজে উঠল, তাকিয়ে দেখল, আলেখের নামটা স্ক্রীনে ভেসে উঠেছে।

হ্যালো।

যা বলেছিলাম আপনাকে, ড্যাড তো কালকেই যেতে চাইছিল। বাট আমার কালকে ভিষন ইম্পর্ট্যান্ট একটা মিটিং আছে, ওটা কিছুতেই পোস্টপন্ড করা যাবে না। সো আমরা যদি পরশু যাই তাহলে কি কোনও প্রবলেম হবে?

না না, কোনও প্রবলেম নেই। মা নিজেই বলছিল একদিন আগে জানাতে পারলেই হবে।

গ্রেট। তাহলে এটাই ফাইনাল, আমরা পরশু আসছি।

ওকে, কটা নাগাদ আসবেন আমাকে জানিয়ে দেবেন আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেব।

থ্যাঙ্কস, কিন্তু তার প্রয়োজন হবে না। আমরা আগে হোটেলে চেক ইন করব, তারপর আপনাদের বাড়িতে যাব। আপনি শুধু আমাকে আপনার অ্যাড্রেস টা টেক্সট করে দেবেন, আমরা ঠিক পৌঁছে যাব। অবশ্যই টাইম টা আপনাকে আগেই জানিয়ে দেব।

ওকে।

ওকে, গুড নাইট মিস বাসু।

গুড নাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলি নিচে নেমে এল, চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবী তখনও ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে কথা বলছেন। কুহেলিকে দেখে চৈতালী দেবী বললেন,

কথা হল?

হ্যা।

কি বললেন ওনারা?

ওনারা পরশু আসবেন, সময়টা এখনও জানাননি। পরে জানিয়ে দেবেন।

পরশু, ঠিক আছে। আমি কালকে নার্সিংহোমে কথা বলে নেব, অসুবিধা হবে না। বাবার সাথে কথা বলছিলাম বুঝলি তো, ওনারও একই কথা মানুষ ভালো হলে বাকি কোনও কিছুতেই আপত্তি নেই।

এটা কুহেলি আগেই আন্দাজ করেছিল। চৈতালী দেবী আবার বললেন,

বাবাকে আসতে বলি পরশু?

শৈলজা দেবী বাধা দিয়ে বললেন,

একদম না, বেয়াই মশাইয়ের শরীরটা এমনিই ভালো নেই, শুধু শুধু কেন টেনে আনবে? আমরা কথা বলি, সব ঠিক হলে নাহয় কুহু নাতজামাইকে নিয়ে ওনার সাথে দেখা করে আসবে।

হুম, ঠিকই বলেছ।

বারবার এই নাতজামাই শব্দটা শুনতে কুহেলির কেমন একটা অদ্ভুত লাগছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না, কিই বা বলবে! চৈতালী দেবী বললেন,

চিরু টারও গত মাসেই বদলি হয়ে গেল। ওকে অন্তত আসতে বলা যেত, এক কাজ করি দেবাঞ্জলিকে আসতে বলি, কি বল মা?

হ্যা, এটা ঠিক বলেছ। ওকে আসতে বলে দাও।

চৈতালী দেবী সঙ্গে সঙ্গে দেবাঞ্জলিকে ফোন করে সবটা জানিয়ে পরশু আসতে বলে দিলেন। দেবাঞ্জলি খবরটা শুনেই খুব খুশি, সকাল সকালই চলে আসবে সেটাও জানিয়ে দিল। দেবাঞ্জলির কথায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই কুহেলির দেবার্ঘ্যর কথা মনে পড়ল। ওর কথা মনে হতেই একটা খারাপলাগা ওকে ঘিরে ধরল। ডিনারের সময় হয়ে গেছে, মান্তু খাবার বেড়ে দিয়েছে, তিনজনে মিলে খেতে বসল। খাওয়ার টেবিলেও অনেক আলোচনা হল, কিন্তু তার একটাও ঠিক মত কুহেলির কানে গেল না। মাঝে মাঝে শুধু হু হা করে গেল, খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে উঠে এল। খুব একটা রাত হয়নি, ফোনটা হাতে নিয়ে খাটের পাশের জানালার ধারে বসল। অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব পেরিয়ে মেসেঞ্জার টা অন করল, অন্য নামগুলোর মাঝে দেবার্ঘ্যর নামটাও আগের মতই রয়েছে। নামের পাশে সবুজ বিন্দুটা দেখা যাচ্ছে না, আঙ্গুলের আলতো স্পর্শে চ্যাটবক্স টা ওপেন হল। পুরনো মেসেজ গুলো এখনও তেমনই রয়েছে, শুধু ওদের মাঝের সম্পর্কটাই আর নেই। দেবার্ঘ্যর ডিপিতে এখন কোনও ছবিই নেই, শুধু কয়েকটা লাইন লেখা,
”জীবনে কখনও পিছন ফিরে তাকাতে নেই, হাজার চেষ্টা করেও অতীতকে তুমি বদলাতে পারবে না। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকাও, অতীত তোমার হাতে না থাকলেও ভবিষ্যৎ তোমার হাতে। এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাওয়াই জীবনের ধর্ম।“
লাইনগুলো পড়ে কুহেলির মনে হল, সত্যিই তো, হাজার চেষ্টা করেও তো অতীতকে বদলানো যায় না, তাহলে শুধু শুধু সময় নস্ট করে কি লাভ! যে অতীতকে পিছনে ফেলে এসেছে, তার কথা মনে করে আগামী ভবিষ্যতকে উপেক্ষা করা উচিত নয়। অতীতকে কখনও ভোলা যায় না এটা যেমন সত্যি তেমনই এটাও সত্যি অতীতকে আঁকড়ে ধরে এগোনো যায় না। ফোনটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিল কুহেলি, আর নিজের অতীতের দিকে ফিরে তাকাবে না সে। এখন থেকে শুধুই সামনের দিকে তাকাবে, জীবনের ছন্দে পা মিলিয়ে এগিয়ে যাবে নিজের ভবিষ্যতের দিকে।

ক্রমশ___________

আশা করি আজকের পর্ব টা আপনাদের সবার ভালোলেগেছে। কুহেলির বাড়িতেও তাহলে সব ঠিকঠাকই হল, এবার পালা দুই পরিবারের মুখোমুখি সাক্ষাতের। কি মনে হয়, কেমন হবে সেই আলাপ পর্ব? আলেখের সঙ্গে আলাপ করে কি চৈতালী দেবীর মনের সংশয় দূর হবে? আপনাদের মতামত জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। প্রতিবারের মত এবারও আমি অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের জন্য। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here