সংগোপনে’ পর্ব-১৯

0
1648

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_১৯
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

মাঝখানের একটা দিন যেন চোখের পলকে পেরিয়ে গেল। কুহেলির বাড়িতে সারাটা দিন সে কি ব্যস্ততা, গোটা দিনটা তো শুধু ঘরদোর পরিষ্কার করতেই কেটে গেল। শৈলজা দেবী সবটা নিজে নির্দেশ দিয়ে করাচ্ছেন, বেচারি মান্তুর বড্ড খাটা খাটনি হয়ে গেল। চৈতালী দেবী অবশ্য এসবে হাত লাগাতে পারেননি, নার্সিংহোমে ব্যস্ত ছিলেন। কুহেলি একবার বলার চেষ্টা করেছিল, এসবের কোনও দরকার নেই, কিন্তু শৈলজা দেবী সে কথা কানেই নিলেন না। উপরন্তু কুহেলিকে দুটো ধমক দিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দিলেন, অগত্যা বসে বসে এইসব কান্ড কারখানা দেখা ছাড়া কুহেলির বিশেষ কিছুই করার ছিল না। সন্ধ্যেবেলায় তো শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী মিলে রীতিমত একটা ছোটখাট বৈঠক করে ফেললেন, সঙ্গে আবার মান্তুও ছিল। বৈঠকের বিষয় আর কিছুই নয়, আগামীকালের মেনুতে কি কি থাকবে সেই নিয়েই এত আলোচনা। দীর্ঘ আলোচনার পরে যে ফর্দ তৈরি হল, সেটা দেখে তো কুহেলির ভিরমি যাওয়ার যোগাড়। ছপ্পন ভোগের থালিও মনে হয় এই ফর্দের কাছে লজ্জা পেয়ে যাবে, কুহেলি অতি কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সেগুলো বাতিল করল। নতুন যে ফর্দ তৈরি হল সেটাও কিছু কম যায় না, তবে একটা সাধারণ ডিনারে মানানসই। ইতিমধ্যে কুহেলি ওর ঠিকানা আলেখকে পাঠিয়ে দিয়েছে আর আলেখও কুহেলিকে জানিয়েছে ওরা সন্ধ্যেবেলায় আসবে। সেটা শুনেই চৈতালী দেবী কুহেলিকে ওদের ডিনারে নিমন্ত্রণ করতে বলেন। কুহেলিও সেইমত আলেখকে বলে দিয়েছে, একেবারে ডিনার সেরেই ফিরতে হবে, আলেখ আপত্তি করেনি। যাইহোক গোটা দিনটা তো এইসবের মধ্যে দিয়েই পেরিয়ে গেল। আজ সকাল থেকে সবার ব্যস্ততা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে, সকাল থেকেই রাতের খাবারের প্রস্তুতি চলছে। শৈলজা দেবী আজ অন্যদিনের তুলনায় আগে উঠে পড়েছেন, সকাল সকাল নিজের পুজোর পাট সেরেই ঢুকে পড়েছেন রান্না ঘরে। বেশ কিছু পদ তিনি নিজেই রাধবেন, চৈতালী দেবী আর কুহেলি দুজনেই বারন করেছিলেন কিন্তু তিনি কিছুতেই শোনেননি। ওনার কথা হল,

আরে বাবা এ কি যেমন তেমন কোনও দিন নাকি! আজকে আমার কুহুর হবু শ্বশুর আর আমার হবু নাতজামাই প্রথম বার এবাড়িতে আসবে বলে কথা। এই পদ গুলো তো আমি নিজেই রাধব, চৈতালী তুমিও কিন্তু ওই পদ গুলো নিজেই রাধবে, ওগুলো তুমি আমার থেকেও ভালো রান্না কর।

আজ শৈলজা দেবীর দেহে মনে যেন একটা নতুন শক্তির সঞ্চার হয়েছে। দারুন উৎসাহের সাথে সবটা করছেন, কুহেলির খুব ভালোলাগছে ওনাকে এতোটা প্রাণবন্ত দেখে। শৈলজা দেবী গোভিন্দভোগ চালে ঘি মাখাতে মাখাতে হঠাৎ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন,

হ্যা রে কুহু, তুই কাল বললি বটে, তবে আমার কিন্তু এখনও একটু সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। এই ষোলআনা বাঙালি খাবার ওনাদের পছন্দ হবে তো?

চৈতালী দেবীও সায় দিয়ে বললেন,

হ্যা রে কুহু, আমিও সেটাই ভাবছি। ওনারা এমনিতেই বাঙালি নন, তাছাড়া এত বিত্তবান, ওনাদের এই ঘরোয়া খাবার কীকরে পছন্দ হবে বল তো!

মা, আমি বলছি তো, একদম চিন্তা করো না। ওনাদের এগুলো খুব ভালো লাগবে তুমি দেখ। আর আমার ঠাম্মু আর মায়ের হাতের রান্না কারো পছন্দ না হয়ে যায় কীকরে?

শৈলজা দেবী বললেন,

দেখিস বাপু।

ঠাম্মুউউউ, তুমি এত বেশি ভেব না তো, নিজের কাজ টা তাড়াতাড়ি সেরে ফেল। রান্না করছ ঠিক আছে, কিন্তু খাওয়ার অনিয়ম করা যাবে না কিন্তু। রান্না হয়নি বলে খাওয়ায় দেরী করা যাবে না, বলে রাখলাম।

আচ্ছা বেশ, তাই হবে। এখন যা তো এখান থেকে, তুই থাকলে আরও দেরী হবে।

একদম না, আমি এখানেই থাকব। যা কথা হয়েছে তার বাইরে কোনও কাজে হাত দেবে না তুমি। আমি এখান থেকে চলে গেলেই তুমি আরও কাজ নিয়ে বসে যাবে আমি জানি, ওটি হচ্ছে না।

চৈতালী দেবী পাতুড়ির জন্য সরষে বাটতে বাটতে ওদের কান্ড কারখানা দেখে হেসে ফেললেন। শেষমেশ কুহেলিও রান্নাঘরেই রয়ে গেল, হাতে হাতে অনেক কাজ এগিয়ে দিল। সবাই মিলে যখন রান্না শেষ করল, তখন একটা বাজে। শৈলজা দেবীর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, এতক্ষণ গরমে কাজ করে সবাই একেবারে ঘেমে নেয়ে একসা। সবাই যে যার ঘরে গিয়ে স্নান সেরে আবার ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত হল। খেতে বসেও ওনাদের আলোচনা শেষ হল না, শৈলজা দেবী বললেন,

হ্যা গো চৈতালী, তাহলে শুধু ভাত টাই বাকি থাকল তো?

হ্যা মা, বাকি সব হয়ে গেছে।

ভালো করে দেখেছ তো, কিছু বাদ থেকে গেল না তো?

না মা, কিচ্ছু বাদ যায় নি।

বেশ, ভালো কথা দেবাঞ্জলি এল না তো? সকালেই আসবে বলেছিল না?

এটা এতক্ষণ কুহেলিরও খেয়াল হয় নি, সকালেই তো আসবে বলেছিল। চৈতালী দেবী বললেন,

হ্যা, কিন্তু আসতে পারল না গো। আমাকে ফোন করেছিল, ওদের স্কুলে আজকেই একটা মিটিং পড়ে গেছে। কি বলল, সামনে ওদের স্কুলের পঞ্চাশ বছর পূর্তি সেই নিয়েই মিটিং, সবাইকে থাকতেই হবে।

ও, ইশ ও থাকলে আরও কত ভালো হত। তা কখন আসবে?

আসতে পারবে না মা, ওর স্কুল তো সেই শান্তিপুরের কাছে, একটা না দুটো স্টেশন আগে, নামটা মনেই থাকে না। সেখান থেকে আসতেই তো দুঘন্টা লাগে, কীকরে আসবে বল।

হুম, কি আর করা যাবে। যাক গে, কুহু তুই আমার নাতজমাইয়ের সাথে কথা বলেছিস? ওনারা রওনা করেছেন কিনা খোজ নিয়েছিস।

কুহেলি খুব স্বাভাবিক ভাবে খেতে খেতে উত্তর দিল,

না।

এতে শৈলজা দেবী ভিষন অবাক হয়ে খাওয়া থামিয়ে দিয়ে বললেন,

কি! এখনও খবর নিস নি! এ কিরকম কথা? আজ প্রথমবার আসবেন ওনারা, আমাদেরও তো একটা দায়িত্ব আছে নাকি! এক্ষুনি ফোন কর।

কুহেলি বিষম খেল, কোনরকমে জল খেয়ে শান্ত হয়ে বলল,

এক্ষুনি ফোন করব!

হ্যা, এক্ষুনি।

ঠাম্মু ওনারা হয়তো ফ্লাইটে আছেন এখন।

তাতে কি হল? তুই ফোন কর।

ফ্লাইটে থাকলে ফোন অফ করে রাখতে হয়।

সে তো তুই ফোন করলেই বুঝতে পারবি, আগে ফোন কর।

কুহেলি কিছুতেই ব্যাপারটা এড়াতে পারল না, অগত্যা খাওয়া থামিয়ে ফোন এনে কল করতেই হল। মনে প্রাণে চাইছিল যাতে লাইনটা কানেক্ট না হয়, কারণ এভাবে ফোন করে খোজ নিতে ওর কেমন একটা লাগছে। আলেখও বা কি মনে করবে সেটাও জানা নেই, তাই লাইনটা কানেক্ট না হলেই ভাল। হলোও তাই, নম্বরটা ডায়াল করার একটু পড়েই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর জানিয়ে দিল ওপর প্রান্তের ফোনটি বর্তমানে সুইচড অফ্ আছে। মানে কুহেলির ধারণাই ঠিক, ওরা এখন ফ্লাইটে আছে, কুহেলি শৈলজা দেবীকে সেকথা বলতেই উনি বললেন,

ঠিক আছে, পরে আবার ফোন করবি কিন্তু।

কুহেলি কিছু না বলে চুপচাপ সায় দিয়ে দিল। খাওয়ার পর শৈলজা দেবীকে শুইয়ে দিয়ে তবে নিজের ঘরে এল কুহেলি। উনি তো আজ শুতেই চাইছিলেন না, কিন্তু কুহেলি একটা কথাও শোনেনি। তবে কুহেলি জোর না করলেও উনি জেগে থাকতে পারতেন না, ওষুধের প্রভাবে এমনিই ঘুম এসে যেত। চৈতালী দেবীরও আজ ভালই পরিশ্রম হয়ে গেছে, তাই উনিও একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন। কুহেলিরও আপাতত কিছু করার নেই তাই চুপচাপ খাটের পাশের জানালাটার ধারে বসে একটা পুরনো গল্পের বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। পড়তে পড়তে বইটার মধ্যে ডুবে গিয়েছিল প্রায়, চমক ভাঙল ফোনের শব্দে। তাকিয়ে দেখল আলেখ কল করছে, ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আলেখের গলা পাওয়া গেল।

গুড আফটার নুন মিস বাসু।

গুড আফটার নুন স্যার।

বলুন।

কুহেলি একটু অবাক হল, ফোনটা তো আলেখ করেছে, তাহলে ও কি বলবে?

সরি?

এবার আলেখও অবাক হল,

মিস বাসু, আপনি কিছু বলার জন্যই তো ফোন করেছিলেন?

এবার কুহেলি বুঝতে পারল, আজকাল তো ফোন অফ থাকলেও অন করার সঙ্গে সঙ্গে কোম্পানি গুলো মেসেজ করে জানিয়ে দেয় কে কতবার ফোন করেছে, কখন করেছে। কুহেলি একটু ইতস্তত করে বলল,

হ্যা… না.. মানে হ্যা..

মিস বাসু সব ঠিক আছে তো?

আলেখের গলায় চিন্তার সুর, কুহেলি ব্যস্ত হয়ে বলল,

না না, সব ঠিক আছে। আসলে আমার ঠাম্মু বলছিল আপনাদের খোজ নিতে, আপনারা ঠিকঠাক কলকাতায় পৌঁছলেন কিনা, তাই…..

আলেখ হেসে বলল,

ওহ, আমি ভাবলাম…. আমরা একদম ঠিকঠাক মত পৌঁছে গেছি, এইতো, জাস্ট টেন মিনিটস হল এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েছি। এখন হোটেলের দিকে যাচ্ছি, এখনও মিনিট কুড়ি লাগবে পৌঁছাতে।

ও, কোন হোটেল?

গ্র্যান্ড।

ওহ, গ্র্যান্ড থেকে আমাদের বাড়িতে আসতেও মোটামুটি পঁচিশ তিরিশ মিনিট লাগে।

হুম, আপনি অ্যাড্রেস দেওয়ার পরেই চেক করে নিয়েছি। আমরা সাতটায় পৌঁছে যাব আপনাদের বাড়িতে।

ওকে।

একটু থেমে কুহেলি জিজ্ঞেস করল,

স্যার কেমন আছেন?

প্রশ্নটা সে আলেখকে করলেও উত্তর এল স্বয়ং নভতেজ শর্মার কাছ থেকে। উত্তর না বলে অভিযোগ বলাই ভাল,

কুহেলি, আমি তোমাকে অলরেডি নিজের মেয়ে বলে মেনে নিয়েছি আর তুমি এখনও আমাকে স্যার বলছ? তোমার কাছ থেকে কিন্তু এটা আমি আশা করিনি, তার মানে তুমি মন থেকে আমাকে আপন মনে কর না, তাই না?

কুহেলির খুব খারাপ লাগল, সত্যিই তো, উনি তো কত সহজেই ওকে আপন করে নিয়েছেন। কিন্তু কুহেলিও বা কি করবে, হঠাৎ করে তো আর ড্যাড বা অন্য কোনো পিতৃ সূচক সম্বোধন করতে পারে না। এখনও তো সম্পর্ক টা শুরুই হয় নি, একটু তো সময় লাগবেই। কুহেলির মনের কথা টা বুঝতে পেরেই হয়তো নভতেজ শর্মা বললেন,

জানি, এত তাড়াতাড়ি হয়তো তোমার আমাকে ড্যাড বলতে সংকোচ হচ্ছে, কিন্তু অন্তত পক্ষে আঙ্কেল তো বলতে পারো। তা না করে, এখনও স্যার বলছ! আমি কিন্তু সত্যিই কষ্ট পেয়েছি।

কুহেলির এবার খুব খারাপ লাগছে, একটু থেমে বলল,

সরি আঙ্কেল।

ওদিক থেকে কিছুক্ষণ কোনও আওয়াজ এল না, কুহেলি ভাবল উনি হয়তো সত্যিই খুব কষ্ট পেয়েছেন। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল, কিন্তু একটু পরেই ওকে অবাক করে দিয়ে নভতেজ শর্মা জোরে হেসে উঠলেন। কুহেলি রীতিমত চমকে উঠল, কিছুক্ষণ হেসে উনি বললেন,

ভয় পেয়ে গিয়েছিলে না? আরে আমি তো মজা করছিলাম।

বলে আবার হাসতে লাগলেন, কুহেলি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ওর সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল, নভতেজ শর্মা আবার বললেন,

তবে আমি মজা করলেও তুমি কিন্তু আর আমাকে স্যার বলতে পারবে না। তাহলে কিন্তু সত্যিই কষ্ট পাব, আপাতত আঙ্কেল টা ঠিক আছে।

কুহেলি হেসে বলল,

ওকে আঙ্কেল।

আরও দু চারটে টুক টাক কথা বলে ফোনটা রেখে দিল কুহেলি। বইটা বন্ধ করে জায়গায় রেখে নিচে নেমে এল, চৈতালী দেবী ড্রয়িং রুমে বসে কারো সাথে ফোনে কথা বলছিলেন। কুহেলি গিয়ে ওনার পাশে বসল, কিছুক্ষণ কথা শোনার পরেই বুঝতে পারল চৈতালী দেবী ওর মাসি মানে চৈতী দেবীর সঙ্গে কথা বলছেন। আলোচ্য বিষয় টা নিশ্চয়ই আর বলতে হবে না, আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর চৈতালী দেবী কুহেলিকে ফোনটা দিলেন। চৈতী দেবী খুব খুশি হয়েছেন, অনেকক্ষণ ধরে কুহেলির সাথে কথা বললেন। ওদের কথা শেষ হতে হতে শৈলজা দেবীও চলে এলেন, হাতে একটা সুন্দর শাড়ী।

কুহু এখানেই আছিস, ভালই হল, এই নে এটা ধর।

বলে শাড়িটা কুহেলির হাতে দিলেন, কুহেলি একটু অবাক হয়ে বলল,

এটা দিয়ে আমি কি করব?

শৈলজা দেবী তার থেকেও বেশি অবাক হয়ে বললেন,

কি করবি মানে! পরবি, আবার কি করবি? তোকে দেখতে আসছে বলে কথা, শাড়ি না পরলে চলবে কি করে?

ঠাম্মু ওনারা আমাকে দেখতে আসছেন না, তোমাদের সাথে কথা বলতে আসছেন। ওনারা তো অলরেডি আমাকে দেখেছেন, আমাকে আগে থেকেই চেনেন।

অত আমি জানি না, আজকে এই শাড়িটা পরতে বলেছি মানে এটাই পরবি।

কুহেলি আরও একটু আপত্তি করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শৈলজা দেবী তাতে কানই দিলেন না। ওনারা কখন আসছেন জেনে নিয়ে সন্ধ্যে দিতে চলে গেলেন। চৈতালী দেবী ইতিমধ্যে উঠে নিজের কাজে লেগে পড়েছেন, ঘরদোর ভালো করে গুছিয়ে নিচ্ছেন। কুহেলি শাড়িটা নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল, শাড়ি পরতে ওর ভালই লাগে কিন্তু আজকে শাড়ি পরার কোনও প্রয়োজন আছে বলে ওর মনে হয় না। যাই হোক কিছু করার নেই, সময় খুব বেশি বাকি নেই, শাড়ি পরতে গেলে এখনই তৈরি হওয়া শুরু করতে হবে। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে শাড়ি পড়তে শুরু করল, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরল। শাড়িটা সত্যিই খুব সুন্দর, জামদানি বলে কথা, সুন্দর না হয়ে যাবেটাই বা কোথায়। তারপর শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কানে হালকা ঝোলা একটা দুল পড়ল, গলায় পরল একটা সরু লকেট দেওয়া চেন। হাতে পরার মত তেমন কিছু পাচ্ছিল না, আছে অনেক কিছুই কিন্তু একটাও এই শাড়িটার সাথে ভালোলাগছে না। এমন সময় চৈতালী দেবী ওর ঘরে ঢুকলেন, কুহেলিকে দেখে বললেন,

বাহ্, শাড়িটায় খুব সুন্দর মানিয়েছে তো তোকে। হাতে কি পরছিস?

হাতে পরার মত তেমন কিছু পাচ্ছি না গো, খুঁজছি।

আর খুঁজতে হবে না, এই নে।

চৈতালী দেবী একজোড়া বালা ওর হাতে দিয়ে বললেন,

এটা পর, খুব ভালো মানাবে।

বালা দুটো সত্যিই খুব সুন্দর মানাচ্ছে শাড়িটার সাথে। বালা দুটো পরে কুহেলি বলল,

এগুলো কার মা? আগে দেখিনি তো?

চৈতালী দেবী একটু ম্লান হেসে বললেন,

এগুলো তোরই। তোর বাবা দিয়েছিল তোর প্রথম জন্মদিনে, আমার কথা মতই ছোট না করে একেবারে বড়ই বানানো হয়েছিল। তোর বিয়েতে দেব বলে তুলে রেখে দিয়েছিলাম, আজ শাড়িটা দেখে মনে হল খুব ভালো মানাবে। তাই নিয়ে এলাম, আর তাছাড়াও, আজকের দিনে তোর বাবার আশির্বাদ টাও তোর সঙ্গে থাকবে।

কুহেলির চোখটা জলে ভরে এল, চৈতালী দেবী ওর চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে বললেন,

আজকের দিনে চোখের জল ফেলিস না, তোর বাবাও কিন্তু তাহলে কষ্ট পাবে। তোর তো মনে নেই, যখনই তোর বাবা তোকে কোলে নিত তুই খিলখিল করে হেসে উঠতিস।

কুহেলি বালা দুটোয় হাত বুলিয়ে আলতো করে হাসল। চৈতালী দেবী ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

মন খারাপ করিস না, ওনাদের আসার সময় হয়ে এসেছে। তুই রেডি হয়ে নিচে আয়, আমি যাই দেখি বাকি কাজ সেরে আমাকেও তো একটু রেডি হতে হবে।

চৈতালী দেবী চলে গেলেন, কুহেলি চোখ দুটো ভালো করে মুছে নিল। ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বাকি সাজটা সম্পূর্ণ করল। ইচ্ছে করেই আজ লাইনারের পরিবর্তে গভীর চোখ দুটোয় কাজলের ছোয়া দিল, ঈষৎ গোলাপি ঠোঁট দুটো আরও একটু রাঙিয়ে নিল। চুলটা ছেড়েই রাখল, সুগন্ধীর ছোয়া মেখে কপালে একটা ছোট্ট টিপ দিয়ে যখন সাজটা সম্পূর্ণ করল তখন কুহেলির রূপে যেন একটা অনন্য সৌন্দর্য্যের পরশ লেগেছে। চোখ ধাঁধানো রূপের ছটা নয়, বরং একটা স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্যের আভা ফুটে উঠেছে। কুহেলি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ক্লান্তিহীন সময়ের কাটা টা সাতটার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। আলেখ এবং নভতেজ শর্মা দুজনেই ওর মতই পাঞ্চুয়াল, সুতরাং ওরা এলেন বলে। কুহেলি ফোনটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে এল, শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী বসে কথা বলছিলেন, ওনাদেরও সব প্রস্তুতি শেষ, এখন শুধু অপেক্ষা। কুহেলিকে দেখে ওদের দুজনের চোখেই একটা মুগ্ধতার ভাব ফুটে উঠল, শৈলজা দেবী বললেন,

কি মিষ্টি লাগছে রে তোকে কুহু, দেখ চৈতালী।

চৈতালী দেবী কিছু বললেন না, এগিয়ে এসে কুহেলির গালে একটা হাত রেখে হাসলেন। আর ঠিক তখনই কলিংবেলটা বেজে উঠল, শৈলজা দেবী ব্যস্ত হয়ে বললেন,

ওই বোধহয় ওনারা এসে পড়েছেন।

কুহেলি নিজে গেল দরজা খুলতে, কারণ শুধুমাত্র কুহেলিই ওদের পরিচিত। সঙ্গে অবশ্য চৈতালী দেবীও গেলেন। দরজাটা খুলতেই সামনে পরিচিত হাসিমুখ দুটো দেখতে পেল কুহেলি। হেসে ওদের দুজনকে ভিতরে আসার আমন্ত্রণ জানাল, কিন্তু সেই আমন্ত্রণ আলেখের কর্ণগোচর হল না। দরজার বাইরেই স্থির হয়ে দাড়িয়ে রইল, নিষ্পলক চোখে চেয়ে আছে কুহেলির দিকে। শাড়ি পরিহিতা কুহেলিকে যেন চিনতেই পারছে না, অফিস আউটফিটের বাইরে শুধুমাত্র সেদিন সালোয়ারে দেখেছিল। সেদিনও অভিভূত হয়েছিল কিন্তু আজকের কুহেলির সঙ্গে সেদিন কুহেলির কোনও তুলনাই চলে না। কুহেলি না ডাকলে ওরকম হতভম্ভের মত আরও কতক্ষন দাড়িয়ে থাকত কে জানে! কুহেলি এবং চৈতালী দেবী ওদের ভিতরে এনে বসালেন। কুহেলি প্রথমেই নভতেজ শর্মাকে প্রণাম করল, উনি কুহেলির মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করে বললেন,

খুব সুখী হও। দেখি একটু, আরে বাহ, খুব মিষ্টি লাগছে তোমাকে, ভেরি প্রিটি।

কুহেলি চোখটা নামিয়ে একটু হাসল তারপর একে একে সবার সঙ্গে ওনাদের পরিচয় করিয়ে দিল, আলেখ হাসি মুখে সবার সঙ্গে পরিচয় করল। এমনকি শৈলজা দেবী এবং চৈতালী দেবীর পা ছুয়ে প্রণাম করল। এতে শৈলজা দেবী এবং চৈতালী দেবী দুজনেই বেশ খুশি হলেন, সঙ্গে কিছুটা অবাকও। হয়তো আশা করেননি আলেখ এতটা নম্র হবে, কুহেলি তো আলেখের স্বভাব কিছুটা হলেও জানে কিন্তু এতটা হয়তো সেও আশা করেনি। অবাক হলেও মনে মনে খুব খুশি হল, কিন্তু অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল। কুহেলি সবার সঙ্গে আলেখের পরিচয় করিয়ে এবার নভতেজ শর্মার সঙ্গে সবার পরিচয় করাল। আর ঠিক তারপরেই নভতেজ শর্মা উঠে গিয়ে শৈলজা দেবীর পা ছুয়ে প্রণাম করলেন। এটা কুহেলি বা অন্য কেউই আশা করেনি, ঘটনাটা এতটাই অবিশ্বাস্য যে সবাই কিছুক্ষণের জন্য কেমন হতবাক হয়ে গেল। এতকিছুর মধ্যে কিন্তু একজোড়া চোখ সুযোগ পেলেই চলে যাচ্ছে কুহেলির দিকে। ব্যক্তি টি কে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না, আলেখ একমুহুর্তের জন্যও কুহেলির দিক থেকে চোখ সরাতে পারছে না। আবার একভাবে তাকাতেও পারছে না, অনেক চেষ্টা করছে অবাধ্য চোখ দুটোকে শাসন করার। কিন্তু আজ ওর চোখদুটো যেন হঠাৎ করেই ভিষন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হালকা গোলাপি শাড়ির সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে একটা বিশেষ রকমের সোনালী নক্সা। তার সঙ্গে একদম মানানসই অথচ পরিমিত সাজে কুহেলিকে অসম্ভব মোহময়ী দেখাচ্ছে। খোলা চুলের কিছুটা অংশ ডানদিকের কাধের উপর থেকে নেমে এসেছে সামনে। আর ওই কপালের ছোট্ট টিপটা, যেন কুহেলির রূপে একটা অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। আলেখ যেন সেই রূপের সাগরে হারিয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ নভতেজ শর্মার ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেল। আলেখ নিজেকে সংযত করল, একরকম জোর করেই কুহেলির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। নভতেজ শর্মা ইশারায় কিছু একটা বলতেই আলেখ কতগুলো প্যাকেট ওনার হাতে দিল। উনি সেই প্যাকেট গুলো একে একে চৈতালী দেবী এবং শৈলজা দেবীর হাতে দিলেন। ওনারা ভিষন আপত্তি করলেন, কিন্তু নভতেজ শর্মা শুনলেন না, বললেন,

আপনাদের সবথেকে মূল্যবান সম্পত্তি টি নিয়ে যেতে এসেছি, তার জন্য কিছু ঘুষ তো দিতেই হবে।

শৈলজা দেবী হিন্দী বোঝেন সবই কিন্তু ঠিক মত বলতে পারেন না, নভতেজ শর্মার এই কথার উত্তরে একগাল হেসে ওনার ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে যা বললেন তার মানে হল এই,

এই সম্পদ এমন এক সম্পদ যা সবাইকেই একদিন অন্যের হাতে তুলে দিতেই হয়। আমাদেরও তাই করতে হবে, কিন্তু তার আগে সবটা যাচাই করে নেওয়াটাও জরুরি। সব তো আর ঘুষ দিয়ে হয় না, তাই না?

এবার আলেখ হঠাৎ ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ হাসিটা হেসে বলল,

ঠাম্মু… আমি আপনাকে ঠাম্মু বলতে পারি তো?

আলেখের মুখ থেকে ঠাম্মু ডাকটা শুনে সবাই ভিষন অবাক হয়েছে, বিশেষ করে কুহেলি। অবাক হয়ে আলেখের দিকে তাকিয়ে রইল, শৈলজা দেবী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হেসে বললেন,

নিশ্চয়ই পারো। আমার কাছে কুহু যেমন তুমিও তেমন, কিন্তু বাবা ঠাম্মুকে তো আপনি বলা যাবে না, তুমি বলতে হবে। পারবে?

আলেখ হেসে বলল,

পারব।

এরপর অনেকক্ষন ধরে দুই পরিবারের মধ্যে অনেক কথা হল। কুহেলি চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবীর মুখ দেখেই বুঝতে পারল, ওনাদের মনে সামান্য যে সংশয় ছিল সেটা আস্তে আস্তে মিলিয়ে আসছে। দীর্ঘ আলোচনার মধ্যে মান্তু একবার চা মিষ্টি দিয়ে গেছে, তাও বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেছে। একসময় চৈতালী দেবী বললেন,

সত্যি বলতে কুহু যখন প্রথম আপনাদের কথা বলল, আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে একটা সংশয় থেকেই যাচ্ছিল, মেয়ের মা তো, বুঝতেই পারছেন। কিন্তু এখন আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে বুঝতে পারছি কুহু ঠিকই বলেছিল, আপনাদের মত পরিবারে আমার কুহু খুব ভালো থাকবে। আলেখের মত একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলে ও খুব সুখী হবে।

কথাটা শুনে আলেখ আর কুহেলি দুজনেই একে অপরের দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই দুজনেই একটু আলতো হেসে চোখ ফিরিয়ে নিল। চৈতালী দেবীর কথার উত্তরে নভতেজ শর্মা বললেন,

এটা আপনি ঠিক বলছেন না, কুহেলি বেটা এতটাই ভালো ওকে যে কেউ নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে পেতে চাইবে। আমি জানি আলেখ ছেলে হিসেবে ভাল কিন্তু কুহেলির থেকেও আলেখ আর আমি অনেক বেশি লাকি। এতদিন পর আমার শুন্য সংসারে লক্ষ্মী আসছে, তাও আবার কুহেলির মত একজন মেয়ে। এই সম্পর্কটা স্বীকার করার জন্য আপনাদের আমি কিভাবে ধন্যবাদ জানাব আমি বুঝতে পারছি না।

দুইপক্ষ এই সম্পর্কটা এত খুশি মনে মেনে নিয়েছে দেখে কুহেলির খুব ভালোলাগছিল। কুহেলি এতক্ষণ শৈলজা দেবীর পাশে বসে ছিল, নভতেজ শর্মা হঠাৎ ওকে নিজের কাছে ডাকলেন। কুহেলি একবার চৈতালী দেবীর দিকে তাকিয়ে ধীর পায়ে উঠে ওনার পাশে গিয়ে বসল। উনি একটা ছোট লাল রঙের ভেলভেটের বক্স কুহেলির হাতে দিলেন, ওটা যে জুয়েলারী বক্স সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। কুহেলি একটু ইতস্তত করতে লাগল, এভাবে হঠাৎ করে …. চৈতালী দেবী এবং শৈলজা দেবী দুজনেই অবাক হয়েছেন। আজ তো শুধুমাত্র আলাপ পর্ব, আর আজকেই… নভতেজ শর্মা সবার মনের ভাবটা খুব সহজেই বুঝতে পারলেন। একটু হেসে কুহেলির মাথায় হাত রেখে বললেন,

সংকোচ করো না বেটা, এটা তোমার আন্টির আশীর্বাদ। আজ উনি থাকলে নিজে হাতে তোমাকে দিতেন, সেটা তো আর সম্ভব নয় তাই আমিই ওর হয়ে এটা তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি, না করো না।

এই কথার পর না করার কোনও অবকাশই থাকে না। কুহেলি বক্স টা হাতে নিলে উনি ওটা খুলে দেখতে বললেন। কুহেলিও বাধ্য মেয়ের মত বক্সটা খুলল, খুব সুন্দর একজোড়া কানের দুল। নভতেজ শর্মা অনুরোধের সুরে বললেন,

একবার এটা পরবে বেটা?

এমন একটা অনুরোধ ফেরানোর ক্ষমতা বোধহয় কারোরই হত না, কুহেলি খুশি মনে নিজের কানের দুলটা খুলে ওনার দেওয়া কানের দুলটা পরল। নভতেজ শর্মা বেশ কিছুক্ষণ একভাবে কুহেলির দিকে চেয়ে রইলেন, কুহেলি লক্ষ্য করল ওনার চোখের কোনটা চিকচিক করছে। কিছুক্ষণ ওইভাবেই কুহেলিকে দেখার পর উনি বললেন,

আজ নন্দিনী থাকলে সত্যিই খুব খুশি হত।

বলে নিজের চোখের কোণে জমে থাকা জলের বিন্দু দুটো মুছে নিয়ে আবার আগের মতই হাসি মুখে বললেন,

সরি, একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম, যাক সে কথা। কুহেলি বেটা তোমাকে দারুন মানিয়েছে কিন্তু এই দুলটায়। এটা যেন তোমার জন্যই তৈরি হয়েছে।

কুহেলি একটু হাসল, তারপর একবার আলেখের দিকে তাকাল, এর আগেও দেখেছে ওর মায়ের কথা উঠলেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। আজও ওর মুখটা কেমন থমথমে দেখাচ্ছে, কুহেলি বুঝল আলেখ প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে ধরে রাখার কিন্তু পারছে না। কুহেলির খুব ইচ্ছে হল ওকে একটু সান্ত্বনা দিতে কিন্তু সবার মধ্যে কিছু বলতে পারল না। আলেখ মাথাটা নীচু করে বসে রইল, আর কুহেলি চেয়েও কিছু করতে পারল না। হঠাৎই শৈলজা দেবী ওর সমস্যার সমাধান করে দিলেন,

কুহু, তুই আলেখকে আমাদের বাড়িটা একটু ঘুরিয়ে দেখালি না? প্রথমবার এসেছে, যা একটু ঘুরিয়ে দেখা।

কুহেলি এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল, একমুহুর্তও সময় নস্ট না করে উঠে দাড়িয়ে বলল,

আসুন।

আলেখ বিনা বাক্য ব্যয়ে কুহেলির সঙ্গে চলে এল। ওর নিজেরও সবার সামনে থাকতে একটু কষ্টই হচ্ছিল। কুহেলি আলেখকে নিয়ে সোজা ছাদে উঠে এল, একটা ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। ওদের ছাদে একটা দোলনা আছে, আলেখকে নিয়ে সেই দোলনাতে গিয়েই বসল। বেশ কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলল না, কুহেলি জানে আলেখের এখন একটু একা থাকার প্রয়োজন। বেশ কিছুক্ষণ পর আলেখ কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

থ্যাঙ্কস।

কুহেলি কিছু বলল না। আলেখ বলতে থাকল,

সবই তো জানেন, বোঝেনও সব তাই আলাদা করে বলার আর কিছুই নেই। আমি খুব চেষ্টা করি জানেন তো, সত্যিই খুব চেষ্টা করি। প্রত্যেকবার ভাবি মমের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলোকে মনে করে খুশি থাকব। কিন্তু পারি না, মমের কথা উঠলেই….

আলেখের গলা ধরে এসেছে, কুহেলি তাকিয়ে দেখল ওর দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্ট গুলো। কুহেলির চোখ দুটোও ভিজে এল, আলেখ আবার বলতে শুরু করল।

জানেন তো মমের উল্লেখ হলেই আমার চোখের সামনে মমের নিষ্প্রাণ দেহটা ভেসে ওঠে। শেষের কটা দিন খুব কষ্ট পেয়েছিল, মম……..

আলেখ আর কথা বলতে পারল না, চোখ দুটো বন্ধ করে নিল। বন্ধ আগল ভেদ করেও বারি পতন অব্যাহত রইল। কুহেলি চুপচাপ কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কোথাও গিয়ে যেন ওদের দুজনের কষ্টটা একজায়গায় মিলে মিশে যায়। হঠাৎ কুহেলির হাতটা ওর অজান্তেই আলেখের গাল স্পর্শ করল, পরম যত্নে মুছিয়ে দিল উষ্ণ জলকণা গুলো। হঠাৎ একটা কোমল স্পর্শে আলেখ চমকে উঠল, কুহেলির দিকে তাকিয়েই স্থির হয়ে গেল। কুহেলির ঈষৎ ভেজা গভীর চোখ দুটোয় যেন একটু একটু করে হারিয়ে যেতে লাগল। কুহেলিও জানে না ও কি করছে, কেন করছে। হঠাৎ একসময় আলেখ আচমকাই কুহেলিকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিল, কুহেলি বাধা দিল না। দুজনেই যেন একটা অন্য আবেশের মধ্যে রয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পর আলেখ নিজের অবস্থান টা বুঝতে পেরে কুহেলিকে ছেড়ে উঠে দাড়াল। কুহেলিরও ঘোর কেটে গেল, দুজনেরই একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হতে লাগল। আলেখ কুহেলির দিকে না তাকিয়েই বলল,

সরি মিস বাসু, আসলে….

কুহেলি আলেখকে বাধা দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বলল,

ইটস ওকে, এটা নিয়ে কথা না বলাই মনে হয় ভালো।

আলেখ বুঝল কুহেলি অস্বস্তি বোধ করছে, সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওর নিজেরও অস্বস্তি হচ্ছে, হঠাৎ করে কেন যে ওরকম করল! কুহেলির মনেও একই প্রশ্ন ঘুরছে, হঠাৎ করে ও কি করছিল, কীকরে করল এমনটা!! কিন্তু পরিস্থিতিটা একটু স্বাভাবিক করা প্রয়োজন, এভাবে তো আরও বেশি অস্বস্তি হবে। আলেখ নিজেকে স্বাভাবিক করে চির পরিচিত হাসিটা এনে বলল,

চলুন মিস বাসু, আপনার রুমটা অন্তত দেখে আসি, নাহলে ঠাম্মু যদি জিজ্ঞেস করে এই দোলনা টা ছাড়া আর কিছুই তো বলতে পারব না।

কুহেলি বুঝল আলেখ ওর অস্বস্তি টা কাটানোর জন্যই এই কথাগুলো বলছে। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে, এই মানুষটা কত সহজে সবকিছু স্বাভাবিক করে তুলতে পারে। কুহেলি হেসে আলেখকে নিয়ে নিজের রুমে চলে এল, শুধু ওর ঘরটাই নয় পুরো দোতলাটাই ঘুরিয়ে দেখাল। ধীরে ধীরে দুজনেই আগের মতই স্বাভাবিক হয়ে গেল, যেন একটু আগের ঘটনাটা ঘটেই নি। ওদিকে নীচে এতক্ষণে কথা অনেকদূর এগিয়েছে, দুই পক্ষের কেউই বিয়েতে বেশি দেরী করতে চান না। সুতরাং শুভস্য শীঘ্রম কেই স্লোগান করে দুই পক্ষ একেবারে কোমর বেঁধে আলোচনায় নেমে পড়ল। নভতেজ শর্মা প্রথমেই হাত তুলে দিয়েছেন, ওনার তেমন ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজন নেই যারা সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে পাঞ্জাবি রীতিনীতি মেনে বিয়ের সব আয়োজন করতে পারবে। সুতরাং বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব কুহেলিদের, ওনারা শুধু বরযাত্রী নিয়ে সময়মত উপস্থিত হবেন, বাকি সব দায়িত্ব কনেপক্ষের। এতে অবশ্য শৈলজা দেবী ভিষন খুশি হলেন, বাঙালি রীতি মেনে বিয়ে হবে, খুশি তো হবেনই। শেষে ঠিক হল শৈলজা দেবী ওনার গুরুদেবের সঙ্গে কথা বলে আগামী শ্রাবণ মাসেই একটা ভালো দিন স্থির করবেন। তারপর সেই অনুযায়ী বাকি প্রস্তুতি শুরু করা যাবে। ওনাদের কথা শেষ হতে হতেই আলেখ আর কুহেলিও চলে এল, ওদের দেখেই শৈলজা দেবী আনন্দে ওদের কাছে টেনে নিলেন। দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

খুব শিগগিরই তোমরা দুজন নতুন জীবন শুরু করতে চলেছ। আমি আজ খুব খুশি, আমার ছোট্ট কুহু আজ কত বড় হয়ে গেছে।

কুহেলি ওনাকে জড়িয়ে ধরল, ওর প্রিয় ঠাম্মুকে এত খুশি দেখে ওরও খুব ভালোলাগছে। এর মধ্যেই চৈতালী দেবী বললেন,

আচ্ছা, এবার কিন্তু আমাদের ডিনার শুরু করা উচিৎ, সময় হয়ে গেছে।

শৈলজা দেবী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

ওমা, তাই তো, চৈতালী তুমি ব্যবস্থা কর।

চৈতালী দেবী উঠে ডিনারের ব্যবস্থা করতে গেলেন, কুহেলিও ওনার সঙ্গে গেল। মান্তুকে খাবার গরম করতে বলে দুজনে মিলে টেবিলটা সাজাতে লাগলেন। চৈতালী দেবী বললেন,

কুহু, তুই ঠিকই বলেছিলি, ওনাদের মত মানুষ হয় না। এইযুগের ছেলে হয়েও বিশেষ করে এত বিত্তবান হওয়া সত্বেও আলেখ কত নম্র। আর ওর বাবাও, খুব ভালো মনের মানুষ, এতটুকু অহংকার নেই। তুই একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস কুহু, দেখিস ওই পরিবারে তুই খুব সুখী হবি।

কুহেলি কিছু বলল না, পরবর্তীতে কি হবে ও জানে না, কিন্তু এই মুহূর্তে ওর সবথেকে প্রিয় মানুষ দুটোকে এত খুশি দেখে ওর নিজেকে সত্যিই খুব সুখী মনে হচ্ছে। মান্তুর খাবার গরম করা হয়ে গেলে দুজনে মিলে সেগুলো একদম সাবেকি বাঙালি পদ্ধতিতে আলাদা আলাদা বাটিতে সাজিয়ে প্লেটের চারপাশে সুন্দর করে রেখে দিল। সব সাজানো হয়ে গেলে সবাই মিলে খেতে বসল, এত রকম বাঙালি পদ আলেখ বা নভতেজ শর্মা কেউই আগে খাননি। দুজনেই সবগুলো পদ খেলেন, শুধু খেলেন বললে কম বলা হবে, পরম তৃপ্তি করে খেলেন। মাছের মাথা দিয়ে মুগের ডাল থেকে শুরু করে শেষ পাতের পায়েস পর্যন্ত সবকিছুই যেন ওনাদের কাছে অমৃত মনে হচ্ছিল। খাওয়ার পরেও নভতেজ শর্মা রান্নার প্রশংসা করা বন্ধ করলেন না, বিশেষ করে ভেটকি মাছের পাতুরি। কলার পাতায় মোড়া বস্তু টার যে এত অতুলনীয় স্বাদ হতে পারে তা নাকি উনি কল্পনাও করতে পারেন না। আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে ওনারা ফেরার জন্য উঠলেন, আলেখ বেরোনোর আগে আরও একবার চৈতালী দেবী আর শৈলজা দেবীকে প্রণাম করল। নভতেজ শর্মাও শৈলজা দেবীকে প্রণাম করতে ভুললেন না, কুহেলিও প্রণাম করল। কুহেলি আর চৈতালী দেবী ওনাদের গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আলেখ গাড়িতে উঠে একবার কুহেলির দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে ওদের দুজনকেই গুডনাইট জানাল। কুহেলি আর চৈতালী দেবীও প্রতিউত্তর জানালেন। আলেখরা চলে যাওয়ার পর ওরা ঘরে ফিরে দেখে শৈলজা দেবী মান্তুর সঙ্গে কিছু একটা নিয়ে জোর তর আলোচনা করছেন। শেষটায় যা বোঝা গেল, তা হল এই যে শৈলজা দেবী এখন থেকেই বিয়ের ফর্দ তৈরী করতে লেগেছেন। তার উৎসাহ এখন দেখে কে! মনের মত একটি নাত জামাই পেয়েছেন, তার প্রশংসা তো থামছেই না। শেষে অনেক কষ্টে তাকে ঠান্ডা করে ওষুধ খাইয়ে একেবারে ঘুম পাড়িয়ে তবে নিজের ঘরে এল কুহেলি। শাড়িটা ছেড়ে, একটা হালকা নাইট স্যুট পরে গয়না গাটি গুলো খুলতে বসল। হাতের বালাটা খুলে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিল, সকালেই ওটা আবার চৈতালী দেবীকে দিয়ে দেবে। এটা আপাতত ওনার কাছেই থাক, গলার চেনটা খুলে কানের দুলটা খুলতে গিয়েই আলেখের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গেই মনে পড়ে গেল সেই ঘটনাটা, আবার সেই একই প্রশ্ন গুলো উকি দিতে লাগল। আবেগের দোলায় এতোটা কীকরে ভেসে গেল! এরকম নিয়ন্ত্রণ হারা তো এর আগে কখনোই মনে হয়নি নিজেকে। অনেক ভেবেও কোনও সদুত্তর পেল না কুহেলি, ভাবনার জগতে আরও কতক্ষন বিচরণ করত বলা যায় না কিন্তু চৈতালী দেবীর কথায় বাস্তবে ফিরতে হল।

কি ভাবছিস কুহু?

হ্যা? কই কিছু না তো।

চৈতালী দেবী কিছু না বলে শুধু হাসলেন। এগিয়ে এসে বললেন,

আলেখ খুব ভালো ছেলে, আমাদের ওকে খুব ভালো লেগেছে। বাবাও ওকে দেখে খুব খুশি হবে দেখিস।

এটা বলেই চৈতালী দেবী হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ার মত করে বললেন,

হ্যা রে কুহু, ওনারা তো কালই ফিরে যাচ্ছেন। তাই তো বললেন তখন। ইশ আমার একদম মনেই ছিল না রে।

কি হল?

আরে, বাবার সঙ্গে আলাপ হল না তো!

সে তো পরেও করা যাবে।

সে যাবে, কিন্তু বিয়ের তারিখটা ফাইনাল হওয়ার আগে দেখা করতে পারলে ভাল হত। ইশ ওনাদের একবার বলে দেখলেই হত।

কিন্তু সেটা কীকরে সম্ভব মা? তুমিই তো বললে ওনারা কালকেই ফিরে যাচ্ছেন।

কুহু, তুই একবার কথা বলে দেখ না। মিস্টার শর্মা বলছিলেন ওনাদের বিকেলের ফ্লাইট। যদি একবার আলেখ সকালে তোর সঙ্গে যায়।

মা, এটা কি বলছ? এভাবে হুট করে বলা যায় নাকি?

আরে তুই বলেই দেখ না, আলেখকে যেটুকু দেখেছি তাতে ও আপত্তি করবে না।

এত স্বল্প সময়ে আলেখের প্রতি ওনার বিশ্বাস দেখে কুহেলি একটু অবাক হলেও মনে মনে খুশিই হল।

ঠিক আছে বলে দেখব।

চৈতালী হেসে ওর থুতনি টা ধরে একটু আদর করে দিলেন।

একবার কথা বলে শুয়ে পড়িস কিন্তু, শুধু শুধু রাত জাগবি না। আমিও যাই, কালকে আবার সকাল সকাল নার্সিংহোমে যেতে হবে।

চৈতালী দেবী চলে যাচ্ছিলেন, কুহেলি পিছন থেকে ডেকে বালা দুটো ওনার হাতে দিল। চৈতালী দেবী বললেন,

এটা আবার আমাকে দিচ্ছিস কেন? তোর কাছেই রাখ।

না মা, এটা এখন তোমার কাছেই রাখ, পরে সময়মত দিও।

চৈতালী দেবী আর কথা বাড়ালেন না, বালা দুটো নিয়ে চলে গেলেন। কুহেলি কানের দুল দুটো খুলে সযত্নে বক্সে রেখে তুলে রাখল। মুখটা ধুয়ে এসে বিছানায় বসে ফোনটা হাতে নিল। এখন আলেখকে ফোন করতে হবে, একটু সংকোচ হচ্ছে। কি জানি এভাবে হুট করে ওর সঙ্গে যেতে বলায় কিছু মনে করবে কিনা! একটু ইতস্তত করে ফোনটা করেই ফেলল। কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পরেই আলেখের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

বলুন মিস বাসু।

ডিস্টার্ব করলাম?

নট অ্যাট অল, আপনি বলুন।

আসলে একটা দরকারেই ফোন করলাম।

এনিথিং সিরিয়াস?

নো নো, আসলে….না, মানে.. ওই…

একটু ইতস্তত করে কুহেলি সবটা বুঝিয়ে বলল। শুনে আলেখ বলল,

এটা বলার জন্য আপনি এত ভাবছিলেন?

হ্যা, মানে…আমি ভাবছিলাম আপনার যদি কোনও অসুবিধা থাকে।

মিস বাসু, এতে অসুবিধার কি আছে? আমাদের ফ্লাইট সাড়ে পাঁচটায়। পুরো সকালটা আমি এমনিতেই ফ্রি আছি। আপনার সঙ্গে যেতে আমার কোনও অসুবিধা নেই।

ওকে, তাহলে আমি ঠিক দশটায় আপনাকে পিক করে নেব।

ফাইন।

ওকে, গুডনাইট।

গুডনাইট।

ফোনটা রেখে কুহেলি শুয়ে পড়ল, হাত বাড়িয়ে পাশের ছোট্ট টেবিলটায় জ্বলতে থাকা নাইট ল্যাম্প টা অফ করে দিল। চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে নানারকম ভাবনা ভিড় করে আসতে লাগল। কত তাড়াতাড়ি কত কিছু হয়ে গেল, আজ এককথায় ওর বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, শুধু তারিখটা ঠিক করা বাকি। তাও যা শুনছে তাতে আগামী মাস দুয়েকের বেশি দেরি হবে বলে মনে হয় না। ওর বিয়ে! কথাটা ভাবতেও কেমন অদ্ভুত লাগছে। এমনটা যে হতে পারে কুহেলি কোনদিনও স্বপ্নেও ভাবেনি। তবে এটাই তো জীবন, সবসময় জীবন আমাদের সাজিয়ে রাখা পথে এগোয় না। সোজা পথে চলতে চলতে হঠাৎ এমন একটা বাঁক নেয়, যার ফলস্বরূপ আমাদের গোটা জীবনটাই বদলে যায়। ঠিক যেমন এখন কুহেলির জীবনে ঘটছে, ওর একে রাখা জীবনের চিত্রপটের অনেকটাই বদলে গেছে। ভবিষ্যতে হয়তো সেই চিত্রটা আরও পাল্টে যাবে। তবে সেসব তো এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে, সময় হলেই জানা যাবে। এখন আপাতত বর্তমানেই মনঃসংযোগ করা যাক। চিন্তার জাল বুনতে বুনতে কখন যেন ঘুমের সাগরে হারিয়ে গেছে কুহেলি। দেয়াল ঘড়িতে সময় বলছে বারোটা পাঁচ, অবিরাম ঘুরতে থাকা সময় কাটা দুটো আপন মনে এগিয়ে চলল আরও একটা নতুন দিনের দিকে।

ক্রমশ_____________

কেমন লাগল আজকের পর্ব? যথাসাধ্য বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনাদের মতামত জানাবেন কিন্তু। অপেক্ষায় থাকব। কুহেলির বিয়ে তবে শেষমেশ ফাইনাল হয়েই গেল, আর বেশি অপেক্ষা করাব না আপনাদের। আগামী পর্ব থেকেই আলেখ আর কুহেলির বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করার চেষ্টা করব। এত দায়িত্ব একা নিতে পারব না কিন্তু, আপনাদেরকেও পাশে চাই কিন্তু। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here