সংগোপনে’ পর্ব-২১

0
1892

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২১
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

সারাদিন কর্মব্যস্ততার মধ্যে দিয়েই কেটে গেল। কাজের প্রয়োজনে মাত্র দু বার আলেখের সঙ্গে কথা হয়েছে কুহেলির। অফিস আওয়ার প্রায় শেষ হয়েই এসেছে, তেমন কাজও আর বাকি নেই, সুতরাং ওভার টাইম করারও প্রয়োজন নেই। হাতের কাজটুকু শেষ করে কুহেলি নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নীচে নেমে এল। আলেখের কাজ এখনও শেষ হয়নি, অফিসে বসে অপেক্ষা করাও যায় না। কিন্তু কথাটা আজকেই বলবে, তাই নিচে এসে একটা পাশে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একে একে মোটামুটি সবাই চলে গেল কিন্তু আলেখের দেখা নেই, শেষে প্রায় একঘন্টা পর আলেখকে আসতে দেখা গেল। কুহেলি ওর দিকে এগিয়ে যেতেই আলেখ অবাক হয়ে বলল,

মিস বাসু, আপনি এখনও যাননি?

না, আসলে আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।

আমার কেবিনে এলেন না কেন?

আসলে কথাটা পার্সোনাল।

সো হোয়াট?

অফিসে পার্সোনাল কথা বলাটা আমার ঠিক মনে হল না।

তাই বলে আপনি এতক্ষণ ওয়েট করবেন? একবার আমাকে অন্তত বলতে তো পারতেন। আমি না হয় একটু তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করতাম।

ইটস ওকে স্যার, আমার কোনও প্রবলেম হয়নি।

সে তো দেখতেই পাচ্ছি, ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা করেছেন।

গরমের মধ্যে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে সত্যিই বড্ড ঘেমে গেছে বেচারি। আলেখ কুহেলিকে হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগল, এরকম আচমকা হাত ধরায় কুহেলি একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাধা দেওয়ার চেষ্টা করার আগেই ওরা পার্কিংয়ে এসে পড়ল, কুহেলিকে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও ড্রাইভিং সিটে বসল। আগে গাড়ির এসি টা অন করল, এতক্ষণ গরমের মধ্যে দাড়িয়ে থাকার পর এসির ঠান্ডা হাওয়ায় মনটা জুড়িয়ে যাচ্ছিল কুহেলির। কিন্তু তার থেকেও বেশি ভাল লাগল আলেখের ব্যবহারে, কতটা যত্নশীল মানুষটা, সবদিকে নজর থাকে। আলেখকে যত দেখছে ততই নিজের সিদ্ধান্তের উপর বিশ্বাসটা দৃঢ় হচ্ছে, নাহ ভুল হয়তো সে করেনি। কালকে নিশীথের বলা কথাগুলো একমুহুর্তের জন্য হলেও ওর মনে সংশয়ের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে, এমন একজন মানুষ এতবড় একটা বিষয়ে মিথ্যে কথা বলতেই পারেন না। আলেখ গাড়ি স্টার্ট করে সোজা কুহেলির অ্যাপার্টমেন্টের রাস্তা ধরল, সেটা দেখে কুহেলি বলল,

স্যার আমার কিছু বলার ছিল তো।

হুম, বলবেন তো, সেই জন্যেই তো যাচ্ছি।

কিন্তু এটা তো আমার ফ্ল্যাটের রাস্তা।

হ্যা, আমরা আপনার ফ্ল্যাটেই যাচ্ছি। কেন, আপনার ফ্ল্যাটে বসে কথা বলা যাবে না? নাকি আমার আপনার ফ্ল্যাটে যাওয়াটা আপনার পছন্দ নয়?

না ম…..

কুহেলির কথা শেষ হওয়ার আগেই আলেখ বলল,

না? ওহ সো সরি তাহলে তো অন্য কোথাও যেতে হবে। আসলে আমি ঠিক বুঝতে পারিনি তো, ইটস ওকে।

আরে আমি কি তাই বললাম নাকি?

তাই তো বললেন।

কোথায়? আপনি তো আমার কথাটা পুরো শুনলেনই না।

কুহেলিকে ব্যতিব্যস্ত হতে দেখে আলেখ মুচকি মুচকি হাসতে লাগল, আর সেটা দেখে কুহেলি বুঝল আলেখ ওর সাথে মজা করছে। কুহেলির ভারী রাগ হল, ওর বলে রীতিমত চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল, আলেখ ওর কথাটা ভুল বুঝছে ভেবে আর উনি নাকি মজা করছেন!! কুহেলি আর কোনও কথা বলল না, চুপচাপ বাইরের দিকে মুখ করে বসে রইল। আলেখ পরিস্থিতিটা বুঝে বলল,

সরি মিস বাসু, আই ওয়াস জাস্ট জোকিং।

কুহেলি কোনও জবাব দিল না, আগের মতই বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আলেখ বুঝল কুহেলির হয়তো খারাপ লেগেছে, গাড়িটা একটা ফাঁকা জায়গা দেখে একপাশে দাড় করাল। আচমকা গাড়ি দাড় করানোয় কুহেলি চমকে আলেখের দিকে তাকাল, আলেখ সোজা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। কুহেলি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,

এখানে দাড়ালেন কেন?

আলেখ সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল,

সরি, আমি বুঝতে পারিনি আপনার খারাপ লাগবে। আমি জাস্ট এমনিই একটু মজা করছিলাম।

আলেখকে ওভাবে সরি বলতে দেখে কুহেলির খারাপ লাগল।

ইটস ওকে স্যার, আমার খারাপ লাগেনি।

আলেখ একটু থেমে বলল,

মিস বাসু আমরা একটা নতুন সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চলেছি, আমার মনে হয় এবার আমাদের মধ্যের এই ফর্ম্যালিটি গুলো একটু কম করা দরকার।

মানে?

মানে, আর মাত্র দুমাস বাকি আমাদের বিয়ের। আমরা অফিসিয়ালি হাসবেন্ড অ্যান্ড ওয়াইফ হতে চলেছি। আমাদের মধ্যে সেরকম কোনও সম্পর্ক না হলেও অন্তত বন্ধুত্বের সম্পর্কটা কিন্তু হতেই পারে। মানে হওয়া উচিত, তাতে আমাদেরই সুবিধা, জীবনের আগামী দিনগুলো আমাদের একসাথেই পথ চলতে হবে তাই বন্ধুত্ব দিয়ে সম্পর্কটা শুরু হলে আমাদের দুজনেরই কিন্তু সুবিধা। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি বন্ধু হিসেবে আমি খুব একটা খারাপ নই।

শেষের কথাটা আলেখ এমন ভাবে বলল কুহেলি না হেসে পারল না। কথাটা খুবই সত্যি, সারাটা জীবন একসাথে পথ চলতে গেলে অন্তত বন্ধুত্ব হওয়াটা খুবই প্রয়োজন। রক্তের সম্পর্কের বাইরে বন্ধুত্বের চেয়ে পবিত্র সম্পর্ক মনে হয় না আর হয়। অনেক সময় তো রক্তের সম্পর্কের থেকেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক বেশি গভীর হয়ে যায়। আলেখ ওর ডান হাতটা করমর্দনের ভঙ্গিমায় কুহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

একবার ট্রাই করে দেখতে বোধহয় দোষ নেই?

কুহেলি হেসে ওর হাতটা ধরে বলল,

একদমই না, যতক্ষণ ট্রাই না করব, ততক্ষণ বুঝব কীকরে?

আলেখ হেসে আবার গাড়ি স্টার্ট করল, কুহেলিরও বেশ হালকা মনে হচ্ছে। ওদের মাঝের এই বস-এম্প্লয়ী সম্পর্কের ফরমালিটি গুলো যত কমবে ততই ভালো। চলার পথে একজন বন্ধুকে পাশে পেলে পথটা অনেক সহজ হয়ে যায়। কুহেলির ফ্ল্যাটে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগল না, গাড়িটা জায়গামতো পার্ক করে দুজনেই ফ্ল্যাটে উঠে এল। কুহেলি আলেখকে লিভিংরুমে বসিয়ে কফি বানাতে চলে গেল। যদিও এখন অভ্যেস মত আগে ফ্রেশ হতে ইচ্ছে করছে তবুও ইচ্ছেটা দমিয়ে রেখে দুকাপ কফি বানিয়ে এনে আলেখের মুখোমুখি বসল। আলেখ কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল,

বলুন, কি বলতে চান?

কুহেলি একটু সময় নিয়ে মনে মনে সব কথাগুলো গুছিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল।

আমি আপনাকে আমার সম্পর্কে সব কথাই জানিয়েছি, শুধু একটা বিষয় ছাড়া। আজ সেটাই বলতে চাই, আমি চাই আমাদের নতুন সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগে আপনি সবটা জানুন।

কুহেলি কথাগুলো খুব শান্ত অথচ গম্ভীর গলায় বলল, আলেখ বুঝল কথাগুলো নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাও সে বলল,

মিস বাসু, সব কথা যে আমাকে জানাতেই হবে এমন কোনও বাধ্য বাধকতা কিন্তু নেই। সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস থাকা উচিৎ, সেটা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

না স্যার, আমি চাই আপনি সবটা জানুন।

ওকে, অ্যাস ইউ উইশ। আমি বাধা দেব না, বলুন।

কুহেলি একটু থেমে একদম শুরু থেকে সবটা বলল, নিশীথের পাঠানো বেনামী মেসেজ, প্রোডাক্ট লঞ্চের দিন ওর প্রপোজ, তারপরের সব ঘটনা এমনকি গতকালের ঘটনাও। কুহেলি যতক্ষণ কথা বলছিল আলেখ একটাও কথা বলেনি, চুপচাপ মন দিয়ে সবটা শুনেছে। আর ধীরে ধীরে মুখের অভিব্যক্তির একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটেছে। যেটা খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে ধরা পড়ে না, কুহেলি একভাবে সবটা বলে আলেখের দিকে তাকাল। হয়তো ওর প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু তেমন কিছুই বুঝতে পারল না। আলেখ বেশ কিছুক্ষণ কিছুই বলল না, নিজের কফিটা শেষ করে কাপটা সেন্টার টেবিলের ওপর রেখে বলল,

আপনার মতে আমার কিভাবে রিয়্যাক্ট করা উচিৎ?

কুহেলি এমন একটা প্রতিক্রিয়া একেবারেই আশা করেনি। আলেখ ওর কাছে জানতে চাইছে এটা শুনে কেমন প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিৎ!! কুহেলি অবাক হয়ে আলেখের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কি বলবে বা কি বলা উচিত সেটা কিছুতেই মাথায় এল না। আলেখ একটু হেসে বলল,

যেহেতু আমাদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, ইভেন ডেট ও ফাইনাল হয়ে গেছে সেই হিসেবে আমার কি এটা শুনে রাগ করা উচিত?

কুহেলি এই কথারও কোনও উত্তর দিতে পারল না, আলেখ নিজেই বলল,

মিস বাসু, ভালোবাসা এমন একটা অনুভুতি যেটা কখন কিভাবে কার প্রতি সৃষ্টি হবে সেটা কেউ জানে না। এটা কারোর হাতে নেই, ভেবে চিন্তে প্ল্যান করে ভালোবাসা যায় না, এটা তো জাস্ট হয়ে যায়। মিস্টার নিশীথ আগরওয়ালের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একই, ওনার মনেও আপনার প্রতি ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। তাতে দোষের তো কিছু নেই, আর কাউকে ভালোবাসলে তাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছেটাও খুব স্বাভাবিক। উনি নিজের ভালোবাসার কথা আপনাকে জানিয়েছেন আপনি আপনার উত্তর ওনাকে জানিয়েছেন, ব্যস। এখানে আমার মতামত বা আমার প্রতিক্রিয়া কোনও ম্যাটার করে না। যেটা ম্যাটার করে সেটা হল আপনার মতামত, আপনি কি চান সেটাই এখানে শেষ কথা। আর আপনি স্পষ্ট ভাষায় আপনার উত্তর ওনাকে জানিয়েই দিয়েছেন, তাহলে আর সমস্যা কোথায়? রইল ওনার ভালোবাসার কথা, সেটা তো সম্পূর্ণ ওনার ব্যক্তিগত ব্যাপার, আর এটা তো সত্যি, ভালোবাসা এত সহজে ভুলে যাওয়া যায় না। এটা আপনাকে হয়তো বলে দিতে হবে না।

নাহ, এটা সত্যিই কুহেলিকে আলাদা করে বলে দিতে হবে না। কুহেলি চুপ করে আলেখের কথা গুলো শুনছিল, আর ভাবছিল, কেউ এতোটা সহজ ভাবে সবকিছু কীকরে বুঝে নিতে পারে। শুধু তাই নয়, অন্য মানুষের মনের মধ্যে চলতে থাকা অস্থিরতা গুলোকেও কত সহজে শান্ত করে দিতে পারে। কুহেলি এইসব ভাবছিল, তারমধ্যেই আলেখ আবার বলল,

তবে একটা বিষয় আমাকে খুব ভাবাচ্ছে।

আলেখ বেশ সিরিয়াস হয়েই কথাটা বলেছে, কুহেলি একটু উৎকন্ঠিত সুরে বলল,

কি?

আলেখ বেশ ভেবে বলল,

ভাবছিলাম, আমার উড বি ওয়াইফের এত অনুরাগী, সবাইকে সামলাতে পারব তো?

কুহেলি কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে রইল, এইরকম একটা কথায় ঠিক কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে সেটা বুঝে ওঠার আগেই আলেখ হেসে উঠল। কুহেলি এখনও অবাক হয়ে তাকিয়েই আছে, কি অদ্ভুত, আজ যেন কথায় কথায় মজা করছে আলেখ। ওর এইরূপ টা কুহেলির একেবারেই অচেনা, কুহেলিকে ওভাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আলেখ হাসতে হাসতেই বলল,

সরি মিস বাসু, আসলে মজা করার অভ্যেসটা আমার খুব পুরনো। সুযোগ পেলে হাতছাড়া করি না, তবে সবার সঙ্গে করি না, শুধুমাত্র আমার বন্ধু স্থানীয় বা আপনজন দের সঙ্গেই এটা সীমা বদ্ধ।

কুহেলি এতক্ষণ আলেখের কথাটা সেভাবে খেয়াল করেনি, মানে এতটাই চমকে গিয়েছিল যে কথাটাও ঠিক করে বুঝে উঠতে পারেনি তখন। এখন কথাগুলোর অর্থ বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে একরাশ লজ্জা উড়ে এসে জুড়ে বসল। কারনটা প্রতিবারের মত এবারও অজানাই রয়ে গেল। কুহেলি কোনরকমে একটু হেসে কাপ দুটো কিচেনে রাখার অছিলায় ওখান থেকে পালিয়ে এল। আগে ফ্রিজ থেকে একটা ঠান্ডা জলের বোতল বের করে ঢক ঢক করে খানিকটা জল শেষ করে তবে শান্ত হল। আলেখ যেন হঠাৎ করেই অনেকটা সহজ হয়ে গেছে ওর সঙ্গে, যদিও সেটাই স্বাভাবিক। আর কয়েকটা দিন পরেই যার সঙ্গে সারা জীবনের জন্য একসাথে পথ চলার অঙ্গীকার করবে, তার সঙ্গে ধীরে ধীরে সহজ হওয়াটাই তো উচিৎ। তবুও কুহেলির কেমন যেন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে যেটা ও নিজেও ঠিক বুঝতে পারছে না। তবে আলেখ যেভাবে নিশীথের ব্যাপারটা মেনে নিল, তার থেকেও বলা ভাল কুহেলিকে বুঝিয়ে দিল তাতে সত্যিই কুহেলি খুব অবাক হয়েছে। আর ঠিক যতটা অবাক হয়েছে ততটাই শ্রদ্ধা বেড়েছে মানুষটার প্রতি। কুহেলি নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আবার ফিরে এল, আলেখের ঠোঁটের কোণে ওর সেই চির পরিচিত হাসিটা এখনও লেগে আছে। এই হাসিটা কুহেলির ভিষন পরিচিত কিন্তু আজ কেন যেন ওই হাসিটাও একটা অন্যরকম অনুভূতির সৃষ্টি করছে। আলেখ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই ওর একটা কল এসে পড়ায় সেটা আর বলা হল না। আলেখ ওর কাছে অনুমতি নিয়ে কলটা রিসিভ করল, ওপাশের কথা গুলো শুনতে না পেলেও আলেখের কথায় অপর প্রান্তের ব্যক্তি টিকে চিনতে কোনও অসুবিধা হল না। নভতেজ শর্মা কিছু কথা বলার পরে যখন জানতে পারলেন আলেখ এখন কুহেলির সঙ্গে রয়েছে, অমনি ফোনটা কুহেলিকে দিতে বললেন। কুহেলিও বিনা বাক্যব্যয়ে ফোনটা নিয়ে বলল,

গুড ইভনিং আঙ্কেল।

গুড ইভনিং বেটা, হাউ আর ইউ?

ভালো আছি, হাউ আর ইউ?

ভালই ছিলাম, তবে এখন তোমার সঙ্গে কথা বলার পর আরও বেশি ভালো আছি।

কুহেলি শুধু হাসল, নভতেজ শর্মা বললেন,

তোমার মা আমাকে ফোন করেছিলেন, বিয়ের ডেট জানানোর জন্য। আন্টিজীর সাথেও কথা হল, সত্যি বলতে বেটা এই দুটো মাসও আমার কাছে বেশি মনে হচ্ছে। আমি পারলে কালকেই বিয়েটা দিয়ে দিতাম।

কুহেলি এবারও কিছু বলল না, কিই বা বলবে, এমন কথার কি কোনও উত্তর হয়! যাই হোক, উনি আবার বলতে শুরু করলেন।

আমি তোমাকে আজকে এমনিতেও কল করতাম। ভালই হল আলেখকে এখন কল করলাম, তোমার সাথেও একেবারে কথা হয়ে গেল। শোনো যেটা বলার, কালকে তুমি আমাদের বাড়িতে আসবে। আমি আলেখকে বলে দেব, তোমাকে নিয়ে আসবে।

তার দরকার হবে না আঙ্কেল আমি নিজেই যেতে পারব, কিন্তু হঠাৎ? কোনও দরকার আছে?

দরকার তো অবশ্যই আছে, তবে দরকার না থাকলে কি তুমি আসবে না?

কেন আসব না আঙ্কেল? আমি কি তাই বললাম?

জানি তো, আমার মেয়েকে আমি যখনই ডাকব তখনই আসবে। আর তো দুটো মাস, তারপরেই পার্মানেন্টলি আমার মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে আসব।

কুহেলি আরও দুচারটে কথা বলে ফোনটা আলেখকে ফেরত দিল, আলেখ কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রেখে বলল,

তাহলে মিস বাসু, আজকে আসি। কালকে দশটার সময় রেডি থাকবেন, আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাব।

তার দরকার নেই, আমি নিজেই চলে যেতে পারব। আপনি আবার শুধু শুধু কষ্ট করে এতোটা আসবেন কেন?

প্রথমত, ড্যাডের অর্ডার অমান্য করার সামর্থ্য আমার নেই। আর দ্বিতীয়ত, এখানে আসতে আমার কোনরকম কষ্ট হবে না। সো রিল্যাক্স, আপনি শুধু সময়মত রেডি থাকবেন।

এরপর আর কোনও কথা চলে না। আলেখ এবার কুহেলির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল, কুহেলি ওকে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এল। ফ্ল্যাটে ফিরে আগে ওয়াশরুমে ঢুকল, স্নান করে তবে শান্তি পেল। ওর বরাবরের অভ্যাস বাইরে থেকে এসে আগে ফ্রেশ হয়, তারপরে বাকি কথা। তবে এইরকম বিশেষ পরিস্থিতে সেটা আর হয়ে ওঠে না। আটটা বাজে এখনও ডিনারের অনেক দেরী, চুপচাপ খাটে উঠে কোলে একটা বালিশ নিয়ে হেলান দিয়ে বসল। নাহ, সবকিছু বেশ ঠিকঠাকই এগোচ্ছে, দুই পরিবারের ওদের সম্পর্কটা খুশি মনে মেনে নেওয়া থেকে শুরু করে আলেখের নিশীথ আগরওয়ালের ব্যাপারটা এত স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া পর্যন্ত সবটাই যেন খুব সুন্দর, মসৃণ ভাবে হচ্ছে। আগামীতেও সবটা সুন্দর ভাবে হলেই ভালো, কিন্তু কাল হঠাৎ ওঙ্কার ভিলায় তার কি দরকার থাকতে পারে? একটু ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু খুব একটা লাভ হল না। তেমন যুতসই একটাও কারণ মনে এল না, আর অত ভেবে হবেও বা কি, কালকে গেলেই তো দেখা যাবে। কুহেলি আর বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে ল্যাপটপ টা টেনে নিয়ে কাজে মন দিল। কাজ সেরে উঠতে উঠতে রাত দশটা পেরিয়ে গেল, খাবারগুলো গরম করে খেয়ে শুয়ে পড়ল, কাল আবার ওঙ্কার ভিলায় যেতে হবে, ঘুম আসতেও তেমন দেরী হল না। পরদিন সকালে ঠিক সময় মতই তৈরি হয়ে নিল কুহেলি, আজ আর তেমন ফর্ম্যাল কিছু পরেনি। একটা ব্ল্যাক পালাজো আর তার সঙ্গে অফ হোয়াইটের উপর সেলফ ডিজাইন করা সাধারণ একটা লং কুর্তি। চুলগুলো ভিজে থাকায় ছেড়েই রাখল, কানে একটা ছোট্ট ব্ল্যাক স্টোন বসানো টপ আর গলায় একটা সিলভার চেনের সঙ্গে ম্যাচিং ব্ল্যাক স্টোন বসানো একটা ছোট লকেট। এক হাতে ঘড়ি আর অন্য হাতে একটা সরু ব্ল্যাক ব্যাঙ্গেল, প্রসাধনীরও বাহুল্য নেই, হালকা একটু লিপগ্লস আর চোখের কোলে আলতো কাজলের ছোয়া, ব্যাস, কমপ্লিট। গীতা ওকে রবিবারের সকালে এভাবে রেডি হতে দেখে প্রশ্ন করল কোথায় যাচ্ছে, দুপুরের খাবার তাহলে বানাবে কিনা। আজ আর লুকোতে ইচ্ছে হল না, সত্যিটা বলেই দিল, শুনে গীতার সেকি আনন্দ। কি করবে আর কি করবে না কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারল না। শেষে রান্নার ফাঁকে ফাঁকে এখান কার লোকাল সুইট ডিশ বাদাম পুরী বানিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে দিল। গীতার এই আন্তরিক ব্যবহার টা কুহেলির খুব ভালোলাগে, আপনজনের অভাব টা কিছুটা হলেও পূরণ হয়। গীতা রোজকার মত সাড়ে নটার মধ্যে কাজ সেরে বেরিয়ে গেল, আর ঠিক দশটার সময় আলেখ এল। আজ আর উপরে না গিয়ে গাড়িতে বসেই কুহেলিকে ফোন করে দিল, ঠিক পাঁচ মিনিট পরেই কুহেলিকে হেঁটে আসতে দেখা গেল। নিতান্ত সাধারন সাজেও কি অসাধারণ দেখাচ্ছে, আলেখ মুগ্ধ না হয়ে পারল না। কুহেলি এসে ওর পাশের সিটে বসার পর থেকে গোটা গাড়িটা একটা মিষ্টি সুগন্ধে ভরে উঠল। এটা কোনও পারফিউমের গন্ধ নয়, কোনও কৃত্রিম গন্ধে এতোটা নেশা থাকে না। এই ঘ্রাণটা এর আগেও একবার আলেখ অনুভব করেছে, আলেখ মুগ্ধ হয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে ছিল, কুহেলির কথায় যেন ঘোর কাটল।

স্যার?

হ্যা?

কিছু ভাবছেন?

আমি? ন..না তো। কেন?

না মানে আমি দুবার আপনাকে গুড মর্নিং উইশ করলাম কিন্তু আপনি একবারও উত্তর দিলেন না, তাই ভাবলাম।

আলেখ একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

না না, আসলে ঠিক খেয়াল করিনি। সরি অ্যান্ড গুড মর্নিং।

কুহেলি হাসল, হাসিটা যেন সেই মিষ্টি গন্ধটার সঙ্গে মিশে একযোগে ওর বুকের বা পাশটায় আঘাত হানল। হঠাৎ এমন কেন হচ্ছে সেটা কিছুতেই বুঝতে পারল না আলেখ, কোনরকমে নিজেকে সংযত করে ড্রাইভিং এ মন দিল। খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা হাওয়ায় কুহেলির চুলগুলো বাঁধন হারা হয়ে উড়তে লাগল। আর সেই সঙ্গে মাতাল করা গন্ধ টা বারবার আছড়ে পড়তে লাগল আলেখের চেতনায়। কুহেলি সমানে চুলগুলোকে সামলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছে না। আলেখ প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সংযত করার কিন্তু অবাধ্য চোখ দুটো বারবার কুহেলির দিকেই চলে যাচ্ছে। এইভাবেই একসময় ওঙ্কার ভিলা এসে পড়ে, আলেখ গাড়ি থেকে নেমে যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এখন আর সেই মাতাল করা ঘ্রাণ টা ওকে স্পর্শ করতে পারছে না, কারণ কুহেলির থেকে একটা দূরত্ব বজায় রেখে এগোচ্ছে সে। এদিকে কুহেলিও গাড়ি থেকে নেমে যেন বাঁচল, চুলগুলো ভিজে ছিল বলে ছেড়ে রেখেছিল। কিন্তু খোলা জানালার সামনে চুলগুলো সামলাতে গিয়ে যে কি বেগ পেতে হয়েছে তা একমাত্র সেই জানে। চুলগুলোও কেমন ঘেঁটে গেছে, কোনরকমে আঙ্গুল চালিয়ে একটু ঠিকঠাক করে নিল। বাড়িতে প্রবেশ করেই কুহেলির চক্ষু চড়কগাছ, এ যে হাট বসেছে! প্রায় দশ বারো জন লোক বসে আছেন ড্রয়িং রুমে আর আরও জনা কুড়ি পুরুষ মহিলা তাদের আশে পাশে দাড়িয়ে আছেন। প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ব্যাগ বা স্যুটকেস, কারো কারো পাশে তো বেশ বড় রকমের বক্স রাখা। কুহেলির কিছুই বোধগম্য হল না, অবাক হয়ে একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল সেও ওর মতই হতবাক হয়ে গেছে। অর্থাৎ এসব কিছুর খবর আলেখও জানে না, তবে ওদের দুজনের কৌতূহলের নিরসন হতে বেশি দেরি হল না। নভতেজ শর্মা ওদের দেখেই উঠে দাড়িয়ে বললেন,

আরে কুহেলি, আলেখ কাম বেটা। আমি তোমাদের জন্যই ওয়েট করছিলাম।

কুহেলি ওর হতবাক ভাবটা কাটিয়ে ওনার দিকে এগিয়ে গেল, উনি কুহেলি আর আলেখকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পাওয়ার পরে জানা গেল এনারা সব শহরের বড় বড় জুয়েলার্স আর ক্লোদিং মার্চেন্ডারস। কিন্তু এনাদের এখানে আগমনের কারনটা এখনও পরিষ্কার নয়, সেটাও পরিষ্কার হল নভতেজ শর্মার আগামী কথায়।

আলেখ কুহেলি, নেক্সট সানডে তোমাদের এনগেজমেন্ট পার্টি। এনারা সবাই সেই জন্যই আজ এখানে এসেছেন।

আলেখ আর কুহেলি দুজনেই এতটাই অবাক হল এটা শুনে যে দুজনেই সমস্বরে বলে উঠল,

হোয়াট??

আরে এত অবাক হওয়ার কি আছে! দুমাস পরে তোমাদের বিয়ে তার আগে এনগেজমেন্ট তো হবেই।

কিন্তু ড্যাড এভাবে ওনাদের সাথে আলোচনা না করে তুমি কীকরে ডেট ফিক্স করতে পার? ওনাদের মতামতেরও তো একটা ব্যাপার আছে, তারপর আন্টির নার্সিংহোমের ব্যাপার আছে।

তোকে কে বলল আমি ওনাদের সাথে আলোচনা না করেই সব ঠিক করেছি? আমি রীতিমত ওনাদের সাথে কথা বলেই ডেট টা ফিক্স করেছি। ভুল বললাম, এই ডেট টাও উনিই ঠিক করেছেন যিনি বিয়ের ডেট ঠিক করেছেন।

এবার কুহেলি ভিষন রকম অবাক হল।

মানে! আঙ্কেল আপনি কি বলছেন? আমার বাড়িতে সবাই জানে? তাহলে আমাকে জানায়নি কেন?

কারণ আমি বারন করেছিলাম তাই। আমি তোমাদের দুজনকেই সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলাম, তবে সেসব পরে হবে আগে বলো তো আঙ্কেল কে আপনি করে কে বলে?

হ্যা?

এই যে তুমি আমাকে আপনি করে বলছ, এটা কি ঠিক হচ্ছে?

কুহেলির মাথা এমনিই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। তাও একটু সামলে নিয়ে বলল,

ঠিক আছে আর বলব না, কিন্তু আঙ্কেল এইসব হঠাৎ করে।

হঠাৎ করে না হলে সারপ্রাইজ হতো কীকরে?

কুহেলি ধীরে ধীরে নিজেকে শান্ত করে নিল। নভতেজ শর্মা বললেন,

নাও অনেক কথা হয়েছে, এবার চটপট সব সিলেক্ট করে ফেল তো। শহরের সব থেকে বেস্ট জুয়েলারী আর ডিজাইনার হাউস থেকে এনারা এসেছেন এনাদের বেস্ট কালেকশন নিয়ে। নিন, এবার আপনারা শুরু করুন, দেখবেন আমার মেয়ের যেন পছন্দ হয়।

ওনার নির্দেশ পেয়ে সবাই একে একে জুয়েলারী আর ডিজাইনার ড্রেসের সম্ভার সাজিয়ে ফেললেন। দেখতে দেখতে ওঙ্কার ভিলার ড্রয়িং রুম টা একটা শপিং হাউসে পরিণত হয়ে গেল। কুহেলি কি করবে ভেবে পেল না, কিন্তু নভতেজ শর্মা অসম্ভব উৎসাহী। নিজেই কুহেলিকে নিয়ে গিয়ে পছন্দ করতে শুরু করলেন, কুহেলিও আর কোনও উপায় না দেখে ওনার সঙ্গ দিল। একটা সুন্দর রয়্যাল ব্লু রঙের লেহেঙ্গার দিকে কুহেলির চোখ আটকে গেল, অসম্ভব সুন্দর লেহেঙ্গা টা। অতিরিক্ত কাজ নয় বরং সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সোনালি সুতোর কাজের ফাঁকে খুবই পরিমিত গোল্ডেন স্টোনের কাজ করা। নভতেজ শর্মা কুহেলিকে দেখেই বুঝলেন এটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে, আর অন্য কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা এই লেহেঙ্গা টাই ফাইনাল করে ফেললেন। এরপর তার সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী উনি নিজেই পছন্দ করলেন, কুহেলি এত দামী জুয়েলারী নিতে চাইছিল না কিন্তু নভতেজ শর্মা এমন ধমক দিলেন যে আর কিছু বলার সাহস পেল না। এরপর আলেখের ড্রেস পছন্দ করার পালা, নভতেজ শর্মা আলেখকে ডেকে বললেন,

আলেখ এদিকে আয়, নিজেরটা নিজে পছন্দ করে নে।

আলেখ এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, এবার উঠে এসে বলল,

ড্যাড আমি আবার কি সিলেক্ট করব, তুমিই একটা সিলেক্ট করে নাও।

এটা কেমন কথা! এনগেজমেন্ট টা তুই করবি আমি না।

কুহেলি ওদের কথার মধ্যেই শেরওয়ানি গুলো দেখছিল, এমনিই। হঠাৎ একটা শেরওয়ানি তে চোখ দুটো আটকে গেল, খুব অদ্ভুত ভাবে শেরওয়ানি টা ওর লেহেঙ্গা টার সঙ্গে একদম ম্যাচিং। সেই একই রয়্যাল ব্লু কালারের ওপর সোনালি সুতোর কাজ। কুহেলি একদৃষ্টে শেরওয়ানি টার দিকে তাকিয়ে ছিল, আলেখের দৃষ্টি হঠাৎই কুহেলির দিকে গেল। এত মনোযোগ দিয়ে কি দেখছে সেটা দেখার জন্য ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই শেরওয়ানি টা দেখতে পেল। আলেখের ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল, সোজা এগিয়ে এসে শেরওয়ানি টা নিয়ে নিজের সামনে ধরে বলল,

ড্যাড, হাউ অ্যাবাউট দিস?

কুহেলি একটু থতমত খেল, আলেখ যে ওই শেরওয়ানি টাই বেছে নেবে ভাবতে পারেনি। আলেখ মুচকি হেসে একবার কুহেলির দিকে তাকাল, কুহেলিও একটু হাসল। মনে মনে একটু খুশি হল কি? কে জানে! আজকাল নিজের অনুভুতি গুলো নিয়ে বেশি ভাবে না সে। কিন্তু অভিজ্ঞ নভতেজ শর্মার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি দেখা গেল, এখন সেই হাসির পিছনে কি কারণ থাকতে পারে সেটা না হয় উহ্যই থাক। উনি এগিয়ে এসে বললেন,

পারফেক্ট, একদম ম্যাচিং।

আরও কিছু টুকটাক কেনাকাটার পর যখন সবাই বিদায় নিলেন, তখন ইতিমধ্যে দুপুর। নভতেজ শর্মা কিছুতেই কুহেলিকে না খাইয়ে ছাড়লেন না, খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে উনি আলেখকে কুহেলিকে আবার ওর ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিতে বললেন। কুহেলি আপত্তি করে বলল,

আঙ্কেল আমি একাই চলে যেতে পারব। শুধু শুধু স্যারের কষ্ট হয়ে যাবে, সকালেও একবার আমাকে নিয়ে এসেছেন এখন এবার দিতে যাবেন। আমি একা চলে যাব, কোনও অসুবিধা হবে না।

নভতেজ শর্মা ওর কথার কোনও উত্তর না দিয়ে খুব অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন,

তুমি আলেখকে কি বলে ডাকলে?

কুহেলিও এ হেন একটা প্রশ্নের জন্য তৈরি ছিল না, একটু থেমে বলল,

স্যার।

উনি অবাক হয়ে বললেন,

তুমি এখনও আলেখকে স্যার বলো? ইভেন আপনি করে কথা বলো? আর তুই, তুই কি বলিস?

শেষের প্রশ্নটা আলেখকে উদ্দেশ্য করে করা হল। আলেখ খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

মিস বাসু বলেই তো শুরু থেকে অ্যাড্রেস করে আসছি, আর আপনি করেই বলি আমিও।

নভতেজ শর্মা এবার হতাশ হয়ে সোফায় বসে বললেন,

তোরা কি রে? সাতদিন বাদে এনগেজমেন্ট, দুমাস বাদে বিয়ে আর এখনও আপনি আজ্ঞে করছিস? আর নিজের হবু বউকে মিস বাসু এরকম ভাবে কে অ্যাড্রেস করে? আর এই যে কুহেলি, তোমাকেও বলছি নিজের হবু স্বামীকে কে স্যার বলে?

আলেখ বলল,

কিন্তু ড্যাড আমরা শুরু থেকে এভাবেই অভ্যস্ত।

আগের কথা আলাদা আর এখনের কথা আলাদা। না না, এইসব চলবে না, একদম না। আজ থেকে এই আপনি আজ্ঞে বন্ধ করতে হবে, আর আলেখ আজ থেকে তুই কুহেলিকে ওর নাম ধরেই ডাকবি। এত মিষ্টি একটা নাম থাকতে মিস বাসু, কি আশ্চর্য্য! আর কুহেলি তুমিও, স্যার বলা চলবে না, আপনি টাও ছাড়তে হবে।

কুহেলি একটু ক্ষীণ স্বরে বলল,

কিন্তু আঙ্কেল এভাবে হঠাৎ করে, আর তাছাড়াও অফিসেই বা কীকরে সম্ভব?

অফিসে যতক্ষণ থাকছ ততক্ষণ তো ফর্ম্যাল রিলেশন মেনটেন করছ, তখন যা ইচ্ছে কর। কিন্তু তার বাইরে এই ফর্ম্যাল সম্বোধন আমি আল্যাও করব না।

আলেখ একটু আপত্তি করার চেষ্টা করল, কিন্তু উনি কিছুই শুনলেন না। আর কুহেলিকে একাও বাড়ি ফিরতে দিলেন না, সুতরাং আর কথা না বাড়িয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। সারা রাস্তায় দুজনের মধ্যে তেমন একটা কথা হয়নি, এমনিতেই দুজনেই এই আচমকা এনগেজমেন্টের খবরে একটু স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিল, তারমধ্যে এই নতুন পরোয়ানা। এমন হুট করে কি এতদিনের অভ্যাস বদলানো যায় নাকি! তাই কথা না বলাটাই আপাতত ভালো মনে হল দুজনেরই। কুহেলিকে ওর আপ্যারটমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে আলেখ নিজেও নামল, তারপর ওর সামনে এসে একটু থেমে ইতস্তত করে বলল,

কোনও প্রেসার নেই, ড্যাড বলেছে ঠিকই কিন্তু যতদিন না আমরা নিজেরা কম্ফরটেবল হচ্ছি ততদিন যেমন চলছে তেমনই চলুক। শুধু ড্যাডের সামনে একটু সতর্ক থাকলেই হবে।

কুহেলি অবাক হয়ে দেখল, আলেখ গোটা কথার মধ্যে কি সুন্দর ভাবে সম্বোধনের অংশ টুকু বাদ দিয়ে কথা বলল। একটু হাসিও পেল, কি সমস্যায় না পড়া গেছে, এখন এতকিছু ভেবে কথা বলতে হচ্ছে। কুহেলি কোনও কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল, আলেখ চলে যাওয়ার পর কুহেলি ফ্ল্যাটে এসে আগে জুয়েলারী গুলো সাবধানে তুলে রাখল। ও তো আনতেই চাইছিল না কিন্তু নভতেজ শর্মা শোনেননি, তাই বাধ্য হয়ে আনতেই হয়েছে। লেহেঙ্গা টা পরে আসবে, ওর মাপে ফিটিং করে তবে ডেলিভার হবে। যাইহোক, জুয়েলারী গুলো তুলে রেখে ফ্রেশ হয়ে এসে আগে বাড়িতে ফোন করল। আজকে ভিডিও কল করার দিন, কলকেই বলে রেখেছিল আজকে ভিডিও কল করতে পারবে না, ওঙ্কার ভিলায় যেতে হবে। তখনও চৈতালী দেবী ওকে কিছু জানাননি, যতই সারপ্রাইজ হোক ওকে তো জানাতেই পারতেন। বেশ একটা রাগ রাগ ভাব নিয়েই ফোনটা করল, রবিবারের দুপুরের সময়টা চৈতালী দেবী একটু ঘুমান। কিছুক্ষণ পরেই ঘুম জড়ানো গলা শোনা গেল, কিন্তু কুহেলি সেসবে পাত্তা না দিয়ে সোজা আক্রমণে চলে গেল।

তুমি আমাকে বলনি কেন?

কি বলিনি?

মা, আমি জানি তুমি সব জানতে শুধু তুমি না ঠাম্মুও সব জানত কিন্তু তোমরা আমাকে জানাওনি।

চৈতালী দেবী হেসে বললেন,

কীকরে বলতাম বলত? উনি বারবার বলেছিলেন যাতে তোকে না জানাই, উনি সারপ্রাইজ দিতে চাইছিলেন।

তাই বলে তুমি আমাকে একদম কিছুই বললে না!!

বেশ কিছুক্ষণ মা মেয়েতে মান অভিমানের পালা চলল, তবে খুব বেশিক্ষণ না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওসব রাগ টাগ চলে গিয়ে দিব্বি গল্প শুরু হয়ে গেল। আজকের সব ঘটনা কুহেলি চৈতালী দেবীকে বলল, চৈতালী দেবী শুনে বেশ খুশি হলেন। ওনার কথায় জানা গেল, চৈতালী দেবী বলেছিলেন এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান টা উনি করবেন কিন্তু নভতেজ শর্মা রাজি হননি। ওনার কথা হল, বিয়েটা তো কলকাতায় বসে বাঙালি রীতি অনুযায়ী হবে, সুতরাং বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তো ওদের উপরেই তাই এনগেজমেন্টের সব দায়িত্ব উনি নেবেন। আর এনগেজমেন্ট পার্টি টা ব্যাঙ্গালোরে হবে, এমনকি ওনাদের টিকিটও নাকি বুক করা হয়ে গেছে, আগামী শনিবার ওনারা আসছেন। কুহেলি শৈলজা দেবীকে নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল, কিন্তু চৈতালী দেবী আশ্বাস দিয়ে জানালেন উনি ডক্টরের সঙ্গে ইতিমধ্যে পরামর্শ করে নিয়েছেন। দেবাঞ্জলিও আসবে কিন্তু চিরন্তন মানে কুহেলির মামা এখন আসতে পারবে না। এই মুহূর্তে ছুটি পাবে না, স্বরূপ বাবুকেও আনা সম্ভব হচ্ছে না। ওদিকে চৈতী দেবী আর দিঠিও আসবে, কুহেলির মেসো অবশ্য আসতে পারবেন না, সেই একই ছুটির সমস্যা। সবাই শনিবারই আসবেন, রবিবার এনগেজমেন্ট সেদিনটা থেকে আবার সোমবার যে যার জায়গায় ফিরে যাবেন। এতকিছু প্ল্যান ইতিমধ্যেই হয়ে বসে রয়েছে অথচ কুহেলি কিছুই জানত না, আরেক চোট একটু রাগারাগি করে শেষে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে ফোনটা রাখল। সত্যি কত তাড়াতাড়ি সব কিছু হয়ে যাচ্ছে, মাত্র সাতদিন পরেই ওর এনগেজমেন্ট! ভাবতেও কেমন লাগছে।

ক্রমশ______________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

নিন বিয়ে পর্যন্ত ওয়েট করতে হল না, তার আগেই একটু আনন্দের আমেজ নিয়ে হাজির হতে চলেছি। খুব শিগগিরিই আলেখ আর কুহেলির এনগেজমেন্ট হতে চলেছে। আসবেন কিন্তু, আর হ্যা, আজকের পর্বটা কেমন লাগল অবশ্যই জানাবেন। আমি অপেক্ষা করব আপনাদের কমেন্টের। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here