সংগোপনে’ পর্ব-২২

0
1705

#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_২২
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস

আগের পর্বের পর————-

মাঝখানের দিনগুলো যে কোথা থেকে পেরিয়ে গেল, কেউ টেরই পেল না। মাঝখানে আর মাত্র একটা দিন, কাল বাদে পরশু আলেখ আর কুহেলির এনগেজমেন্ট। এরমধ্যে আলেখ বা কুহেলি কেউই কাজের বাইরে তেমন কোনও কথা বলেনি, একমাত্র নভতেজ শর্মার জারি করা পরোয়ানার জন্যই। যাইহোক আজ সকাল থেকেই কুহেলি একটু বেশিই ব্যস্ত, কারণ আগামীকাল সে অফিসে আসতে পারবে না, তাই কাজগুলো এগিয়ে রাখছে। যদিও কুহেলি আসতেই চেয়েছিল কিন্তু আলেখ এবং নভতেজ শর্মা দুজনেই বারন করেছেন। ওনাদের কারোর কথাই অমান্য করার সামর্থ্য কুহেলির নেই, অবশ্য মনে মনে একটু যে খুশি হয় নি তা নয়। এই প্রথম শৈলজা দেবী এখানে আসছেন, চৈতালী দেবী আগে একবার মাত্র এসেছিলেন এই ফ্ল্যাটে শিফট করার সময়। ওনাদের সঙ্গে একটু বেশি সময় কাটাতে পারলে ভালই হয়। তাছাড়াও ওর মামী দেবাঞ্জলি, আর ওর মাসি মানে চৈতী দেবী আর ওনার মেয়ে দিঠিও কালকেই আসছে। সবার সঙ্গে একটা গোটা দিন কাটানোর সুযোগটা বেশ লোভনীয়, তাই আর আপত্তি করেনি। লাঞ্চ ব্রেক অবধি সব ঠিকঠাকই ছিল, বিপত্তি ঘটল তার পরে। লাঞ্চ ব্রেকের একটু পরেই হঠাৎ নভতেজ শর্মার আগমনে সবাই বেশ অবাক হল। উনি যে ঠিক কতদিন পর অফিসে এলেন তার হিসেব মনে হয় কারোরই ঠিক জানা নেই। কুহেলিও একটু অবাক হল, উনি এসেই সোজা আলেখের কেবিনে ঢুকলেন, মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে আলেখকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েও এলেন। ঠিক অফিসের মধ্যস্থানে দাড়িয়ে নভতেজ শর্মা বলতে শুরু করলেন,

এক্সকিউজ মি এভরিওয়ান। আমার কয়েকটা কথা বলার আছে, অনুগ্রহ করে সকলে মন দিয়ে শুনবেন।

কুহেলির হঠাৎ কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হল, মনে একটা আশঙ্কা উকি দিচ্ছে, প্রাণপণে চাইছে সেটা যেন সত্যি নাহয়। কিন্তু ওর আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে নভতেজ শর্মা বললেন,

মাই সন, মাই ওয়ান অ্যান্ড ওনলি সন ইজ গেটিং ম্যারেড সুন।

কথাটা শুনেই অফিসের প্রত্যেকটা লোক হাততালি দিয়ে উঠল, কুহেলির তখন অত্যন্ত শোচনীয় অবস্থা। কি যে হতে চলেছে সেটা ভেবেই কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, একবার আলেখের দিকে তাকিয়ে দেখল সে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে, তবে তারও যে একটু অস্বস্তি হচ্ছে সেটা কুহেলি বেশ বুঝতে পারল। সবাই আলেখকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, শুধু কুহেলি চুপচাপ দাড়িয়ে রইল বা বলা ভাল এরপর যা ঘটতে চলেছে তার জন্য নিজেকে একটু প্রস্তুত করতে লাগল। একটু পরেই নভতেজ শর্মা আবার বলতে শুরু করলেন,

আগামী সানডে মানে পরশু দিন এনগেজমেন্ট। আপনারা সবাই নিমন্ত্রিত, প্রত্যেকেই অবশ্যই আসবেন।

আরও একদফা হাততালির বন্যা বয়ে গেল, নভতেজ শর্মা সবাইকে থামিয়ে বললেন,

বাই দ্য ওয়ে, ব্রাইডকে কিন্তু আপনারা সবাই খুব ভালো করেই চেনেন, সে আপনাদের অতি পরিচিত।

ব্যাস, এই একটা কথাতেই কুহেলির হৃদযন্ত্র টা যেন হঠাৎ করেই অসম্ভব দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হতে লাগল। কারণ এরপর যেটা ঘটতে চলেছে সেটা কুহেলি মোটেই চাইছে না। তবে এই মুহূর্তে তার চাওয়া না চাওয়ায় কিছুই হবে না। ওদিকে সবার মধ্যে একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে, ওদের চেনা কে হতে পারে সেটা ভেবেই সবাই সবিশেষ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। নভতেজ শর্মা কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার কৌতূহল নিরসন করলেন, সোজা কুহেলির দিকে তাকিয়ে বললেন,

কুহেলি বেটা, কাম হিয়ার।

নিজের নামটা শোনামাত্রই কুহেলি সর্বশক্তি দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। চোখ বন্ধ থাকলেও বেশ বুঝতে পারছে এই মুহূর্তে এখানে উপস্থিত প্রত্যেকটা ব্যক্তিই এখন ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। আর এটা ভেবেই ওর অস্বস্তি টা শত সহস্র গুন বেড়ে গেল। কুহেলি জানে এটা লুকিয়ে রাখার মত বিষয় নয়, সবাই একদিন না একদিন ঠিকই জানত, কিন্তু তাইবলে এইভাবে! আশেপাশের কোলাহল তখন চাপা গুঞ্জনে পরিণত হয়েছে, কারোর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না, এটা আবার কিভাবে সম্ভব! কবে কখন কীকরে হল, এইসব টুকরো টুকরো প্রশ্ন উড়ে বেড়াতে লাগল। আর এতে কুহেলির এমনিতেই বেড়ে থাকা অস্বস্তির পরিমাণ আরও কিছুটা বেড়ে গেল। কুহেলিকে ওভাবে দাড়িয়ে থাকতে দেখে নভতেজ শর্মা নিজেই এগিয়ে এসে কুহেলির কাধে একটা হাত রাখলেন। কুহেলি এবার চোখ খুলে ওনার দিকে তাকাতে উনি হাসিমুখে বললেন,

ডোন্ট বি শাই বেটা, কাম।

বলে উনি কুহেলির একটা হাত ধরে নিয়ে আলেখের পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অফিসের সবার চোখে তখনও বিষ্ময় আর জিজ্ঞাসা, কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। কুহেলি অতি কষ্টে একটা সরু হাসির রেখা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল, নভতেজ শর্মা আবার বলতে শুরু করলেন,

মিট মাই উড বি ডটার ইন ল কুহেলি।

সবাই আবার হাততালি দিতে শুরু করল, প্রত্যেকের মুখে হাসিও দেখা গেল কিন্তু বিষ্ময়ের ভাবটা রয়েই গেল। নভতেজ শর্মা আরও কিছুক্ষণ থাকার পরে চলে গেলেন, বাকিরাও কুহেলিকে অভিনন্দন জানিয়ে যে যার কাজে ফিরে গেল কিন্তু চাপা গুঞ্জনটা থামল না। রুহি তো তারপর থেকে সমানে প্রশ্ন করেই চলেছে, যদিও সে যে খুব খুশি হয়েছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কুহেলি কোনরকমে ওর প্রশ্ন গুলোর উত্তর দিয়ে ওকে শান্ত করল, কিন্তু অফিসে ওকে কেন্দ্র করে এই চাপা গুঞ্জন টা একটুও ভালোলাগছে না ওর। অলরেডি অফিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে মেসেজের বন্যা বয়ে গেছে, সবারই এক বক্তব্য, এটা কীকরে হল, কবে হল। কুহেলি চুপচাপ মেসেজ গুলো দেখছিল, এ পর্যন্ত হলেও তো ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাৎ একজন লিখল,

“এই জন্যেই আগের প্রজেক্ট আর এই নিউ প্রজেক্ট দুটোই কুহেলি লিড করল। না হলে অফিসে আরও অনেকেই ছিল যারা এই প্রজেক্ট দুটো লিড করতে পারত। এসব কতদিন ধরে চলছে কে জানে?”

এই মেসেজের উত্তরে অন্য আরেকজন লিখল,

“যা বলেছ, আমিও তো তাই ভাবি, হঠাৎ করেই এতবড় সুযোগ কি কেউ এমনি এমনি পায় নাকি! তবে যাই বল কুহেলির ক্যালি আছে, বস কে এমন ঘায়েল করেছে যে ডিরেক্ট বিয়ে! ইভেন সিনিয়ার শর্মা স্যার পর্যন্ত কত খুশি দেখেছ? সবাইকে আয়ত্ত করে ফেলেছে।“

কুহেলির ভিষন খারাপ লাগল, এতদিন এত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার পর যদি কেউ এরকম কথা বলে তাহলে খারাপ লাগাটা খুব স্বাভাবিক। এদের কথা অনুযায়ী ওর প্রতিভার কোনও গুরুত্বই নেই, যা করেছে সব…. নাহ, এর চেয়ে বেশি ভাবতে পারল না কুহেলি। মানুষের চিন্তাধারা কতটা নিম্নমানের হলে এরকম ধারণা পোষণ করতে পারে। মেসেজ এখনও অব্যাহত, কেউ কেউ সায় দিচ্ছে আবার কেউ কেউ বলছে, হতেও তো পারে ওরা সত্যিই একে অন্যকে ভালোবেসে বিয়ে করছে, অথবা সিনিয়ার শর্মা স্যার নিজেই এই বিয়েটা ঠিক করেছেন। কিন্তু তাও তারা মানতে নারাজ, আসলে কারও মানসিকতা তো আর বলে বদলানো যায় না। কুহেলি সবটাই বোঝে, কিন্তু তাও একটা খারাপলাগা কাজ করতে লাগল। হঠাৎই মেসেজের আগমন বন্ধ হল, কারণটা হল অঙ্কিতের একটা ছোট্ট মেসেজ,

“ডোন্ট ফরগেট, গ্রুপে কুহেলিও আছে। শি ক্যান সি এভরি থিং।“

কুহেলি ফোনটা রেখে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। মনটা খুব খারাপ লাগছে, ডেস্কে কনুই দুটো ভর দিয়ে দুহাত দিয়ে কপালের দুপাশ টা চেপে ধরল। মাথাটাও কেমন যেন দপ দপ করছে, একদম ভালোলাগছে না, চোখ দুটো বন্ধ করে কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে রইল। হঠাৎ পিছনে আলেখের আওয়াজ পেয়ে চমকে উঠে দাড়াল।

মিস বাসু?

ইয়েস স্যার।

আর ইউ অলরাইট?

ইয়েস স্যার অ্যাম ফাইন।

ওকে, তাহলে আপনার ব্যাগটা গুছিয়ে নিন।

কুহেলি একটু অবাক হল, এমনিই এতসব চলছে তারমধ্যে আলেখের এহেন আচরণ। কুহেলি জিজ্ঞেস করল,

কেন?

একটা মিটিং আছে আর্জেন্ট।

মিটিং? কিন্তু আমি তো কিছুই জানতাম না, মানে……

কুহেলির কথা শেষ হওয়ার আগেই আলেখ বলল,

একটু আগেই ফিক্স হয়েছে, আপনি চলুন আমি যেতে যেতে সবটা বুঝিয়ে দিচ্ছি।

কুহেলির খুব অবাক লাগল। এরকম হঠাৎ করে কিসের মিটিং? কিন্তু আর কিছু জিজ্ঞেস না করে চুপচাপ নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে আলেখের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। প্রায় মিনিট দশেক হতে চলল আলেখ ড্রাইভ করছে, এখনও একটাও কথা বলেনি। কুহেলিও কিছু জিজ্ঞেস করেনি কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আলেখের মুখটা কেমন যেন গম্ভীর মনে হচ্ছে, আবার কি হয়েছে কে জানে! একটু পরেই আলেখ সেই ছোট্ট রেস্টুরেন্ট টার সামনে এসে গাড়িটা থামাল। সবে বিকেল হচ্ছে, এইসময়টা এখানে এই প্রথম এল কুহেলি। আজকে মোটামুটি লোকজন আছে, এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। ভাগ্যক্রমে আলেখের প্রিয় টেবিল টা ফাকাই ছিল, সেখানে গিয়ে বসল দুজনে। বেশিক্ষণ হয়নি লাঞ্চ করেছে তাই আলেখ ওদের দুজনের জন্যই শুধু জুস অর্ডার করল। কুহেলি আলেখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, মুখটা অদ্ভুত রকমের থমথমে দেখাচ্ছে। আলেখ যে ওকে কোনও মিটিংয়ের জন্য নিয়ে আসেনি সেটা বেশ বুঝতে পারছে, কিছু যে একটা বলার আছে সেটাও বুঝতে পারছে। সত্যি বলতে আলেখকে এইভাবে দেখে কুহেলি একটু আগের মেসেজ আর মন খারাপের কথা বেমালুম ভুলে গেল। মনের মধ্যে শুধু একটাই কথা ঘুরতে লাগল, নতুন করে আবার কি হল? কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার এসে দুটো জুসের গ্লাস রেখে গেল। আলেখ এতক্ষণ টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছিল, এবার চোখ তুলে কুহেলির দিকে তাকিয়ে বলল,

মিস…না কুহেলি।

আলেখ ওর নাম টা উচ্চারণ করা মাত্র কুহেলি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। আলেখ ওর মনের ভাবটা বুঝে বলল,

ভেবে দেখলাম, সবসময় ড্যাডের সামনে সতর্ক থাকা সম্ভব হবে না। আর তাছাড়াও আজ হোক আর কাল হোক আমাদের এই ফর্ম্যাল অ্যাড্রেস করার অভ্যাস টা ছাড়তেই হবে। সুতরাং এখন থেকেই একটু একটু করে অভ্যাস করা উচিত, আপনার অসুবিধা হলে ইটস ফাইন, টেক ইওর টাইম বাট আমি এখন থেকেই ট্রাই করতে চাই। অফোকর্স যদি আপনার কোনও আপত্তি না থাকে তাহলেই।

কুহেলি মাথা নেড়ে বলল,

আমার কোনও আপত্তি নেই, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমাদের এখন থেকেই অভ্যাস করা উচিত কিন্তু আমি হয়তো এত তাড়াতাড়ি….

ইটস ওকে, আপনি আপনার সুবিধা মত চেষ্টা করবেন।

হুম, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই শুধু এটা বলার জন্য আমাকে এখানে নিয়ে আসেননি।

হুম, আমি এটা বলার জন্য আপনাকে এখানে নিয়ে আসিনি।

আলেখ সোজাসুজি কুহেলির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

অফিসের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মেসেজ গুলো নিয়ে আপনার কিছু বলার আছে?

এটার জন্য কুহেলি মোটেই প্রস্তুত ছিল না। গ্রূপটায় আলেখ নেই, ওটা শুধুমাত্র এম্প্লয়ি দের গ্রুপ। তাহলে আলেখ মেসেজ গুলোর কথা জানল কীকরে! আলেখ নিজেই এই প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল।

অঙ্কিত আমাকে মেসেজ গুলো দেখিয়েছে, কুহেলি আমি ইচ্ছে করলেই ওদের প্রতিবাদ করতে পারতাম। ইভেন আমার ইচ্ছেও করছিল, কেউ কীকরে কিছু না জেনে এভাবে যা খুশি তাই বলতে পারে! কিন্তু আমি একমাত্র আপনার কথা ভেবেই কিছু বলিনি। আমি ওদের যদি কিছু বলি, আমার সামনে হয়তো ওরা নিজেদের ভুলটা মেনে নেবে কিন্তু পিছনে এর থেকেও জঘন্য কুৎসা রটানো শুরু করবে। আর আমি সেটা একদমই চাই না, তবে আপনি যদি বলেন তাহলে আমি অ্যাকশন নিতে পারি।

তার কোনও প্রয়োজন নেই, আপনি ঠিকই বলেছেন। ওরা এখন যা বলছে বলুক, দুদিন পরে আপনিই থেমে যাবে। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই, তাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। মিথ্যে কথা বলব না, মেসেজ গুলো পড়ে আমারও খুব খারাপ লেগেছে, মানুষ কত সহজে কিছু না জেনে অন্যকে জাজ করে, একবারও সত্যিটা জানার প্রয়োজনও বোধ করে না। তবে সেটা সাময়িক, এইসব নিয়ে অযথা নিজের সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।

হুম, আমিও সেটাই মনে করি তবে আপনি যেভাবে মাথা নিচু করে বসে ছিলেন তাতে তো মনে হচ্ছিল আপনার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।

আলেখের ঠোঁটে আবার সেই হাসিটা খেলা করছে, এবার আর কুহেলির বুঝতে ভুল হল না। আলেখ আবার মজা করছে, কুহেলিও হেসে পাল্টা উত্তর দিল।

তাই বুঝি তাড়াহুড়ো করে সব কাজ ফেলে আমাকে এখানে নিয়ে এলেন?

একদম তাই, আরে কাল বাদে পরশু এনগেজমেন্ট। আর এখন যদি উড বি ব্রাইড মন খারাপ করে বসে থাকে তাহলে তো মুশকিল।

চিন্তা নেই, এত সামান্য কারণে মন খারাপ করে বসে থাকার মত মেয়ে আমি নই। স্বাভাবিক ভাবেই একটু খারাপ তো লাগেই, তবে সেটাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া আমি পছন্দ করি না।

আলেখ হাসল, একটু থেমে বলল,

আপনি সত্যিই অন্যদের থেকে আলাদা, ঠিক কোন দিক দিয়ে আলাদা সেটা হয়তো আমি বলতে পারব না তবে কিছু তো একটা আছে যেটা আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।

কুহেলি কিছু না বলে শুধু একটু হাসল। আলেখ বলল,

ড্যাড যে এমন হঠাৎ করে এসব করবে আমি বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছিলাম একেবারে কালকে ইনভাইট করতাম আর ডাইরেক্ট এনগেজমেন্ট পার্টিতেই সবাই আপনাকে দেখত। কিন্তু ড্যাড সবটা গন্ডগোল করে দিল।

কুহেলি আপত্তি করে বলল,

উঁহু, বরং এটাই ভালো হল। সেদিন হঠাৎ আমায় দেখে সবাই না জানি আরও কত কি বলত। তার থেকে এটাই ভাল হল, যা হয়েছে ভালই হয়েছে।

আলেখ আর কথা বাড়াল না, ঠিকই তো বলেছে কুহেলি। ও বিষয়ে আর কোনও কথা না বলে আলেখ বলল,

আন্টি আর ঠাম্মু কাল কটার ফ্লাইটে আসছেন?

দশটা।

ও, আমি রিসিভ করতে যেতে পারতাম কিন্তু অফিসেও যেতে হবে।

ইটস ফাইন, আমি আছি তো। আর তাছাড়াও সাড়ে এগারোটার ফ্লাইটে আমার মাসিরা আসছে, ওদেরও আবার রিসিভ করতে যেতে হবে।

ও, আমাদের বাড়িতেও কালকেই সব গেস্ট আসবে। গেস্ট বলতে তেমন কেউ যদিও নয়, এত শর্ট টাইমে সবাই আসতে পারছে না। আমার এক বুয়া আর ওনার ফ্যামিলি আসছেন আর একজন চাচাজি আসছেন ওনার ফ্যামিলি নিয়ে, ব্যাস।

হুম, আমাদেরও তো সেম প্রবলেম আর তাছাড়াও সবার পক্ষে এখানে আসা সম্ভব হত না। বিয়েটা যেহেতু কলকাতায় হবে তখন সবাই আসবে।

দুজনে আরও বেশ কিছুক্ষণ এইরকম টুকটাক কথা বলল। ওরা নিজেরাও বোধহয় কখনও খেয়াল করে দেখেনি যে ওরা এখন কতটা সহজ ভাবে কথা বলে। সেদিন বন্ধুত্ব করলেও নভতেজ শর্মার জারি করা পরোয়ানার জন্য দুজনেই গুটিয়ে ছিল। তবে আজকে ওদের দেখে মনে হচ্ছে সত্যিই দুজন বন্ধু বসে কথা বলছে। এভাবেই কিছুক্ষণ কথা বলার পর আলেখ কুহেলিকে ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে নিজেও ওঙ্কার ভিলার উদ্দেশ্যে রওনা হল, নভতেজ বাবুর হুকুম আজ তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। বাকি দিনটা কুহেলির ঘর গোছাতেই কেটে গেল, ভাগ্যিস ভাড়া নেওয়ার সময় ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটটা পায়নি! এই টু বিএইচকে ফ্ল্যাট টা বাধ্য হয়েই একটু বেশি ভাড়া দিয়েই নিতে হয়েছিল। তবে এখন কাজে লাগছে, রুম দুটো বেশ বড়, তাছাড়া ড্রয়িং রুমটাও বেশ বড়। সব মিলিয়ে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে, সেগুলোই গুছিয়ে নিচ্ছিল। বেশি দেরি না করে তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ল, সকালে উঠে গীতাকে নিয়ে কিছু কাজ সেরে নিতে হবে বেরোনোর আগে। গীতাকে বলাই ছিল একটু আগে আসতে, এমনিতে সে পৌনে সাতটা নাগাদ আসে তবে আজকে একদম কাটায় কাটায় ছটায় এসে পড়ল। কুহেলিও উঠে পড়েছিল, দুজনে মিলে হাতে হাতে বাকি কাজটুকু সেরে নিল। এরপর কুহেলি রেডি হতে চলে গেল, এয়ারপোর্টে যেতে হবে সময় হয়ে এসেছে, আর গীতা রান্নাঘরে ঢুকে নিজের কাজ শুরু করে দিল, আজ কাজ একটু বেশি। কুহেলি সময়মতই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল, ফ্লাইটও ঠিক সময়মতোই ল্যান্ড করল। চৈতালী দেবী, শৈলজা দেবী আর দেবাঞ্জলি কে নিয়ে ফিরতে ফিরতে প্রায় পৌনে এগারোটা হয়ে গেল। একটু পরেই আবার বেরোতে হবে, চৈতী দেবীদের ফ্লাইটের টাইম হয়ে এসেছে। একটু অপেক্ষা করে একেবারে ওদের নিয়েই আসতে পারত কিন্তু শৈলজা দেবীকে অতক্ষণ অপেক্ষা করাতে চায়নি। ওনাদের ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে কুহেলি আবার বেরিয়ে পড়ল, চৈতী দেবীদের নিয়ে যখন ফিরল তখন বারোটা ছাড়িয়ে গেছে। আজ গীতা অন্য দুটো বাড়ি থেকে ছুটি নিয়েছে, সারাটা দিন এখানেই থাকবে, এটা অবশ্য কুহেলি বলেনি গীতা নিজে থেকেই করেছে। কুহেলি আপত্তি করেনি, ও জানে গীতা ওকে কতটা ভালবাসে, আর এটাও ও ভালোবেসেই করছে। সবাই মিলে ফ্রেশ হতে হতেই দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেল। ডাইনিং টেবিল টা বড়ই, সবার একসাথে বসতে কোনও অসুবিধা হল না। গীতা আজ সব বাঙালি পদ রান্না করেছে, এতদিনে গীতা মোটামুটি বেশ বাঙালি রান্না শিখে নিয়েছে। খেতে বসে সব বাঙালি পদ দেখে শৈলজা দেবী অত্যন্ত খুশি হয়ে বললেন,

আমি তো ভাবিইনি এখানে এসে এত সুন্দর বাঙালি রান্না খেতে পারব। কই দেখি গীতা এদিকে এস তো মা।

গীতাকে ডেকে প্রাণ ভরে আশির্বাদ করলেন, বাকিরাও গীতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠল। খাওয়া শেষে এবার একটু বিশ্রাম করার পালা, সবাই জার্নি করে এসেছে। শৈলজা দেবীকে ওষুধ খাইয়ে কুহেলি নিজের বেডরুমে শুইয়ে দিয়ে এল। আর বাকিরা সবাই অন্য রুমটায় চলে এল, এই রুমটা একদমই ফাঁকা কোনও আসবাব পত্র কিছুই নেই সুতরাং একেবারে গোটা মেঝে জুড়ে ঢালাও বিছানা পাতা হয়েছে। ওদের পাঁচ জনের জন্য যথেষ্ট, সবার বেশ লাগছিল ব্যবস্থাটা। মাঝেমধ্যে একটু অন্যরকম হলে সবারই ভালোলাগে, যাইহোক দুপুরটা সবাই একটু ঘুমিয়ে নিল। গীতা এই ফাঁকে বাড়ি চলে গেছে, সন্ধ্যেবেলায় আবার আসবে। বিকেলে সবাই ঘুম থেকে উঠে এক্কেবারে ফ্রেশ, গোল হয়ে বসে শুরু হল আড্ডা। দিঠি তো মোটামুটি প্রশ্নবাণে কুহেলিকে জর্জরিত করে ফেলল, সবার অনেক কিছু জানার আছে। কুহেলি একে একে সবার কৌতূহল মেটাল, সবকিছু বেশ ভাল চলছিল, হঠাৎ শৈলজা দেবী বললেন,

আচ্ছা দেবাঞ্জলি, তোমার ভাই এখানে থাকে না? ওকে বলা হয়েছে?

কুহেলির মুখটা নিমেষে অন্ধকার হয়ে এল, একটা পুরনো কষ্ট অনুভব করল বুকের বাঁদিক টায়। এত চেষ্টা করে অতীতকে ভুলে যাওয়ার কিন্তু বারবার কোনও না কোনও ভাবে ঠিক মনে পড়েই যায়। কিন্তু দেবাঞ্জলির উত্তরে কুহেলি অসম্ভব অবাক হল।

অর্ঘ্য এখানে থাকত মাসিমা, এখন থাকে না।

কুহেলি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল দেবাঞ্জলির দিকে, কি বলছে সে! দেবার্ঘ্য আর থাকে না এখানে! তাহলে এখন সে কোথায়? উত্তরটাও দেবাঞ্জলির কাছ থেকেই এল।

আসলে এই মাস খানেক হল, ও আমেরিকা চলে গেছে। কিছুদিন ধরেই ট্রাই করছিল, বেশ ভালো কোম্পানিতে জয়েন করেছে।

শুনে সবাই খুব খুশি হল, কুহেলিও খুশি হল তবে বুকের বাপাশের চিনচিনে ব্যাথাটা রয়েই গেল। ফাঁক বুঝে ওখান থেকে উঠে এসে ব্যালকনিতে দাড়াল কুহেলি। একের পর এক চোখের সামনে ভেসে উঠছে দেবার্ঘ্যর সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত গুলো। মনে মনে বলল,

ভাল থেকো দেবার্ঘ্য। নিজের পথ বেছে নিয়েছ, খুব ভাল করেছ জানো তো। এখান থেকে দূরে থাকলেই তুমি আমি দুজনেই হয়তো ভালো থাকব। এই হাজার হাজার মাইলের দূরত্ব হয়তো একদিন আমাদের স্মৃতিগুলোকেও ঝাপসা করে দেবে। পরিস্থিতির কারণে আমিও একটা পথ বেছে নিয়েছি, ওরা খুব ভালো মানুষ জানো তো। আলেখের মত জীবন সঙ্গী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার, আর ওর বাবাকে দেখে মনে হয়েছে নতুন করে আমার বাবাকে ফিরে পেয়েছি। আমি কতটা ওদের যোগ্য হয়ে উঠতে পারব জানি না, তবে চেষ্টা করব, আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব। ওদের সঙ্গে আমি খুব ভালো থাকব, তুমিও ভাল থেকো, এমন কাউকে নিয়ে ভালো থেকো যে তোমাকে খুব ভালোবাসবে। ভাল থেকো দেবার্ঘ্য।

কিছুক্ষণ পর হাসিমুখেই ফিরে এল কুহেলি, না আর মন খারাপ করবে না সে। এখন আগামীর কথা ভেবে নিজের আপনজনের কথা ভেবে খুশি থাকার সময়, অতীতকে মনে করে কষ্ট পাওয়ার নয়। আরও অনেক গল্প করল সবাই মিলে, তার সঙ্গে অবশ্য রান্নাও চলল। চৈতালী দেবী একটু চেষ্টা করেছিলেন রান্নাঘরে ঢোকার কিন্তু গীতা কিছুতেই ঢুকতে দেয়নি, একাই সবটা করছে। রান্না শেষ করে গীতা চলে গেল, অনেক বলেও তাকে খাওয়ানো গেল না এমনকি খাবার দিয়ে দিতে চাইলেও সে কিছুতেই রাজি হল না। রাতের খাওয়াটাও সবাই একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতেই সেরে নিল। তারপর একবার চিরন্তনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে এবার শোয়ার তোড়জোড় শুরু হল। কালকে সকালেই ওঙ্কার ভিলায় চলে যেতে হবে, সমস্ত ব্যবস্থা সেখানেই। কুহেলিকে সাজানো থেকে শুরু করে বাকি সব ব্যবস্থা সেখানেই করা হয়েছে। আলেখ নিজে নিতে আসবে, সুতরাং রাত জেগে লাভ নেই সকাল সকাল উঠতে হবে। তবে সবাই এক জায়গায় থাকলে কি আর তাড়াতাড়ি ঘুম আসে! গল্প করতে করতে বেশ কিছুটা দেরী হয়ে গেল, শেষে যখন সবাই ঘুমাল তখন ঘড়ির কাটা একটার ঘর ছুয়ে ফেলেছে। সকালে সবার শেষে কুহেলির ঘুম ভাঙ্গল, উঠে দেখে মোটামুটি সবাই স্নান সেরে রেডি হওয়াও স্টার্ট করে দিয়েছে। যদিও এখনও বেশ কিছুটা সময় আছে হাতে তাও সবাই আগেভাগেই রেডি হয়ে নিচ্ছে। কুহেলিও অভ্যেস মত উঠে স্নান সেরে তৈরি হয়ে নিল, শৈলজা দেবী একপ্রকার জোর করেই শাড়ি পরালেন। একটা হালকা হলুদ রঙের তাঁত সিল্ক, প্লেন ফুল স্লিভ কালো রঙের ব্লাউজের সঙ্গে হলুদ রং টা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হালকা লিপগ্লস, আর আলতো কাজলের ছোয়া সঙ্গে একটা ছোট্ট কালো টিপ। কি যে মিষ্টি লাগছে কুহেলিকে বলে বোঝাতে পারব না, যাই হোক সবাই যার যার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে একদম রেডি। গীতার ওদিকে ব্রেকফাস্টও বানানো হয়ে গেছে, অন্য বাড়ি দুটোতে কালকে ছুটি নিয়েছিল বলে আজকে একটু আগেই বেরিয়ে গেল গীতা। খেতে খেতে শৈলজা দেবী বললেন,

চৈতালী, আমার নাতজামাইয়ের আংটিটা নিয়েছ তো?

হ্যা, মা নিয়েছি।

আংটির কথা কুহেলির মাথাতেই ছিল না, এখন শুনে মনে হল এনগেজমেন্টে তো আংটিই আসল। কুহেলি একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করল,

তোমরা আংটি নিয়ে এসেছ?

চৈতালী দেবী উত্তর দিলেন,

এ আবার কেমন কথা! আংটি না নিয়ে আসলে হবে কীকরে! আংটি ছাড়া এনগেজমেন্ট হবে নাকি?

না, মানে তোমরা ওনার আংটির মাপ জানলে কীকরে?

ওসব তোর না জানলেও চলবে, সব ব্যবস্থা আছে।

কুহেলি বুঝল তলে তলে দুই বাড়ির মধ্যে অনেক কিছুই আলাপ আলোচনা হয়েছে যার প্রায় কিছুই সে জানে না। আর জেনে করবেই বা কি! যা হচ্ছে ভালই তো হচ্ছে, সবাই কত খুশি, এটাই তো চেয়েছিল সে। সবার ব্রেকফাস্ট শেষ হতে না হতেই কলিংবেলের আহ্বান শোনা গেল, কুহেলি নিজেই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। সামনে হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে আলেখ, আর ওর পাশে আরও একটি ছেলে। তাকে কুহেলি চেনে না, হেসে দুজনকেই ভিতরে আসতে বলল কিন্তু সেটা বোধহয় আলেখের শ্রবনেন্দ্রিয় পর্যন্ত পৌঁছায় নি। কারণ এইমুহুর্তে আলেখের একটি মাত্র ইন্দ্রিয় সক্রিয়, বাকি ইন্দ্রিয়গুলো যেন হঠাৎ তাদের কর্মক্ষমতা বিস্মৃত হয়েছে। অনিমেষ নয়নে চেয়ে আছে কুহেলির দিকে, কোনদিকে হুশ নেই। শাড়ি পরিহিতা কুহেলির সৌন্দর্য্যে যেন একটু বেশিই অভিভূত হয়ে পড়ে আলেখ। অবশ্য শুধু শাড়ি কেন! আজকাল তো কুহেলিকে যে রূপেই দেখছে তাতেই অভিভূত হয়ে পড়ছে। রোজই যেন নিত্য নতুন রূপে এসে ওর হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলছে কুহেলি। এমনটা যে কেন হচ্ছে, তার উত্তর আলেখেরও অজানা। আলেখকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে কুহেলি একটু অস্বস্তি বোধ করল, সঙ্গের ছেলেটি ব্যাপারটা বুঝে আলতো করে আলেখকে একটা ঠেলা মেরে নিচু স্বরে বলল,

ভাইয়া, এখানেই যদি এভাবে তাকিয়ে থাকিস তাহলে তো মুশকিল। ভাবি লজ্জা পাচ্ছে যে।

ছেলেটির কথায় আলেখ চমকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর ছেলেটিকে একটু মৃদু ধমক দিয়ে কুহেলির দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

আসলে… আমি… মানে….

আলেখের কথা শেষ হওয়ার আগেই ছেলেটি বলে উঠল,

আসলে ভাইয়া হঠাৎ করে একটু ভাবুক হয়ে পড়েছিল, সদ্য বিয়ে ঠিক হয়েছে তো এমন হয়। বাই দ্য ওয়ে আই অ্যাম বিহান খুরানা, তোমার হবু দেওর, আর তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করো না। আমি আবার অত আপনি টাপনি বলতে পারি না, শুনতেও কিন্তু পারি না, সো তোমাকেও কিন্তু আমাকে তুমিই বলতে হবে।

বিহান একগাল হেসে কুহেলির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল, কুহেলি একটু হেসে বলল,

তুমি আমাকে চিনলে কিকরে?

বিহান একটু গলাটা পরিষ্কার করে বলল,

ভাইয়া যেভাবে তোমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তাতে আর আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

আলেখ আর কুহেলি দুজনেই একটু লজ্জা পেল, অদ্ভুত অস্বস্তিকর একটা পরিস্থিতি। তবে এই অস্বস্তি টা একটু অন্যরকম, একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে দুজনের মনে। আলেখ আবার একটু ধমক দিল বিহানকে, কুহেলিও ওদের ভিতরে নিয়ে এল। শৈলজা দেবী আর চৈতালী দেবী ছাড়া বাকিরা কেউই আলেখকে দেখেনি। কুহেলি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, আলেখ একে একে সবাইকে প্রণাম করল। দেবাঞ্জলি কিছুতেই প্রণাম নিল না, যতই সম্পর্কে মামী শাশুড়ি হোক বয়স টা তো আর শাশুড়ি হওয়ার মত নয়। আলেখও সকলের সঙ্গে বিহানের পরিচয় করিয়ে দিল, বিহান ওর পিসতুতো ভাই। দেখে কুহেলির সমবয়েসী মনে হয়, যাইহোক আলাপ পর্ব সেরে ওরা এবার রওনা হল ওঙ্কার ভিলার উদ্দেশ্যে। সবাই এক গাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয় জেনেই আলেখ বিহানকে সঙ্গে এনেছে। আলেখ একটা গাড়ি ড্রাইভ করছে আর বিহান অন্যটা, আলেখের গাড়িতে কুহেলি আর দিঠি আর বিহানের গাড়িতে বাকিরা। এই ব্যবস্থাও বিহানেরই করা, গাড়িতে ওঠার আগে কানে কানে আলেখকে বলে গেছে,

ভাইয়া, তোর সুবিধা করে দিলাম, এখন ভাবিকে যত ইচ্ছে দেখ। পারলে তোর হবু শালী টিকেও সরিয়ে নিতাম কিন্তু আর জায়গা নেই গাড়িতে। বাট শালী তো আধি ঘরওয়ালি নো টেনশন, তুই চালিয়ে যা।

উত্তরে আলেখ শুধু একটু ধমক দেওয়া ছাড়া আর কিছু বলেনি। তবে ব্যবস্থা টা মন্দ হয়নি, মাঝে মাঝেই চোখ দুটো চলে যাচ্ছে কুহেলির দিকে। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছে মনে, কারনটা অজানা হলেও ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে আলেখ। তবে এটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, দিঠি এমনিতেই বড্ড বকবক করে আর কুহেলিকে পেলে তো কথাই নেই। এখনও সমান তালে বকে চলেছে, তবে শুধু কুহেলির সঙ্গে নয়, আলেখের সঙ্গেও কথা বলে চলেছে। মনেই হচ্ছে না, এই কিছুক্ষণ আগে আলাপ হয়েছে, আলেখও বেশ হেসে হেসেই গল্প করছে। দিঠি তো অলরেডি জিজু ডাকতে শুরু করে দিয়েছে, কুহেলি অল্প অল্প কথা বলছিল, বেশিরভাগ কথা দিঠি আর আলেখ বলছে। কথায় কথায় কখন যে ওঙ্কার ভিলায় এসে পড়েছে টের পায়নি, গাড়ি থেকে নেমেই অবাক হয়ে গেল কুহেলি। বাড়িটার যেন চেহারাই পাল্টে গেছে, ফুল আর আলোর মালায় সেজে উঠেছে গোটা বাড়িটা, শুধু বাড়ি নয়, লন টাও অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এখনও কাজ চলছে, একটা বেশ বড় স্টেজ করা হয়েছে লনের একটা পাশে তাকে কেন্দ্র করেই বাকি লনটা সেজে উঠেছে। এখানেই যে অনুষ্ঠান টা হবে সেটা আর আলাদা করে বলে দিতে হয় না। কুহেলি সবটা দেখতে দেখতে এগোচ্ছিল, বাকিরাও এগিয়ে গেছে অনেকটা। কুহেলি ইচ্ছে করেই ধীর পায়ে চারপাশটা দেখতে দেখতে এগোচ্ছিল, হঠাৎ কানের কাছে আলেখের কণ্ঠস্বর শুনে একটু যেন কেঁপে উঠল।

এখানে একটাও কিন্তু আসল ফুল নয়, তোমার কথা মতই আসল ফুল গাছেই আছে, একটু মেকি সৌন্দর্য্যের ছোয়ায় নিশ্চয়ই আপত্তি নেই?

আলেখের মুখে তুমি শুনে কুহেলির হৃদস্পন্দন আবার বেড়ে গেল, ওর ঠোঁটের কোনের হাসিটা কেমন যেন স্থির করে দিচ্ছে ওকে। আর কি বলল আলেখ! এগুলো সব নকল ফুল, ওর পছন্দের কথা আলেখ মনে রেখেছে! মাত্র একদিন তো বলেছিল, ফুল গাছেই ভালোলাগে ওর। সেটা আলেখ সত্যিই মনে রেখেছে! একটা অদ্ভুত ভালোলাগার রেশ যেন ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে ওকে। দুজনেই একভাবে তাকিয়ে ছিল একে অন্যের দিকে, যেন চোখের ভাষায় নিজেদের মনে চলতে থাকা নতুন প্রশ্ন গুলোর উত্তর খোজার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ একটা গলা ঝাড়ার শব্দে দুজনেই চমকে সেদিকে তাকাল। বিহান ওদের তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে, এবার বলল,

বলছিলাম, কিছুটা পরের জন্য বাঁচিয়ে রাখ। এখনই যদি এত দেখে নাও তাহলে পরে কিকরবে!

এই কথায় ওরা দুজনেই একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল, আলেখ আবার একটা মৃদু ধমক দিয়ে এগিয়ে গেল। বাড়ির ভিতরে ঢুকে কুহেলি আরও একদফা অবাক হল, ড্রয়িং রুমে রীতিমত আসর বসে গেছে। এই তো মাত্র পাঁচ মিনিট হল এরমধ্যেই এত গল্প! এগিয়ে যেতেই সবার সাথে আলাপ হল, আলেখের বুয়া মেহের খুরানা ওনার হাসবেন্ড হরমন খুরানা আর ওনাদের একমাত্র ছেলে বিহান। ইনি আলেখের নিজের পিসি নন, দুর সম্পর্কের পিসি কিন্তু ব্যবহারে কিছু বোঝার উপায় নেই। এমন ভাবে আপন করে নিলেন কুহেলিকে যেন কত দিনের চেনা। এছাড়া আলেখের এক চাচা জীও এসেছেন, মনিন্দর শর্মা ওনার স্ত্রী হর্ষিতা শর্মা আর ওনাদের ছেলে রাজীব। সবাই বেশ মিশুকে, কুহেলির একবারের জন্যও মনে হল না এদের সাথে এই প্রথম আলাপ হচ্ছে। একটু কথা বলার পরেই গোটা মহিলা মহল আলাদা হয়ে উঠে এল দোতলায়, কত রকমের তাদের গল্প। গল্প করতে করতেই লাঞ্চ টাইম হয়ে গেল, সবাই মিলে একসাথে খেতে বসে বেশ একটা অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছিল কুহেলির। যেন একটা ভরা সংসার, মেহের তো একদম টিপিক্যাল পাঞ্জাবীদের মতই কুহেলির খাওয়ার পিছনে পড়ে গেলেন। কিছুতেই শুনবেন না, আরও খেতে হবে, ওনার কথা মত কুহেলি নাকি কিছুই খায়নি, শেষে হর্ষিতা চাচীর হস্তক্ষেপে উনি শান্ত হলেন। আজ নভতেজ শর্মাও দারুন খুশি, শেষ পর্যন্ত ওনার স্বপ্ন পূরণ হওয়ার প্রথম পর্ব আজ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। খাওয়ার পরে একটু রেস্ট নিতে না নিতেই কুহেলিকে সাজানোর জন্য লোক চলে এল। অনুষ্ঠানের সময় সন্ধ্যে সাতটা, আর এখন বাজে মাত্র আড়াইটে। কুহেলি ভেবে পাচ্ছিল না এত আগে থেকে রেডি হয়ে ও কি করবে, কিন্তু পরে বুঝল। পাক্কা চার ঘণ্টা লাগল ওর তৈরি হতে, কুহেলি সাজতে ভালোবাসে ঠিকই তবে এতক্ষণ একটানা বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে পড়ছিল। কিন্তু সাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর যখন আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি টা দেখল, তখন সব বিরক্তি উধাও হয়ে গেল। এমনিতেই সুন্দরী কুহেলি আজ যেন ইন্দ্রপুরীর অপ্সরাদের থেকেও বেশি সুন্দরী হয়ে উঠেছে। ওর পছন্দ করা নীল আর গোল্ডেন লেহেঙ্গা টা যেন আজ ওর অঙ্গে আরও বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। সবাই ওর খুব প্রশংসা করলেন, শৈলজা দেবী ওর বা হাতের কড়ে আঙ্গুলটা আস্তে করে কামড়ে দিয়ে বললেন,

ভিষন ভালোলাগছে মা।

মেহের এগিয়ে এসে নিজের চোখের কোনা থেকে অল্প একটু কাজল নিয়ে কুহেলির কানের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

অপূর্ব লাগছে বেটা, কারোর নজর না লাগে।

দেখতে দেখতে বাইরে অতিথি সমাগম শুরু হয়ে গেছে, ঠিক সাতটার সময় নভতেজ শর্মা নিজে কুহেলিকে নিতে এলেন। ওকে দেখেই বললেন,

ইউ আর লুকিং ভেরি বিউটিফুল বেটা, আজ তো সবাই তাকিয়ে দেখবে নভতেজ শর্মার হবু পুত্রবধূকে। কেউ নজর ফেরাতেই পারবে না।

কুহেলি শুধু একটু হাসল। ধীরে ধীরে এগোতে লাগল লনের উদ্দেশ্যে, লেহেঙ্গা টা দেখে মনে না হলেও বেশ ভারী। তাই একটু ধীরে সুস্থে সাবধানে হাটতে লাগল কুহেলি। স্টেজে বিহান আর রাজীব দুজনেই রয়েছে, ওদের ঠিক মাঝখানে দাড়ানো আলেখের দিকে চোখ পড়তেই কুহেলির হৃদযন্ত্র যেন একবার স্পন্দিত হতে ভুলে গেল। সেই ম্যাচিং নীল শেরওয়ানি তে আজ ওকে কোনও অংশে কোনও রাজপুত্রের থেকে কম মনে হচ্ছে না। সুদর্শন আলেখ শর্মা যেন আজ অতি সুদর্শন হয়ে উঠেছে। কুহেলিকে আসতে দেখে বিহান মাইকে বলে উঠল,

হিয়ার কামস দ্য মোস্ট স্পেশ্যাল পারসন অফ দিস ইভিনিং, মাই উড বি সিস্টার ইন ল, দ্য ভেরি বিউটিফুল অ্যান্ড ভেরি গর্জিয়াস মিস কুহেলি বাসু।

অ্যানাউন্সমেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই সবার চোখ ঘুরে গেল কুহেলির দিকে, সেই সঙ্গে আলেখেরও। আর ঠিক সকালের মতই আরও একবার স্থির হয়ে গেল, অসামান্য সুন্দরী লাগছে কুহেলিকে, চোখের পলক গুলো তাদের স্বাভাবিক ক্রিয়া ভুলে এক জায়গায় স্থির হয়ে রইল। ওদিকে অতিথিরা তখন করতালির মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে কুহেলিকে। সবার মধ্যে দিয়ে নভতেজ শর্মার হাত ধরে হেঁটে এসে স্টেজে উঠল কুহেলি। নভতেজ শর্মা কুহেলিকে আলেখের পাশে দাঁড় করিয়ে অফিসিয়ালি আরও একবার সবাইকে কুহেলির পরিচয় দিলেন। আলেখ এখনও একভাবে কুহেলির দিকেই তাকিয়ে ছিল, কুহেলি অবশ্য এখন আর আলেখের দিকে তাকিয়ে নেই কারণ এত লোকের সামনে, এত মিডিয়ার সামনে এভাবে কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ওর। অল্প নার্ভাসও লাগছে, আসলে এসবের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা ওর নেই, এত লোকজন এত মিডিয়া আর সবার দৃষ্টি ওর দিকেই, এটা ভাবতেই কেমন একটা লাগছে। ওদিকে আলেখের সে নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই, সে একভাবে চেয়ে আছে কুহেলির দিকে। হঠাৎ পেটের কাছে কনুইয়ের গুতো খেয়ে তবে হুশ ফিরল, বিহান মুচকি হেসে ফিস ফিস করে বলল,

ভাইয়া কন্ট্রোল, সবাই দেখছে তো। মিডিয়াও আছে কিন্তু, এভাবে যদি ভাবির দিকে তাকিয়ে থাকিস তাহলে দেখবি কালকের পেজ থ্রি তে বড় বড় হেডলাইন বেরিয়েছে, বিজনেস টাইকুন দ্য আলেখ শর্মা………

কথাটা আর শেষ করতে পারল না বিহান, কারণ বেচারা তখন একটা জোরদার চিমটি হজম করেছে মুখ বুজে। এবার উপস্থিত হল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, স্টেজে উঠে এলেন চৈতালী দেবী, শৈলজা দেবীকেও বলা হয়েছিল কিন্তু উনি রাজি হননি। কুহেলির পাশে এসে দাড়ালেন চৈতালী দেবী আর নভতেজ শর্মা দাড়ালেন আলেখের পাশে, তার পাশে দাড়ানো বিহান আর রাজীব। নভতেজ শর্মা আলেখের হাতে আংটি তুলে দিলেন, আলেখ ওর বাহাত টা বাড়িয়ে দিল কুহেলির দিকে। কুহেলি ধীরে ধীরে ওর বা হাত টা এগিয়ে দিল, হাত টা যেন মৃদু কাপছে, নার্ভাস লাগছে, হৃদযন্ত্রের গতি স্বাভাবিকের থেকে বেশ দ্রুত। আলেখ আলতো করে স্পর্শ করল কুহেলির হাত, খুব অদ্ভুত ভাবে আলেখের স্পর্শ পাওয়া মাত্র কুহেলির অস্থিরতা যেন মুহূর্তে শান্ত হয়ে এল, সেই স্পর্শে যেন একটা প্রচ্ছন্ন আশ্বাস আছে, কুহেলি এতক্ষণ চোখ দুটো নিচের দিকে নামিয়ে রেখেছিল, এবার চোখ তুলে আলেখের দিকে তাকাতে সেই চোখের দৃষ্টিতেও সেই একই আশ্বাস দেখতে পেল। অদ্ভুত ভাবে কুহেলির সব নার্ভাসনেস, সব অস্বস্তি নিমেষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল, একটা হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটের কোণায়। আলেখ ওর হাতের অনামিকায় আংটিটা পরিয়ে দিতেই করতালির রোল উঠল, এবার চৈতালী দেবী কুহেলির হাতে আংটি তুলে দিলেন। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আংটিটা আলেখের অনামিকায় নিজের স্থান করে নিল। আরো একবার করতালির রোল উঠল, আলেখ আর কুহেলি একে একে সব গুরুজনদের আশির্বাদ নিল। এরপর সবাই একে একে এসে ওদের অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। অফিসের সবাইও এসে অভিনন্দন জানাল, রুহি আর বিদিশা তো ভিষন খুশি, অঙ্কিতও। তবে বাকিরা উপরে হাসলেও তারা যে ততটা খুশি নয় সেটা বেশ ভালই বোঝা যায় কিন্তু তাতে কুহেলির আর কিছু আসে যায় না। কিছুটা সময় মিডিয়াকেও দিতে হল, এতক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যে কুহেলি খেয়াল করেনি, নিশীথ বসে আছে একদম সামনের সারিতে। বাকি অতিথিদের ভিড় একটু হালকা হলে নিশীথ এগিয়ে এল ওদের দিকে। হাসি মুখে বলল,

কংগ্রাচুলেশনস বোথ অফ ইউ।

আলেখ খুব স্বাভাবিক ভাবে হেসে একটা যোগ্য প্রতিউত্তর দিল, কুহেলিও হেসে ধন্যবাদ জানাল। নিশীথ একটা প্যাকেট কুহেলির হাতে তুলে দিয়ে বলল,

একজন বন্ধুর তরফ থেকে একটা ছোট্ট উপহার।

বন্ধু কথাটায় যেন একটু বেশিই জোর দিল নিশীথ, আলেখের অভিব্যক্তি একটু যেন পরিবর্তিত হল, কিন্তু সেটা সে কাউকে বুঝতে দিল না। কুহেলি শুধু একটু হেসে প্যাকেট টা নিল, একটা হালকা গান বাজছিল, হঠাৎ সেই গানটা বন্ধ হয়ে গেল আর মাইকে শোনা গেল বিহানের গলা।

লেডিস অ্যান্ড জেন্টলম্যান, এখন আমার হ্যান্ডসাম ব্রাদার অ্যান্ড ভেরি গর্জিয়াস উড বি সিস্টার ইন ল একটা রোম্যান্টিক ড্যান্স পারফর্ম করবেন। প্লিজ গিভ দেম এ বিগ রাউন্ড অফ্ অ্যাপলস।

এটা শুনে আলেখ আর কুহেলি দুজনেই চমকে উঠল, বিহান অলরেডি এগিয়ে এসেছে ওদের দিকে। কুহেলি আর আলেখ দুজনেই না না করতে লাগল কিন্তু বিহান বা রাজীব কেউ শুনবে না সঙ্গে আবার দিঠিও যোগ দিয়েছে। কুহেলি যে নাচতে পারে না তা নয়, তবে এখন এইভাবে সবার সামনে আলেখের সঙ্গে নাচতে হবে তাও আবার এই ভারী লেহেঙ্গা পরে! আলেখও রাজী হচ্ছিল না কিন্তু শেষে রাজি হতেই হল। ওরা ধীরে ধীরে স্টেজে উঠে এল, একটু অদ্ভুত লাগছে বটে তবে অস্বস্তি টা নেই। গান বেজে উঠল,

‘না জিয়া জিন্দেগি এক পল ভি তুঝসে হোকে জুদা শুন জারা।’

স্টেজের আলো গুলোও কমে এসে একটা নরম নীল আলোয় ভরে উঠল। একটা অদ্ভুত সুন্দর মোহময়ী পরিবেশের সৃষ্টি হল, আলেখ একটা হাত কুহেলির কোমরে রেখে আরেকটা হাত দিয়ে কুহেলির একটা হাত ধরল, কুহেলির একটা হাত আলেখের হাতে আর অন্যটা কাধে। ধীরে ধীরে ওরা মুভ করতে শুরু করল, গানের তালে তালে হালকা হালকা স্টেপে মেতে উঠল দুজনেই। একটা অদ্ভুত বোঝাপড়া ওদের দুজনের মধ্যে, কোথাও এতটুকু অসঙ্গতি নেই। গানের শেষে আলেখের দুটো হাত কুহেলির কোমরে আর কুহেলির দুটো হাত আলেখের কাধে, দুজন দুজনের বেশ কাছাকাছি এসে পড়েছে। যতক্ষণ ওরা নাচছিল, সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে ছিল ওদের দিকে, ওরাও যেন হারিয়ে গিয়েছিল অন্য কোনও জগতে। করতালির শব্দে দুজনেরই ঘোর কাটল, একে অপরকে ছেড়ে সরে দাড়াল। বিহান তো মাইক হাতে নিয়ে প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিল, সবাই খুব প্রশংসা করল। আলেখ ধীরে ধীরে কুহেলির হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনল, এত ভারী লেহেঙ্গা তার সাথে এত ভারী ভারী গয়না। কুহেলি এমনিতেই হাপিয়ে উঠেছিল, তারমধ্যে এখন অল্প হলেও নাচার জন্য আরও হাপিয়ে গেছে। আলেখ কুহেলিকে একটা সাইডে এনে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলল,

তুমি ঠিক আছো কুহেলি?

হ্যা, ঠিক আছি।

কুহেলি মুখে ঠিক আছি বললেও ওকে দেখে আলেখের বুঝতে কষ্ট হল না যে বেচারি বেশ হাপিয়ে গেছে। ওকে একটু ওয়েট করতে বলে আলেখ উঠে কোথাও একটা গেল, কুহেলি চুপচাপ বসে থাকল। সত্যিই বড্ড হাপিয়ে গেছে, এত ভারী ভারী ড্রেস বা গয়না কোনোটাই পরার অভ্যাস নেই। বসে বসে ভাবছিল কতক্ষণে এগুলো খুলতে পারবে, হঠাৎ নিশীথ এসে ওর সামনের চেয়ারটায় বসে বলল,

দ্যাট ওয়াস ব্রিলিয়ান্ট।

কুহেলি বুঝল নিশীথ ড্যান্সের কথা বলছে, একটু হেসে ধন্যবাদ জানাল। আজকাল আর নিশীথের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হয় না, বন্ধু হিসেবে সত্যিই খারাপ নয়। সব থেকে বড় কথা নিশীথ নিজের দেওয়া কথা রেখেছে, তারপর থেকে একবারের জন্যও কখনও কুহেলিকে ওর ভালোবাসার কথা বলেনি। এরমধ্যে আলেখ একগ্লাস জুস এনে কুহেলির হাতে দিয়ে ওর পাশে বসল।

জুস টা খেয়ে নাও।

কুহেলি কিছু বলার আগে হঠাৎ নিশীথ বলল,

মিস্টার শর্মা, আপনি বোধহয় একটু ভুল করে ফেলেছেন।

আলেখ অবাক হয়ে বলল,

ভুল! কি ভুল?

এটা পাইনঅ্যাপেল জুস, অ্যান্ড মিস বাসু ইস অ্যালার্জিক টু পাইনঅ্যাপেলস।

এটা শুনে আলেখ অবাক হলেও কুহেলি অবাক হল না। নিশীথের পক্ষে এটা জানা কোনও বড় কথা নয়, একটা সময় কুহেলির সমস্ত খবর তার নখদর্পণে ছিল, এটা আর এমন কি! নিশীথ একজন ওয়েটার কে ডেকে জুস টা চেঞ্জ করে অন্য কোনও জুস দিতে বলল। আলেখ এটায় যথেষ্ট অবাক হয়েছে, কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু বলতেও পারছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার একগ্লাস অরেঞ্জ জুস এনে দিয়ে গেল, কুহেলি জুস টা খেয়ে যেন শান্তি পেল। গলাটা বড্ড শুকিয়ে গিয়েছিল, আলেখ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই নভতেজ শর্মা এসে কারোর সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য কুহেলিকে নিয়ে গেলেন। আলেখ কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে থাকল, নিশীথ সেটা লক্ষ্য করে একটু মুচকি হেসে বলল,

মিস্টার শর্মা, শি ইজ নাও ইওর ফিয়ন্সে। যাকে দুদিন বাদেই বিয়ে করে লাইফ পার্টনার বানাতে চলেছেন তার সম্পর্কে এই ছোট ছোট তথ্য গুলো একটু জেনে নিন। অনেক সময় এই ছোট ছোট ব্যাপার গুলোই অনেক বড় হয়ে যায়, বি কেয়ারফুল।

নিশীথের কথাগুলো আলেখের মোটেই ভালোলাগল না, হতে পারে ওদের বিয়েটা একটা বোঝাপড়ার ভিত্তিতে দাড়িয়ে আছে কিন্তু তাই বলে একজন তৃতীয় ব্যক্তি ওর ফিউচার ওয়াইফের সম্পর্কে ওকেই জ্ঞান দেবে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। পৃথিবীর কোনও পুরুষই হয়তো সেটা মেনে নিতে পারেনা, আলেখও বা তার ব্যতিক্রম হতে যাবে কেন! নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,

মিস্টার আগরওয়াল, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ ফর ইওর কনসার্ন। ইউ আর রাইট, শি ইজ মাই ফিয়ান্সে নাও।

ফিয়ন্সে শব্দটার ওপর একটু বেশিই জোর দিল আলেখ, এবং সেটা ইচ্ছাকৃতই। আলেখ আবার বলল,

এটা ঠিক যে আমি এখনও কুহেলির সম্পর্কে সব খুঁটিনাটি হয়তো জানি না, কিন্তু আমার দায়িত্ব টা আমি খুব ভালো করেই জানি। একটু সময় লাগবে, আমাদের একে অপরকে সম্পূর্ণ চিনে নিতে এবং আমি নিশ্চিত সময়ের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্কটাও আরও মজবুত হবে।

নিশীথ হেসে বলল,

নিশ্চয়ই, আমিও সেটাই চাই। মিস্টার শর্মা আমি জানি আপনি সবটাই জানেন, মিস বাসুকে আমি যতটা চিনি তাতে নিশ্চিত ভাবে উনি সবটাই আপনাকে বলেছেন। তাই অযথা ঘুরিয়ে কথা বলে লাভ নেই, আমি এমনিতেও ঘুরিয়ে কথা বলা পছন্দ করি না, যা বলার ডাইরেক্ট বলি। আমি মিস বাসুকে ঠিক কতটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না, তবে এটুকু খুব ভালো করে জানি যে আমি ওনাকে অসম্ভব রেসপেক্ট করি। ওনার প্রতিটা ডিসিশিনকেও আমি সমান রেসপেক্ট করি, একথা আমি ওনাকেও বলেছি। আমি ওনাকে কথা দিয়েছি কোনোদিন ওনার সামনে নিজের ভালোবাসার দাবী নিয়ে আসব না। সে কথা আমি শেষ অবধি রাখব, আমি সত্যিই মন থেকে চাই আপনারা সুখী হোন। কিন্তু তাও একটা কথা বলতে চাই, লাইফ যদি আবার কোনোদিন আমাকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় আমি কিন্তু সেটা হাতছাড়া করার মত মানুষ নই। আই থিঙ্ক আপনি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাইছি, সুতরাং নিজেদের এই বোঝাপড়ার সম্পর্কটাকে এতটাই মজবুত করে গড়ে তুলুন যাতে অন্য কেউ কোনও সুযোগ না পায়।

আলেখ কিছু বলল না, শুধু একটা অভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিশীথের দিকে। নিশীথ এবার উঠে দাড়িয়ে বলল,

ওকে মিস্টার শর্মা, এবার আমাকে বেরোতে হবে, এগেইন কংগ্রাচুলেশন। গুড নাইট।

নিশীথ আর দাড়াল না, উঠে চলে গেল। আলেখ সেখানেই বসে রইল, কি অদ্ভুত মানুষ এই নিশীথ আগরওয়াল। কেউ এতোটা সরাসরি নিজের মনের কথাগুলো কীকরে বলতে পারে! তবে ওর প্রত্যেকটা কথা সত্যি। ঠিকই তো বলেছে, সবাই তো আর নিশীথ আগরওয়াল হবে না যে নিজের দেওয়া কথা রাখার জন্য পিছিয়ে যাবে। আলেখ কুহেলির দিকে তাকাল, হেসে হেসে কথা বলছে কারোর সঙ্গে। সেদিকে তাকিয়ে আলেখ আপন মনেই বলে উঠল,

সম্পর্কটা যেভাবেই শুরু হোক না কেন, আমি এই সম্পর্কটা কে কোনোদিন ব্যর্থ হতে দেব না। আমার দিক থেকে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমাদের সম্পর্কটাকে আরও অনেক বেশি গভীর করে তোলার। কথা দিলাম।

ক্রমশ_________

© স্বত্ব সংরক্ষিত

আজ মহা পর্ব দিয়েছি, কেমন লাগল জানাবেন। অবশেষে সুষ্ঠ ভাবেই সম্পন্ন হল আলেখ আর কুহেলির এনগেজমেন্ট পর্ব। কেমন লাগল নিশ্চয়ই জানাবেন কিন্তু। আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি আপনাদের কমেন্টের জন্য। কি মনে হয় বলুন তো, নিশীথের বলা কথা গুলো আলেখ আর কুহেলির সম্পর্কটাকে আরও বেশি গভীর হতে সাহায্য করবে নাকি সৃষ্টি করবে অন্য কোনও সংশয়? আমাকে জানাতে ভুলবেন না। আজ তবে এই পর্যন্তই। দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here