#সংগোপনে
#ধারাবাহিক_পর্ব_৩০
#অচিন_পাখি_কলমে_ভাগ্যলক্ষ্মী_দাস
আগের পর্বের পর————-
এয়ারপোর্টের লবিতে দাড়িয়ে বারবার হাতঘড়িতে চোখ বুলাচ্ছেন নভতেজ শর্মা। রাত দুটো সাতে আলেখ আর কুহেলির ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে। দুটো পঁচিশ হতে চলল, এখনও কেন আসছে না! এরমধ্যেই আলেখ আর কুহেলিকে আসতে দেখা গেল। ওরা জানত না নভতেজ বাবু আসবেন, দুজনেই বেশ অবাক হল। আলেখ এগিয়ে এসে বলল,
ড্যাড তুমি এত রাতে আবার এলে কেন?
ইচ্ছে হয়েছে তাই এসেছি, আর তোর জন্য আসিনি, আমি তো আমার কুহেলি বেটার জন্য এসেছি।
কুহেলি একটু হেসে বলল,
হুম, সে তো বুঝলাম কিন্তু তুমি এত রাতে না এলেই পারতে কিন্তু।
নভতেজ বাবু একটু কপট রাগ দেখিয়ে বললেন,
তুমিও ওর সুরেই গলা মেলাচ্ছ! আর মেলাবে নাই বা কেন! দুজনেই তো এক্কেবারে এক ধাঁচে গড়া।
আলেখ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু নভতেজ বাবু ওকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,
বাকি কথা পরে হবে, কেমন কি ঘুরলি সেসবও পরে শুনব। এখন আগে বাড়ি চল, অনেক রাত হয়েছে।
ওরা সবাই এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এসে গাড়িতে উঠলেন, আলেখ আর কুহেলি পিছনে আর নভতেজ বাবু সামনে ড্রাইভারের পাশে বসলেন। গাড়ি ওদের নিয়ে রওনা হল ওঙ্কার ভিলার উদ্দেশ্য, রাতের ফাঁকা রাস্তায় পনের মিনিটের বেশি লাগল না পৌঁছাতে। বাড়িতে ঢুকে যেন একটা আলাদা শান্তি অনুভব করল দুজনেই, কথায় আছে না, পৃথিবীর যত সুন্দর কোণেই যাও না কেন নিজের বাড়িতে যে শান্তি পাওয়া যায় সেটা আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। প্রভাত এসে ওদের লাগেজ গুলো ওদের রুমে পৌছে দিল, ওদেরও বড্ড ক্লান্ত লাগছে, এতক্ষণের জার্নির শেষে ক্লান্তি তো আসবেই। নভতেজ বাবু ঘরে যাওয়ার আগে বলে গেলেন,
শোনো কালকে কিন্তু দুজনের কেউই অফিসে যাওয়ার কথা মনেও আনবে না। কালকেও আমিই সামলে নেব, পরশু থেকে আবার সব তোদের হাতে ছেড়ে দেব।
একথাটা হয়তো আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন ছিল না, এত রাতে বলতে গেলে ভোর রাতে ঘুমিয়ে ওদের পক্ষে অফিসে যাওয়া এমনিই সম্ভব হত না। দুজনে নিজেদের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ল, শুতে যতটুকু দেরী হল তার অর্ধেকেরও কম সময়ে ওদের চোখে ঘুম নেমে এল। সকালেও উঠতে বেশ দেরী হল, আগে কুহেলির ঘুম ভাঙ্গল, ঘড়িতে দেখল সাড়ে নটা বেজে গেছে। এত বেলা পর্যন্ত মনে হয় এই প্রথম ঘুমাল, আলেখ এখনও ঘুমাচ্ছে। ওকে বিরক্ত না করেই কুহেলি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে একেবারে ফ্রেশ হয়ে নিল। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল আলেখ এখনও ঘুমাচ্ছে, ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে নীচে নেমে এল। নভতেজ বাবু অনেকক্ষণ হল অফিসে চলে গেছেন, কিচেনে এসে দেখল বৃন্দা লাঞ্চের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওকে দেখে একগাল হেসে গুড মর্নিং উইশ করল, কুহেলিও প্রত্যুত্তরে একটা মিষ্টি হাসির সঙ্গে গুডমর্নিং উইশ করে বলল,
তো বৃন্দা দি, কেমন আছ?
ভাল, আপনারা কেমন ঘুরলেন?
দারুন, আচ্ছা ব্রেকফাস্টের মেনু কি?
আজকে স্যার বললেন একদম ঘরোয়া খাবার বানাতে, তাই আলুর পরোটা আর রায়তা বানিয়েছি।
বাহ্, খুব ভালো করেছ। সত্যি এই কয়েকদিন আমাদের এই ইন্ডিয়ান ফুড গুলো খুব মিস করেছি।
বৃদা হেসে বলল,
আপনি কফি এখনই খাবেন না একেবারে ব্রেকফাস্টের সঙ্গে খাবেন?
উম, আলুর পরোটার সঙ্গে কফিটা ঠিক যাবে না বুঝলে তো, তুমি বরং এখনই দাও।
ওকে, স্যার উঠেছেন? ওনারটা তৈরি করব?
এতক্ষণে হয়তো উঠে পড়েছে, তুমি ওর টাও বানাও। না উঠলেও আমি ডেকে দেব, অনেক বেলা হয়েছে। এরপর ব্রেকফাস্টই বা করবে কখন আর লাঞ্চ টাই বা হবে কখন।
বৃন্দা হেসে কফি বানানোয় মন দিল, দু কাপ কফি তৈরি করে একটা ট্রে তে সাজিয়ে কুহেলির হাতে দিল। কুহেলি কফি নিয়ে ওদের ঘরে এসে দেখল আলেখ তখনও ঘুমিয়ে, অঘোরে ঘুমাচ্ছে। কুহেলি বেডসাইড টেবিল টায় ট্রে টা রেখে আলেখকে ডাকল। একবার, দুবার, তিনবার কিন্তু কোনও ফল হল না, আলেখ যে অতলে সেই অতলেই রয়ে গেল। কুহেলি এতদিনের মধ্যে ওকে এত গভীর ভাবে ঘুমোতে দেখেনি, কিন্তু বেলা সাড়ে দশটা পেরিয়ে গেছে। আর ঘুমাতে দেওয়া যায় না, কিন্তু এত ডাকার পরেও তো ঘুম ভাঙছে না। হঠাৎ কুহেলির মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল, অত্যন্ত সাধারণ একটা উপায়। কিন্তু অনেকসময় এই নিতান্ত সাধারণ উপায় গুলোই কাজে দেয়। কুহেলির ঠোঁটে একটা দুষ্টু হাসি খেলে বেড়াচ্ছে, আস্তে করে হাঁটু মুড়ে বসল। খুব সাবধানে আলেখের ডান হাতটা তুলে তর্জনী টা আলতো করে গরম কফিতে ছোয়াতেই আলেখ একটা মৃদু শব্দ করে এক লাফে উঠে বসল। কুহেলি তাই দেখে তো হেসেই অস্থির, এদিকে আলেখ তো প্রথমে বুঝতেই পারল না ব্যাপারটা কি হল। ঘুম টুম এক্কেবারে ছুটে গেছে, তর্জনী টা একটু মুখে দিয়ে বলল,
এটা কি ছিল?
কুহেলি সেই এক ভাবে হাসতে হাসতেই বলল,
অ্যালার্ম।
এটা কেমন অ্যালার্ম!
আমার স্টাইলের অ্যালার্ম, দারুন কার্যকরী কিন্তু।
বলেই আবার হাসতে শুরু করল। আলেখ আর কিছু না বলে এক ভাবে তাকিয়ে রইল কুহেলির দিকে, প্রাণ খুলে হাসছে। ওর হাসির প্রতিটা ধ্বনি যেন ঝঙ্কার তুলে ছড়িয়ে পড়ছে আলেখের মনে। আলেখের মনে হল হঠাৎ করেই ওর জীবনটা রঙিন হয়ে উঠেছে, ভালোবাসলে বুঝি এমন হয়! কুহেলি এবার হাসি থামিয়ে বলল,
তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে এসো, না হলে কফি ঠান্ডা হয়ে যাবে।
আলেখও কোনও রকম কথা নাবলে উঠে ব্রাশ করে এসে কফিটা খেয়ে নিল। তারপর আলেখ ফ্রেশ হয়ে নিলে দুজনে ব্রেকফাস্ট সেরে এবার সব লাগেজ আন প্যাক করতে বসল। তবে তার আগে কুহেলি বাড়িতে ফোন করে কথা বলে নিয়েছে, কাল অত রাতে আর ফোন করা হয়নি। কথা শেষ করে এবার শুরু হল আন প্যাকিংয়ের পালা। কুহেলি এত শপিং করেছে যে ওখানে একটা নতুন ট্রলিব্যাগ কিনতে হয়েছে। কুহেলি আগে সব আন প্যাক করে সরিয়ে রেখে এবার বসল গিফটের ট্রলি নিয়ে। আলেখ শপিং করার সময় আর জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি, কোথায় যেন শুনেছিল মেয়েদের সাজ সজ্জার সময় আর শপিংয়ের সময় বিরক্ত করাটা নাকি বেশ ঝুঁকি পূর্ণ। আলেখ বুদ্ধিমানের মতই সে ঝুঁকি নেয়নি, তবে মনের মধ্যে প্রশ্ন গুলো তো থেকেই গিয়েছিল। এখন জিজ্ঞেস করল,
আচ্ছা কুহেলি, তুমি এতকিছু কার জন্য কিনেছ?
কুহেলি গিফট গুলো বের করতে করতেই একটু অবাক হয়ে বলল,
কার জন্য মানে! সবার জন্য।
সবার জন্য?
হুম, সবার জন্য।
বলে কুহেলি একটা একটা করে গিফট গুলো আলেখকে দেখিয়ে বলতে লাগল,
এটা ড্যাডের জন্য, এটা মায়ের, এটা ঠাম্মুর, এটা দিঠির…..
একে একে সবার নাম নিয়ে ফেলল, বিহান রাজীব এমনকি বৃন্দা দি, প্রভাত কেউই বাদ গেল না। শুধু কি তাই! কুহেলি নিশীথের জন্য পর্যন্ত গিফট এনেছে! এটা আলেখের একদমই পছন্দ হল না, কিন্তু কিছু বলল না। সে জানে, কুহেলি নিশীথ কে শুধুমাত্র বন্ধুই ভাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সবার নাম নেওয়া হয়ে গেল শুধু আলেখের নামটাই বাদ রয়ে গেল। আলেখের একটু যেন অভিমান হল, সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে শুধু ওই বাদ! একটু অভিমানী সুরেই বলল,
আর কারোর জন্য কিছু নাওনি?
কুহেলি ইচ্ছে করেই আলেখের জন্য কেনা লিমিটেড এডিশন রিস্ট ওয়াচ টা আড়ালে সরিয়ে রেখেছিল। শুধু কি আলেখই মজা করবে নাকি! সেও কম যায় না। আলেখের যে একটু অভিমান হয়েছে বেশ বুঝতে পারল কুহেলি। হাসিটা চেপে রেখে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
আর? আর কার জন্যে নেব? কেউ কি বাদ রয়ে গেল?
ভেবে দেখ।
কুহেলির ভিষন ভালোলাগছে, বেশ উপভোগ করছে আলেখের এই অভিমান। আবারও হাসিটাকে অনেক কষ্টে সংবরণ করে, একটু ভাবার ভঙ্গি করে বলল,
কই, মনে পড়ছে না তো!
আলেখের এবার সত্যিই রাগ হল, কুহেলি এভাবে কীকরে ওর কথা ভুলে যেতে পারে! রেগে ওখান থেকে উঠে চলে যেতে যেতে বলল,
বেশ, মনে যখন পড়ছে না তখন কি আর করা যাবে। আমি জিমে যাচ্ছি, অনেকদিন ওয়ার্কআউট করা হয়নি।
কুহেলি এবার ঘড়ির বক্সটা হাতে নিয়ে বলল,
আচ্ছা, যাওয়ার আগে একটু ইন্ডিয়া আর সুইটজারল্যান্ডের টাইম ডিফারেন্স টা বলে দিয়ে যাও তো।
আলেখের এমনিই মনটা খারাপ হয়ে রয়েছে, তার মধ্যে এমন অবান্তর প্রশ্ন শুনে যেন একটু বিরক্তই হল। এতদিন ওখানে কাটিয়ে আসার পর এখন টাইম ডিফারেন্স জানতে চাওয়ার মানে টা কি! একটু থেমে বেশ গম্ভীর স্বরেই বলল,
এতদিন তো থেকে এলে, এর মধ্যে ভুলে গেলে! সাড়ে তিন ঘণ্টা। কিন্তু এখন এটা জেনে কি করবে?
কুহেলি ওর পেটের মধ্যে পাক দিতে থাকা হাসিটাকে অতি কষ্টে দমন করে বলল,
না, আসলে এই রিস্ট ওয়াচ টার টাইম টা অ্যাডজাস্ট করতে হবে তো এখনও সুইটজারল্যান্ডের টাইমই রয়েছে।
আলেখ একটু অবাক হয়ে তাকাল রিস্ট ওয়াচটার দিকে। এটা তো ওকে দেখায়নি কুহেলি, এটা আবার কার জন্য এনেছে!
এটা কার?
কুহেলি একটা দুষ্টুমি ভরা চাহনি আলেখের দিকে ছুড়ে দিয়ে অল্প হেসে বলল,
উম, তুমি ছাড়া আর তো কেউ বাকি আছে বলে মনে হয় না!
আলেখ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত দাড়িয়ে থাকল, কুহেলি ওর সঙ্গে এমন একটা মজা করতে পারে এটা যেন ভাবতেই পারেনি। কুহেলি ততক্ষণে আবার হাসতে শুরু করে দিয়েছে, আলেখের হতভম্ব মুখটা দেখতে ভারী ভালোলাগছে। আলেখ নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে বলল,
তুমি.. তুমি আমাকে এইভাবে বোকা বানালে!
কুহেলি হাসতে হাসতেই জবাব দিল,
বোকা কোথায় বানালাম! আমি তো শুধু একটু মজা করলাম, যেমন তুমি আমার সাথে করো।
খুব হাসি পাচ্ছে না! দাড়াও তোমার হচ্ছে।
বলেই আলেখ কুহেলিকে ধরতে যেতেই কুহেলি সেখান থেকে লাফিয়ে সরে গিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
উহু, অত সহজ না। কি মনে কর বলতো! শুধু তুমিই মজা করতে পার! আমিও কোনও অংশে কম যাই না।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি, তবে আমি সহজে তোমাকে ছাড়ছি না। আমাকে এইভাবে বোকা বানানোর মজা দেখাচ্ছি তোমাকে দাড়াও।
বলে আবার আলেখ কুহেলিকে ধরতে গেল, কিন্তু এবারও ওর নাগাল পেল না। সারা ঘর ময় ছুটোছুটি করেও কিছুতেই আলেখ কুহেলিকে ধরতে পারল না। আর তাতে কুহেলির সে কি হাসি, শেষে আলেখ হঠাৎ অতর্কিতে কুহেলির একটা হাত ধরে ফেলল। কুহেলি নিজেকে ছাড়িয়ে আবার পালানোর চেষ্টা করতে যেতেই আলেখ এক টানে ওকে নিজের কাছে এনে ফেলল। আচমকা এমন টানে টাল সামলাতে না পেরে কুহেলি একদম আলেখের বুকের ওপর এসে পড়ল। তাতে আলেখও নিজের ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে কুহেলিকে নিয়েই সোজা বিছানার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। আর এই ঘটনার জেরেই ঘটে গেল আরও একটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ঘটনা। পড়ার সময় ওরা এমন ভাবে পড়ল যে দুজনের দুজোড়া ঠোঁট আচমকাই স্পর্শ করল একে অপরকে। ঘটনার আকস্মিতায় ওরা এতটাই বিস্মিত হয়ে গেল যে সমস্ত বোধশক্তি যেন নিজেদের কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। আবার সেই গোলাপের পাপড়ির মত ঠোঁট দুটোর ছোঁয়ায় আলেখের মনে সংযমের শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ ভালোবাসার অনুভূতিরা আবার বাঁধন ছেড়ার নেশায় মেতে উঠতে চাইল। আলেখের প্রশস্ত বুকে কুহেলির উদ্ভিন্ন যৌবনের স্পর্শ যেন ওর হৃদযন্ত্রের গতি অসম্ভব দ্রুত করে তুলল। ঘন হয়ে এল ওর নিঃশ্বাস, কুহেলিকে ঘিরে থাকা বাহুদ্বয়ের বেষ্টনী যেন আপনা থেকেই আরও একটু দৃঢ় হল। আর কুহেলি….. এমন একটা কিছু যে অকস্মাৎ ঘটে যেতে পারে এ বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু খুব অদ্ভুত ভাবে, আলেখের ঠোঁট জোড়ার স্পর্শ অনুভব করা মাত্র ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল সেইদিনের সেই আবেগঘন মুহুর্তেরা। সেই অচেনা অনুভূতি গুলো আবার উকি দিয়ে ওর সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরন ছড়িয়ে দিল, বাড়িয়ে দিল ওর হৃদযন্ত্রের গতির অস্বাভাবিকতা। একটা অবশ করে দেওয়া অজানা আবেশে বুজে এল ওর গভীর চোখ দুটো। তবে আজ এই অকস্মাৎ স্পর্শ প্রগাঢ় চুম্বনের গভীরতায় পৌঁছাল না, আলেখ যেন বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত নিজের সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ছিটকে উঠে দাড়াল। কুহেলিও যেন ঘোর কাটিয়ে উঠে দাড়াল, ঘরে একটা অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। আলেখ নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল,
সরি, আমি আসলে বুঝতে পারিনি, আ….
কুহেলি মাঝপথেই বলে উঠল,
ইটস ওকে, ইট ওয়াজ অ্যান অ্যাকসিডেন্ট।
বলে কুহেলি সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল, আলেখও আর না দাড়িয়ে ওর জিমে চলে গেল। দুজনেই এখন কিছুটা সময় একান্তে কাটাতে চায়, তবে দুজনের কারনটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কুহেলি ওয়াশরুমে ঢুকেই আগে চোখে মুখে জল দিল, মনটা আবার বড্ড অশান্ত হয়ে উঠেছে। বারবার নিজের মনকে যেন জোর করেই বোঝাতে চাইল, ওটা শুধুমাত্র একটা দুর্ঘটনা, এটা নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই। কিন্তু মনের আনাচে কানাচে জেগে ওঠা সেই অচেনা নাম না জানা অনুভূতি গুলো বারবার ওকে বাঁধা দিতে লাগল, যেন বোঝাতে চাইল ওটা শুধুই দুর্ঘটনা নয়। কুহেলি যেন ভাবতে বাধ্য হল,
যখনই আমি আলেখের কাছাকাছি আসি আমার হার্টবিট এত দ্রুত কেন হয়ে যায় প্রতিবার! কিসের এই ব্যাকুলতা? কেন জেগে ওঠে এই অচেনা অনুভূতি গুলো বারবার? কেন? আমি কি তবে…. না না, অসম্ভব এ হতেই পারে না। আমার মনে ভালোবাসার জন্য আর কোনও জায়গা নেই। তবে.. কিসের এই অনুভূতি! কেন বারবার মনটা এভাবে ব্যাকুল হয়ে ওঠে?
কুহেলি কিছুতেই নিজের প্রশ্ন গুলোর উত্তর খুঁজে পেল না। কিংবা হয়তো উত্তর গুলো ওর চোখের সামনেই ছিল, সে দেখতেও পেয়েছিল কিন্তু মানতে চায়নি। কিন্তু সত্যিটা দেখেও চোখ বন্ধ করে নিলেই কি সেটা বদলে যায়? মানতে চাও আর না চাও সত্যি টা তার জায়গাতেই থেকে যায়, একদিন ঠিক তাকে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু কুহেলি এইমুহুর্তে সত্যিটা যেন বুঝেও বুঝতে চাইল না, শাওয়ারের ঠান্ডা জলের তলায় দাড়িয়ে যেন অশান্ত মনটাকে শান্ত করে নিতে চাইল। আর আলেখ… সে জিমে এসেছে বটে কিন্তু ওয়ার্কআউট করতে নয়, কুহেলির কাছ থেকে পালিয়ে আসার জন্য। কুহেলির প্রতি ওর ভালোবাসা উপলব্ধি করার পর থেকে যেন নিজের অনুভূতি গুলোকে সংযত করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে কুহেলির সামনে থাকলে হয়তো নিজেকে সংযত করা সত্যিই খুব কঠিন হয়ে যেত। কিছুক্ষণ নিজেকে শান্ত করে সামান্য কিছু ওয়ার্কআউট করে আবার ফিরে এল রুমে। কুহেলিকে কোথাও দেখতে পেল না, তাতে অবশ্য একটু স্বস্তিই পেল, এখন বেশকিছুক্ষণ ওদের দেখা না হওয়াটাই ভাল। তবে লাঞ্চের সময় ওদের আবার মুখোমুখি হতেই হল, আলতো একটু নিয়মরক্ষা হাসি বিনিময় ছাড়া আর একটাও কথা হল না। দুপুরটা এভাবেই কেটে গেল, সন্ধ্যের দিকটায় আলেখ নিজের ঘরে বসে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিল আর কুহেলি কিচেনে ঢুকে বৃন্দার সঙ্গে মিলে ডিনারের প্রস্তুতি করছিল। আজ হঠাৎ একটু শখ হয়েছে রান্না করবে, বৃন্দা অনেকবার বারন করেছে কিন্তু কুহেলি শোনেনি। অগত্যা, বৃন্দা হাতে হাতে কিছু কাজ করে দিচ্ছিল, আর কুহেলি কোমর বেঁধে রান্নার তোড়জোড় করছিল। এমন সময় ডোরবেল বাজল, ঘড়ির দিকে তাকাল কুহেলি, নভতেজ বাবুর আসার সময় এখনও হয়নি। আজ তো উনি প্রভাত কে বলেই গিয়েছেন, অফিস থেকে একেবারে অন্য একটা কাজ সেরে ফিরবেন, প্রায় আটটা বাজবে। তাহলে এখন আবার কে এল! প্রভাত গিয়ে দরজা খুলতেই একটা মেয়েলি কণ্ঠস্বর গোটা বাড়ি ময় ছড়িয়ে পড়ল। যেন কেউ প্রচন্ড উত্তেজিত হয়ে কাউকে অবিরাম ডেকে চলেছে। কিন্তু ডাক টা ভারী অদ্ভুত, কুহেলি কৌতূহলী হয়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এল। ড্রয়িং রুমে আসতেই চোখে পড়ল, একটি অতীব সুন্দরী মেয়ে, পরনে নি লেন্থের শকিং রেড বডিহাগিং অফ শোল্ডার ওয়ান পিস। পায়ে ম্যাচিং রেড হাই হিলস, কুল ব্লন্ড চুলগুলো স্ট্রেট করে ছেড়ে রাখা। কানে দুটো বড় বড় সিলভার রিং, হাতে সিলভার ব্রেসলেটের সঙ্গে ম্যাচিং রিস্টওয়াচ আর গলায় একটা ব্ল্যাক নেকপিসের সঙ্গে ছোট্ট একটা সিলভার লকেট। সব মিলিয়ে এই আধুনিকা সুন্দরী টিকে দেখে যে কেউ রুপোলি পর্দার অভিনেত্রী বলে মনে করতেই পারে। মেয়েটি এখনও সেই অদ্ভুত সম্বোধনে কাউকে ডেকেই চলেছে।
আলু…. আলু হোয়্যার আর ইউ? আলু… লুক হুজ হিয়ার। হেই আলু… আলু।
আলু!! এটা আবার কিরকম নাম! আর কে এই মেয়েটি? কাকে খুঁজছে? প্রভাত বেচারা কেমন ঘাবড়ে গিয়ে একপাশে দাড়িয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে এই নতুন অতিথি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগই দেয়নি। কুহেলি এগিয়ে আসছিল কিন্তু তার আগেই দোতলার সিড়ির মুখে আলেখের আওয়াজ পাওয়া গেল।
রিতু!!
আলেখকে দেখেই যেন এই রিতু নামক মেয়েটির মুখে প্রশস্ত একটা হাসি ফুটে উঠল। তাহলে এই রিতু আলেখের পরিচিত, কিন্তু কখনও তো সে কুহেলিকে রিতুর কথা বলেনি! আলেখ সিড়ি থেকে নামতেই রিতু একছুটে গিয়ে আলেখকে জড়িয়ে ধরল।
মাই আলু… আই মিস ইউ সো মাচ ইয়ার।
আলেখও সমান ভাবেই রিতুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
আই মিস ইউ টু।
কুহেলি ঘটনার আকস্মিকতায় যেন প্রবল বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। কে এই রিতু! আর এইভাবে জড়িয়ে ধরার মানে টা কি! দুজনের মাঝে সামান্য হাওয়া চলাচল করার জায়গা টুকুও পর্যন্ত নেই! আর সবথেকে বড় কথা, এখানে কুহেলি রয়েছে, প্রভাত সহ আরও কয়েকজন কাজের লোক রয়েছে। সেদিকে যেন ওদের কোনও ভ্রুক্ষেপই নেই! কুহেলির হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হল, না, কোনও খারাপ লাগা নয়, একটা অসম্ভব রাগে যেন ওর সর্বাঙ্গ জ্বলে যেতে লাগল। কারণ? নাহ, কারণ সে জানে না বা এই মুহূর্তে জানতেও চায় না। কিছুক্ষণ পর রিতু আলেখকে ছেড়ে বলল,
কত দিন পর দেখছি তোকে, হাউ আর ইউ?
ফাইন, তুই বল তোর কি খবর? কোনও খবরই নেই, ফোন করলে ফোন ধরিস না। কলব্যাকও করিস না, ইভেন বিয়েতেও এলি না।
সরি ইয়ার, তুই তো জানিস কি পরিমান বিজি থাকি আমি, একদমই সময় পাইনা।
রাইট রাইট, তুই একাই তো বিজি! নিজের বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়েটা পর্যন্ত অ্যাটেন্ড করলি না।
স্টপ ইট আলু, আর শোন বেশ করেছি তোর বিয়েতে আসিনি। তুই তো আমাকে এককথায় দাগা দিলি, তোর কিন্তু আমাকে বিয়ে করার কথা ছিল। সেখানে তুই জাস্ট আমাকে ডিচ করে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিলি, কেন আসব বলতো?
আচ্ছা!! আমি কিন্তু কোনোদিনই বলিনি তোকে বিয়ে করব, তুইই বলতিস।
দুজনে যেন হাসিতে গড়িয়ে পড়ল, কুহেলির একদম ভালোলাগছে না। রাগটা যেন ক্রমশই বাড়ছে, আর তার সঙ্গে একটা অজানা কষ্টও যেন নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। কুহেলির আর এক মুহূর্তও এখানে থাকতে ইচ্ছে করল না, কিচেনের দিকে পা বাড়াতেই শুনতে পেল রিতু বলছে,
আচ্ছা, এসব ছাড়। হোয়্যার ইজ শি? একটু দেখি আমার এই হ্যান্ডসাম আলুর মন কে চুরি করল!
কুহেলি এটা শুনেও থামল না, কিন্তু আলেখের ডাকে থামতে হল।
কুহেলি, তুমি এখানেই আছ! কাম হিয়ার।
ঠোঁটে একটা মেকি হাসি ঝুলিয়ে কুহেলি এগিয়ে গেল ওদের দিকে। নিজের মনের খবরটা অন্য কাউকে জানতে দিয়ে কি লাভ! আলেখ হেসে বলল,
কুহেলি, মিট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড রিতু.. রাত্রি অহুজা। অ্যান্ড রিতু শি ইজ মাই ওয়াইফ কুহেলি।
রিতু হেসে কুহেলির দিকে একটা হাত করমর্দনের জন্য এগিয়ে দিয়ে বলল,
হাই, নাইস টু মিট ইউ।
কুহেলিও ভদ্রতার খাতিরে হেসে রিতুর এগিয়ে দেওয়া হাতটা ধরে বলল,
সেম হিয়ার।
রিতু মেয়েটা যেন উত্তাল খরস্রোতা নদীর মত, হঠাৎ কুহেলির হাত টা ধরে সোফায় গিয়ে বসে বলল,
আমি স্পেশালি তোমার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি। সরি তোমাদের বিয়েতে আসতে পারিনি, আসলে তখন অলরেডি হাতে পরপর অনেকগুলো কন্সাইনমেন্ট ছিল। কিন্তু দেখ, টাইম পেয়েই চলে এসেছি, বেশ কটাদিন তোমাদের সাথে কাটিয়ে যাব।
মেয়েটা ভারী মিষ্টি কথা বলে, কুহেলির সঙ্গেও এমন ভাবে কথা বলছে যেন কত দিনের চেনা। কুহেলির রাগটা ধীরে ধীরে কমে এল, হাসি মুখে বলল,
এত খুবই ভালো কথা, আমি প্রভাত কে বলে গেস্টরুমে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
নো নিড, পাশের বাংলো টা আমাদের। এখন যদিও এখানে তেমন আসাই হয় না, তাও বাংলো টা এখনও আমাদেরই আছে।
ওহ।
ইউ নো কুহেলি, আমি আর আলু… আই মিন আলেখ সেই ছোট বেলার বন্ধু। একসাথে পুরো স্কুল লাইফটা কাটিয়েছি, তারপর তো ড্যাড লন্ডনে সেটেল করে গেল। আমাকেও চলে যেতে হল, তারপর যা হয় ধীরে ধীরে হায়ার স্টাডিজ তারপর ক্যারিয়ারে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম দুজনে যে যোগাযোগ প্রায় হয় না বললেই চলে। কিন্তু তাতে আমাদের ফ্রেন্ডশিপে কোনও ঘাটতি হয়নি, কি বলিস আলু?
রিতু কলকল করে হেসে উঠল, আলেখ একটা পাশে বসে বলল,
একদম, তবে এই যোগাযোগ না হওয়ার বিল টা তুই একা নিজের ঘাড়েই ফাড়। আমার উপর একদম চাপাবি না, আমি মাঝে মধ্যেই তোর খোজ নিতাম ইভেন এখনও নিই। কিন্তু ইউকের নম্বর ওয়ান মডেল রাত্রি অহুজার তার পুরনো বন্ধুর খোঁজ নেওয়ার সময় কোথায়!
জাস্ট শাট আপ।
কুহেলির মনে রাগটা আর নেই, কিন্তু একটা খারাপ লাগা এখনও কাজ করছে। কুহেলি হাসি মুখেই বলল,
তোমরা বসে কথা বলো, আমি কফি নিয়ে আসছি।
আলেখ বলল,
তুমি কেন যাচ্ছ? বৃন্দা দি আছে তো।
বৃন্দা দিকে আমি একটু কাজ করতে দিয়েছি, তোমরা বসো আমি এক্ষুনি আসছি।
কুহেলি উঠে কিচেনে চলে গেল, আলেখের যেন একটু খটকা লাগল। কুহেলির মুখে ওর সেই সহজাত হাসিটা নেই, যেন একটা মেকি হাসির আড়ালে কিছু লুকিয়ে রাখতে চাইছে। তবে এখন সেদিকে খুব একটা মনোযোগ দিতে পারল না, রিতুর বকবকের সাথে তাল মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যেই নভতেজ বাবুও এসে পড়লেন, এতদিন বাদে রিতুকে দেখে উনিও খুব খুশি হলেন। কুহেলি সময়ের আন্দাজ করেই চারকাপ কফি বানিয়েছিল, কফি সহযোগে আড্ডা বেশ ভালই জমে উঠল। কুহেলি যথাসাধ্য চেষ্টা করল খুশি মনে গল্পে যোগ দেওয়ার কিন্তু মনের কোণে এক টুকরো অকারণ মনখারাপের মেঘ কিছুতেই সেটা হতে দিল না। ডিনারের সময় হয়ে আসছে এবার রান্নায় হাত না দিলে আর হবে না। কুহেলি উঠে বলল,
রাত্রি, আজকে ডিনার টা আমাদের সাথে করো।
আলেখ আর নভতেজ বাবু দুজনেই কুহেলিকে সমর্থন করলেন। কিন্তু রাত্রি বলল,
আরে আমার জন্য শুধু শুধু এত কষ্ট করতে হবে না।
কুহেলি একটু হেসে বলল,
এতে কষ্টের কিছু নেই, আমি এমনিতেই এখন ডিনার তৈরী করতেই যাচ্ছি।
কুহেলির কথায় ওরা তিনজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাল। আলেখ বলল,
তুমি হঠাৎ রান্না করছ কেন? বৃন্দা দি আছে তো।
কুহেলি একটু অদ্ভুত হেসে বলল,
ইচ্ছে হল।
আলেখের আবার সেই খটকা টা লাগল, একটু বেশিই অন্যরকম লাগছে কুহেলিকে। তবে এই মুহূর্তে কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না, তাই পরে সময় মত কথা বলবে ঠিক করে নিল। নভতেজ বাবু অবশ্য দারুন খুশি হলেন,
আহ্, চমৎকার। আজকের ডিনার টা তাহলে বেশ স্পেশাল হতে চলেছে।
কুহেলি কিছু না বলে শুধু একটু হাসল। রাত্রি এখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, বিস্ময় মাখানো চোখেই বলল,
তুমি রান্না করতে পার?
ওই, একটু আধটু।
তাহলে তো আজ ডিনার টা এখানেই করতে হচ্ছে। আমি তো ঠিক মত ম্যাগিও বানাতে পারি না।
আলেখ একটু মজা করে বলল,
তুই তো বরাবরের ইউজলেস।
শাট আপ।
কুহেলি কিচেনে এসে রান্নায় মন দিল, নেট দেখে আর কিছুটা বৃন্দার সাহায্যে সব পাঞ্জাবি ডিশ রান্না করছে। রাজমা চাওল, ডাল মাখনি, পাঞ্জাবি কাড়ি আর শেষ পাতে ক্ষীর। রান্না সারা হয়ে গেলে ওরা সবাই একসাথে ডিনার করতে বসল। সব পাঞ্জাবি ডিশ দেখে তো নভতেজ বাবু দারুন খুশি। রিতু আলেখের পাশে বসেছে, সেটা দেখে ইচ্ছে করেই আজ কুহেলি আলেখের পাশে না বসে ওর উল্টো দিকে বসেছে। যেটা আলেখের মনের খটকা টাকে আরও বাড়িয়ে দিল। কিন্তু এইমুহুর্তে কিছু বলা সম্ভব নয় জেনেই আপাতত খাওয়ায় মন দিল। রিতু তো যাকে বলে হামলে পড়ে খেল সবকিছু, আর পারলে প্রতিটা গ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে একবার করে কুহেলির প্রশংসা করে যাচ্ছে। কুহেলির ভারী অদ্ভুত লাগছে, একদিকে মেয়েটাকে বেশ ভালোলাগছে আবার অন্যদিকে খারাপও লাগছে। এইরকম অদ্ভুত বিভ্রান্তি কর পরিস্থিতি ওর একদম ভালোলাগছে না। রিতু খেতে খেতে বলল,
ওয়াও কুহেলি, জাস্ট অসম। লন্ডনে তো এসব ভুলেই গিয়েছিলাম, মম যদিও রান্না করে কিন্তু আমি তো বাড়িতে থাকতেই পারি না। কাজের জন্য সেপারেট থাকতে হয়, ঐসব রস কষ হীন খাবার খেয়ে খেয়ে মুখের স্বাদটাই যেন চলে গিয়েছিল, থ্যাঙ্কস আ লট কুহেলি।
কুহেলি একটু হেসে বলল,
তোমার যে ভালোলেগেছে আমি তাতেই খুশি, থ্যাঙ্কস বলার কোনও প্রয়োজন নেই।
আলেখ একটু মজার ছলে বলল,
আচ্ছা রিতু, তুই যে এইসব খাচ্ছিস, শুধু খাচ্ছিস বললেও কম বলা হবে, একেবারে গোগ্রাসে গিলছিস। তোকে দেখে কেউ বলবে তুই মডেল! মুটি হয়ে যাবি কিন্তু, তখন আর কেউ পাত্তা দেবে না।
এই শোন, বেশি ফালতু না বকে চুপচাপ খা তো। আমার ফিগার আমি বুঝে নেব তোকে অত চিন্তা করতে হবে না।
সব খাওয়ার শেষে এবার ডেসার্টের পালা, রিতু একটা বোল নিয়ে এক চামচ মুখে দিয়ে বলল,
ওয়াও, মাইন্ড ব্লোইং। হেই আলু।
আলেখ রিতুর দিকে ফিরে ‘কি’ বলতেই রিতু এক চামচ ক্ষীর ওর মুখে পুরে দিল। এটা দেখে কুহেলির মনের কোণে জমে থাকা মন খারাপের মেঘটা ধীরে ধীরে ওর গোটা মনটাকে ছেয়ে ফেলল। তার সঙ্গে রাগটাও যেন আবার ফিরে আসছে, না ঠিক রাগ হয়তো বলা যায় না, অভিমান বলাটাই বোধহয় ঠিক হবে। ডিনারের পর্ব মিটলে রিতু আরও একদফা কুহেলির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে শেষে বিদায় নিল। আলেখ রিতুকে এগিয়ে দিয়ে সোজা নিজের ঘরে ঢুকল, কুহেলির কিছু যে একটা হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু কি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে না। কথা বলা প্রয়োজন, আলেখের মনে হল হয়তো সকালের ওই ঘটনার জন্যই এইরকম আচরণ করছে! ঘরে ঢুকে দেখল কুহেলি ঘরে নেই, ওয়াশরুমেও নেই, ব্যালকনিতেও নেই। কোথায় গেল মেয়েটা! আলেখ একে একে উপর নীচ সব জায়গায় খুঁজল। কিন্তু কোথাও পেল না, শেষে কি মনে করে ছাদের দিকে পা বাড়াল। ছাদের একটা কোনায় সেই চেয়ার দুটোর পাশে স্থান পেয়েছে কুহেলির সাধের গোলাপ গাছ দুটো। নিয়মিত পরিচর্যায় আবার ওরা প্রাণ ফিরে পেয়েছে, হলুদ আর লাল গোলাপে ভরে আছে গাছ দুটো। কুহেলির মন খারাপের সাথী এই গাছ দুটো, আগেও যখনই ওর মন খারাপ হত তখনই এই গাছ দুটোর পাশে বসে থাকত। কোমল পাপড়ি গুলোয় হাত বুলিয়ে যেন অনেকটা শান্তি পেত, মিষ্টি ঘ্রাণটা যেন ধীরে ধীরে ওর মনের আকাশে জমে থাকা মন খারাপের মেঘ গুলোকে সরিয়ে দিত। আজও তাই এই গাছ দুটোর কাছেই এসেছে কুহেলি, আজও তার মন খারাপ। কারনটা যদিও অজানা, কুহেলি বুঝতে পারছে না ওর কেন এত খারাপ লাগছে! রাগ অভিমান দুঃখ কষ্ট সব মিলেমিশে যে অদ্ভুত এক অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ কি? আলেখ আর রিতু সেই ছোটবেলার বন্ধু, বেস্ট ফ্রেন্ড। আর এত গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনুযায়ী ওদের আচরণ এতটুকুও অস্বাভাবিক নয়। সেটা কুহেলি বুঝতে পারছে, কিন্তু তাও কিছুতেই মন খারাপের মেঘ টাকে সরাতে পারছে না। রিতুকে ওর নিজেরও যথেষ্ট ভালোলেগেছে, মেয়েটাকে ভালোলাগার মতই। কিন্তু তাও কেন যেন ওর সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারছে না। অজস্র প্রশ্নের ভিড়ে কুহেলি যেন হারিয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ আলেখের ডাকে চমকে উঠল।
কুহেলি! তুমি এখানে এভাবে বসে আছ কেন? কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে।
কুহেলির এখন আলেখের সঙ্গে একটুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওকে দেখলেই যেন রাগ অভিমান সব একসঙ্গে এসে ভিড় করছে। ছোট্ট করে উত্তর দিল,
এমনি।
আলেখ বেশ বুঝতে পারল কুহেলির মন খারাপ। আর ওর কেন যেন মনে হল সকালের ঘটনার জন্যই কুহেলির মনটা খারাপ। আলেখ কুহেলির পাশেই বসে বলল,
কুহেলি, তুমি কি এখনও সকালের জন্য…..
কথাটা শেষ করল না আলেখ। কুহেলি বুঝতে পেরে বলল,
না, ওটা সত্যি একটা অ্যাকসিডেন্ট ছিল। শুধু শুধু ওটা নিয়ে মন খারাপ করব কেন?
তাহলে?
তাহলে কি?
কুহেলি আমি বুঝতে পারছি তোমার কোনও কারণে মনটা ভালো নেই। কি হয়েছে? আমাকে বলতে পার।
কুহেলি একবার তাকাল আলেখের দিকে, সেই ঈষৎ সবুজ চোখের তারায় যেন একটা আকুলতা দেখতে পেল। কিন্তু কুহেলি কি উত্তর দেবে এই প্রশ্নের! উত্তর তো তার নিজেরও অজানা। অগত্যা মিথ্যের আশ্রয় নিতেই হল, একটু ম্লান হেসে বলল,
কিছু না, এমনিই একটু মন খারাপ লাগছিল। অনেক রাত হল, ঘুমও পাচ্ছে তাছাড়া কালকে অফিসেও যেতে হবে।
কুহেলি উঠে সিড়ির দিকে এগোল। আলেখ উঠে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ কুহেলির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। কুহেলি যে সত্যি কথা বলছে না, সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। হয়তো এইমুহুর্তে বলতে চাইছে না মনে করে আলেখও আর কিছু বলল না। সবারই জীবনে একটু নিজস্ব স্বাধীন জায়গার প্রয়োজন হয়, যেখানে অকারণে পদার্পণ না করাটাই ভালো। এই কয়েকদিনে আলেখ এটা খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে, কুহেলি কোনও কিছু নিয়ে বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকে না। আজও সাময়িক কোনও কারণে মন খারাপের কালো মেঘে ঢেকে আছে ওর মনটা হয়তো কাল সকালেই দেখবে সব মেঘ কেটে গেছে। আলেখ একবার কুহেলির প্রিয় গোলাপ গাছ দুটোর দিকে তাকাল, একটু যেন হিংসে হল। কুহেলির সব মনখারাপের গোপন কথা জানে এরা, যা আলেখেরও অজানা। কিন্তু পরক্ষণেই একটু হেসে আলতো হাতে লাল গোলাপ টা একটু ছুয়ে নেমে গেল নীচে।
ক্রমশ___________
রাত্রি অহুজা… আলেখ আর কুহেলির জীবনে কি প্রভাব পড়বে এই রাত্রি অহুজা ওরফে রিতুর অকস্মাৎ আগমনে? কি মনে হয় আপনাদের? আমাকে জানাতে ভুলবেন না কিন্তু। আশা করি আজকের পর্বটা আপনাদের ভালো লেগেছে। নিজেদের মতামত অবশ্যই জানাবেন। আজ তবে আসি, দেখা হবে আগামী পর্বে ততদিন পর্যন্ত পড়তে থাকুন ভালো থাকুন।